অস্বাভাবিক বাজার পরিস্থিতি
যশোর শহরের বেজপাড়া এলাকার দোকান কর্মচারি রাকিবুল আলম প্রতিমাসে গড়ে ৪ হাজার টাকার শুকনা বাজার নিয়ে থাকেন একই এলাকার মুদি দোকানী রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে। বাকিতে কিনে মাস শেষে বেতন পেয়ে তিনি দোকানীকে পরিশোধ করতেন ১২ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে। কিন্তু চলতি মাসে ওই দোকানী রাকিবুলকে আর বাকিতে পণ্য দেননি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, কিছু কোম্পানির কাছ থেকে মুদি দোকানীরা বাকিতে পণ্য কেনার সুযোগ পেতেন। সেই সুযোগ চলতি মাস থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আবার দাম বৃদ্ধির জন্য পণ্য কিনতে পূঁজিও বেশি লাগছে। এতে দোকানী নগর টাকার সংকটে পড়েছেন। যেকারণে বাকিতে পণ্য বিক্রি করছেনা। এতে বেকায়দায় পড়েছেন রাকিবুল। নিরুপায় হয়ে এক আত্নীয়র কাছ থেকে টাকা ধার করে সদায় কিনেছেন তিনি।
শহরের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী অটিস্টিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বপন হোসেন জানান, দাম বৃদ্ধির কারণে নিত্যপণ্যের খরচও কমাতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, বাজারে যে জিনিসের দাম। এর জন্য এখন খরচের পরিমাণও কমছে। যেখানে কিনতাম এক কেজি চাল, সেখানে কিনছি আধা কেজি। কী করার উপায় নেই। না খেয়ে তো আর বাঁচা যায় না। তার উপর এলাকার মুদি দোকান থেকে কিছু জিনিস বাকিতে কিনতাম, মাস শেষে বেতন পেলে সেটি পরিশোধ করতাম কিন্তু দোকানী আর বাকিতে পণ্য বিক্রি করছেনা। কারণ হিসেবে বলছেন, সব জিনিসের দাম বাড়ার কারণে তাদের পূঁজি বেশি লাগছে, আবার কোম্পানি কোন বাকিতে পণ্য দিচ্ছেনা। যেকারণে তারাও আর বাকিতে বিক্রি করছেনা।
শহরের বড় বাজারের মুদি দোকানে ডিম কিনতে আসা রেল রোডের বাসিন্দা ফেরিওয়ালা এনতাজুল ইসলাম বলেন, মাংস কিনে খেতে পারি দুই তিন মাস পর পর। ডিম কিনে খাব, তার দামও বেশি প্রতি পিসে ৩টাকা। কী যে হবে দেশটাতে।
উপশহরের বাসিন্দা স্বপন কুমার সরকার। কাজ করেন একটি কাপড়ের দোকানে। বাড়িতে সদস্য ৫জন। তার বেতন না বাড়লেও এক মাসের ব্যবধানে বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হু হু করে বেড়ে যাওয়ায় সংসার খরচ নিয়ে বে-কায়দায় পড়েছেন তিনি।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আমার পক্ষে সংসার চালানো খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। এক বছর ধরে কাপড়ের দোকানে আছি বেতন বাড়েনি। কিন্তু বাজারে কোন কিছু কিনতে গেলে সব জিনিসের দাম বেশি। কীভাবে চলতে পারি। সংসার নিয়ে অনেক টেনশেনে আছি।
নাম প্রকাশে অনিুচ্ছুক এক সরকারি চাকুরীজীবির স্ত্রী বলেন, এখন মনে হয় ২৫ তারিখে মাস পূরণ হলে ভালো হয়। কিন্তু মানুষ হয়ে জন্মাইছি। খেতে হবে, না খেলে মরতে হবে এটাই সত্যি।
শহরের বড় বাজারের মুদি দোকানী আশিষ সাহা বলেন, আমাদের ব্যবসায় বাকিতে পণ্য বিক্রি করতে হয়, যারা নিয়মিত সদায় করেন তাদের বাকি না দিলে ব্যবসা হয়না। প্রতিমাসে আমার বাকিতে পণ্য বিক্রি করতে হয় অন্তত লাখ টাকার। তবে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি অস্বাভাবিক। আগে কয়েকটি কোম্পানি বাকিতে পণ্য দিলেও এখন তারা দিচ্ছেনা। সব জিনিসের দাম বাড়ায় পূঁজি লাগছে বেশি। আবার বিক্রিও কমে গেছে। এতে আর বাকিতে পণ্য বিক্রি করতে পারছিনা। তবে খুব কাছের লোকদের কিছু মাল বাকিতে দিচ্ছি। বাকিতে পণ্য না দেবার কারণে বিক্রি কমে গেছে। এতে দুর্দশায় আছি। ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
পাশের আরেক মুদি দোকানী রবিউল আলম বলেন, চাল, ডাল, তেল, আটা-ময়দা, মশলার দাম অনেক বেশি। একারণে মহাজনরা বাকি দিচ্ছেনা। আবার পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে মানুষ চাহিদার তুলনায় কম কিনছেন। এতে নগর টাকার জোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। বাকিতে পণ্য বিক্রি করলে দোকানে লাল বাতি জ্বলবে।
মুদি দোকানী ত্রিনাথ সাহা বলেন, বড় বাজারে কমপক্ষে শতাধিক মুদি দোকানী রয়েছেন। এরমধ্যে ৯০ ভাগ দোকানী কেউ বাকিতে পণ্য বিক্রি করছেনা। যাদের লেনদেন খুব ভালো শুধুমাত্র তাদেরকে দেয়া হচ্ছে। নাহলে ব্যবসা টিকবেনা।
শুধু মুদি দোকানগুলো নয়, শহরের আবাসিক এলাকার হোটেল ব্যবসায়ী ও চা দোকানীরাও বাকিতে জিনিস বিক্রি করছেনা। শহরের প্রাণকেন্দ্র হাসপাতাল মোড়ের চা দোকানী লিটন বলেন, সব বেকারী পন্যর দাম বেড়েছে। এতে পুঁজি বেশি লাগছে। যেকারণে বাকিতে বিক্রি করলে নিজের সংসার চলবেনা। যাদের লেনদেন খুব ভালো শুধুমাত্র তাদেরকে কিছু বাকি দিচ্ছি।
গত এক মাসের ব্যবধানে যশোরের বাজারে ৩৩ টি খাদ্যপণ্যের মধ্যে বেড়েছে ২০টির দাম। কমেছে শুধু একটি পণ্যের দাম। স্থিতিশীল রয়েছে ১২টির। দোকানিরা বলছে, এক মাসের ব্যবধানে বাজারে মোটা চাল, আটা, ময়দা, সয়াবিন, পাম অয়েল, মসুর ডাল, ছোলা, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদ, আদা, জিরা, তেজপাতা, গুঁড়া দুধ, চিনি ও ডিমের দাম বেড়েছে। বাজারে শুধুমাত্র কমেছে ব্রয়লার মুরগির দাম, যা গত মাসের থেকে বর্তমানে কেজিতে ৫ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে।
যেসব পণ্যের দাম তার মধ্যে সবেচেয় বেশি বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। এছাড়া বাজারে খোলা আটা-ময়দা, ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, ডিম, আদা, রসুন ও আলুর দাম বেড়েছে ১০-২৯ শতাংশ পর্যন্ত। এ সব পণ্যই একটি পরিবারের জন্য প্রতিদিনের অপরিহার্য।
ফুড পার্কের সত্ত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম সব জিনিসেরই দাম বেড়েছে। ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ঝামেলা হচ্ছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন না যে দাম বেড়েছে। সবাই রাগারাগি করেন। সব জিনিসের দাম বাড়ার কারণে ক্রেতারা পণ্য কম কিনছেন। আমারাও বাকিতে দিচ্ছিনা। কারণ আগে কোম্পানির কাছ থেকে দোকানিরা বাকিতে পণ্য নিতে পারতো, বিকেলে বা দুইদিন এমনকি কিছু পণ্যে একমাসও সময় পাওয়া যেতো পরিশোধ করার। এখন নগদ ছাড়া কোম্পানিগুলো পণ্য দিচ্ছে না।
পুরাতন খয়েরতলা বাজারের সাদ্দাম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী সাদ্দাম হোসেন বলেন, ৫০ কেজি ময়দার বস্তা আগে দেড় হাজার টাকায় কিনতাম। দাম বেড়ে তা ১ হাজার ৭০০ হয়েছে। এখন সেই ৫০ কেজির বস্তা প্রায় ৩ হাজার টাকা। দ্বিগুণ দাম বেড়েছে। আটার দাম ২ কেজির প্যাকেটে ৩০-৪০ টাকা বেড়েছে। খুচরা ২ কেজির প্যাকেটের ময়দার দাম ৮৫ থেকে বেড়ে ১৩০ টাকা হয়েছে। প্যাকেটজাত লবণের দাম ২৫ থেকে বেড়ে ৩৫ টাকা, ওয়াশিং পাউডার কেজিপ্রতি ৮০ থেকে বেড়ে ১৪০ টাকা, চিনি ৬৮ থেকে বেড়ে ৮৫ টাকা, চিনিগুড়া চালের দাম কেজিপ্রতি প্রায় ২০ টাকা বেড়ে এখন ১১০-১২০ টাকা, মোটা মসুর ডালের দাম কেজিপ্রতি ৪০ টাকা বেড়েছে। ৩৫০ টাকার জিরা বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকায়। তিনি আরোও বলেন, ক্রেতাদের মধ্যে বাকি কেনার চাহিদা বাড়ছে, তবে আমাদের পক্ষে দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা।
পাইকারি বিক্রেতা মনোহারপুর অয়েল মিলের সত্ত্বাধিকারী ওহেদুজ্জামান বলেন, ভারত গম রফতানি বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণার পরেই মিলাররা ময়দা বস্তা প্রতি ৩০০ টাকা দাম বাড়িয়েছে। ৫০ কেজি বস্তার ময়দার দাম আগে ১ হাজার ৯০০ টাকা ছিল। দাম বেড়ে ২ হাজার ২০০ টাকা হয়। এখন আমাদেরকেই প্রায় ২ হাজার ৭৫০ টাকায় কিনতে হয়। বস্তাপ্রতি লাভ আসে মাত্র ১৫-২০ টাকা। আটার বস্তা যেখানে ১ হাজার ৮০০ টাকা ছিল, সেই আটা আমাদেরকেই কিনতে হচ্ছে ২ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে। সম্ভবত আটা-ময়দার দাম আরও বাড়তে পারে। এতে আমাদের বিনিয়োগ বাড়লেও লাভ একই থাকছে। যেকারণে বাকিতে মাল দেয়া বন্ধ করে দিয়েছি।
বড় বাজারের ৫টি দোকান ঘুরে দেখা যায়, সব ধরনের গুঁড়ো দুধের দাম কেজিপ্রতি ৩০-৪০ টাকা বেড়েছে। ডিপ্লোমা দুধ বিক্রি হচ্ছে ৭৬০ টাকায়, যা আগে ছিল ৭২০ টাকা, ডানো প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৯০ টাকায়, যা আগে ছিল ৭০০ টাকা।
সবজির বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজিতে ১০-২০ টাকা দাম বেড়েছে। গোল আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়, পটল ৩০ টাকা, বেগুন ৫০-৬০ টাকা, বরবটি ৩০ টাকা, ঢেঁড়স ২০ টাকা, শসা ৩০ টাকা ও পেঁপে ৫০ টাকায়। কাঁচা মরিচের দাম কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১০০-১১০ টাকায়। পেঁয়াজ ঈদের আগে প্রতি ৫ কেজি ছিল ১৩০ টাকা। গতকাল বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। রসুন ৬০টাকা ছিল যা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১২৫টাকা। ফার্মের মুরগির ডিম প্রতি ডজন ৮৪ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৩২ টাকায়।
যশোর নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা ইকবাল কবীর জাহিদ বলেন, বাজার পরিস্থিতি অস্বাভাবিক, মানুষের আয় না বাড়লেও ব্যয় বাড়ছে হু হু করে। নি¤œ ও মধ্যবৃত্তরা খুবই দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। হাজার হাজার নাগরিক রয়েছেন যারা বছরের পর বছর ধরে মুদি দোকান থেকে পণ্য কিনতেন, কিন্তু হঠাৎ বেশিরভাগ দোকানগুলো বাকিতে পণ্য বিক্রি কমিয়ে দেবার কারণে বেকায়দায় পড়েছেন তারা।
অস্বাভাবিক বাজার পরিস্থিতি
শুক্রবার, ২৭ মে ২০২২
যশোর শহরের বেজপাড়া এলাকার দোকান কর্মচারি রাকিবুল আলম প্রতিমাসে গড়ে ৪ হাজার টাকার শুকনা বাজার নিয়ে থাকেন একই এলাকার মুদি দোকানী রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে। বাকিতে কিনে মাস শেষে বেতন পেয়ে তিনি দোকানীকে পরিশোধ করতেন ১২ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে। কিন্তু চলতি মাসে ওই দোকানী রাকিবুলকে আর বাকিতে পণ্য দেননি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, কিছু কোম্পানির কাছ থেকে মুদি দোকানীরা বাকিতে পণ্য কেনার সুযোগ পেতেন। সেই সুযোগ চলতি মাস থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আবার দাম বৃদ্ধির জন্য পণ্য কিনতে পূঁজিও বেশি লাগছে। এতে দোকানী নগর টাকার সংকটে পড়েছেন। যেকারণে বাকিতে পণ্য বিক্রি করছেনা। এতে বেকায়দায় পড়েছেন রাকিবুল। নিরুপায় হয়ে এক আত্নীয়র কাছ থেকে টাকা ধার করে সদায় কিনেছেন তিনি।
শহরের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী অটিস্টিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বপন হোসেন জানান, দাম বৃদ্ধির কারণে নিত্যপণ্যের খরচও কমাতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, বাজারে যে জিনিসের দাম। এর জন্য এখন খরচের পরিমাণও কমছে। যেখানে কিনতাম এক কেজি চাল, সেখানে কিনছি আধা কেজি। কী করার উপায় নেই। না খেয়ে তো আর বাঁচা যায় না। তার উপর এলাকার মুদি দোকান থেকে কিছু জিনিস বাকিতে কিনতাম, মাস শেষে বেতন পেলে সেটি পরিশোধ করতাম কিন্তু দোকানী আর বাকিতে পণ্য বিক্রি করছেনা। কারণ হিসেবে বলছেন, সব জিনিসের দাম বাড়ার কারণে তাদের পূঁজি বেশি লাগছে, আবার কোম্পানি কোন বাকিতে পণ্য দিচ্ছেনা। যেকারণে তারাও আর বাকিতে বিক্রি করছেনা।
শহরের বড় বাজারের মুদি দোকানে ডিম কিনতে আসা রেল রোডের বাসিন্দা ফেরিওয়ালা এনতাজুল ইসলাম বলেন, মাংস কিনে খেতে পারি দুই তিন মাস পর পর। ডিম কিনে খাব, তার দামও বেশি প্রতি পিসে ৩টাকা। কী যে হবে দেশটাতে।
উপশহরের বাসিন্দা স্বপন কুমার সরকার। কাজ করেন একটি কাপড়ের দোকানে। বাড়িতে সদস্য ৫জন। তার বেতন না বাড়লেও এক মাসের ব্যবধানে বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হু হু করে বেড়ে যাওয়ায় সংসার খরচ নিয়ে বে-কায়দায় পড়েছেন তিনি।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আমার পক্ষে সংসার চালানো খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। এক বছর ধরে কাপড়ের দোকানে আছি বেতন বাড়েনি। কিন্তু বাজারে কোন কিছু কিনতে গেলে সব জিনিসের দাম বেশি। কীভাবে চলতে পারি। সংসার নিয়ে অনেক টেনশেনে আছি।
নাম প্রকাশে অনিুচ্ছুক এক সরকারি চাকুরীজীবির স্ত্রী বলেন, এখন মনে হয় ২৫ তারিখে মাস পূরণ হলে ভালো হয়। কিন্তু মানুষ হয়ে জন্মাইছি। খেতে হবে, না খেলে মরতে হবে এটাই সত্যি।
শহরের বড় বাজারের মুদি দোকানী আশিষ সাহা বলেন, আমাদের ব্যবসায় বাকিতে পণ্য বিক্রি করতে হয়, যারা নিয়মিত সদায় করেন তাদের বাকি না দিলে ব্যবসা হয়না। প্রতিমাসে আমার বাকিতে পণ্য বিক্রি করতে হয় অন্তত লাখ টাকার। তবে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি অস্বাভাবিক। আগে কয়েকটি কোম্পানি বাকিতে পণ্য দিলেও এখন তারা দিচ্ছেনা। সব জিনিসের দাম বাড়ায় পূঁজি লাগছে বেশি। আবার বিক্রিও কমে গেছে। এতে আর বাকিতে পণ্য বিক্রি করতে পারছিনা। তবে খুব কাছের লোকদের কিছু মাল বাকিতে দিচ্ছি। বাকিতে পণ্য না দেবার কারণে বিক্রি কমে গেছে। এতে দুর্দশায় আছি। ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
পাশের আরেক মুদি দোকানী রবিউল আলম বলেন, চাল, ডাল, তেল, আটা-ময়দা, মশলার দাম অনেক বেশি। একারণে মহাজনরা বাকি দিচ্ছেনা। আবার পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে মানুষ চাহিদার তুলনায় কম কিনছেন। এতে নগর টাকার জোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। বাকিতে পণ্য বিক্রি করলে দোকানে লাল বাতি জ্বলবে।
মুদি দোকানী ত্রিনাথ সাহা বলেন, বড় বাজারে কমপক্ষে শতাধিক মুদি দোকানী রয়েছেন। এরমধ্যে ৯০ ভাগ দোকানী কেউ বাকিতে পণ্য বিক্রি করছেনা। যাদের লেনদেন খুব ভালো শুধুমাত্র তাদেরকে দেয়া হচ্ছে। নাহলে ব্যবসা টিকবেনা।
শুধু মুদি দোকানগুলো নয়, শহরের আবাসিক এলাকার হোটেল ব্যবসায়ী ও চা দোকানীরাও বাকিতে জিনিস বিক্রি করছেনা। শহরের প্রাণকেন্দ্র হাসপাতাল মোড়ের চা দোকানী লিটন বলেন, সব বেকারী পন্যর দাম বেড়েছে। এতে পুঁজি বেশি লাগছে। যেকারণে বাকিতে বিক্রি করলে নিজের সংসার চলবেনা। যাদের লেনদেন খুব ভালো শুধুমাত্র তাদেরকে কিছু বাকি দিচ্ছি।
গত এক মাসের ব্যবধানে যশোরের বাজারে ৩৩ টি খাদ্যপণ্যের মধ্যে বেড়েছে ২০টির দাম। কমেছে শুধু একটি পণ্যের দাম। স্থিতিশীল রয়েছে ১২টির। দোকানিরা বলছে, এক মাসের ব্যবধানে বাজারে মোটা চাল, আটা, ময়দা, সয়াবিন, পাম অয়েল, মসুর ডাল, ছোলা, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদ, আদা, জিরা, তেজপাতা, গুঁড়া দুধ, চিনি ও ডিমের দাম বেড়েছে। বাজারে শুধুমাত্র কমেছে ব্রয়লার মুরগির দাম, যা গত মাসের থেকে বর্তমানে কেজিতে ৫ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে।
যেসব পণ্যের দাম তার মধ্যে সবেচেয় বেশি বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। এছাড়া বাজারে খোলা আটা-ময়দা, ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, ডিম, আদা, রসুন ও আলুর দাম বেড়েছে ১০-২৯ শতাংশ পর্যন্ত। এ সব পণ্যই একটি পরিবারের জন্য প্রতিদিনের অপরিহার্য।
ফুড পার্কের সত্ত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম সব জিনিসেরই দাম বেড়েছে। ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ঝামেলা হচ্ছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন না যে দাম বেড়েছে। সবাই রাগারাগি করেন। সব জিনিসের দাম বাড়ার কারণে ক্রেতারা পণ্য কম কিনছেন। আমারাও বাকিতে দিচ্ছিনা। কারণ আগে কোম্পানির কাছ থেকে দোকানিরা বাকিতে পণ্য নিতে পারতো, বিকেলে বা দুইদিন এমনকি কিছু পণ্যে একমাসও সময় পাওয়া যেতো পরিশোধ করার। এখন নগদ ছাড়া কোম্পানিগুলো পণ্য দিচ্ছে না।
পুরাতন খয়েরতলা বাজারের সাদ্দাম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী সাদ্দাম হোসেন বলেন, ৫০ কেজি ময়দার বস্তা আগে দেড় হাজার টাকায় কিনতাম। দাম বেড়ে তা ১ হাজার ৭০০ হয়েছে। এখন সেই ৫০ কেজির বস্তা প্রায় ৩ হাজার টাকা। দ্বিগুণ দাম বেড়েছে। আটার দাম ২ কেজির প্যাকেটে ৩০-৪০ টাকা বেড়েছে। খুচরা ২ কেজির প্যাকেটের ময়দার দাম ৮৫ থেকে বেড়ে ১৩০ টাকা হয়েছে। প্যাকেটজাত লবণের দাম ২৫ থেকে বেড়ে ৩৫ টাকা, ওয়াশিং পাউডার কেজিপ্রতি ৮০ থেকে বেড়ে ১৪০ টাকা, চিনি ৬৮ থেকে বেড়ে ৮৫ টাকা, চিনিগুড়া চালের দাম কেজিপ্রতি প্রায় ২০ টাকা বেড়ে এখন ১১০-১২০ টাকা, মোটা মসুর ডালের দাম কেজিপ্রতি ৪০ টাকা বেড়েছে। ৩৫০ টাকার জিরা বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকায়। তিনি আরোও বলেন, ক্রেতাদের মধ্যে বাকি কেনার চাহিদা বাড়ছে, তবে আমাদের পক্ষে দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা।
পাইকারি বিক্রেতা মনোহারপুর অয়েল মিলের সত্ত্বাধিকারী ওহেদুজ্জামান বলেন, ভারত গম রফতানি বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণার পরেই মিলাররা ময়দা বস্তা প্রতি ৩০০ টাকা দাম বাড়িয়েছে। ৫০ কেজি বস্তার ময়দার দাম আগে ১ হাজার ৯০০ টাকা ছিল। দাম বেড়ে ২ হাজার ২০০ টাকা হয়। এখন আমাদেরকেই প্রায় ২ হাজার ৭৫০ টাকায় কিনতে হয়। বস্তাপ্রতি লাভ আসে মাত্র ১৫-২০ টাকা। আটার বস্তা যেখানে ১ হাজার ৮০০ টাকা ছিল, সেই আটা আমাদেরকেই কিনতে হচ্ছে ২ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে। সম্ভবত আটা-ময়দার দাম আরও বাড়তে পারে। এতে আমাদের বিনিয়োগ বাড়লেও লাভ একই থাকছে। যেকারণে বাকিতে মাল দেয়া বন্ধ করে দিয়েছি।
বড় বাজারের ৫টি দোকান ঘুরে দেখা যায়, সব ধরনের গুঁড়ো দুধের দাম কেজিপ্রতি ৩০-৪০ টাকা বেড়েছে। ডিপ্লোমা দুধ বিক্রি হচ্ছে ৭৬০ টাকায়, যা আগে ছিল ৭২০ টাকা, ডানো প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৯০ টাকায়, যা আগে ছিল ৭০০ টাকা।
সবজির বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজিতে ১০-২০ টাকা দাম বেড়েছে। গোল আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়, পটল ৩০ টাকা, বেগুন ৫০-৬০ টাকা, বরবটি ৩০ টাকা, ঢেঁড়স ২০ টাকা, শসা ৩০ টাকা ও পেঁপে ৫০ টাকায়। কাঁচা মরিচের দাম কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১০০-১১০ টাকায়। পেঁয়াজ ঈদের আগে প্রতি ৫ কেজি ছিল ১৩০ টাকা। গতকাল বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। রসুন ৬০টাকা ছিল যা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১২৫টাকা। ফার্মের মুরগির ডিম প্রতি ডজন ৮৪ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৩২ টাকায়।
যশোর নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা ইকবাল কবীর জাহিদ বলেন, বাজার পরিস্থিতি অস্বাভাবিক, মানুষের আয় না বাড়লেও ব্যয় বাড়ছে হু হু করে। নি¤œ ও মধ্যবৃত্তরা খুবই দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। হাজার হাজার নাগরিক রয়েছেন যারা বছরের পর বছর ধরে মুদি দোকান থেকে পণ্য কিনতেন, কিন্তু হঠাৎ বেশিরভাগ দোকানগুলো বাকিতে পণ্য বিক্রি কমিয়ে দেবার কারণে বেকায়দায় পড়েছেন তারা।