দুই সন্তানের জননী ফাতেমা বেগম (২৮)। মহিপুর মৎস্য পল্লীতে মাছ ভাঙার কাজ করেন। ৫ টাকা কেজিতে দৈনিক ৮০ থেকে ১০০ কেজি টাইগার চিংড়ির মাথা আলাদা করতে পারেন তিনি। ছোট টাইগার চিংড়ি (জেলেদের ভাষায় গেন্টি) ৮ থেকে ১০ কেজি পান। ছোট চিংড়ি প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। এতে ফাতেমা বেগমের দৈনিক আয় দাঁড়ায় প্রায় ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা। তবে যখন মাছ কম থাকে তখন দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। কোন কোন দিন এর চেয়ে আয় কমও হয়। প্রতি মাসে গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করেন ফাতেমা বেগম। নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৬ মাস ফাতেমা বেগমের মতো ৬০০ থেকে ৭০০ নারী এ কাজে শ্রম বিক্রি করে সংসার চালান।
দেশের অন্যতম মৎস্য বন্দর মহিপুর-আলীপুর ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকে মৎস্য পল্লীতে জড়ো হয়ে অপেক্ষায় বসে থাকেন নারী শ্রমিকরা। তাদের সঙ্গে থাকে দুটি বালতি এবং ভাঙা ককসেট দিয়ে তৈরি বসার পিড়ি। ফিশিং ট্রলার থেকে চিংড়ি মাছ গদির ফ্লোরে তুলতেই সারিবদ্ধভাবে বসে পড়েন তারা। শুরু করেন মাছ কাটার প্রতিযোগিতা। স্তূপ করা চিংড়ি মাছের মাথা আলাদা করার কাজ শেষ হলে পরিমাপ করেন পুরুষ শ্রমিকরা। কে কত কেজি মাছ কাটছে নোট হয় টালি খাতায়। সপ্তাহের বৃহস্পতিবার হিসাবান্তে বিল পরিশোধ করেন আড়ৎ মালিকরা। এতে এক একজন নারী শ্রমিক সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা সঞ্চায় করেন। আর মাছ কাটার সময় ছোট মাছগুলো তারা বালতিতে জমা করেন। ছোট মাছগুলো স্থানীয় পাইকাররা ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি ধরে কিনে নেয়। এতে তাদের প্রতিদিন গড়ে ৫০০ টাকা আয় হয়। এই টাকা নারী শ্রমিকরা সংসারের প্রয়োজনে ব্যয় করেন। এভাবেই প্রতিদিন শ্রম বিক্রি করেন ৬০০ থেকে ৭০০ নারী শ্রমিক। যখন কাজ থাকে না তখন বসে বসে গল্প আড্ডায় সময় পার করেন। উপকূলের প্রত্যেকটি মৎস্য পল্লীতে চোখে পড়ে এমন দৃশ্য।
মৎস্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পটুয়াখালী জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে এসে বাসা নিয়ে আলীপুর, মহিপুর মৎস্য পল্লীতে মাছ কাটার কাজ করেন নারীরা। স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা ও অসহায় পরিবারের মহিলারা এ কাজ করেন। নারীরা এ কাজে অংশগ্রহণ করায় খুব সহজে অল্প সময়ের মধ্যে ব্যবসায়ীরা তাদের মাছ রপ্তানি উপযোগী করতে পারছেন। আর অসহায় নারীরাও পেয়েছেন সংসারের খরচ নির্বাহের কর্ম।
আলীপুরের মৎস্য ব্যবসায়ী আ. জলিল ঘরামী বলেন, আমরা ব্যবসায়ীরা নারী শ্রমিকের মাধ্যমে চিংড়ি মাছের মাথা আলাদা করে খুলনায় পাঠাই। সেখান থেকে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে রপ্তানি হয়। নারীরা কাজ করায় প্রক্রিয়াজাত সহজ হয়েছে।
উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের তুলাতলী গ্রামের শিখা রানী, নাজমা বেগম, আসমা বেগম, রেহেনা খাতুন ও রাবেয়া বেগম এই ৫ জন নারী মহিপুরে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন। সপ্তাহে ৬ দিন মাছ কাটার কাজ করে বৃহস্পতিবার বিল নিয়ে গ্রামে চলে যান। শুক্রবার থাকেন গ্রামের বাড়ি, শনিবার এসে কাজ শুরু করেন। তাদের মধ্যে শিখা রানী বলেন, সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করে যে টাকা পাই তাতে সংসার ভালোই চলছে। কার্তিক মাস থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত ৬ মাস এ কাজ থাকে। বছরের বাকি ৬ মাস কোন কাজ না থাকায় সংসার চালাতে কষ্ট হয়।
৭৩ বছর বয়সী সেতারা বেগম কানে কম শোনেন। ভরণপোষণের কেউ না থাকায় তিনিও এ কাজ করেন। হাত কম চলে বিধায় তার দৈনিক আয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। তিনি বলেন, বুড়ো হয়ে গেছি। কানে ঠিক মতো শুনি না। প্রতিদিন কাজে আইতে পারি না। শরীর ঠিক থাকলে আই। যে টাহা পাই হ্যা দিয়া ঔষুধ খাই। চাউল কিনি না, সরকার দেয়।
বিধবা হাসিনা বেগম জানান, জীবিকার তাগিদে এ পেশায় এসেছেন। তাদের কারও স্বামী ঘাটের শ্রমিক, সমুদ্রের জেলে, ভ্যানচালক কিংবা দিনমজুর পেশায় আছেন। আবার কারও স্বামী মারা গেছেন। কারও স্বামী অন্যত্র বিয়ে করে তাদের ফেলে চলে গেছেন। তিনি বলেন, যখন গদিতে মাছ থাকে না তখন বসে বসে সুখ-দুঃখের গল্প শুনি। মাছ উঠলেই কাজ শুরু করি। এভাবেই গত ৬ বছর যাবৎ মাছ কাটার কাজ করে সংসার চালাচ্ছি।
নারীদের পাশাপাশি মাছ কাটার কাজ করছেন পুরুষরাও। আমতলী পৌর শহরের তুষার গাজী মহিপুরের জলকপাট এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে এ কাজ করছেন। তিনি জানান, প্রতি সপ্তাহে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা আয় করছেন তিনি। যখন মাছ কাটার কাজ না থাকে তখন গদিতে কাজ করেন। বেশ ভালোই চলছে তার সংসার।
মহিপুরের মৎস্য আড়ৎদার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বলেন, মহিপুরের দুই মার্কেটে পাঁচ শতাধিক নারী শ্রমিক মাছ কাটার কাজ করেন। বছরের নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৬ মাস সমুদ্রে চিংড়ি মাছ ধরা মৌসুম চলে। এই ৬ মাসে এক একজন নারী শ্রমিক কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা সঞ্চয় করতে পারেন। এখানে প্রতি কেজি চিংড়ি মাছ ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা বিক্রি হয়।
শনিবার, ০১ এপ্রিল ২০২৩
দুই সন্তানের জননী ফাতেমা বেগম (২৮)। মহিপুর মৎস্য পল্লীতে মাছ ভাঙার কাজ করেন। ৫ টাকা কেজিতে দৈনিক ৮০ থেকে ১০০ কেজি টাইগার চিংড়ির মাথা আলাদা করতে পারেন তিনি। ছোট টাইগার চিংড়ি (জেলেদের ভাষায় গেন্টি) ৮ থেকে ১০ কেজি পান। ছোট চিংড়ি প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। এতে ফাতেমা বেগমের দৈনিক আয় দাঁড়ায় প্রায় ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা। তবে যখন মাছ কম থাকে তখন দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। কোন কোন দিন এর চেয়ে আয় কমও হয়। প্রতি মাসে গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করেন ফাতেমা বেগম। নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৬ মাস ফাতেমা বেগমের মতো ৬০০ থেকে ৭০০ নারী এ কাজে শ্রম বিক্রি করে সংসার চালান।
দেশের অন্যতম মৎস্য বন্দর মহিপুর-আলীপুর ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকে মৎস্য পল্লীতে জড়ো হয়ে অপেক্ষায় বসে থাকেন নারী শ্রমিকরা। তাদের সঙ্গে থাকে দুটি বালতি এবং ভাঙা ককসেট দিয়ে তৈরি বসার পিড়ি। ফিশিং ট্রলার থেকে চিংড়ি মাছ গদির ফ্লোরে তুলতেই সারিবদ্ধভাবে বসে পড়েন তারা। শুরু করেন মাছ কাটার প্রতিযোগিতা। স্তূপ করা চিংড়ি মাছের মাথা আলাদা করার কাজ শেষ হলে পরিমাপ করেন পুরুষ শ্রমিকরা। কে কত কেজি মাছ কাটছে নোট হয় টালি খাতায়। সপ্তাহের বৃহস্পতিবার হিসাবান্তে বিল পরিশোধ করেন আড়ৎ মালিকরা। এতে এক একজন নারী শ্রমিক সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা সঞ্চায় করেন। আর মাছ কাটার সময় ছোট মাছগুলো তারা বালতিতে জমা করেন। ছোট মাছগুলো স্থানীয় পাইকাররা ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি ধরে কিনে নেয়। এতে তাদের প্রতিদিন গড়ে ৫০০ টাকা আয় হয়। এই টাকা নারী শ্রমিকরা সংসারের প্রয়োজনে ব্যয় করেন। এভাবেই প্রতিদিন শ্রম বিক্রি করেন ৬০০ থেকে ৭০০ নারী শ্রমিক। যখন কাজ থাকে না তখন বসে বসে গল্প আড্ডায় সময় পার করেন। উপকূলের প্রত্যেকটি মৎস্য পল্লীতে চোখে পড়ে এমন দৃশ্য।
মৎস্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পটুয়াখালী জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে এসে বাসা নিয়ে আলীপুর, মহিপুর মৎস্য পল্লীতে মাছ কাটার কাজ করেন নারীরা। স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা ও অসহায় পরিবারের মহিলারা এ কাজ করেন। নারীরা এ কাজে অংশগ্রহণ করায় খুব সহজে অল্প সময়ের মধ্যে ব্যবসায়ীরা তাদের মাছ রপ্তানি উপযোগী করতে পারছেন। আর অসহায় নারীরাও পেয়েছেন সংসারের খরচ নির্বাহের কর্ম।
আলীপুরের মৎস্য ব্যবসায়ী আ. জলিল ঘরামী বলেন, আমরা ব্যবসায়ীরা নারী শ্রমিকের মাধ্যমে চিংড়ি মাছের মাথা আলাদা করে খুলনায় পাঠাই। সেখান থেকে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে রপ্তানি হয়। নারীরা কাজ করায় প্রক্রিয়াজাত সহজ হয়েছে।
উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের তুলাতলী গ্রামের শিখা রানী, নাজমা বেগম, আসমা বেগম, রেহেনা খাতুন ও রাবেয়া বেগম এই ৫ জন নারী মহিপুরে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন। সপ্তাহে ৬ দিন মাছ কাটার কাজ করে বৃহস্পতিবার বিল নিয়ে গ্রামে চলে যান। শুক্রবার থাকেন গ্রামের বাড়ি, শনিবার এসে কাজ শুরু করেন। তাদের মধ্যে শিখা রানী বলেন, সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করে যে টাকা পাই তাতে সংসার ভালোই চলছে। কার্তিক মাস থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত ৬ মাস এ কাজ থাকে। বছরের বাকি ৬ মাস কোন কাজ না থাকায় সংসার চালাতে কষ্ট হয়।
৭৩ বছর বয়সী সেতারা বেগম কানে কম শোনেন। ভরণপোষণের কেউ না থাকায় তিনিও এ কাজ করেন। হাত কম চলে বিধায় তার দৈনিক আয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। তিনি বলেন, বুড়ো হয়ে গেছি। কানে ঠিক মতো শুনি না। প্রতিদিন কাজে আইতে পারি না। শরীর ঠিক থাকলে আই। যে টাহা পাই হ্যা দিয়া ঔষুধ খাই। চাউল কিনি না, সরকার দেয়।
বিধবা হাসিনা বেগম জানান, জীবিকার তাগিদে এ পেশায় এসেছেন। তাদের কারও স্বামী ঘাটের শ্রমিক, সমুদ্রের জেলে, ভ্যানচালক কিংবা দিনমজুর পেশায় আছেন। আবার কারও স্বামী মারা গেছেন। কারও স্বামী অন্যত্র বিয়ে করে তাদের ফেলে চলে গেছেন। তিনি বলেন, যখন গদিতে মাছ থাকে না তখন বসে বসে সুখ-দুঃখের গল্প শুনি। মাছ উঠলেই কাজ শুরু করি। এভাবেই গত ৬ বছর যাবৎ মাছ কাটার কাজ করে সংসার চালাচ্ছি।
নারীদের পাশাপাশি মাছ কাটার কাজ করছেন পুরুষরাও। আমতলী পৌর শহরের তুষার গাজী মহিপুরের জলকপাট এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে এ কাজ করছেন। তিনি জানান, প্রতি সপ্তাহে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা আয় করছেন তিনি। যখন মাছ কাটার কাজ না থাকে তখন গদিতে কাজ করেন। বেশ ভালোই চলছে তার সংসার।
মহিপুরের মৎস্য আড়ৎদার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বলেন, মহিপুরের দুই মার্কেটে পাঁচ শতাধিক নারী শ্রমিক মাছ কাটার কাজ করেন। বছরের নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৬ মাস সমুদ্রে চিংড়ি মাছ ধরা মৌসুম চলে। এই ৬ মাসে এক একজন নারী শ্রমিক কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা সঞ্চয় করতে পারেন। এখানে প্রতি কেজি চিংড়ি মাছ ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা বিক্রি হয়।