আকস্মিক বন্যায় সিলেটের ১১টি উপজেলায় ২ হাজার ১৭৩ কোটি টাকার মৎস্যসম্পদ ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া আড়তে রাখা চাল নষ্ট হয়েছে বন্যার পানিতে। জেলার মোট ১৮ হাজার ৭৪৯টি পুকুর, দিঘী, হ্যাচারি ও মাছের খামার তলিয়ে গেছে। এতে ২ কোটি ১৩ লাখ মাছের পোনা এবং ২ হাজার ৩০৫ টন মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গিয়ে মাছ চাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। মাছ ভেসে যাওয়া ছাড়াও হয়েছে অবকাঠামোগত ক্ষতি।
এর ফলে সিলেট জেলার ১৫ হাজার ১৬৩ জন খামার মালিকের ২ হাজার ১৭৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ।
জকিগঞ্জ উপজেলার বীরশ্রী এলাকার মাছ চাষি আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, পুকুরে মাছ চাষের জন্য প্রায় ২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি। বন্যার শুরুতে পুকুরের চারদিকে ঘের দিয়ে মাছ বাঁচানোর চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। বন্যার তোড়ে সব মাছ ভেসে গেছে।
বন্যায় জকিগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, বিশ্বনাথ, জৈন্তাপুর ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। জকিগঞ্জে ৬ হাজার ৩৫০টি মাছের খামার তলিয়ে ৬২২ কোটি টাকা, গোয়াইনঘাটে ২ হাজার ৫৯২টি খামার তলিয়ে ১৪০ কোটি টাকা, কানাইঘাটে ২ হাজার ৩৫০টি খামার তলিয়ে ৬৪ কোটি টাকা, বিশ্বনাথে ২ হাজার ১৫০টি খামার তলিয়ে ১৫৫ কোটি টাকা, জৈন্তাপুরে ২ হাজার ১০০টি খামার তলিয়ে ৬৭৪ কোটি টাকা ও বিয়ানীবাজারে এক হাজার ৪০২টি খামার তলিয়ে ২১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়া সিলেট সদর উপজেলায় ৫৩৫টি মাছের খামার, গোলাপগঞ্জে ৮৪৫টি, বালাগঞ্জে ৭০টি, কোম্পানীগঞ্জে ১৪৫টি ?ও দক্ষিণ সুরমায় ২১০টি খামার তলিয়ে গেছে। সিলেট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, জেলায় মাছ চাষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, যা অপূরণীয়। আর এ ক্ষতির পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
সিলেটের তুলনায় সুনামগঞ্জে সামগ্রিকভাবে বন্যার প্রকোপ কম হয়েছে। জেলার দোয়ারাবাজার, ছাতক, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর ও সুনামগঞ্জ সদর এলাকা প্লাবিত হলেও মাছ চাষিদের ক্ষতি হয়েছে তুলনামূলক কম।
সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুনীল মন্ডল বলেন, বন্যায় মাছ চাষিদের অন্তত আড়াই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। জেলায় ৪৫০টি পুকুর-খামার-হ্যাচারি ডুবে ৩৫ টন মাছ ও ৩০ লাখ মাছের পোনা ভেসে গেছে।
সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ শহর পয়েন্টে বিপদসীমার নিচে নামলেও সিলেটের সব পয়েন্টে এখনও বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, রোববার (২২ মে) সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলা পয়েন্টে ৮৪ সেন্টিমিটার উপর ও সিলেট নগরী পয়েন্টে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই সময় কুশিয়ারা নদীর পানি সিলেটের জকিগঞ্জের অমলশীদ পয়েন্টে বিপদসীমার ১৩২ সেন্টিমিটার উপর এবং বিয়ানীবাজারের শেওলা পয়েন্টে ৪৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সুনামগঞ্জে সুরমা নদী সুনামগঞ্জ শহর পয়েন্টে বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে পুরাতন সুরমা নদী জেলার দিরাই উপজেলায় বিপদসীমার ৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই সময় নেত্রকোনার কলমাকান্দায় সোমেশ্বরী নদী বিপদসীমার ২৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
অন্যদিকে, বন্যায় মাছের খামার, পুকুর ও দিঘী তলিয়ে মাছ চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অনেক এলাকায় বন্যার পানিতে মাছ ধরার উৎসব চলছে। বন্যাকবলিত প্রায় প্রতিটি রাস্তা বা যেকোন উঁচু সড়কের পাশে অসংখ্য শিশু-কিশোর ও যুবককে ছোট ছোট জাল নিয়ে মাছ ধরতে দেখা গেছে।
দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কামালবাজার এলাকায় মাছ ধরতে থাকা শিশু কবির আহমেদ জানায়, বন্যার পানিতে প্রচুর মাছ ধরা পড়ছে। সকাল থেকে জালে বেশ কিছু মাছ ধরা পড়েছে, যা দিয়ে কয়েক বেলার রান্না চালানো সম্ভব। এদিকে সিলেটে এক সপ্তাহ দাপট দেখিয়ে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও ব্যাপক লোকসানে ফেলে দিয়েছে অনেককে। এর মধ্যে ধান-চালের ব্যবসায়ীরা পড়েছেন অপূরণীয় ক্ষতিতে। সিলেট নগরের সুরমা নদী তীরবর্তী ধান-চালের মিল ও আড়তে গুদামজাত করে রাখা কোটি টাকার ধান-চাল নষ্ট করেছে বন্যার পানি।
সুরমার উত্তরপাড়ের নগরীর কাজিরবাজার ধান-চালের মিল ও আড়তে গিয়ে জানা যায়, গুদামগুলোর কোন কোনটায় ছিল কোমর পানি। গুদামে রাখা সারি সারি ধান-চালের বস্তা ভিজে নষ্ট হয়েছে বন্যার পানিতে। বৃহস্পতিবার (১৯ মে) থেকে বন্যার পানি কমতে শুরু করায় শনিবার থেকে গুদামগুলো খুলতে শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। গুদামগুলো থেকে বেরিয়ে আসছে ধান-চালের পচা দুর্গন্ধ। মজুদকৃত ৫০ কেজির হাজার হাজার বস্তা চাল এবং ২ মণ ওজনের ধানের বস্তার স্তূপ ভিজে পচন ধরেছে। কাজিরবাজারের প্রতিটি গুদামেই ঢুকেছিল বন্যার পানি। আকস্মিক বন্যার কারণে আড়তদাররা ধান-চালের বস্তা সরানোর সময় পাননি। ধান-চালের পচা দুর্গন্ধে এখন ওই এলাকার বাতাস দুষিত হয়ে আছে। এমন অপূরণীয় ক্ষতিতে ব্যবসায়ীরা কান্না করছেন।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, কাজিরবাজার এলাকার মোস্তাক অ্যান্ড ব্রাদার্স মিল, পদ্মা রাইস মিল, দয়া ও জামান মিল, রঙ্গেশ অটো রাইস মিল, এমএস অটো রাইস মিল, মতিন ব্রাদার্স, হাসান ব্রাদার্স ও ফাইয়ানসহ অনেক মিল এবং আড়তে হাজার হাজার বস্তা ধান-চাল রাখা ছিল। সেই গুদামগুলোর নিচের অন্তত ৫ ফুট পর্যন্ত রাখা বস্তাগুলোর ধান-চাল পচে নষ্ট হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে এক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় সরকারকে পাশে না দাঁড়ালে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন তারা।
একই অবস্থা সুরমা তীরবর্তী আরেক এলাকা শেখঘাটে। সেখানেই রয়েছে অনেক ধান-চালের মিল ও আড়ত। শেখঘাটের এসএল অটো রাইসমিল ও মেসার্স জনতা ট্রেডার্সের পরিচালক আবদুল হামিদ বলেন, শেখঘাট এলাকাতে বেশ কয়েকটি অটো রাইসমিল রয়েছে। সব মিলেই বন্যার পানি ঢুকেছিল। এতে কয়েক কোটি টাকার ধান-চালের ক্ষতি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা এখন পথে বসার জোগাড়।
শেখঘাটের আড়ত ও অটো রাইসমিলগুলা ঘুরে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা প্রতিষ্ঠানের গুদাম ও অটো রাইসমিল থেকে ভেজা চাল ও ধানের বস্তা বের করছেন। ওই এলাকাজুড়ে ধান-চাল পচা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। গুদামগুলোর মধ্যে জমে থাকা পানিতে চাল পড়ে সেগুলো থেকেই গন্ধ বের হচ্ছে।
সিলেটের কাজির বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য আবদুল মালেক বলেন, কাজির বাজার ও শেখঘাট অংশে শতাধিক চালের ব্যবসায়ী রয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রায় ১০ থেকে ১৫টি অটো রাইসমিল। চাল ব্যবসায়ীদের আলাদা গুদামও রয়েছে। গুদামে হাজার হাজার বস্তা চাল রাখা থাকে। সেগুলো একসঙ্গে সরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। নদীর পানি উপচে গুদাম ও রাইসমিলে প্রবেশ করে ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ১০ মে থেকে সিলেটে ভারী বর্ষণ শুরু হয়। সেই সঙ্গে উজান থেকে একের পর এক নামতে শুরু করে পাহাড়ি ঢল। ফলে ১১ মে থেকেই সিলেটের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে থাকে।
এক সপ্তাহ পর সুরমার পানি বিপদসীমার নিচে নামলেও জলাবদ্ধতা দূর হয়নি
এক সপ্তাহ পর বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। তবে পানি কমলেও সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার জলাবদ্ধতা দূর হয়নি। নীর পানি। শনিবার (২১ মে) সকাল থেকে সুনামগঞ্জের সুরমা বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে আর সেটিকে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি বলে জানিয়েছে পাউবো। তবে নদীর পানি কমে গেলেও শহরের বিভিন্ন এলাকার পানি স্থির থেকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বানভাসী মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নবী নগর এলাকার রত্না বেগম বলেন, ‘পানি প্রতিবছর আয় কিন্তু এবার এত তাড়াতাড়ি আইয়া আমরা যা গৃহস্থি করছিলাম সব পানিতে ভিজি গেছে, শুকনা ধান এই পানিত আবার ভিজছে।’
শান্তিবাগ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা সুবল দাস বলেন, ‘পানি কমতেছে কিন্তু খুব ধীর গতিতে আর পানির জন্য এলাকাগুলোতে গন্ধ ছড়াচ্ছে যা খুব কষ্ট হচ্ছে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুদ্দোহা জানান, সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে ছাতকে এখনও সুরমার পানি বিপদসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত বলেন, বন্যায় পৌর শহরের অনেক আবাসিক এলাকায় পানি উঠেছে। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ আছে।
রোববার, ২২ মে ২০২২
আকস্মিক বন্যায় সিলেটের ১১টি উপজেলায় ২ হাজার ১৭৩ কোটি টাকার মৎস্যসম্পদ ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া আড়তে রাখা চাল নষ্ট হয়েছে বন্যার পানিতে। জেলার মোট ১৮ হাজার ৭৪৯টি পুকুর, দিঘী, হ্যাচারি ও মাছের খামার তলিয়ে গেছে। এতে ২ কোটি ১৩ লাখ মাছের পোনা এবং ২ হাজার ৩০৫ টন মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গিয়ে মাছ চাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। মাছ ভেসে যাওয়া ছাড়াও হয়েছে অবকাঠামোগত ক্ষতি।
এর ফলে সিলেট জেলার ১৫ হাজার ১৬৩ জন খামার মালিকের ২ হাজার ১৭৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ।
জকিগঞ্জ উপজেলার বীরশ্রী এলাকার মাছ চাষি আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, পুকুরে মাছ চাষের জন্য প্রায় ২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি। বন্যার শুরুতে পুকুরের চারদিকে ঘের দিয়ে মাছ বাঁচানোর চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। বন্যার তোড়ে সব মাছ ভেসে গেছে।
বন্যায় জকিগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, বিশ্বনাথ, জৈন্তাপুর ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। জকিগঞ্জে ৬ হাজার ৩৫০টি মাছের খামার তলিয়ে ৬২২ কোটি টাকা, গোয়াইনঘাটে ২ হাজার ৫৯২টি খামার তলিয়ে ১৪০ কোটি টাকা, কানাইঘাটে ২ হাজার ৩৫০টি খামার তলিয়ে ৬৪ কোটি টাকা, বিশ্বনাথে ২ হাজার ১৫০টি খামার তলিয়ে ১৫৫ কোটি টাকা, জৈন্তাপুরে ২ হাজার ১০০টি খামার তলিয়ে ৬৭৪ কোটি টাকা ও বিয়ানীবাজারে এক হাজার ৪০২টি খামার তলিয়ে ২১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়া সিলেট সদর উপজেলায় ৫৩৫টি মাছের খামার, গোলাপগঞ্জে ৮৪৫টি, বালাগঞ্জে ৭০টি, কোম্পানীগঞ্জে ১৪৫টি ?ও দক্ষিণ সুরমায় ২১০টি খামার তলিয়ে গেছে। সিলেট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, জেলায় মাছ চাষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, যা অপূরণীয়। আর এ ক্ষতির পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
সিলেটের তুলনায় সুনামগঞ্জে সামগ্রিকভাবে বন্যার প্রকোপ কম হয়েছে। জেলার দোয়ারাবাজার, ছাতক, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর ও সুনামগঞ্জ সদর এলাকা প্লাবিত হলেও মাছ চাষিদের ক্ষতি হয়েছে তুলনামূলক কম।
সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুনীল মন্ডল বলেন, বন্যায় মাছ চাষিদের অন্তত আড়াই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। জেলায় ৪৫০টি পুকুর-খামার-হ্যাচারি ডুবে ৩৫ টন মাছ ও ৩০ লাখ মাছের পোনা ভেসে গেছে।
সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ শহর পয়েন্টে বিপদসীমার নিচে নামলেও সিলেটের সব পয়েন্টে এখনও বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, রোববার (২২ মে) সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলা পয়েন্টে ৮৪ সেন্টিমিটার উপর ও সিলেট নগরী পয়েন্টে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই সময় কুশিয়ারা নদীর পানি সিলেটের জকিগঞ্জের অমলশীদ পয়েন্টে বিপদসীমার ১৩২ সেন্টিমিটার উপর এবং বিয়ানীবাজারের শেওলা পয়েন্টে ৪৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সুনামগঞ্জে সুরমা নদী সুনামগঞ্জ শহর পয়েন্টে বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে পুরাতন সুরমা নদী জেলার দিরাই উপজেলায় বিপদসীমার ৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই সময় নেত্রকোনার কলমাকান্দায় সোমেশ্বরী নদী বিপদসীমার ২৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
অন্যদিকে, বন্যায় মাছের খামার, পুকুর ও দিঘী তলিয়ে মাছ চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অনেক এলাকায় বন্যার পানিতে মাছ ধরার উৎসব চলছে। বন্যাকবলিত প্রায় প্রতিটি রাস্তা বা যেকোন উঁচু সড়কের পাশে অসংখ্য শিশু-কিশোর ও যুবককে ছোট ছোট জাল নিয়ে মাছ ধরতে দেখা গেছে।
দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কামালবাজার এলাকায় মাছ ধরতে থাকা শিশু কবির আহমেদ জানায়, বন্যার পানিতে প্রচুর মাছ ধরা পড়ছে। সকাল থেকে জালে বেশ কিছু মাছ ধরা পড়েছে, যা দিয়ে কয়েক বেলার রান্না চালানো সম্ভব। এদিকে সিলেটে এক সপ্তাহ দাপট দেখিয়ে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও ব্যাপক লোকসানে ফেলে দিয়েছে অনেককে। এর মধ্যে ধান-চালের ব্যবসায়ীরা পড়েছেন অপূরণীয় ক্ষতিতে। সিলেট নগরের সুরমা নদী তীরবর্তী ধান-চালের মিল ও আড়তে গুদামজাত করে রাখা কোটি টাকার ধান-চাল নষ্ট করেছে বন্যার পানি।
সুরমার উত্তরপাড়ের নগরীর কাজিরবাজার ধান-চালের মিল ও আড়তে গিয়ে জানা যায়, গুদামগুলোর কোন কোনটায় ছিল কোমর পানি। গুদামে রাখা সারি সারি ধান-চালের বস্তা ভিজে নষ্ট হয়েছে বন্যার পানিতে। বৃহস্পতিবার (১৯ মে) থেকে বন্যার পানি কমতে শুরু করায় শনিবার থেকে গুদামগুলো খুলতে শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। গুদামগুলো থেকে বেরিয়ে আসছে ধান-চালের পচা দুর্গন্ধ। মজুদকৃত ৫০ কেজির হাজার হাজার বস্তা চাল এবং ২ মণ ওজনের ধানের বস্তার স্তূপ ভিজে পচন ধরেছে। কাজিরবাজারের প্রতিটি গুদামেই ঢুকেছিল বন্যার পানি। আকস্মিক বন্যার কারণে আড়তদাররা ধান-চালের বস্তা সরানোর সময় পাননি। ধান-চালের পচা দুর্গন্ধে এখন ওই এলাকার বাতাস দুষিত হয়ে আছে। এমন অপূরণীয় ক্ষতিতে ব্যবসায়ীরা কান্না করছেন।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, কাজিরবাজার এলাকার মোস্তাক অ্যান্ড ব্রাদার্স মিল, পদ্মা রাইস মিল, দয়া ও জামান মিল, রঙ্গেশ অটো রাইস মিল, এমএস অটো রাইস মিল, মতিন ব্রাদার্স, হাসান ব্রাদার্স ও ফাইয়ানসহ অনেক মিল এবং আড়তে হাজার হাজার বস্তা ধান-চাল রাখা ছিল। সেই গুদামগুলোর নিচের অন্তত ৫ ফুট পর্যন্ত রাখা বস্তাগুলোর ধান-চাল পচে নষ্ট হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে এক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় সরকারকে পাশে না দাঁড়ালে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন তারা।
একই অবস্থা সুরমা তীরবর্তী আরেক এলাকা শেখঘাটে। সেখানেই রয়েছে অনেক ধান-চালের মিল ও আড়ত। শেখঘাটের এসএল অটো রাইসমিল ও মেসার্স জনতা ট্রেডার্সের পরিচালক আবদুল হামিদ বলেন, শেখঘাট এলাকাতে বেশ কয়েকটি অটো রাইসমিল রয়েছে। সব মিলেই বন্যার পানি ঢুকেছিল। এতে কয়েক কোটি টাকার ধান-চালের ক্ষতি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা এখন পথে বসার জোগাড়।
শেখঘাটের আড়ত ও অটো রাইসমিলগুলা ঘুরে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা প্রতিষ্ঠানের গুদাম ও অটো রাইসমিল থেকে ভেজা চাল ও ধানের বস্তা বের করছেন। ওই এলাকাজুড়ে ধান-চাল পচা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। গুদামগুলোর মধ্যে জমে থাকা পানিতে চাল পড়ে সেগুলো থেকেই গন্ধ বের হচ্ছে।
সিলেটের কাজির বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য আবদুল মালেক বলেন, কাজির বাজার ও শেখঘাট অংশে শতাধিক চালের ব্যবসায়ী রয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রায় ১০ থেকে ১৫টি অটো রাইসমিল। চাল ব্যবসায়ীদের আলাদা গুদামও রয়েছে। গুদামে হাজার হাজার বস্তা চাল রাখা থাকে। সেগুলো একসঙ্গে সরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। নদীর পানি উপচে গুদাম ও রাইসমিলে প্রবেশ করে ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ১০ মে থেকে সিলেটে ভারী বর্ষণ শুরু হয়। সেই সঙ্গে উজান থেকে একের পর এক নামতে শুরু করে পাহাড়ি ঢল। ফলে ১১ মে থেকেই সিলেটের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে থাকে।
এক সপ্তাহ পর সুরমার পানি বিপদসীমার নিচে নামলেও জলাবদ্ধতা দূর হয়নি
এক সপ্তাহ পর বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। তবে পানি কমলেও সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার জলাবদ্ধতা দূর হয়নি। নীর পানি। শনিবার (২১ মে) সকাল থেকে সুনামগঞ্জের সুরমা বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে আর সেটিকে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি বলে জানিয়েছে পাউবো। তবে নদীর পানি কমে গেলেও শহরের বিভিন্ন এলাকার পানি স্থির থেকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বানভাসী মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নবী নগর এলাকার রত্না বেগম বলেন, ‘পানি প্রতিবছর আয় কিন্তু এবার এত তাড়াতাড়ি আইয়া আমরা যা গৃহস্থি করছিলাম সব পানিতে ভিজি গেছে, শুকনা ধান এই পানিত আবার ভিজছে।’
শান্তিবাগ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা সুবল দাস বলেন, ‘পানি কমতেছে কিন্তু খুব ধীর গতিতে আর পানির জন্য এলাকাগুলোতে গন্ধ ছড়াচ্ছে যা খুব কষ্ট হচ্ছে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুদ্দোহা জানান, সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে ছাতকে এখনও সুরমার পানি বিপদসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত বলেন, বন্যায় পৌর শহরের অনেক আবাসিক এলাকায় পানি উঠেছে। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ আছে।