মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যথা সময়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, প্রতিষ্ঠান ছুটির নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রস্থান, শিক্ষার্থী সংকট ও অবকাঠামো সমস্যাসহ শিক্ষকদের অপেশাদারী মনোভাব ও শিক্ষক স্বল্পতার কারণে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা বেহাল দশায় পতিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব সর্বাধিক। শিক্ষার ভীত গড়ে উঠে প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে।
অথচ গজারিয়া উপজেলার অধিকাংশ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজ করছে এক প্রকার নৈরাজ্যকর অবস্থা।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন ভাতা বৃদ্ধি পাওয়ার পরও সে তুলনায় অধিকাংশ স্কুলে শিক্ষার মান নিম্নগামী।
এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অদক্ষতা, পাঠদানে অমনোযোগিতা, সঠিক উপায়ে ক্লাস পরিচালনা না করা ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের অবহেলা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের সময় নিজ এলাকায় নিয়োগের শর্ত থাকলেও রাজধানী শহর ঢাকা থেকে স্বল্প দুরত্বের গজারিয়া উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক পরিবার নিয়ে অবস্থান করেন নিজ এলাকার বাহিরে শহরে। অধিকাংশ শিক্ষক স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব/ব্যবস্থাপনা কমিটি ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে সঠিক সময়ে বিদ্যালয়ে আগমন ও প্রস্তান করে না বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনিয়ম তদারকীর দায়িত্বে থাকা শিক্ষা কর্মকর্তারা অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে অনিয়মের সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষকদের সু-রক্ষা দিয়ে থাকেন বলে জানা যায়। গত দুই মাসাধিক কাল সময়ে গজারিয়া উপজেলার বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে সরজমিন ঘুরে ও স্থানীয় অভিভাবকসহ এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে বিভিন্ন অনিয়মের চিত্রের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। এ সকল অনিয়ম বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মকর্তাদের সাথে কথা বললেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহনের সংখ্যা নাম মাত্র। গত ২৯ অক্টোবর বুধবার ৭১ নং আব্দুল্লাহপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে সকাল পৌনে দশটায় বিদ্যালয়ের প্রধান ফটক তালাবন্ধ দেখা গেছে। সকাল দশটার পর দুই জন শিক্ষক বিদ্যালয়ে হাজির হলেও ওই সময় পর্যন্ত পাঠগ্রহনের জন্য একজন শিক্ষার্থীও শ্রেণি কক্ষে পাওয়া যায়নি। প্রধান শিক্ষক (চলতি দায়িত্বে) মো. আব্দুল হক সকাল ১০ টা কুড়ি মিনিটের সময় বিদ্যালয়ে হাজির হয়ে জানান, স্থানীয় মহল্লার মসজিদে মাইকিং করে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ডেকে আনতে হয়, ওই কথায় সায় দিলেন স্থানীয় বাসিন্দা জসীম উদ্দিন। ৪ জন শিক্ষকের অপর দুইজন নুরুননাহার ও মনিরা বেগম ওই দিন বিনা নোটিশে ছিলেন নিজ কর্মস্থলে অনুপস্থিত। বিদ্যালয়টিতে মোট ৭০ জন শিক্ষার্থী থাকার দাবী করলেও সকাল এগারটা পযর্ন্ত শ্রেণি কক্ষে কোন শিক্ষার্থীকে উপস্থিত পাওয়া যাযনি। ৪৮ নং টানবলাকী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আমিনুল ইসলাম ঢাকায় বসবাস করেন তিনি প্রায় প্রতিদিন কর্মদিবসে বিদ্যালয়ে বিলম্বে আসেন এবং স্কুল ছুটির সময় হওয়ার আগেই কর্মস্থল ত্যাগ করার অভিযোগ রয়েছে, সরজমিন গিয়ে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন কর্তৃপক্ষ ছাড়া কারো সাথে কথা বলবেন না।
৫ নভেম্বর বুধবার সকাল সোয় নয়টায় ২১ নং আনারপুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে মাত্র দুই জন শিক্ষককে উপস্থিত পাওয়া গেছে। সকাল পৌনে দশটায় সহকারী শিক্ষক আল আমিন বিদ্যালয়ে হাজির হয়ে শিক্ষক হাজিরা খাতায় স্বাক্ষরে আগমনের সময় উল্লেখ করেন সকাল ৯টা। ৭৩ নং জামালদী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯ টায় গিয়ে দুই জন শিক্ষক উপস্থিত পাওয়া গেছে। প্রধান শিক্ষক নাসরিন আক্তার ও নাজমা বেগমসহ ৩ জন শিক্ষক তাদের ঢাকার বাসা থেকে এসে বিদ্যালয়ে পাঠদান করলেও ওই দিন প্রধান শিক্ষক নাসরিন আক্তার ও সহকারী শিক্ষক নাজমা বেগম ছিলেন স্কুল সময়ে শপিংয়ে। এ বিষয়ে দায়িত্ব প্রাপ্ত গজারিয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ইলিয়াস আহম্মদ বলেন, বিষয়টি তিনি অবগত নয়, খোজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানান ওই কর্মকর্তা। ১০ নভেম্বর সোমবার ৮০ নং গুয়াগাছিয়া মধ্যপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রধান শিক্ষক মুন্নী আক্তার ও সহকারী শিক্ষক আরিফা বেগমকে বিদ্যালয়ে পাওয়া যায়নি, অপর সহকারী শিক্ষক শাহ আলম জানান, ওই দুই শিক্ষক শিশু জরিপ কাজে বাহিরে রয়েছে, কিন্তু শিক্ষক হাজিরা খাতায় দুই শিক্ষকের উপস্থিতি স্বাক্ষর ছিল না ওই দিনে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এর আগেও ২৯ অক্টোবর কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত ৮০ নং গুয়াগাছিয়া মধ্যপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মুন্নী আক্তার ও শাহ আলম কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় কারণ দর্শানোর নোটিশ করেছিল উপজেলা শিক্ষা কার্যালয়। ১৯ নভেম্বর বুধবার ৬৯ নং পোড়াচক বাউশিয়া পুর্ব নয়াকান্দী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে সকাল সোয়া নয়টায় সহকারী শিক্ষক সামছুননাহারকে ব্যতীত কোন শিক্ষক উপস্থিত পাওয়া যায়নি, সকাল সাড়ে নয়টা থেকে সাড়ে এগারটা পর্যন্ত সময়ে একে একে বিদ্যালয়ে আগমন করনে সহকারী শিক্ষক লতিফা সরকার, দেলোয়ার হোসেন, সুরাইয়া আক্তার, আশরাফুল ইসলাম ও সবশেষে প্রধান শিক্ষক আমেনা খাতুন। স্থানীয় অভিভাবকদের সূত্রে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক আমেনা খাতুন ও সহকারী শিক্ষক তার ছেলে আশরাফুল ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকা থেকে প্রায় প্রতি কর্মদিবসে বিলম্বে কর্মস্থলে আগমন করেন। স্থানীয়রা বিদ্যালয়টিকে মায়ে-পুতের স্কুল বলে জানায়,
২ নভেম্বর রোববার বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে ৪৮ নং টান বলাকী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরজমিন গিয়ে কোন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের হাজির পাওয়া যায়নি।
২৫ নভেম্বর মঙ্গলবার সোয়া ৯টায় , ১৬ নং উত্তর শাহপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, প্রধান শিক্ষক (চলতি দায়িত্ব)আসমা সিদ্দীকা ও সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার ময়না বিদ্যালয়ে আগমন করেন সকাল পৌনে দশটায়। খাদিজা আক্তার প্রতি কর্মদিবসে বিলম্বে স্কুলে আসেন বলে জানা যায়। গত সোমবার পহেলা ডিসেম্বর ৮১ নং চরবাউশিয়া বড়কান্দী প্রাথমিক বিদ্যলয়ে সরজমিন দেখা যায়, সহকারী শিক্ষক জাহিদুল ইসলাম সকাল সোয়া দশটায় স্কুলে উপস্থিত হয়ে শিক্ষক হাজিরা খাতায় অগমনের সময় উল্লেখ করেন সকাল ৯টায় গজারিয়া উপজেলা শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার মূল ভুখন্ড থেকে নদী বিচ্ছিন্ন গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের আনুমানিক ১ কিলোমিটার দুরত্বের ব্যবধানে ৮০, ৮৩ ও ৮৭ নং ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থান ও পাশর্বর্তী ৮৪ নং জামালপুর প্রাথমিক বিদ্যলয়ের অবস্থান। স্থানীয় অভিভাবক ও এলাকাবাসী সুত্রে জানা যায়, গুয়াগাছিয়া ইউনিয়ের ৮০,৮৩,ও ৮৪ নং বিদ্যালয় গুলোতে হাজিরা খাতায় উল্লেখিত শিক্ষার্থীদের সংখ্যার সাথে বাস্তব থাকা শিক্ষার্থীর সংখ্যায় গড় মিল রয়েছে
গজারিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সুত্রে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের আশিটির অধিক পদ শূণ্য রয়েছে। গজারিয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শাহানাজ পারভিন মোবাইল ফোনে জানান, সার্বিক বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করবেন।