alt

সংস্কৃতি

‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা’

সরকার আবদুল মান্নান

সংবাদ অনলাইন ডেস্ক : বুধবার, ১৪ এপ্রিল ২০২১

এক.

উৎসব একটি সর্বমানবীয় বিষয়। কবে থেকে মানুষ উৎসবের আয়োজন করেছে তার কোনো ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু মানুষ উৎসব ভালোবাসে, উৎসবের ভেতর দিয়ে কিছুটা সময় আনন্দে থাকে, নিজের কাছে এবং অনেকের কাছে খুলে ধরে নিজেকে, গ্রহণ করে মেলে ধরা অনেককে। এক ধরনের মুক্তি ও আনন্দের বোধ থেকে চিরকাল মানুষ কতভাবে যে উৎসবকে বরণ করে নিয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ফলে বিশ^জুড়ে কত রকমের উৎসব যে আছে তার কোনো হিসাব-নিকাশ নেই।

ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে এই উৎসবের পরিধি বৈশি^ক পর্য়ায়ে বিস্তৃত এবং এর সঙ্গে আছে ধর্ম-বর্ণ- গোত্র ও পেশার নিরিখে বৈচিত্র্য। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে আছে জন্মোৎস, বৈবাহিক উৎসব, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, জন্মাষ্ঠমী, ভাইফোঁটা ইত্যাদি। আমাদের দেশে এইসব উৎসবে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশী আমন্ত্রিত হন এবং পরিবারগুলোর ভেতরে বন্ধন দৃঢ় হয়। কিছু আছে ধর্মীয় অনুষ্ঠান। মুসলমানদের ঈদ, মহরম, শবেবরাত; সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা। এছাড়া কালীপূজা, সরস্বতী পূজা, লক্ষ্মী পূজা, বিশকর্মা পূজার আয়োজনও বহুল প্রচলিত। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বড়দিন, গুড ফ্রাইডে, ইস্টার স্যাটারডে পালিত হয় বাংলাভাষী মানুষের মধ্যে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীগণ পালন করেন শ্রী বুদ্ধের জন্মোৎসব বুদ্ধপূর্ণিমা, বৈশাখী পূর্ণিমা, আষাঢ়ী পূর্ণিমা, মধুপূর্ণিমা, মাঘীপূর্ণিমা, প্রবারণা ইত্যাদি। এইসব ধর্মীয় উৎসব যে ধর্ম¦ালম্বীদেরই হোক না কেন, বাঙালিরা কিন্তু একে অন্যের ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করে এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করে। এই ঐতিহ্য শত শত বছরের পুরনো।

কিছু উৎসব জাতিগত বিপুল অর্জনের সঙ্গে জড়িত। আমাদের দেশে এই উৎসবগুলো হলো একুশে উৎসব, বিজয় উৎসব, স্বাধীনতা দিবস পালন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মোৎস ইত্যাদি। এইসব উৎসবের ভেতর দিয়ে ধর্ম, বর্ণ, রপশা,

গোত্র নির্বিশেষে আমরা বারবার ফিরে যাই একটি স্বাধীন-স্বার্বভৌম জাতির জন্মের ঋণ স্বীকার করার জন্য বিনম্র শ্রদ্ধা ও সম্মানের আয়োজনে। কিছু উৎসব আছে বৈশি^ক। যেমন খ্রিস্টীয় নববর্ষ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ভ্যালেন্টাইন্স ডে, আন্তর্জাতিক নারীদিবস, মে ডে, বিশ^ পরিবেশ দিবস এবং এছাড়া বিচিত্র অনুষঙ্গে পালিত হয় আরও অসংখ্য উৎসব। এই বিচিত্র উৎসবের মধ্যে যে উৎসবটি বাঙালি জতীয় জীবনে বিপুল ঐতিহ্য ও প্রাণের কোলাহল নিয়ে আবির্ভূত হয় সেই উৎসবটি হলো বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ।

দুই.

বাঙালি জাতীয় জীবনে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন উৎসব নববর্ষ। ইতিহাসের বিচিত্র বাঁক ও মোড় বদলেনর পটভূমিতে এই উৎসবটির তাৎপর্য বদলেছে, রূপ বদলেছে, ঘটেছে বিচিত্র রূপান্তর। পৃথিবীর প্রায় সব উৎসবের ক্ষেত্রেই এই ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। মধ্যযুগে এই উৎসবের জন্ম হয়েছিল কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির পটভূমিতে। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে সেই সময় ভূস্বামীগণ বর্ষব্যাপী কর আদায়ের সূচনা করতেন। ব্যবসায়িক ধারদেনারও মীমাংসা হতো এই দিনে। এর সঙ্গে আয়োজন করা হতো মেলা ও নানা ধরনের অনুষ্ঠান। কিন্তু সেই সময় এই পুণ্যাহ বা পবিত্র দিবসের সঙ্গে যতটা না ছিল সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্য তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ফলে এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক ছিল খাতকের- ভোক্তার নয়।

কিন্তু সময় পাল্টায়। পাল্টায় জীবনের বিচিত্র কর্মযজ্ঞ। ১৯৪৭-এর পর বাংলা নববর্ষ পালন করাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়। তখন শহরে এই উৎসব ছিল না বললেই চলে। আর সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রবাদিতা ও চরম রক্ষণশীলতার বিষয়গুলো যেহেতু শহরকেদ্রিক সেহেতু সে সময় ঢাকা শহরসহ অন্যান্য শহরগুলোতে নববর্ষের আয়োজন কিছু পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু গ্রামের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কল্যাণ ও মঙ্গলের এক ধরনের সম্মিলিত অবচেতনার ঐতিহ্য থেকে তারা এই উৎসব পালন করত এবং প্রতিটি মানুষের কাছে এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে নববর্ষটি যেভাবে কাটানো হবে বছরের বাকি দিনগুলোও সেভাইে কাটবে। সুতরাং ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই এই দিনটিকে সাধ্যমত ভালো কাটানোর চেষ্টা করত। ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ বানানো, ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন করা; কয়েকটি গ্রাম নিয়ে মেলার আয়োজন কার; গান, যাত্রা, পালা, নাটকের আয়োজন কার; বিচিত্র খেলাধুলার আয়োজন করা। এইসবের ভেতর দিয়ে দিনটিকে স্মরণীয় ও তাৎপর্যময় করে তোলার চেষ্টা ছিল গ্রামীণ জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

তিন.

ষাটের দশকে গ্রামীণ জীবনে এই উৎসবটি উপভোগ করার সৌভাগ্য আমাদের অনেকেরই হয়েছে। ঘরের ভিটি ও উঠান লেপে তকতকে করে রাখার জন্য বিলের এঁটেল মাটির একটি স্তূপ থাকত প্রতিটি পরিবারে। ওই মাটির সঙ্গে গোবর মিশিয়ে ঘর ও ঘরের ভিটি এবং ওঠোন লেপেমুছে ঝকঝকে করে তোলার কর্মযজ্ঞ শুরুর হতো পহেলা বৈশাখের সপ্তাখানেক আগে থেইে। দাদি, মা, চাচি, জেঠি, ফুফিরা তখন মহা ব্যস্ত হয়ে উঠতেন। কাজ আর কাজ। কাজের কোনো শেষ নেই। আমরা ছোটরা বুঝতাম নববর্ষ চলে এসেছে এবং সঙ্গে এসেছে বৈশাখী মেলা। আমাদের আনন্দের শেষ নেই। অন্যান্য সময় মা-বাবাকে বিরক্ত করলে রাগ করতেন, বকাঝকা করতেন। কিন্তু এখন অন্যরকম। রাগ করেন না, বকাঝকা করেন না। সন্তানদের জন্য একটি ভেতরগত কল্যাণকামনার বাহ্যিক রূপ মুখাবয়বে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রচণ্ড পরিশ্রমের মধ্যেও তারা হাস্যোজ্জ্বল। আমাদের সন্তুষ্ঠ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। শুধু তাই নয় এই উৎসবকে কেন্দ্র করে কত অতিথি যে আসবে, কাছের-দূরের কত বন্ধু, স্বজন, সুভার্থীর পবিত্র পদধূলি পড়বে বাড়ির আঙ্গিনায় তার প্রস্তুতি চলছে দিনভর। এ যেন ‘ঘরকে বাহির আর বাহিরকে ঘরে’ আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তুতি। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেরছন : “এই পল্লী মাঝে মাঝে যখন আপনার বাড়ির মধ্যে বাহিরের বৃহৎ জগতের রক্তচলাচল অনুভব করিবার জন্য উৎসুক হইয়া উঠে, তখন মেলাই তাহার প্রধান উপায়। এই মেলাই আমাদের দেশে বাহিরকে ঘরের মধ্যে আহ্বান। এই উৎসবে পল্লী আপনার সমস্ত সংকীর্ণতা বিস্মৃত হয়- তাহার হৃদয় খুলিয়া দান করিবার ও গ্রহণ করিবার এই প্রধান উপলক্ষ্য। যেমন আকাশের জলে জলাশয় পূর্ণ করবিার সময় বর্ষাগম, তেমনি বিশ্বের ভারে পল্লীর হৃদয়কে ভরিয়া দিবার উপযুক্ত অবসর মেলা।” এখন বুঝি নববর্ষের প্রাককালে কেন আয়োজন চলত পরিশুদ্ধতার; মনে ও মননে, আস্থা ও বিশ্বাসে কেন তারা লালন করতেন গ্রহণের চিরকালীন আশ্রয়। এই যে পরিশুদ্ধতার আশ্রয়, সকল মানুষকে গ্রহণ করার আশ্রয় তা কি কারো একার বিষয় ছিল? না। এ ছিল একটি সম্মিলিত জনগোষ্ঠীর চেতন-অবচেতনে লালিত চিরকালীন ঐতিহ্য। এই ভূখণ্ডের কেউই এর বাইরে থাকতে পারেনি। এক ধরনের সর্বমানবীয় জীবনাকাক্সক্ষার বোধ ওই সামান্য মানুষগুলোকে অসামান্য সৌন্দর্যময় করে তুলতে দেখেছি।

চার

নববর্ষে ঘরে ঘরে সাধ্যমতো ভালো খাবারের আয়োজ হতো। সাধ্যমতো ভালো পোশাক পরার চেষ্টা করত সবাই। আপ্যায়নে যেন কোনো ত্রুটি না-হয় সেদিকেও লক্ষ রাখতে দেখেছি মা-বাবাকে, আত্মীয়-স্বজনকে। প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে খুব মনে হয়, একটি আত্মীয়তান্ত্রিক সমাজের যে পরিচয় বিধৃত হয়ে আছে আমাদের হাজার বছরের ইতিহসে তার প্রায় শেষ রশ্মিটুকু দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল। এবং এই আনন্দ সবচেয়ে বেশি উপভোগ করতাম বৈশাখী মেলায়। গ্রামীণ বাজার, খেলার মাঠ, ঈদগার মাঠ ও মণ্ডপে বসত ওই মেলা। মেলায় এসে পসরা সাজিয়ে বসতেন কামার, কুমোর, ছুতার, জোলা, কৃষাণ, কাঁসারু, বেদেনি, গলাইকর, হালুইকর প্রমুখ। কারো কোনো ধর্মীয় পরিচয় ছিলনা, জাতপাতের পরিচয় ছিলনা, ধনী-দরিদ্রের পরিচয় ছিলনা- সবার একমাত্র পরিচয় ছিল মানুষ এবং মিষ্টি বাক্যে, হাসি-তামাশায়, ইয়ার্কি-ফাজলামোতে একজন আরেকজনকে সম্বোধন করা ও আপন করে নেওয়ার কিযে একটি শান্ত-সৌম্য পরিবেশ তৈরি হতো, তার কোনো তুলনা এখন আর পাই না। প্রকৃতির মধ্যেও ছিল উৎসবমুখরতার নানা বর্ণবৈচিত্র্য। ছাগল-গরুর শরীর রং করা হতো, মুরগির পালকে লাগত আলতা আর গাছের গোড়ায় সাদা রং, হাঁড়ি-পাতিলের গায়ে আল্পনা, নানা রকম রঙিন কাগজ ও কাঠ দিয়ে এবং মাটি পুড়িয়ে বানানো হতো বিচিত্র পশু ও পাখপাখালি। কেন করা হতো এইসব? এর কি কোনো মানে আছে? এখন মনে হয়, খুব মানে আছে। আমি যখন এই লেখাটি লিখছিলাম তখন আমার শ্ববিদ্যালয়ের এক সহপাঠী ফেসবুকে প্রশ্ন তুলেছেন, “মংগল শোভাযাত্রা”র নামে মুখোশ ও পশুপাখির অবয়ব নিয়ে নেচে গেয়ে মিছিল কি আমাদের বাঙালির সংস্কৃতি!!! না অপসংস্কৃতি!!!!!।” তার লেখাটি হুবহু তুলে ধরলাম। মন্তব্যে আমি লিখেছি, “একদম বাঙালি সংস্কৃতি, বন্ধু। এই ব-দ্বীপের কয়েকশ বছরের ইতিহাস পড়লেই তোমার এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে। মনে রেখো, এই পৃথিবীতে মানুষ কোনো বিচ্ছিন্ন সৃষ্টি নয়। প্রকৃতিতে যা কিছু আছে তাদের সবাইকে নিয়েই মানবসংসার। ধন্যবাদ বন্ধু।” বৈশাখী উৎসবের ভেতর দিয়ে প্রাণিজগৎ থেকে শুরু করে বস্তুজগতের সঙ্গেও যে মানুষের একটি অদৃশ্য মানবিক সম্পর্ক নিয়ত প্রবহমাণ, বিচিত্র প্রাণীর মুখোশ আর বস্তুকে প্রাণময় করে তোলার মধ্যে সেই সম্পর্কের চেতনাপ্রবাহ মূর্তমান হয়ে ওঠে। সকল প্রাণির প্রতি মানবিক হওয়া, বৃক্ষ-বিটপী-গুল্মের প্রতি মানবিক হওয়া এবং এমনকি কীটপতঙ্গের প্রতিও মানবিক হওয়ার এই শোভাযাত্রাকে অর্থহীন বলা ঠিক নয়; বাঙালি সংস্কৃতি কি না এমন প্রশ্ন তোলাও ঠিক নয়। কেননা সারা পৃথিবীতে সর্বজনীন যত উৎসব আছে তার মূলে নিহিত আছে ছন্দ- মানুষের সঙ্গে মানুষের ছন্দ, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির ছন্দ, মানুষের সঙ্গে বিশ^ব্রহ্মামাণ্ডের ছন্দ। এই ছন্দকে যারা দেখতে পাবে না তারা চোখ থেকেও অন্ধ। তারা মানবজন্মের মাহাত্ম্য থেকে বঞ্চিত এবং তারাই নানাভাবে ইনিয়েবিনিয়ে এইসব শাশ্বত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে জাতিগত সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের সংঘাত তৈরি করতে চায়। এই যে প্রশ্নগুলো উঠছে, তারও একটি ইতিহাস আছে। সে প্রসঙ্গে বলার সুযোগ এই প্রবন্ধে নেই।

পাঁচ.

অর্ধশতকের ব্যবধানে নববর্ষ উৎসবে অনেক বিবর্তন দেখলাম। বাহ্যিক আয়োজনের মধ্যেই শুধু এই বিবর্তন হয়েছে তা নয় বরং চেতনাগতভাবেও অনেক সরে এসেছে নববর্ষের উৎসব। এর পেছনে মারাত্মকভাবে কাজ করেছে পুজিঁবাদি বিশ^ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় কট্টরপন্থার উত্থান। উৎসবের একটি অর্থনৈতিক দিক আছেই। সুপ্রাচীন কালেও ছিল এবং এখনো আছে। অনন্দের একটি প্রকৃতিগত দিক আছে এবং একটি বিলাসিতার দিকও আছে। বিলাসিতা যখন মুখ্য হয়ে ওঠে তখন উৎসব তার ঐতিহ্যের অমরতা হারায়। তখন প্রাণের সঙ্গে প্রাণের বন্ধন আর থকে না, প্রাণের সঙ্গে প্রকৃতির বন্ধনও থাকে না। এখন শহরে তো বটেই, গ্রামীণ জীবনেও জাতীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির প্রভাব এতটাই বেড়েছে যে উৎসবকে তারা বের করে নিয়ে এসেছে তার আদিম ও অকৃত্রিম অবয়ব থেকে। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী এখন উৎসব চলে। এই অবস্থা থেকে হয়তো মুক্তির কোনো উপায় নেই। এখানে হুমকিটা ভয়াবহ নয়- বিবর্তনের। বিবর্তন সবসময় শুভ হয় না। কেননা এই উৎসবের সঙ্গে বাঙালি জীবনের দৃশ্যগ্রাহ্য ও অদৃশ্য যে বহুতর বন্ধন ছিল জীবন ও প্রকৃতির সঙ্গে তার শেকড় অনেকাংশেই ছিন্ন হয়েছে। কিন্তু মূল হুমকিটা আসে কট্টরপন্থি ও উগ্রবাদী মুসলমানদের কাছ থেকে। ইসলামের মানবতাবাদী ও জাতিগত ঐতিহ্য রক্ষার জীবনাদর্শ থেকে বিচ্যুত এই শ্রেণিটি শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ঘোর বিরোধী। এমনকি মুক্তবুদ্ধি ও জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চাকেও তারা কিছুতেই মানতে চায় না। ফলে যা কিছু সুন্দর ও মানবিক, যা কিছু সৃষ্টিশীল ও কল্যাণকর, যা কিছু মানুষকে মুক্তি ও আনন্দের মধ্যে প্রাণময় করে তোলে তার প্রায় সবকিছুই এখন হুমকির মধ্যে পড়েছে। নববর্ষ ও নববর্ষের উৎসব তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যে অপশক্তির হাতে ক্ষমতা চলে যায় তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় উত্থান ঘটে অর্থনৈতিকভাবে, চিন্তায় ও বোধবুদ্ধিতে পশ্চাৎপদ এই জঙ্গীগোষ্ঠীর। তারপর বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা তাদের স্বার্থের জন্য এদের নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে দিয়ে তাদের দানবীয় করে তুলেছে। এখন আর সামলানো যাচ্ছে না। অথচ এই উৎসব উপলক্ষ্যে তারা সরকারি ছুটি ভোগ করছে এবং যারা সরকারি চাকরি করছেন তারা আওয়মী লীগের সরকার কর্তৃক প্রদয়ে উৎসব-ভাতা ভোগ করছেন। তাদের মধ্যে এমন একজনেরও সন্ধান পাওয়া যায়নি নববর্ষ ও উৎসব মানেন না এবং উৎসবভাতা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এদের অনেকেরই ব্যক্তিজীবন পরিচ্ছন্ন নয়। সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও পরিচ্ছন্নতার যে জীবন নববর্ষের আদর্শ, সেই জীবন এরা লালন করেন না। ন্যায় ও অন্যায়, সত্য ও মিথ্যা, সুন্দর ও অসুন্দর এবং ভালো ও মন্দের মধ্যকার পার্থক্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা এদের নেই। কূপমণ্ডূকতার মধ্যে এদের বসবাসের ফলে আমাদের জাতিগত সকল ইতিহাস ও ঐতিহ্য হুমকির মধ্যে পড়েছে।

কিন্তু সত্য ও সুন্দরের বিনাশ নেই। নববর্ষ ও বৈশাখী উৎসব আমাদের ধর্মীয় উৎসব নয়- জাতিগত উৎসব। সকল ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও পেশার মানুষ এই উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। শুধু বাংলাদেশে নয়, বাঙালি-বিশে্ব এই উৎসব পালিত হয় প্রাণের তাগিদে, মহা সমারোহে। করোনা মহামারীতে আক্রান্ত বিশে্ব কোনো কিছুই তার আপন গতিতে চলছে না। এই মহামারী যখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তখনই আর্বিভূত হয়েছে নববর্ষ। ঘরে বসেই আমরা মেতে উঠব নববর্ষের উৎসবে। আর পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য কল্যাণ কামনা করবো এবং প্রার্থনা করব : “মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।”

ছবি

‘রোড টু বালুরঘাট’, মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থীদের চিত্র প্রদর্শন

ছবি

পাবলিশহার এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড পেলেন বাংলাদেশের মিতিয়া ওসমান

ছবি

চট্টগ্রামে শান্তিপূর্ণ ও উৎসব মুখর পরিবেশে বর্ষ বরন সম্পন্ন

ছবি

জামালপুরে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত

ছবি

বনাঢ্য নানান আয়োজনে বিভাগীয় নগরী রংপুরে পালিত হচ্ছে পহেলা বৈশাখ

ছবি

আজ চৈত্র সংক্রান্তি

ছবি

বর্ষবরণে সময়ের বিধি-নিষেধ মানবে না সাংস্কৃতিক জোট

ছবি

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার গুণীজন সংবর্ধনা

ছবি

স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রায় সকল প্রতিষ্ঠানকে কাজ করতে হবে : ড. কামাল চৌধুরী

ছবি

এলাকাবাসীর সঙ্গে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ

জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের নতুন কমিটি, ড. সনজীদা খাতুন সভাপতি, ড. আতিউর রহমান নির্বাহী সভাপতি,লিলি ইসলাম সাধারণ সম্পাদক

ছবি

এবার বইমেলায় ৬০ কোটি টাকার বই বিক্রি

ছবি

আজ শেষ হচ্ছে মহান একুশের বইমেলা, বিক্রি বেড়েছে শেষ মুহুর্তে

ছবি

আগামী বছর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলার জায়গা বরাদ্দ নাওদিতে পারে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়

ছবি

বইমেলা, মেয়াদ বাড়ায় খুশি সবাই

ছবি

বইমেলায় ফ্রান্স প্রবাসী কাজী এনায়েত উল্লাহর দুই বই

ছবি

নারী লেখকদের বই কম, বিক্রিও কম

ছবি

বইমেলায় বিদায়ের সুর

ছবি

শিশুদের আনন্দ উচ্ছ্বাসে জমজমাট বইমেলার শিশু প্রহর

ছবি

বইমেলায় শিশুদের চোখে মুখে ছিল আনন্দ উচ্ছ্বাস

ছবি

বই মেলায় খুদে লেখকদের গল্প সংকলন ‘কিশোর রূপাবলি’

ছবি

`বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশিত উন্নত শিরের বাঙালি জাতি চাই’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন

ছবি

বইমেলায় সরোজ মেহেদীর ‘চেনা নগরে অচিন সময়ে’

ছবি

বইমেলায় মাহবুবুর রহমান তুহিনের ‘চেকবই’

বইমেলায় প্রকাশিত হলো সাংবাদিক মনিরুজ্জামান উজ্জ্বলের ‘যাপিত জীবনের গল্প’

ছবি

সমাজসেবায় একুশে পদকঃ এখনও ফেরি করে দই বিক্রি করেন জিয়াউল হক

ছবি

বইমেলায় পন্নী নিয়োগীর নতুন গ্রল্পগ্রন্থ আতশবাজি

ছবি

ভাষার শক্তি জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সুদৃঢ় করে: উপাচার্য ড. মশিউর রহমান

ছবি

রুবেলের গ্রন্থ শিশির ঝরা কবিতা

ঢাবিতে পাঁচ দিনব্যাপী ‘আমার ভাষার চলচ্চিত্র’ উৎসব শুরু

ছবি

সোনারগাঁয়ে লোকজ উৎসবে খেলাঘরের নাচ-গান পরিবেশন

ছবি

বাংলা একাডেমি পুরস্কার ফেরত দিলেন জাকির তালুকদার

ছবি

রংতুলির মাধ্যমে নিরাপদ সড়কের দাবি শিশুদের

ছবি

জাতীয় প্রেস ক্লাবে পিঠা উৎসব ও লোকগানের আসর

ফরিদপুরে ২ ফেব্রূয়ারি থেকে ঐতিহ্যবাহী জসীম পল্লী মেলা

ছবি

লেনিন উপন্যাসের প্রকাশনা উৎসব

tab

সংস্কৃতি

‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা’

সরকার আবদুল মান্নান

সংবাদ অনলাইন ডেস্ক

বুধবার, ১৪ এপ্রিল ২০২১

এক.

উৎসব একটি সর্বমানবীয় বিষয়। কবে থেকে মানুষ উৎসবের আয়োজন করেছে তার কোনো ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু মানুষ উৎসব ভালোবাসে, উৎসবের ভেতর দিয়ে কিছুটা সময় আনন্দে থাকে, নিজের কাছে এবং অনেকের কাছে খুলে ধরে নিজেকে, গ্রহণ করে মেলে ধরা অনেককে। এক ধরনের মুক্তি ও আনন্দের বোধ থেকে চিরকাল মানুষ কতভাবে যে উৎসবকে বরণ করে নিয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ফলে বিশ^জুড়ে কত রকমের উৎসব যে আছে তার কোনো হিসাব-নিকাশ নেই।

ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে এই উৎসবের পরিধি বৈশি^ক পর্য়ায়ে বিস্তৃত এবং এর সঙ্গে আছে ধর্ম-বর্ণ- গোত্র ও পেশার নিরিখে বৈচিত্র্য। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে আছে জন্মোৎস, বৈবাহিক উৎসব, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, জন্মাষ্ঠমী, ভাইফোঁটা ইত্যাদি। আমাদের দেশে এইসব উৎসবে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশী আমন্ত্রিত হন এবং পরিবারগুলোর ভেতরে বন্ধন দৃঢ় হয়। কিছু আছে ধর্মীয় অনুষ্ঠান। মুসলমানদের ঈদ, মহরম, শবেবরাত; সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা। এছাড়া কালীপূজা, সরস্বতী পূজা, লক্ষ্মী পূজা, বিশকর্মা পূজার আয়োজনও বহুল প্রচলিত। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বড়দিন, গুড ফ্রাইডে, ইস্টার স্যাটারডে পালিত হয় বাংলাভাষী মানুষের মধ্যে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীগণ পালন করেন শ্রী বুদ্ধের জন্মোৎসব বুদ্ধপূর্ণিমা, বৈশাখী পূর্ণিমা, আষাঢ়ী পূর্ণিমা, মধুপূর্ণিমা, মাঘীপূর্ণিমা, প্রবারণা ইত্যাদি। এইসব ধর্মীয় উৎসব যে ধর্ম¦ালম্বীদেরই হোক না কেন, বাঙালিরা কিন্তু একে অন্যের ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করে এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করে। এই ঐতিহ্য শত শত বছরের পুরনো।

কিছু উৎসব জাতিগত বিপুল অর্জনের সঙ্গে জড়িত। আমাদের দেশে এই উৎসবগুলো হলো একুশে উৎসব, বিজয় উৎসব, স্বাধীনতা দিবস পালন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মোৎস ইত্যাদি। এইসব উৎসবের ভেতর দিয়ে ধর্ম, বর্ণ, রপশা,

গোত্র নির্বিশেষে আমরা বারবার ফিরে যাই একটি স্বাধীন-স্বার্বভৌম জাতির জন্মের ঋণ স্বীকার করার জন্য বিনম্র শ্রদ্ধা ও সম্মানের আয়োজনে। কিছু উৎসব আছে বৈশি^ক। যেমন খ্রিস্টীয় নববর্ষ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ভ্যালেন্টাইন্স ডে, আন্তর্জাতিক নারীদিবস, মে ডে, বিশ^ পরিবেশ দিবস এবং এছাড়া বিচিত্র অনুষঙ্গে পালিত হয় আরও অসংখ্য উৎসব। এই বিচিত্র উৎসবের মধ্যে যে উৎসবটি বাঙালি জতীয় জীবনে বিপুল ঐতিহ্য ও প্রাণের কোলাহল নিয়ে আবির্ভূত হয় সেই উৎসবটি হলো বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ।

দুই.

বাঙালি জাতীয় জীবনে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন উৎসব নববর্ষ। ইতিহাসের বিচিত্র বাঁক ও মোড় বদলেনর পটভূমিতে এই উৎসবটির তাৎপর্য বদলেছে, রূপ বদলেছে, ঘটেছে বিচিত্র রূপান্তর। পৃথিবীর প্রায় সব উৎসবের ক্ষেত্রেই এই ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। মধ্যযুগে এই উৎসবের জন্ম হয়েছিল কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির পটভূমিতে। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে সেই সময় ভূস্বামীগণ বর্ষব্যাপী কর আদায়ের সূচনা করতেন। ব্যবসায়িক ধারদেনারও মীমাংসা হতো এই দিনে। এর সঙ্গে আয়োজন করা হতো মেলা ও নানা ধরনের অনুষ্ঠান। কিন্তু সেই সময় এই পুণ্যাহ বা পবিত্র দিবসের সঙ্গে যতটা না ছিল সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্য তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ফলে এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক ছিল খাতকের- ভোক্তার নয়।

কিন্তু সময় পাল্টায়। পাল্টায় জীবনের বিচিত্র কর্মযজ্ঞ। ১৯৪৭-এর পর বাংলা নববর্ষ পালন করাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়। তখন শহরে এই উৎসব ছিল না বললেই চলে। আর সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রবাদিতা ও চরম রক্ষণশীলতার বিষয়গুলো যেহেতু শহরকেদ্রিক সেহেতু সে সময় ঢাকা শহরসহ অন্যান্য শহরগুলোতে নববর্ষের আয়োজন কিছু পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু গ্রামের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কল্যাণ ও মঙ্গলের এক ধরনের সম্মিলিত অবচেতনার ঐতিহ্য থেকে তারা এই উৎসব পালন করত এবং প্রতিটি মানুষের কাছে এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে নববর্ষটি যেভাবে কাটানো হবে বছরের বাকি দিনগুলোও সেভাইে কাটবে। সুতরাং ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই এই দিনটিকে সাধ্যমত ভালো কাটানোর চেষ্টা করত। ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ বানানো, ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন করা; কয়েকটি গ্রাম নিয়ে মেলার আয়োজন কার; গান, যাত্রা, পালা, নাটকের আয়োজন কার; বিচিত্র খেলাধুলার আয়োজন করা। এইসবের ভেতর দিয়ে দিনটিকে স্মরণীয় ও তাৎপর্যময় করে তোলার চেষ্টা ছিল গ্রামীণ জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

তিন.

ষাটের দশকে গ্রামীণ জীবনে এই উৎসবটি উপভোগ করার সৌভাগ্য আমাদের অনেকেরই হয়েছে। ঘরের ভিটি ও উঠান লেপে তকতকে করে রাখার জন্য বিলের এঁটেল মাটির একটি স্তূপ থাকত প্রতিটি পরিবারে। ওই মাটির সঙ্গে গোবর মিশিয়ে ঘর ও ঘরের ভিটি এবং ওঠোন লেপেমুছে ঝকঝকে করে তোলার কর্মযজ্ঞ শুরুর হতো পহেলা বৈশাখের সপ্তাখানেক আগে থেইে। দাদি, মা, চাচি, জেঠি, ফুফিরা তখন মহা ব্যস্ত হয়ে উঠতেন। কাজ আর কাজ। কাজের কোনো শেষ নেই। আমরা ছোটরা বুঝতাম নববর্ষ চলে এসেছে এবং সঙ্গে এসেছে বৈশাখী মেলা। আমাদের আনন্দের শেষ নেই। অন্যান্য সময় মা-বাবাকে বিরক্ত করলে রাগ করতেন, বকাঝকা করতেন। কিন্তু এখন অন্যরকম। রাগ করেন না, বকাঝকা করেন না। সন্তানদের জন্য একটি ভেতরগত কল্যাণকামনার বাহ্যিক রূপ মুখাবয়বে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রচণ্ড পরিশ্রমের মধ্যেও তারা হাস্যোজ্জ্বল। আমাদের সন্তুষ্ঠ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। শুধু তাই নয় এই উৎসবকে কেন্দ্র করে কত অতিথি যে আসবে, কাছের-দূরের কত বন্ধু, স্বজন, সুভার্থীর পবিত্র পদধূলি পড়বে বাড়ির আঙ্গিনায় তার প্রস্তুতি চলছে দিনভর। এ যেন ‘ঘরকে বাহির আর বাহিরকে ঘরে’ আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তুতি। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেরছন : “এই পল্লী মাঝে মাঝে যখন আপনার বাড়ির মধ্যে বাহিরের বৃহৎ জগতের রক্তচলাচল অনুভব করিবার জন্য উৎসুক হইয়া উঠে, তখন মেলাই তাহার প্রধান উপায়। এই মেলাই আমাদের দেশে বাহিরকে ঘরের মধ্যে আহ্বান। এই উৎসবে পল্লী আপনার সমস্ত সংকীর্ণতা বিস্মৃত হয়- তাহার হৃদয় খুলিয়া দান করিবার ও গ্রহণ করিবার এই প্রধান উপলক্ষ্য। যেমন আকাশের জলে জলাশয় পূর্ণ করবিার সময় বর্ষাগম, তেমনি বিশ্বের ভারে পল্লীর হৃদয়কে ভরিয়া দিবার উপযুক্ত অবসর মেলা।” এখন বুঝি নববর্ষের প্রাককালে কেন আয়োজন চলত পরিশুদ্ধতার; মনে ও মননে, আস্থা ও বিশ্বাসে কেন তারা লালন করতেন গ্রহণের চিরকালীন আশ্রয়। এই যে পরিশুদ্ধতার আশ্রয়, সকল মানুষকে গ্রহণ করার আশ্রয় তা কি কারো একার বিষয় ছিল? না। এ ছিল একটি সম্মিলিত জনগোষ্ঠীর চেতন-অবচেতনে লালিত চিরকালীন ঐতিহ্য। এই ভূখণ্ডের কেউই এর বাইরে থাকতে পারেনি। এক ধরনের সর্বমানবীয় জীবনাকাক্সক্ষার বোধ ওই সামান্য মানুষগুলোকে অসামান্য সৌন্দর্যময় করে তুলতে দেখেছি।

চার

নববর্ষে ঘরে ঘরে সাধ্যমতো ভালো খাবারের আয়োজ হতো। সাধ্যমতো ভালো পোশাক পরার চেষ্টা করত সবাই। আপ্যায়নে যেন কোনো ত্রুটি না-হয় সেদিকেও লক্ষ রাখতে দেখেছি মা-বাবাকে, আত্মীয়-স্বজনকে। প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে খুব মনে হয়, একটি আত্মীয়তান্ত্রিক সমাজের যে পরিচয় বিধৃত হয়ে আছে আমাদের হাজার বছরের ইতিহসে তার প্রায় শেষ রশ্মিটুকু দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল। এবং এই আনন্দ সবচেয়ে বেশি উপভোগ করতাম বৈশাখী মেলায়। গ্রামীণ বাজার, খেলার মাঠ, ঈদগার মাঠ ও মণ্ডপে বসত ওই মেলা। মেলায় এসে পসরা সাজিয়ে বসতেন কামার, কুমোর, ছুতার, জোলা, কৃষাণ, কাঁসারু, বেদেনি, গলাইকর, হালুইকর প্রমুখ। কারো কোনো ধর্মীয় পরিচয় ছিলনা, জাতপাতের পরিচয় ছিলনা, ধনী-দরিদ্রের পরিচয় ছিলনা- সবার একমাত্র পরিচয় ছিল মানুষ এবং মিষ্টি বাক্যে, হাসি-তামাশায়, ইয়ার্কি-ফাজলামোতে একজন আরেকজনকে সম্বোধন করা ও আপন করে নেওয়ার কিযে একটি শান্ত-সৌম্য পরিবেশ তৈরি হতো, তার কোনো তুলনা এখন আর পাই না। প্রকৃতির মধ্যেও ছিল উৎসবমুখরতার নানা বর্ণবৈচিত্র্য। ছাগল-গরুর শরীর রং করা হতো, মুরগির পালকে লাগত আলতা আর গাছের গোড়ায় সাদা রং, হাঁড়ি-পাতিলের গায়ে আল্পনা, নানা রকম রঙিন কাগজ ও কাঠ দিয়ে এবং মাটি পুড়িয়ে বানানো হতো বিচিত্র পশু ও পাখপাখালি। কেন করা হতো এইসব? এর কি কোনো মানে আছে? এখন মনে হয়, খুব মানে আছে। আমি যখন এই লেখাটি লিখছিলাম তখন আমার শ্ববিদ্যালয়ের এক সহপাঠী ফেসবুকে প্রশ্ন তুলেছেন, “মংগল শোভাযাত্রা”র নামে মুখোশ ও পশুপাখির অবয়ব নিয়ে নেচে গেয়ে মিছিল কি আমাদের বাঙালির সংস্কৃতি!!! না অপসংস্কৃতি!!!!!।” তার লেখাটি হুবহু তুলে ধরলাম। মন্তব্যে আমি লিখেছি, “একদম বাঙালি সংস্কৃতি, বন্ধু। এই ব-দ্বীপের কয়েকশ বছরের ইতিহাস পড়লেই তোমার এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে। মনে রেখো, এই পৃথিবীতে মানুষ কোনো বিচ্ছিন্ন সৃষ্টি নয়। প্রকৃতিতে যা কিছু আছে তাদের সবাইকে নিয়েই মানবসংসার। ধন্যবাদ বন্ধু।” বৈশাখী উৎসবের ভেতর দিয়ে প্রাণিজগৎ থেকে শুরু করে বস্তুজগতের সঙ্গেও যে মানুষের একটি অদৃশ্য মানবিক সম্পর্ক নিয়ত প্রবহমাণ, বিচিত্র প্রাণীর মুখোশ আর বস্তুকে প্রাণময় করে তোলার মধ্যে সেই সম্পর্কের চেতনাপ্রবাহ মূর্তমান হয়ে ওঠে। সকল প্রাণির প্রতি মানবিক হওয়া, বৃক্ষ-বিটপী-গুল্মের প্রতি মানবিক হওয়া এবং এমনকি কীটপতঙ্গের প্রতিও মানবিক হওয়ার এই শোভাযাত্রাকে অর্থহীন বলা ঠিক নয়; বাঙালি সংস্কৃতি কি না এমন প্রশ্ন তোলাও ঠিক নয়। কেননা সারা পৃথিবীতে সর্বজনীন যত উৎসব আছে তার মূলে নিহিত আছে ছন্দ- মানুষের সঙ্গে মানুষের ছন্দ, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির ছন্দ, মানুষের সঙ্গে বিশ^ব্রহ্মামাণ্ডের ছন্দ। এই ছন্দকে যারা দেখতে পাবে না তারা চোখ থেকেও অন্ধ। তারা মানবজন্মের মাহাত্ম্য থেকে বঞ্চিত এবং তারাই নানাভাবে ইনিয়েবিনিয়ে এইসব শাশ্বত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে জাতিগত সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের সংঘাত তৈরি করতে চায়। এই যে প্রশ্নগুলো উঠছে, তারও একটি ইতিহাস আছে। সে প্রসঙ্গে বলার সুযোগ এই প্রবন্ধে নেই।

পাঁচ.

অর্ধশতকের ব্যবধানে নববর্ষ উৎসবে অনেক বিবর্তন দেখলাম। বাহ্যিক আয়োজনের মধ্যেই শুধু এই বিবর্তন হয়েছে তা নয় বরং চেতনাগতভাবেও অনেক সরে এসেছে নববর্ষের উৎসব। এর পেছনে মারাত্মকভাবে কাজ করেছে পুজিঁবাদি বিশ^ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় কট্টরপন্থার উত্থান। উৎসবের একটি অর্থনৈতিক দিক আছেই। সুপ্রাচীন কালেও ছিল এবং এখনো আছে। অনন্দের একটি প্রকৃতিগত দিক আছে এবং একটি বিলাসিতার দিকও আছে। বিলাসিতা যখন মুখ্য হয়ে ওঠে তখন উৎসব তার ঐতিহ্যের অমরতা হারায়। তখন প্রাণের সঙ্গে প্রাণের বন্ধন আর থকে না, প্রাণের সঙ্গে প্রকৃতির বন্ধনও থাকে না। এখন শহরে তো বটেই, গ্রামীণ জীবনেও জাতীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির প্রভাব এতটাই বেড়েছে যে উৎসবকে তারা বের করে নিয়ে এসেছে তার আদিম ও অকৃত্রিম অবয়ব থেকে। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী এখন উৎসব চলে। এই অবস্থা থেকে হয়তো মুক্তির কোনো উপায় নেই। এখানে হুমকিটা ভয়াবহ নয়- বিবর্তনের। বিবর্তন সবসময় শুভ হয় না। কেননা এই উৎসবের সঙ্গে বাঙালি জীবনের দৃশ্যগ্রাহ্য ও অদৃশ্য যে বহুতর বন্ধন ছিল জীবন ও প্রকৃতির সঙ্গে তার শেকড় অনেকাংশেই ছিন্ন হয়েছে। কিন্তু মূল হুমকিটা আসে কট্টরপন্থি ও উগ্রবাদী মুসলমানদের কাছ থেকে। ইসলামের মানবতাবাদী ও জাতিগত ঐতিহ্য রক্ষার জীবনাদর্শ থেকে বিচ্যুত এই শ্রেণিটি শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ঘোর বিরোধী। এমনকি মুক্তবুদ্ধি ও জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চাকেও তারা কিছুতেই মানতে চায় না। ফলে যা কিছু সুন্দর ও মানবিক, যা কিছু সৃষ্টিশীল ও কল্যাণকর, যা কিছু মানুষকে মুক্তি ও আনন্দের মধ্যে প্রাণময় করে তোলে তার প্রায় সবকিছুই এখন হুমকির মধ্যে পড়েছে। নববর্ষ ও নববর্ষের উৎসব তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যে অপশক্তির হাতে ক্ষমতা চলে যায় তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় উত্থান ঘটে অর্থনৈতিকভাবে, চিন্তায় ও বোধবুদ্ধিতে পশ্চাৎপদ এই জঙ্গীগোষ্ঠীর। তারপর বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা তাদের স্বার্থের জন্য এদের নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে দিয়ে তাদের দানবীয় করে তুলেছে। এখন আর সামলানো যাচ্ছে না। অথচ এই উৎসব উপলক্ষ্যে তারা সরকারি ছুটি ভোগ করছে এবং যারা সরকারি চাকরি করছেন তারা আওয়মী লীগের সরকার কর্তৃক প্রদয়ে উৎসব-ভাতা ভোগ করছেন। তাদের মধ্যে এমন একজনেরও সন্ধান পাওয়া যায়নি নববর্ষ ও উৎসব মানেন না এবং উৎসবভাতা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এদের অনেকেরই ব্যক্তিজীবন পরিচ্ছন্ন নয়। সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও পরিচ্ছন্নতার যে জীবন নববর্ষের আদর্শ, সেই জীবন এরা লালন করেন না। ন্যায় ও অন্যায়, সত্য ও মিথ্যা, সুন্দর ও অসুন্দর এবং ভালো ও মন্দের মধ্যকার পার্থক্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা এদের নেই। কূপমণ্ডূকতার মধ্যে এদের বসবাসের ফলে আমাদের জাতিগত সকল ইতিহাস ও ঐতিহ্য হুমকির মধ্যে পড়েছে।

কিন্তু সত্য ও সুন্দরের বিনাশ নেই। নববর্ষ ও বৈশাখী উৎসব আমাদের ধর্মীয় উৎসব নয়- জাতিগত উৎসব। সকল ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও পেশার মানুষ এই উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। শুধু বাংলাদেশে নয়, বাঙালি-বিশে্ব এই উৎসব পালিত হয় প্রাণের তাগিদে, মহা সমারোহে। করোনা মহামারীতে আক্রান্ত বিশে্ব কোনো কিছুই তার আপন গতিতে চলছে না। এই মহামারী যখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তখনই আর্বিভূত হয়েছে নববর্ষ। ঘরে বসেই আমরা মেতে উঠব নববর্ষের উৎসবে। আর পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য কল্যাণ কামনা করবো এবং প্রার্থনা করব : “মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।”

back to top