alt

অপরাধ ও দুর্নীতি

ঢাকায় পুলিশ খুনের আসামি যেভাবে দুবাইয়ের আরাভ খান

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক : বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ ২০২৩

ঢাকার পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত পলাতক আসামি রবিউল ইসলাম আপন ওরফে আরাভ খান। সব মামলায় আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দুবাই গিয়ে রীতিমতো জুয়েলারি ব্যবসায়ী বনে গিয়েছেন তিনি।

জাঁকজমক আয়োজনে নিজের নামে জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান উদ্বোধনের ঘোষণা দেয়ার পর তার আসল পরিচয় জানতে পারেন সবাই। স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন ও চলচ্চিত্র তারকাদের আমন্ত্রণ নিয়ে কয়েক দিন ধরে আলোচনা চলছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ওই দোকানের মালিক আরাভ খানই পুলিশ ইন্সপেক্টর মামুন হত্যা মামলার প্রধান আসামি রবিউল ইসলাম।

তাকে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সাহায্য নেওয়া হবে জানিয়ে পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, “ওই রবিউল এখন দুবাইয়ে অবস্থান করছেন ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে, যেখানে তার নাম লেখা আরাভ খান।”

রবিউলের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার হিরন ইউনিয়নে। স্থানীয়রা বলছেন, তার পিতৃপ্রদত্ত নাম ‘সোহাগ মোল্লা’। বিভিন্ন সময় তার খোঁজে এলাকায় পুলিশ গেছে। ২০১৮ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যার পর সেই মামলাতেও পুলিশ তাকে খুঁজতে এলাকায় যায়।

তখনই জানা যায়, ওই সোহাগই ঢাকায় রবিউলসহ বিভিন্ন নাম নিয়ে ‘ব্ল্যাকমেইল ও প্রতারণা’ করে বেড়াচ্ছেন। তিনি বিভিন্ন পরিচয়ে বেশ কয়েকটি বিয়ে করেছেন বলেও স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির ভাষ্য।

এসবির পরিদর্শক মামুন ইমরান খান ২০১৮ সালের ৮ জুলাই বন্ধু রহমত উল্লাহ সঙ্গে বনানীর একটি বাসায় গিয়ে খুন হন। পরদিন তার মৃতদেহ বস্তায় ভরে উলুখোলার জঙ্গলে নিয়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে পোড়ানো হয় অপরাধের চিহ্ন গোপন করার জন্য।

মামলার তদন্ত শেষে পরের বছরের এপ্রিলে অভিযোগপত্র দেয় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সেই অভিযোগপত্রে বলা হয়, রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে বিত্তবানদের ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করত একটি চক্র। তাদের লক্ষ্য ছিল রহমত উল্লাহকে আটকে ‘অশালীন’ ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে টাকা আদায় করা।

সেজন্য ওই চক্র জন্মদিনের নাটক সাজিয়ে রহমতকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল বনানীর এক বাসায়।বন্ধু রহমতের সঙ্গে সেখানে গিয়ে হত্যার শিকার হন পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান।

সেসময় মামলাটির তদন্তে যুক্ত ছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহীদুর রহমান। তিনি জানান, রবিউলসহ ১০ জনকে আসামি করেই ২০১৯ সালের এপ্রিলে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যা মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয় আদালতে।

পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, “এই রবিউলই দুবাইয়ের আরাভ খান বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তাকে আমরা ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।"

মামুন হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে রবিউল ছাড়াও তার স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার কেয়া (২১), নিহত মামুনের বন্ধু রহমত উল্লাহ (৩৫), স্বপন সরকার (৩৯), দিদার পাঠান (২১), মিজান শেখ (২১), আতিক হাসান (২১), সারোয়ার হোসেন (২৩) এবং দুই কিশোরীকে আসামি করা হয়।

সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৮ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে ভারতে চলে যান সে সময় ৩০ বছর বয়সী রবিউল ইসলাম। সেখানে বিয়ে করেন। পরে ভুয়া নাম-পরিচয় ব্যবহার করে ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন। সেই পাসপোর্ট দিয়েই পাড়ি জমান দুবাইয়ে। এখন তিনি বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী।

স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যায় দুবাইয়ের নিউ গোল্ড সুকে উদ্বোধন হচ্ছে তার আরাভ জুয়েলার্সের। এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে গেছেন ক্রীড়াঙ্গন ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের বেশ কয়েকজন তারকা। কয়েক দিন আগে এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের খ্যাতিমান তারকাদের সম্ভাব্য উপস্থিতির কথা উল্লেখ করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন রবিউল।

সেখানে তিনি লিখেছিলেন, দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা টাওয়ারের ৬৫ তলায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। যার নম্বর ৬৫১০। আরও ৪-৫টি ফ্ল্যাটের মালিকও তিনি। পাশাপাশি রয়েছে একটি সুইমিংপুল ও বাগানসহ বড় ডুপ্লেক্স বাড়িও। যেখানে মাঝেমধ্যে মায়াবী হরিণ জবাই দিয়ে বাংলাদেশিদের দাওয়াত খাওয়াচ্ছেন। বাগানে চাষ করছেন বাংলাদেশি সবজি। রয়েছে একাধিক দামি গাড়ি। আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধন উপলক্ষে ৬০ কেজি সোনা দিয়ে বানানো হয়েছে বাজপাখির আদলে লোগো, যা তৈরিতে সময় লেগেছে প্রায় আড়াই মাস। এটা তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা।

ফেসবুক পোস্ট দেখে অনেকেই চিনে ফেলেন, তিনি বাংলাদেশে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার আসামি রবিউল ইসলাম। ফেরারি একজন আসামি দুবাইয়ে গিয়ে কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন, তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, পুলিশের সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার টাকায় দুবাইয়ে সোনার ব্যবসা শুরু করেন রবিউল।

সম্প্রতি দুবাই বিশ্বে স্বর্ণের ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। দুবাইপ্রবাসী অনেক বাংলাদেশি সেখানে স্বর্ণের দোকানে কাজ করেন, আবার স্বর্ণের দোকানের মালিকানায়ও রয়েছেন কেউ কেউ। তবে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশিরা দেশটিতে অর্থ পাচার করে ফ্ল্যাট, বাড়ি, তারকা হোটেল ইত্যাদি কিনছেন। কেউ কেউ স্বর্ণ ব্যবসায়ও বিনিয়োগ করছেন। যদিও সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত কাউকে দুবাইয়ের এসব ব্যবসায় বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়নি বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন ২০১৮ সালের ৭ জুলাই রহমত উল্লাহ নামের এক ব্যক্তির আমন্ত্রণে ঢাকার বনানীর একটি বাড়িতে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সেখানে তাকে ‘ব্ল্যাকমেল’ করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করা হয়। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, মামুনকে ফাঁদে ফেলে বনানীর ওই বাসায় ডেকে নেওয়া হয়। তাকে ফ্ল্যাটে নিয়ে বেঁধে, স্কচটেপ দিয়ে মুখ আটকে নির্দয়ভাবে পেটানো হয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে মামুন মারা যান। পরে গাজীপুর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।

ওই হত্যাকাণ্ডে রহমত উল্লাহ, রবিউল ইসলাম, সুরাইয়া আক্তার কেয়া, স্বপন সরকার, দিদার পাঠান, মিজান শেখ, আতিক হাসান, সারওয়ার হোসেন, মেহেরুন্নিসা ওরফে স্বর্ণা ও ফারিয়া বিনতে মাইসাকে আসামি করে বনানী থানায় হত্যা মামলা করে পরিদর্শক মামুনের পরিবার। তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ এ মামলায় রহমত উল্লাহ এবং রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয় ওরফে হৃদিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। সেখানে রবিউল ইসলামকে পলাতক উল্লেখ করা হয়। পরে আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।

পরিদর্শক মামুন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর রবিউল ইসলাম নামের একজন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তাকে জেলে পাঠান। ৯ মাস কারাবাসের পর ওই তরুণ বলেন, তিনি রবিউল ইসলাম নন, তার আসল নাম আবু ইউসুফ। রবিউল ইসলামের কথামতো তার নাম-পরিচয় ব্যবহার করে আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন তিনি।

এরপর আদালত বিষয়টি অনুসন্ধান করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। ডিবির অনুসন্ধানে জানা যায়, খুনের মামলার আসামি রবিউলের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম মতিউর রহমান। আর রবিউলের পরিবর্তে আদালতে আত্মসমর্পণকারী আবু ইউসুফের বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানার আইনপুর গ্রাম।

গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, রবিউল ইসলামের একটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট রয়েছে। সেখানে নাম ব্যবহার করা হয়েছে হৃদি খান। ওই পাসপোর্টের নম্বর ০৩৮৫১৮৮। হত্যা মামলার পর তিনি ভারতে গিয়ে আরাভ খান নাম দিয়ে আরেকটি পাসপোর্ট তৈরি করেন। ২০২০ সালের ২৮ জুলাই তিনি পশ্চিমবঙ্গের নরেন্দ্রপুর উদয় সংঘ ক্লাব এলাকার বাসিন্দা হিসেবে ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন। ওই পাসপোর্টে তার বাবার নাম লেখেন জাকির খান, মায়ের নাম দেন রেহানা বিবি খান এবং স্ত্রীর নাম সাজিমা নাসরিন। তার ভারতীয় পাসপোর্ট নম্বর ইউ ৪৯৮৫৩৮৯।

ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (খিলগাঁও জোন) শহিদুর রহমান বলেন, জুয়েলার্সের মালিক আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলামকে দেশে ফিরিয়ে এনে আদালতে সোপর্দ করার চেষ্টা চলছে।

রবিউলকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কাজ শুরু করেছে পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মনজুর রহমান জানিয়েছেন।

ছবি

প্রতারণা মামলায় হেলেনা জাহাঙ্গীরের ২ বছরের কারাদণ্ড

ছবি

আরাভ খানের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি

ছবি

অসুস্থ খালেদা, কয়লা খনি দুর্নীতির অভিযোগ গঠন পেছালো

ছবি

প্রশ্নফাঁসের দায়ে সেই বুয়েট শিক্ষক কারাগারে

ছবি

দুবাই পালানোর আগে আরাভের ঠিকানা ছিল পশ্চিমবঙ্গের কন্দর্পপুর

ছবি

নাইকো দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিচার শুরু

ছবি

নকল হচ্ছে ক্যানসারের ওষুধ, ৫ অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি

ছবি

ডাচ-বাংলা ব্যাংকের টাকা লুটের ঘটনায় দু’জনের দায় স্বীকার

ছবি

বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে মাদ্রাসায় হামলা, সুপার ও দপ্তরীসহ আহত ৪

ছবি

লাইভে এসে মাহি মিথ্যা বলেছেন: মোল্যা নজরুল

ছবি

আরাভ খানের পেছনে কে?

ছবি

জীবনে কাউকে ‘চড়ও’ মাড়েনি, দাবি পুলিশ হত্যাকাণ্ডে জড়িত আরাভ খানের

ছবি

বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন হত্যা: বান্ধবী বুশরার স্থায়ী জামিন

ছবি

চাকরি ফেরত পাবে না বহিষ্কৃত দুদক কর্মকর্তা শরীফ

স্ত্রীসহ পুলিশ সদস্য ও ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল

ছবি

সীমা অক্সিজেন কারখানার পরিচালকের রিমান্ড আবেদন

ছবি

তাফসির আউয়ালকে ৬ মাসের জন্য বিদেশ যাওয়ার অনুমতি

ছবি

নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে রিটের শুনানি আজ

ছবি

চাঁদাবাজি: হেলেনা জাহাঙ্গীরসহ ৫ জনের রায় ২০ মার্চ

মানি লন্ডারিং : তারেক রহমানের এপিএস অপুর জামিন স্থগিত

ছবি

নওগাঁয় শিক্ষকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানববন্ধন

পরিকল্পনায় জড়িত মানি প্লান্টের একাধিক কর্মীও

ছবি

নিউইয়র্কে ৯ বাড়ি: অনুসন্ধানে সহযোগিতা করতে গোলাপকে নির্দেশ

ছবি

বান্দরবানে আরো ৯ জঙ্গি গ্রেপ্তার

ছবি

উন্মুক্ত কোর্টে জামিন আদেশ : হাইকোর্ট

ছবি

ডাচ-বাংলার আরও আড়াই কোটি টাকা উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৮

যৌতুকের ধারাকে ৩০২ এ নেয়ার মামলা আপিল বিভাগে পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি

ছবি

ডাকাতি হয় ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা: গতকাল উদ্ধারের দাবি ৯ কোটি, আজ বলে ৪ কোটি

ছবি

বিক্রির উদ্দেশ্যে ৩ মাসের শিশু অপহরণ

ছবি

চুনারুঘাটে টমটম চুরির অভিযোগে ছয়জন গ্রেপ্তার

ছবি

১১ কোটি টাকা ছিনতাই,উদ্ধার ৯ কোটি, আটক ৭

১১ কোটি টাকা ছিনতাই,উদ্ধার ৯ কোটি, আটক ৭

ছবি

গুলিস্তানে বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৩

ছবি

ধর্ষণের পর হত্যা, মামাতো ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ড

ছবি

‘দুই শিশুর অভিভাবকই ডেসপারেট, উল্টো আমরা বিপদে আছি’

ছবি

সরকার নির্ধারিত মূল্যেই সামিটকে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে হবে: আপিল বিভাগ

tab

অপরাধ ও দুর্নীতি

ঢাকায় পুলিশ খুনের আসামি যেভাবে দুবাইয়ের আরাভ খান

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ ২০২৩

ঢাকার পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত পলাতক আসামি রবিউল ইসলাম আপন ওরফে আরাভ খান। সব মামলায় আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দুবাই গিয়ে রীতিমতো জুয়েলারি ব্যবসায়ী বনে গিয়েছেন তিনি।

জাঁকজমক আয়োজনে নিজের নামে জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান উদ্বোধনের ঘোষণা দেয়ার পর তার আসল পরিচয় জানতে পারেন সবাই। স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন ও চলচ্চিত্র তারকাদের আমন্ত্রণ নিয়ে কয়েক দিন ধরে আলোচনা চলছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ওই দোকানের মালিক আরাভ খানই পুলিশ ইন্সপেক্টর মামুন হত্যা মামলার প্রধান আসামি রবিউল ইসলাম।

তাকে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সাহায্য নেওয়া হবে জানিয়ে পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, “ওই রবিউল এখন দুবাইয়ে অবস্থান করছেন ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে, যেখানে তার নাম লেখা আরাভ খান।”

রবিউলের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার হিরন ইউনিয়নে। স্থানীয়রা বলছেন, তার পিতৃপ্রদত্ত নাম ‘সোহাগ মোল্লা’। বিভিন্ন সময় তার খোঁজে এলাকায় পুলিশ গেছে। ২০১৮ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যার পর সেই মামলাতেও পুলিশ তাকে খুঁজতে এলাকায় যায়।

তখনই জানা যায়, ওই সোহাগই ঢাকায় রবিউলসহ বিভিন্ন নাম নিয়ে ‘ব্ল্যাকমেইল ও প্রতারণা’ করে বেড়াচ্ছেন। তিনি বিভিন্ন পরিচয়ে বেশ কয়েকটি বিয়ে করেছেন বলেও স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির ভাষ্য।

এসবির পরিদর্শক মামুন ইমরান খান ২০১৮ সালের ৮ জুলাই বন্ধু রহমত উল্লাহ সঙ্গে বনানীর একটি বাসায় গিয়ে খুন হন। পরদিন তার মৃতদেহ বস্তায় ভরে উলুখোলার জঙ্গলে নিয়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে পোড়ানো হয় অপরাধের চিহ্ন গোপন করার জন্য।

মামলার তদন্ত শেষে পরের বছরের এপ্রিলে অভিযোগপত্র দেয় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সেই অভিযোগপত্রে বলা হয়, রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে বিত্তবানদের ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করত একটি চক্র। তাদের লক্ষ্য ছিল রহমত উল্লাহকে আটকে ‘অশালীন’ ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে টাকা আদায় করা।

সেজন্য ওই চক্র জন্মদিনের নাটক সাজিয়ে রহমতকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল বনানীর এক বাসায়।বন্ধু রহমতের সঙ্গে সেখানে গিয়ে হত্যার শিকার হন পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান।

সেসময় মামলাটির তদন্তে যুক্ত ছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহীদুর রহমান। তিনি জানান, রবিউলসহ ১০ জনকে আসামি করেই ২০১৯ সালের এপ্রিলে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যা মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয় আদালতে।

পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, “এই রবিউলই দুবাইয়ের আরাভ খান বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তাকে আমরা ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।"

মামুন হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে রবিউল ছাড়াও তার স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার কেয়া (২১), নিহত মামুনের বন্ধু রহমত উল্লাহ (৩৫), স্বপন সরকার (৩৯), দিদার পাঠান (২১), মিজান শেখ (২১), আতিক হাসান (২১), সারোয়ার হোসেন (২৩) এবং দুই কিশোরীকে আসামি করা হয়।

সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৮ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে ভারতে চলে যান সে সময় ৩০ বছর বয়সী রবিউল ইসলাম। সেখানে বিয়ে করেন। পরে ভুয়া নাম-পরিচয় ব্যবহার করে ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন। সেই পাসপোর্ট দিয়েই পাড়ি জমান দুবাইয়ে। এখন তিনি বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী।

স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যায় দুবাইয়ের নিউ গোল্ড সুকে উদ্বোধন হচ্ছে তার আরাভ জুয়েলার্সের। এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে গেছেন ক্রীড়াঙ্গন ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের বেশ কয়েকজন তারকা। কয়েক দিন আগে এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের খ্যাতিমান তারকাদের সম্ভাব্য উপস্থিতির কথা উল্লেখ করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন রবিউল।

সেখানে তিনি লিখেছিলেন, দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা টাওয়ারের ৬৫ তলায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। যার নম্বর ৬৫১০। আরও ৪-৫টি ফ্ল্যাটের মালিকও তিনি। পাশাপাশি রয়েছে একটি সুইমিংপুল ও বাগানসহ বড় ডুপ্লেক্স বাড়িও। যেখানে মাঝেমধ্যে মায়াবী হরিণ জবাই দিয়ে বাংলাদেশিদের দাওয়াত খাওয়াচ্ছেন। বাগানে চাষ করছেন বাংলাদেশি সবজি। রয়েছে একাধিক দামি গাড়ি। আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধন উপলক্ষে ৬০ কেজি সোনা দিয়ে বানানো হয়েছে বাজপাখির আদলে লোগো, যা তৈরিতে সময় লেগেছে প্রায় আড়াই মাস। এটা তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা।

ফেসবুক পোস্ট দেখে অনেকেই চিনে ফেলেন, তিনি বাংলাদেশে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার আসামি রবিউল ইসলাম। ফেরারি একজন আসামি দুবাইয়ে গিয়ে কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন, তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, পুলিশের সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার টাকায় দুবাইয়ে সোনার ব্যবসা শুরু করেন রবিউল।

সম্প্রতি দুবাই বিশ্বে স্বর্ণের ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। দুবাইপ্রবাসী অনেক বাংলাদেশি সেখানে স্বর্ণের দোকানে কাজ করেন, আবার স্বর্ণের দোকানের মালিকানায়ও রয়েছেন কেউ কেউ। তবে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশিরা দেশটিতে অর্থ পাচার করে ফ্ল্যাট, বাড়ি, তারকা হোটেল ইত্যাদি কিনছেন। কেউ কেউ স্বর্ণ ব্যবসায়ও বিনিয়োগ করছেন। যদিও সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত কাউকে দুবাইয়ের এসব ব্যবসায় বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়নি বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন ২০১৮ সালের ৭ জুলাই রহমত উল্লাহ নামের এক ব্যক্তির আমন্ত্রণে ঢাকার বনানীর একটি বাড়িতে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সেখানে তাকে ‘ব্ল্যাকমেল’ করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করা হয়। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, মামুনকে ফাঁদে ফেলে বনানীর ওই বাসায় ডেকে নেওয়া হয়। তাকে ফ্ল্যাটে নিয়ে বেঁধে, স্কচটেপ দিয়ে মুখ আটকে নির্দয়ভাবে পেটানো হয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে মামুন মারা যান। পরে গাজীপুর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।

ওই হত্যাকাণ্ডে রহমত উল্লাহ, রবিউল ইসলাম, সুরাইয়া আক্তার কেয়া, স্বপন সরকার, দিদার পাঠান, মিজান শেখ, আতিক হাসান, সারওয়ার হোসেন, মেহেরুন্নিসা ওরফে স্বর্ণা ও ফারিয়া বিনতে মাইসাকে আসামি করে বনানী থানায় হত্যা মামলা করে পরিদর্শক মামুনের পরিবার। তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ এ মামলায় রহমত উল্লাহ এবং রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয় ওরফে হৃদিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। সেখানে রবিউল ইসলামকে পলাতক উল্লেখ করা হয়। পরে আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।

পরিদর্শক মামুন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর রবিউল ইসলাম নামের একজন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তাকে জেলে পাঠান। ৯ মাস কারাবাসের পর ওই তরুণ বলেন, তিনি রবিউল ইসলাম নন, তার আসল নাম আবু ইউসুফ। রবিউল ইসলামের কথামতো তার নাম-পরিচয় ব্যবহার করে আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন তিনি।

এরপর আদালত বিষয়টি অনুসন্ধান করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। ডিবির অনুসন্ধানে জানা যায়, খুনের মামলার আসামি রবিউলের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম মতিউর রহমান। আর রবিউলের পরিবর্তে আদালতে আত্মসমর্পণকারী আবু ইউসুফের বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানার আইনপুর গ্রাম।

গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, রবিউল ইসলামের একটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট রয়েছে। সেখানে নাম ব্যবহার করা হয়েছে হৃদি খান। ওই পাসপোর্টের নম্বর ০৩৮৫১৮৮। হত্যা মামলার পর তিনি ভারতে গিয়ে আরাভ খান নাম দিয়ে আরেকটি পাসপোর্ট তৈরি করেন। ২০২০ সালের ২৮ জুলাই তিনি পশ্চিমবঙ্গের নরেন্দ্রপুর উদয় সংঘ ক্লাব এলাকার বাসিন্দা হিসেবে ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন। ওই পাসপোর্টে তার বাবার নাম লেখেন জাকির খান, মায়ের নাম দেন রেহানা বিবি খান এবং স্ত্রীর নাম সাজিমা নাসরিন। তার ভারতীয় পাসপোর্ট নম্বর ইউ ৪৯৮৫৩৮৯।

ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (খিলগাঁও জোন) শহিদুর রহমান বলেন, জুয়েলার্সের মালিক আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলামকে দেশে ফিরিয়ে এনে আদালতে সোপর্দ করার চেষ্টা চলছে।

রবিউলকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কাজ শুরু করেছে পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মনজুর রহমান জানিয়েছেন।

back to top