গাইবান্ধা : নদী তীরে কাঠের কান্ড ও ডালপালার স্তূপ -সংবাদ
বন্যার স্রোতে উজান থেকে ভেসে আসে নানা রকম কাঠ, গাছের ডাল, কান্ড, এমনকি বিশাল আকারের গাছও। ভারতের পাহাড়ি এলাকা ও সীমান্তঘেঁষা অরণ্য অঞ্চল থেকে এসব কাঠ ভেসে আসে ব্রহ্মপুত্র নদীরে স্রোতে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে উজানে বৃষ্টিপাত ও পানি বৃদ্ধিতে নদীজুড়ে বিভিন্ন গাছের কাঠের কান্ড ও ডালপালা ভেসে আসে। আর সেই কাঠ সংগ্রহে এখন ব্যস্ত নদী তীরের মানুষজন। কেউ নৌকা নিয়ে, কেউবা সাঁতরে নেমে কাঠ তুলছে তীর ঘেঁষে।
গাইবান্ধা সদর, সুন্দগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি, কুড়িগ্রামের চিলমারী, উলিপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও জামালপুর জেলার নদীতীরবর্তী এলাকায় এখন এক ধরনের উৎসবমুখর পরিবেশ দেখা যায়। নদীর স্রোতে ভেসে আসা কাঠ ধরতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটায় স্থানীয়রা। তাদের কাছে এটি যেন প্রকৃতির উপহার। নদীর স্রোতের গতিপথ ও ভাটির দিকে ভেসে আসা কাঠের হিসাব রাখে অনেকেই। কখন কোথায় কাঠ ভেসে আসবে, তা আন্দাজ করে তারা আগেভাগেই নৌকা নিয়ে প্রস্তুত থাকে।
সাঘাটা উপজেলার হাসিলকান্দি চরের দেখা গেছে, নৌকা নিয়ে তিনজন যুবক নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে কাঠ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতে আছে। কেউ জাল ফেলছে, কেউ বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ভাসমান কাঠ থামাচ্ছে। নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকা আরও কয়েকজন অপেক্ষায়—কোনো বড় গাছ ভেসে এলে সবাই মিলে তা টেনে তীরে তুলবে।
স্থানীয় বাসিন্দা হাবিজার রহমান বলেন, প্রতি বর্ষায় নদীর স্রোতে অনেক কাঠ ভেসে আসে। আগে আমরা এগুলো তেমন গুরুত্ব দিতাম না। এবার এতো বড় বড় কাঠ গাছ আসছে যা দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। এখন এসব কাঠ বিক্রি করে অনেকে ভালো আয় করছে। তিনি জানান, একটি বড় কাঠের গুঁড়ি ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি করা যায়।
ফুলছড়ি উপজেলার দক্ষিণ খাটিয়ামারী চরের রহিমা বেগম বলেন, আমাদের এখানে জীবিকা সীমিত। নদী ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়েছি। এখন নদীর কাঠই আমাদের রুজি—রোজগারের বড় ভরসা। আমার ছেলে নৌকা নিয়ে কাঠ ধরে, আমি সেগুলো শুকিয়ে বাজারে বিক্রি করি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ভারতের আসাম রাজ্যের পাহাড়ি অরণ্য ও ব্রহ্মপুত্রের উজান অংশে বর্ষায় প্রচুর গাছ ভেসে যায়। এসব কাঠের একটি অংশ বাংলাদেশের ভাটির দিকে এসে পড়ে। নদীর স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসা কাঠে কখনো বড় গাছের কাণ্ড ও থাকে, যা কাটলে জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আবার কেউ কেউ এসব কাঠ দিয়ে আসবাব তৈরি করে বিক্রিও করে থাকেন।
সাঘাটা হলদিয়া ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য ওমর আলী সরকার জানান, আগে উজান থেকে কাঠ ভেসে আসতো। তবে এবছর যেভাবে এসেছে তা ধারনা বাইরে। তিনি মনে করেন অব্যশই ভারতে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ধ্বসে গাছপালা ভেঙ্গে পেড়েছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রধান এম. আবদুস্ সালাম জানান, নদী তীরের মানুষ যেভাবে প্রাকৃতিকভাবে কাঠ সংগ্রহ করছে, সেটি স্থানীয় অর্থনীতিতে কিছুটা ভূমিকা রাখছে। তবে বড় কাঠ সংগ্রহে ঝুঁকি আছে, কারণ স্রোত প্রবল থাকায় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে। তিনি আরোও জানান, ভেসে আসা কাঠ বিকল্প জীবিকার পথ সৃষ্টি করেছে।
ফুলছড়ির বালাসীঘাটের আব্দুল হামিদ মিয়া জানান, বন্যার মৌসুমে নদী ভরপুর থাকায় কাঠ সংগ্রহের সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কাও থাকে। প্রবল স্রোতের কারণে অনেক সময় কাঠের গুঁড়ি উল্টে গিয়ে নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা কেউ কেউ পানিতে পড়ে যায়।
কয়েক বছর আগে সাঘাটা উপজেলার কালুরপাড়া চরে কাঠ তুলতে গিয়ে এক যুবকের প্রাণহানি ঘটে। তাই এখন অনেকেই দলবদ্ধভাবে কাজ করে।
কুন্দেরপাড়া চরের ইউনুস আলী জানান, নৌকা না থাকায় কাঠ সংগ্রহে সমস্যা হয়েছে। অনেকে ঝুকি নিয়ে দেখা দেখি করে কাঠ সংগ্রহ করেছে।
নদীর কাঠ সংগ্রহ এখন স্থানীয় অর্থনীতির একটি অঘোষিত অংশে পরিণত হয়েছে। কেউ নিজ ব্যবহারের জন্য কাঠ সংগ্রহ করেন, কেউ তা বিক্রি করেন, আবার কেউ কাঠ শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ফলে নদীর তীরে এ মৌসুমে একধরনের কর্মচাঞ্চল্য দেখা যায়। ফুলছড়ি উজালড্ঙা গ্রামের সালেহা বেগম বলেন, যে কাঠ সংগ্রহ করেছি তাতে আগামী একবছর আর খড়ির চিন্তা নেই।
গাইবান্ধার পরিবেশবিদ র্যাফেল জানান, নদী স্রোতে ভেসে আসা কাঠ সংগ্রহ সরাসরি পরিবেশের ক্ষতি না করলেও, অসচেতনভাবে নদীতে বাঁধা দেওয়া বা নৌকার চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে তা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এই প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে কিছুটা নিয়ম-কানুন প্রয়োজন।
গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রায় চর ও নদী তীরের অন্ততপক্ষে ৪০ হাজার পরিবার কাঠ সংগ্রহ করেছে বলে জানা যায়। চরবাসীর কাছে এই কাঠ যেন আশীর্বাদ। বন্যা শেষে যখন মাঠ—ঘাট ভেসে যায়, ফসল নষ্ট হয়, তখন এই কাঠই তাদের হাতে আসে নতুন জীবিকার হাতছানি নিয়ে। নদীর স্রোতে ভেসে আসা কাঠ এখন শুধু একটি প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, বরং চরবাসীর টিকে থাকার লড়াইয়ের নীরব সাক্ষী হয়ে উঠেছে।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
গাইবান্ধা : নদী তীরে কাঠের কান্ড ও ডালপালার স্তূপ -সংবাদ
বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
বন্যার স্রোতে উজান থেকে ভেসে আসে নানা রকম কাঠ, গাছের ডাল, কান্ড, এমনকি বিশাল আকারের গাছও। ভারতের পাহাড়ি এলাকা ও সীমান্তঘেঁষা অরণ্য অঞ্চল থেকে এসব কাঠ ভেসে আসে ব্রহ্মপুত্র নদীরে স্রোতে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে উজানে বৃষ্টিপাত ও পানি বৃদ্ধিতে নদীজুড়ে বিভিন্ন গাছের কাঠের কান্ড ও ডালপালা ভেসে আসে। আর সেই কাঠ সংগ্রহে এখন ব্যস্ত নদী তীরের মানুষজন। কেউ নৌকা নিয়ে, কেউবা সাঁতরে নেমে কাঠ তুলছে তীর ঘেঁষে।
গাইবান্ধা সদর, সুন্দগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি, কুড়িগ্রামের চিলমারী, উলিপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও জামালপুর জেলার নদীতীরবর্তী এলাকায় এখন এক ধরনের উৎসবমুখর পরিবেশ দেখা যায়। নদীর স্রোতে ভেসে আসা কাঠ ধরতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটায় স্থানীয়রা। তাদের কাছে এটি যেন প্রকৃতির উপহার। নদীর স্রোতের গতিপথ ও ভাটির দিকে ভেসে আসা কাঠের হিসাব রাখে অনেকেই। কখন কোথায় কাঠ ভেসে আসবে, তা আন্দাজ করে তারা আগেভাগেই নৌকা নিয়ে প্রস্তুত থাকে।
সাঘাটা উপজেলার হাসিলকান্দি চরের দেখা গেছে, নৌকা নিয়ে তিনজন যুবক নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে কাঠ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতে আছে। কেউ জাল ফেলছে, কেউ বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ভাসমান কাঠ থামাচ্ছে। নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকা আরও কয়েকজন অপেক্ষায়—কোনো বড় গাছ ভেসে এলে সবাই মিলে তা টেনে তীরে তুলবে।
স্থানীয় বাসিন্দা হাবিজার রহমান বলেন, প্রতি বর্ষায় নদীর স্রোতে অনেক কাঠ ভেসে আসে। আগে আমরা এগুলো তেমন গুরুত্ব দিতাম না। এবার এতো বড় বড় কাঠ গাছ আসছে যা দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। এখন এসব কাঠ বিক্রি করে অনেকে ভালো আয় করছে। তিনি জানান, একটি বড় কাঠের গুঁড়ি ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি করা যায়।
ফুলছড়ি উপজেলার দক্ষিণ খাটিয়ামারী চরের রহিমা বেগম বলেন, আমাদের এখানে জীবিকা সীমিত। নদী ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়েছি। এখন নদীর কাঠই আমাদের রুজি—রোজগারের বড় ভরসা। আমার ছেলে নৌকা নিয়ে কাঠ ধরে, আমি সেগুলো শুকিয়ে বাজারে বিক্রি করি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ভারতের আসাম রাজ্যের পাহাড়ি অরণ্য ও ব্রহ্মপুত্রের উজান অংশে বর্ষায় প্রচুর গাছ ভেসে যায়। এসব কাঠের একটি অংশ বাংলাদেশের ভাটির দিকে এসে পড়ে। নদীর স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসা কাঠে কখনো বড় গাছের কাণ্ড ও থাকে, যা কাটলে জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আবার কেউ কেউ এসব কাঠ দিয়ে আসবাব তৈরি করে বিক্রিও করে থাকেন।
সাঘাটা হলদিয়া ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য ওমর আলী সরকার জানান, আগে উজান থেকে কাঠ ভেসে আসতো। তবে এবছর যেভাবে এসেছে তা ধারনা বাইরে। তিনি মনে করেন অব্যশই ভারতে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ধ্বসে গাছপালা ভেঙ্গে পেড়েছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রধান এম. আবদুস্ সালাম জানান, নদী তীরের মানুষ যেভাবে প্রাকৃতিকভাবে কাঠ সংগ্রহ করছে, সেটি স্থানীয় অর্থনীতিতে কিছুটা ভূমিকা রাখছে। তবে বড় কাঠ সংগ্রহে ঝুঁকি আছে, কারণ স্রোত প্রবল থাকায় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে। তিনি আরোও জানান, ভেসে আসা কাঠ বিকল্প জীবিকার পথ সৃষ্টি করেছে।
ফুলছড়ির বালাসীঘাটের আব্দুল হামিদ মিয়া জানান, বন্যার মৌসুমে নদী ভরপুর থাকায় কাঠ সংগ্রহের সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কাও থাকে। প্রবল স্রোতের কারণে অনেক সময় কাঠের গুঁড়ি উল্টে গিয়ে নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা কেউ কেউ পানিতে পড়ে যায়।
কয়েক বছর আগে সাঘাটা উপজেলার কালুরপাড়া চরে কাঠ তুলতে গিয়ে এক যুবকের প্রাণহানি ঘটে। তাই এখন অনেকেই দলবদ্ধভাবে কাজ করে।
কুন্দেরপাড়া চরের ইউনুস আলী জানান, নৌকা না থাকায় কাঠ সংগ্রহে সমস্যা হয়েছে। অনেকে ঝুকি নিয়ে দেখা দেখি করে কাঠ সংগ্রহ করেছে।
নদীর কাঠ সংগ্রহ এখন স্থানীয় অর্থনীতির একটি অঘোষিত অংশে পরিণত হয়েছে। কেউ নিজ ব্যবহারের জন্য কাঠ সংগ্রহ করেন, কেউ তা বিক্রি করেন, আবার কেউ কাঠ শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ফলে নদীর তীরে এ মৌসুমে একধরনের কর্মচাঞ্চল্য দেখা যায়। ফুলছড়ি উজালড্ঙা গ্রামের সালেহা বেগম বলেন, যে কাঠ সংগ্রহ করেছি তাতে আগামী একবছর আর খড়ির চিন্তা নেই।
গাইবান্ধার পরিবেশবিদ র্যাফেল জানান, নদী স্রোতে ভেসে আসা কাঠ সংগ্রহ সরাসরি পরিবেশের ক্ষতি না করলেও, অসচেতনভাবে নদীতে বাঁধা দেওয়া বা নৌকার চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে তা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এই প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে কিছুটা নিয়ম-কানুন প্রয়োজন।
গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রায় চর ও নদী তীরের অন্ততপক্ষে ৪০ হাজার পরিবার কাঠ সংগ্রহ করেছে বলে জানা যায়। চরবাসীর কাছে এই কাঠ যেন আশীর্বাদ। বন্যা শেষে যখন মাঠ—ঘাট ভেসে যায়, ফসল নষ্ট হয়, তখন এই কাঠই তাদের হাতে আসে নতুন জীবিকার হাতছানি নিয়ে। নদীর স্রোতে ভেসে আসা কাঠ এখন শুধু একটি প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, বরং চরবাসীর টিকে থাকার লড়াইয়ের নীরব সাক্ষী হয়ে উঠেছে।