১৮ বছরেও সংস্কার হয়নি সিডরে বিধ্বস্ত বাগেরহাটে মোরেলগঞ্জের রাস্তাঘাট -সংবাদ
শনিবার ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলা ‘সিডর’-এর কালরাত্রি। সেই কালরাত্রির ভয়াল দুর্যোগ গোটা উপকূলবাসীকে আজো তাড়া করে ফিরছে। ২০০৭ সালের এইদিনে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় পৌনে ৩শ’ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ বাংলাদেশ উপকূলের ১০টি জেলার ওপর হামলে পড়ে সব লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল।
ঘূর্ণিঝড়ে প্রাক-প্রস্তুতি ও আগাম সতর্কতা অনেকটা সন্তোষজনক থাকায় প্রানহানির সংখ্যা যথেষ্ট হ্রাস করা সম্ভব হলেও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। সরকারি হিসেবে যা ১৬ হাজার কোটি বলে তৎকালীন সেনা সমর্থিত কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্বীকার করেছিল। সরকারি হিসেবেই মৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৩ হাজার আদম সন্তান। নিখোঁজের তালিকায় ছিল আরও প্রায় দেড় সহশ্রাধিক আদম সন্তানের নাম। পরবর্তীতে যাদের প্রায় কারোরই আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে সিডরের তাণ্ডবে দক্ষিণ উপকূলের বিশাল জনপদের প্রায় ৪ লাখ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ এবং প্রায় ১০ লাখ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। একই সঙ্গে প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমির আমন ধান সম্পূর্ণ এবং ৫ লাখ হেক্টরের ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ৫০ লাখ গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগীর মৃত্যু ঘটে সিডরের তাণ্ডবে।
এছাড়াও প্রায় পৌনে ৭শ’ কিলোমিটার আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়কসহ পল্লী যোগাযোগ অবকাঠামো সম্পূর্ণ এবং প্রায় ৯০ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিধ্বস্ত এলাকার প্রায় ১৮শ’ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ এবং প্রায় সাড়ে ৬ হাজার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেতু ও কালভার্টের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও ছিল উদ্বেগজনক। বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের দেড় সহশ্রাধিক সেতু এবং কালভার্ট সম্পূর্ণ এবং প্রায় ৯শ’ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সেদিনের ওই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় দেশের উপকূলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলের ৩০টি জেলায় কম-বেশি আঘাত হানলেও ৭টি জেলার ২শ’ উপজেলার প্রায় সাড়ে ১৭শ’ ইউনিয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৩ হাজার বলা হলেও তা কমপক্ষে ২০ লাখ। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যাও ছিল প্রায় পৌনে ১ কোটি। সরকারিভাবে ৩ হাজার ১৯৯ জনের মৃত্যু ও ১ হাজার ৭২৬ জনের নিখোঁজের কথা বলা হলেও এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি ছিল। বেশিরভাগ নিখোঁজদের আর কোনো সন্ধান না মেলায় তাদের সবাইকে সিডরের বয়ে আনা জলোচ্ছাস সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে এসব নিখোঁজদের স্বজনরা নিকটজনের লাশটিও আর দেখতে পায়নি।
তবে উপকূলীয় এলাকায় সেদিন সিডরের তাণ্ডবে ক্ষয়ক্ষতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারতো যদি বিশাল সুন্দরবন, উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী ও পরিকল্পিত বনায়ন না থাকতো। প্রকৃতির ওই তাণ্ডব সেদিন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রুখে দিয়েছিল প্রকৃতিই। প্রকৃতির ওই তাণ্ডব সামাল দিতে সে রাতে উপকূলীয় বনায়ন কর্মসূচি ও সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের আড়াই লাখ হেক্টরের বনভূমিই ‘প্রকৃতিবর্ম’ তৈরি করেছিল। তবে প্রকৃতির ওই ধ্বংসলীলা রুখতে সে রাতে উপকূলীয় বনভূমির লক্ষ লক্ষ গাছসহ সাধারণ মানুষেরও প্রায় ১ কোটি গাছ মাটিতে মিশে গিয়েছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তর ২০০৭ সালের ১১ নভেম্বর দুপুর ১২টায় দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ২শ’ কিলোমিটার ভাটিতে একটি লঘুচাপ শনাক্ত করে। যা ক্রমশ উত্তর-পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে আন্দামান নিকোবরকে ডানে রেখে এগুতে থাকে। ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় লঘুচাপটি আন্দামান থেকে প্রায় ৫শ’ কিলোটিার পূর্ব দিক দিয়ে সোজা উত্তরে এগুতো শুরু করে। এরপর লঘুচাপটি নিম্নচাপ থেকে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়ে ক্রমশ উত্তর দিকে বাংলাদেশ-ভারত সাগর সীমান্ত উপকূল বরাবর এগুতে থাকে। ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশ উপকূলের ৫শ’ কিলোমিটার দক্ষিণ দিয়ে ক্রমশ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মাঝ বরাবর রায়মঙ্গল-হাড়িয়াভাঙ্গা উপকূলে অগ্রসর হচ্ছিল। ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মাত্র ১শ’ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসে। ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় সুন্দরবন এলাকা অতিক্রম করবে বলে মনে করা হলেও বিকেলেই আকষ্মিকভাবে তার গতিপথ পরিবর্তন করে উত্তরমুখি থেকে উত্তর-পূর্বমুখি হতে শুরু করে। সন্ধ্যা ৬টার পরই ঝড়টি আরও দ্রুত গতিতে উত্তর-পূর্বমুখি হয়ে ভারত-বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমান্ত থেকে প্রায় ৩শ’ কিলোমিটার পূর্বে বরগুনা এবং বাগেরহাটের মধ্যবর্তী হরিণঘাটা-বুড়িশ্বর ও বিশখালী নদীর বঙ্গোপসাগর মোহনা দিয়ে প্রায় পৌনে ৩শ’ কিলোমিটার বেগে মূল ভূখণ্ডে আছড়ে পড়ে।
ঝড়টির ব্যাপ্তি মাত্র দেড়শ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তার দৈর্ঘ্য ছিল অনেক দীর্ঘ। সাগরপাড়ের হরিণঘাটা-পাথরঘাটা থেকে প্রায় আড়াইশ’ কিলোমিটার দূরে বরিশাল মহানগরী পর্যন্ত একই সঙ্গে প্রায় সমান বেগে সিডরের নারকীয় তাণ্ডব অব্যাহত ছিল। এমনকি খোদ বরিশাল মহানগরীতেও ঘূর্ণিঝড়-সিডর প্রায় সোয়া ২শ’ কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়ে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত পশ্চিমে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা, রামপাল থেকে বরিশাল হয়ে মাদারীপুর, শরিয়তপুর ও গোপালগঞ্জ পর্যন্ত সিডরের তাণ্ডব অব্যাহত ছিল। পৌনে ৩শ’ কিলোমিটার বেগের ঝড়ের সঙ্গে প্রায় ১৫-২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাস উপকূলের বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরিশাল, ঝালকাঠি ও পিরোজপুরের বিশাল জনপদসহ ফসলি জমি, বৃক্ষাদিকে লন্ডভন্ড করে দেয়।
সিডরের কালরাত্রির পরদিন ১৬ নভেম্বর সকাল থেকেই স্থানীয় প্রশাসন ছাড়াও সেনাবাহিনীর সদসরা উদ্ধার তৎপড়তা শুরু করেন। রেড ক্রিসেন্টের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির তৎকালীন সময়ের ৪০ সহ¯্রাধিক স্বেচ্ছাসেবক সিডরের দিন সকাল থেকে উপকূলের লক্ষাধিক মানুষকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে স্থানান্তরসহ দুর্যোগ পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতায়ও অংশগ্রহণ করে। ১৭ নভেম্বরের মধ্যে দুর্যোগ কবলিত বেশিরভাগ এলাকায় সেনাবাহিনী ও রেডক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকরা উদ্ধার কাজ শুরু করার পাশাপাশি কিছু ত্রাণ তৎপরতাও নিশ্চিত করেন।
১৬ নভেম্বর রাতের মধ্যে বরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা জাতীয় মহাসড়কটি যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব হয়। ১৮ নভেম্বর বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা ও বরিশাল-বরগুনা মহাসড়কেও যানবাহন চলাচল শুরু হলেও ফেরি সার্ভিস পুনর্বহালসহ পরিপূর্ণ সড়ক পরিবহন সচল করতে আরও দিন পনের পেরিয়ে যায়। ফলে প্রথমদিকে আকাশ পথেই ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করে সেনা ও বিমান বাহিনী। সঙ্গে বাংলাদেশ নৌবাহিনীও উপকূলের দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোতে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তীতে দেশি বিদেশি বিভিন্ন পর্যায় থেকেও ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।
তবে সিডর উত্তরকালে প্রায় ৪০টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বিভিন্ন সাহায্য ও সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও ৩২টি দেশ পরবর্তীতে তা বাস্তবায়ন করেনি। এমনকি ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী প্রণব মুখার্জিও বরিশাল বিমানবন্দর হয়ে শরণখোলার ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকা সফর করে সেখানকার কয়েকটি গ্রামের দুর্গতদের ঘরবাড়ি নির্মাণ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তবায়ন হয় ২০১০ সালের পরে। পাকিস্তান ও মার্কিন সরকার সেদিন বাংলাদেশের ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকায় তাদের বিমান ও সেনা সদস্যদের পাঠিয়ে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল। পাক বিমান বাহিনীর ৪টি ‘সি-১১০’ পরিবহন বিমান দুদিনে বরিশাল বিমানবন্দরে ত্রাণ ও উদ্ধারকারী দল নিয়ে অবতরণ করে। বরিশাল থেকে ২টি মোবাইল হাসপাতালসহ পাক সম্মিলিত বাহিনী মাসব্যাপী পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া ও ভান্ডারিয়াতে চিকিৎসা সহায়তা কার্যক্রমে অংশ নেয়। পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানি সরবরাহেও পাকসেনা সদস্যরা অংশগ্রহণ করেছিল। বরিশাল বিমানবন্দরে ত্রাণ সমন্বয় কেন্দ্র স্থাপন করে সেদিন ঘূর্ণি উপদ্রুত উপকূলীয় এলাকায় ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা পরিচালিত হয়েছিল।
তবে এখনও সিডরের কালরাত এলেই গোটা উপকূল জুড়ে মানুষের মনে অজানা আতঙ্ক তৈরি হয়। মূলত বাংলাদেশ উপকূলে গত ২শ’ বছরের ইতিহাসে নভেম্বর মাসে একাধিক তীব্র আকারের ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এরমধ্যে ’৭০ সালের ১২ নভেম্বর রাতে হেরিকেন মাত্রার ঘূর্ণিঝড় এবং ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর ছাড়াও ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর রাতেও মাঝারি মাত্রার আরেকটি ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সুন্দরবন উপকূলে আঘাত হেনেছিল।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
১৮ বছরেও সংস্কার হয়নি সিডরে বিধ্বস্ত বাগেরহাটে মোরেলগঞ্জের রাস্তাঘাট -সংবাদ
শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৫
শনিবার ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলা ‘সিডর’-এর কালরাত্রি। সেই কালরাত্রির ভয়াল দুর্যোগ গোটা উপকূলবাসীকে আজো তাড়া করে ফিরছে। ২০০৭ সালের এইদিনে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় পৌনে ৩শ’ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ বাংলাদেশ উপকূলের ১০টি জেলার ওপর হামলে পড়ে সব লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল।
ঘূর্ণিঝড়ে প্রাক-প্রস্তুতি ও আগাম সতর্কতা অনেকটা সন্তোষজনক থাকায় প্রানহানির সংখ্যা যথেষ্ট হ্রাস করা সম্ভব হলেও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। সরকারি হিসেবে যা ১৬ হাজার কোটি বলে তৎকালীন সেনা সমর্থিত কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্বীকার করেছিল। সরকারি হিসেবেই মৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৩ হাজার আদম সন্তান। নিখোঁজের তালিকায় ছিল আরও প্রায় দেড় সহশ্রাধিক আদম সন্তানের নাম। পরবর্তীতে যাদের প্রায় কারোরই আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে সিডরের তাণ্ডবে দক্ষিণ উপকূলের বিশাল জনপদের প্রায় ৪ লাখ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ এবং প্রায় ১০ লাখ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। একই সঙ্গে প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমির আমন ধান সম্পূর্ণ এবং ৫ লাখ হেক্টরের ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ৫০ লাখ গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগীর মৃত্যু ঘটে সিডরের তাণ্ডবে।
এছাড়াও প্রায় পৌনে ৭শ’ কিলোমিটার আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়কসহ পল্লী যোগাযোগ অবকাঠামো সম্পূর্ণ এবং প্রায় ৯০ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিধ্বস্ত এলাকার প্রায় ১৮শ’ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ এবং প্রায় সাড়ে ৬ হাজার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেতু ও কালভার্টের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও ছিল উদ্বেগজনক। বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের দেড় সহশ্রাধিক সেতু এবং কালভার্ট সম্পূর্ণ এবং প্রায় ৯শ’ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সেদিনের ওই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় দেশের উপকূলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলের ৩০টি জেলায় কম-বেশি আঘাত হানলেও ৭টি জেলার ২শ’ উপজেলার প্রায় সাড়ে ১৭শ’ ইউনিয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৩ হাজার বলা হলেও তা কমপক্ষে ২০ লাখ। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যাও ছিল প্রায় পৌনে ১ কোটি। সরকারিভাবে ৩ হাজার ১৯৯ জনের মৃত্যু ও ১ হাজার ৭২৬ জনের নিখোঁজের কথা বলা হলেও এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি ছিল। বেশিরভাগ নিখোঁজদের আর কোনো সন্ধান না মেলায় তাদের সবাইকে সিডরের বয়ে আনা জলোচ্ছাস সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে এসব নিখোঁজদের স্বজনরা নিকটজনের লাশটিও আর দেখতে পায়নি।
তবে উপকূলীয় এলাকায় সেদিন সিডরের তাণ্ডবে ক্ষয়ক্ষতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারতো যদি বিশাল সুন্দরবন, উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী ও পরিকল্পিত বনায়ন না থাকতো। প্রকৃতির ওই তাণ্ডব সেদিন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রুখে দিয়েছিল প্রকৃতিই। প্রকৃতির ওই তাণ্ডব সামাল দিতে সে রাতে উপকূলীয় বনায়ন কর্মসূচি ও সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের আড়াই লাখ হেক্টরের বনভূমিই ‘প্রকৃতিবর্ম’ তৈরি করেছিল। তবে প্রকৃতির ওই ধ্বংসলীলা রুখতে সে রাতে উপকূলীয় বনভূমির লক্ষ লক্ষ গাছসহ সাধারণ মানুষেরও প্রায় ১ কোটি গাছ মাটিতে মিশে গিয়েছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তর ২০০৭ সালের ১১ নভেম্বর দুপুর ১২টায় দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ২শ’ কিলোমিটার ভাটিতে একটি লঘুচাপ শনাক্ত করে। যা ক্রমশ উত্তর-পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে আন্দামান নিকোবরকে ডানে রেখে এগুতে থাকে। ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় লঘুচাপটি আন্দামান থেকে প্রায় ৫শ’ কিলোটিার পূর্ব দিক দিয়ে সোজা উত্তরে এগুতো শুরু করে। এরপর লঘুচাপটি নিম্নচাপ থেকে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়ে ক্রমশ উত্তর দিকে বাংলাদেশ-ভারত সাগর সীমান্ত উপকূল বরাবর এগুতে থাকে। ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশ উপকূলের ৫শ’ কিলোমিটার দক্ষিণ দিয়ে ক্রমশ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মাঝ বরাবর রায়মঙ্গল-হাড়িয়াভাঙ্গা উপকূলে অগ্রসর হচ্ছিল। ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মাত্র ১শ’ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসে। ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় সুন্দরবন এলাকা অতিক্রম করবে বলে মনে করা হলেও বিকেলেই আকষ্মিকভাবে তার গতিপথ পরিবর্তন করে উত্তরমুখি থেকে উত্তর-পূর্বমুখি হতে শুরু করে। সন্ধ্যা ৬টার পরই ঝড়টি আরও দ্রুত গতিতে উত্তর-পূর্বমুখি হয়ে ভারত-বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমান্ত থেকে প্রায় ৩শ’ কিলোমিটার পূর্বে বরগুনা এবং বাগেরহাটের মধ্যবর্তী হরিণঘাটা-বুড়িশ্বর ও বিশখালী নদীর বঙ্গোপসাগর মোহনা দিয়ে প্রায় পৌনে ৩শ’ কিলোমিটার বেগে মূল ভূখণ্ডে আছড়ে পড়ে।
ঝড়টির ব্যাপ্তি মাত্র দেড়শ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তার দৈর্ঘ্য ছিল অনেক দীর্ঘ। সাগরপাড়ের হরিণঘাটা-পাথরঘাটা থেকে প্রায় আড়াইশ’ কিলোমিটার দূরে বরিশাল মহানগরী পর্যন্ত একই সঙ্গে প্রায় সমান বেগে সিডরের নারকীয় তাণ্ডব অব্যাহত ছিল। এমনকি খোদ বরিশাল মহানগরীতেও ঘূর্ণিঝড়-সিডর প্রায় সোয়া ২শ’ কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়ে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত পশ্চিমে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা, রামপাল থেকে বরিশাল হয়ে মাদারীপুর, শরিয়তপুর ও গোপালগঞ্জ পর্যন্ত সিডরের তাণ্ডব অব্যাহত ছিল। পৌনে ৩শ’ কিলোমিটার বেগের ঝড়ের সঙ্গে প্রায় ১৫-২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাস উপকূলের বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরিশাল, ঝালকাঠি ও পিরোজপুরের বিশাল জনপদসহ ফসলি জমি, বৃক্ষাদিকে লন্ডভন্ড করে দেয়।
সিডরের কালরাত্রির পরদিন ১৬ নভেম্বর সকাল থেকেই স্থানীয় প্রশাসন ছাড়াও সেনাবাহিনীর সদসরা উদ্ধার তৎপড়তা শুরু করেন। রেড ক্রিসেন্টের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির তৎকালীন সময়ের ৪০ সহ¯্রাধিক স্বেচ্ছাসেবক সিডরের দিন সকাল থেকে উপকূলের লক্ষাধিক মানুষকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে স্থানান্তরসহ দুর্যোগ পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতায়ও অংশগ্রহণ করে। ১৭ নভেম্বরের মধ্যে দুর্যোগ কবলিত বেশিরভাগ এলাকায় সেনাবাহিনী ও রেডক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকরা উদ্ধার কাজ শুরু করার পাশাপাশি কিছু ত্রাণ তৎপরতাও নিশ্চিত করেন।
১৬ নভেম্বর রাতের মধ্যে বরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা জাতীয় মহাসড়কটি যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব হয়। ১৮ নভেম্বর বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা ও বরিশাল-বরগুনা মহাসড়কেও যানবাহন চলাচল শুরু হলেও ফেরি সার্ভিস পুনর্বহালসহ পরিপূর্ণ সড়ক পরিবহন সচল করতে আরও দিন পনের পেরিয়ে যায়। ফলে প্রথমদিকে আকাশ পথেই ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করে সেনা ও বিমান বাহিনী। সঙ্গে বাংলাদেশ নৌবাহিনীও উপকূলের দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোতে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তীতে দেশি বিদেশি বিভিন্ন পর্যায় থেকেও ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।
তবে সিডর উত্তরকালে প্রায় ৪০টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বিভিন্ন সাহায্য ও সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও ৩২টি দেশ পরবর্তীতে তা বাস্তবায়ন করেনি। এমনকি ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী প্রণব মুখার্জিও বরিশাল বিমানবন্দর হয়ে শরণখোলার ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকা সফর করে সেখানকার কয়েকটি গ্রামের দুর্গতদের ঘরবাড়ি নির্মাণ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তবায়ন হয় ২০১০ সালের পরে। পাকিস্তান ও মার্কিন সরকার সেদিন বাংলাদেশের ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকায় তাদের বিমান ও সেনা সদস্যদের পাঠিয়ে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল। পাক বিমান বাহিনীর ৪টি ‘সি-১১০’ পরিবহন বিমান দুদিনে বরিশাল বিমানবন্দরে ত্রাণ ও উদ্ধারকারী দল নিয়ে অবতরণ করে। বরিশাল থেকে ২টি মোবাইল হাসপাতালসহ পাক সম্মিলিত বাহিনী মাসব্যাপী পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া ও ভান্ডারিয়াতে চিকিৎসা সহায়তা কার্যক্রমে অংশ নেয়। পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানি সরবরাহেও পাকসেনা সদস্যরা অংশগ্রহণ করেছিল। বরিশাল বিমানবন্দরে ত্রাণ সমন্বয় কেন্দ্র স্থাপন করে সেদিন ঘূর্ণি উপদ্রুত উপকূলীয় এলাকায় ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা পরিচালিত হয়েছিল।
তবে এখনও সিডরের কালরাত এলেই গোটা উপকূল জুড়ে মানুষের মনে অজানা আতঙ্ক তৈরি হয়। মূলত বাংলাদেশ উপকূলে গত ২শ’ বছরের ইতিহাসে নভেম্বর মাসে একাধিক তীব্র আকারের ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এরমধ্যে ’৭০ সালের ১২ নভেম্বর রাতে হেরিকেন মাত্রার ঘূর্ণিঝড় এবং ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর ছাড়াও ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর রাতেও মাঝারি মাত্রার আরেকটি ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সুন্দরবন উপকূলে আঘাত হেনেছিল।