নতুন শিক্ষাক্রম
দেশের সব স্কুলে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই এখনও পৌঁছেনি। নতুন শিক্ষাক্রমের বই ছাপাও পুরোপুরি শেষ হয়নি। তবে নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষক প্রশিক্ষণ শুরু হচ্ছে আজ। পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন শিক্ষকরা।
মাত্র পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ ‘অভিজ্ঞাভিত্তিক শিখনে ভালো’ ফল দেবে না বলে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। তারা বলেন, যেখানে ‘মাস্টার ট্রেইনার’রা নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর ছয়দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তারা উপজেলাভিত্তিক ‘ট্রেইনার’দেরও ছয় দিনের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এখন উপজেলার ‘ট্রেইনার’রা সাধারণ শিক্ষকদের পাঁচদিনে কীভাবে নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর পূর্ণ ধারণা দেবেন?
শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেবেন সদ্য প্রশিক্ষণ পাওয়া ‘মাস্টার ট্রেইনার বা উপজেলাভিত্তিক ট্রেইনাররা’। তারা ছয় দিনের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ‘কোর ট্রেইনার’দের কাছ থেকে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, মাউশির আঞ্চলিক পরিচালক ও উপপরিচালকদের প্রধান অতিথি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এছাড়া উপজেলার একাডেমিক সুপারভাইজার এবং প্রশিক্ষণ ভেন্যুর প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন। এ ক্ষেত্রে উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার যদি প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি কোর্স সমন্বয়ক হতে পারবেন না।
প্রশিক্ষণ কোর্স আয়োজনের জন্য ভেন্যু নির্বাচন হবে পর্যাপ্ত কক্ষ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত আলো বাতাসের সুবিধা সংবলিত প্রতিষ্ঠানে। নিজ উপজেলা ব্যতীত অন্য উপজেলার প্রশিক্ষকদের জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করার নির্দেশনা দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।
জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও মাউশির প্রশিক্ষণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক তাসলিমা বেগম সংবাদকে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণীকক্ষে মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের ৯৫/৯৬ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। অনেক স্কুলেই দেখা গেছে ২১টি শিক্ষকের পদের ১১টিই শূন্য। সরকারি স্কুলেও শিক্ষক সংকট রয়েছে।’
এই পরিস্থিতিতে কোনভাবেই শ্রেণীকক্ষে নতুন শিক্ষাক্রমের ‘যথার্থ’ মূল্যায়ন হবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘তুলনামূলক অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিক্ষকদের মাস্টার ট্রেইনার বানানো হয়। তাদের যদি নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর ধারণা পেতে ছয় দিন প্রশিক্ষণ নিতে হয় তারা কীভাবে সাধারণ শিক্ষকদের তা পাঁচদিনে যথাযথ ধারণা দেবেন?’ ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সাবেক এই অধ্যক্ষ বলেন, ‘শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মেধা, দক্ষতা, শিখন ও যোগ্যতার যথার্থ মূল্যায়ন ভালো ফল দেবে না। আমরা যখন সৃজনশীল বিষয় চালু করেছিলাম, তখন শিক্ষক মাস্টার ট্রেইনারদের ১২ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। তাদের দিয়েই সাধারণ শিক্ষকদের তিনদিন বা পাঁচদিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। এর ফলে সৃজনশীল শিক্ষা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ শিক্ষকরাই তা ঠিকমত বুঝতে পারেনি।’
এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, সারাদেশের মোট ৪৩২টি উপজেলা বা কেন্দ্রে একযোগে শিক্ষক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এর আগে ‘কোর ট্রেইনার’ (প্রশিক্ষকের প্রশিক্ষক) দিয়ে ছয় দিনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এক হাজার ৫৬ জন মাস্টার ট্রেইনার (শিক্ষক প্রশিক্ষক) তৈরি করা হয়। তারা প্রতি উপজেলা থেকে ‘বাছাই করা’ ৩৩ জন শিক্ষককে (মোট ১৭ হাজার ২০০ জন) ছয় দিনের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তারাই আজ থেকে সাধারণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন।
মাউশির তথ্য অনুযায়ী, ৬ ও ৭ জানুয়ারি, ১৩ জানুয়ারি (শুক্রবার) ও ১৪ জানুয়ারি এবং ১৫ জানুয়ারি (রোববার) মোট পাঁচ দিন নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর প্রশিক্ষণ পাবেন শিক্ষকরা।
প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলবে। দুপুরের মধ্যাহ্ন ভোজ ও নামাজের বিরতি এক ঘণ্টা এবং ১৫ মিনিট করে দুই দফায় মোট ৩০ মিনিটের রিফ্রেশমেন্টের বিরতি থাকবে। বিধি মোতাবেক ভ্যাট এবং কর কর্তন করে সব প্রশিক্ষণার্থীকে দুপুরের খাবারের টাকা নগদ দেয়া হবে।
প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু দিন সকাল ১১টার মধ্যে প্রশিক্ষণার্থীদের স্কিম কর্তৃক সরবরাহকৃত রেজিস্ট্রেশন শিট পূরণপূর্বক উপস্থিত মোট প্রশিক্ষণার্থীর তালিকা সংশ্লিষ্ট জেলা শিক্ষা অফিসে পাঠাতে হবে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের। তা ইমেইলে বা ‘ডিসেমিনেশন অফ নিউ কারিকুলাম স্কিমে’ ই-মেইলে পাঠাতে হবে।
নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই ছাপায় বিলম্ব
২০২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হয়েছে। নতুন শিক্ষাবর্ষের এক সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষার্থী পাঠ্যবই হাতে পায়নি।
এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বৃহস্পতিবার (৫ জানুয়ারি) সংবাদকে বলেন, এখন পর্যন্ত মাধ্যমিকের ৮২ শতাংশের বেশি এবং প্রাথমিকের ৮০ শতাংশের মতো বই ছাপা শেষ হয়েছে। বাকি বইও দ্রুততম সময়ের মধ্য উপজেলা পর্যায়ে পাঠানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। পুরোদমে ছাপা, বাঁধাই ও বিতরণ কার্যক্রম চলছে।
চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পাঠ্যবই মুদ্রণ কার্যক্রম সম্পন্ন হতে পারে বলে গত ৪ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানিয়েছেন। যদিও গত ১ জানুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন জানান, পাঠ্যবই ছাপা শেষ হতে একমাস লাগবে।
পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে এই বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যে শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ হচ্ছে। অর্থ সংকট, সমন্বয়নহীনতা ও কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে এতদিন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জটিলতায় পড়েছিল।
প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষকদের সম্মানী
প্রতিদিনের প্রশিক্ষণের জন্য ৫০০ টাকা করে সম্মানী এবং দূরবর্তী জেলা থেকে প্রশিক্ষণ নিতে আসা শিক্ষকরা ২৫০ টাকা করে যাতায়াত ভাড়াও পাবেন। সারাদেশের প্রায় দুই লাখ ৮১ হাজার শিক্ষক বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন। সম্মানী, ভ্যানু ভাড়া, আপ্যায়ন এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ কেনা বাবদ সরকারের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
মাউশির প্রশিক্ষণ শাখার পরিচালক ও ‘ডিসেমিনেশন অফ নিউ কারিকুলাম স্কিম’র পরিচালক অধ্যাপক প্রবীর কুমার ভট্টাটার্য জানিয়েছেন, পাঁচ দিন ৪০৮টি উপজেলা ও ২৫টি থানায় প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়েছে। এতে দুই লাখ ৮০ হাজারের বেশি শিক্ষক অংশ নিচ্ছেন।
মাউশি কর্তৃপক্ষ প্রথমে ৬, ৭, ১৩, ১৪ ও ২০ জানুয়ারি প্রশিক্ষণ পরিচালনার নির্দেশনা দিয়েছিল। এরপর একদিনের প্রশিক্ষণের সময় পরিবর্তন করা হয়। ২০ জানুয়ারির প্রশিক্ষণ ১৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে।
মাউশি থেকে জানা গেছে, উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ গত ১৭ ডিসেম্বর শুরু হওয়ার কথা ছিল। যথাসময়ে ‘অর্থের যোগান’ না হওয়ায় সেটি হয়নি। পরবর্তীতে ২৬ ডিসেম্বর এই প্রশিক্ষণ শুরু করার কথা ছিল, তাও হয়নি। এরপর ২৭ ডিসেম্বর এই অনলাইনে শিক্ষক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। কিন্তু বেশিরভাগই শিক্ষকই ওইদিন প্রশিক্ষণের সময়সূচি জানতে পারেনি। ওই সময় ছয়দিনের প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। মাউশির অধীনে বাস্তবায়ন হওয়া ‘সেসিপ’ প্রকল্প থেকে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে।
২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যদান হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে মোট ১০টি করে বই থাকছে। বইগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা, ধর্ম এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।
এরপর ২০২৪ সালে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণী এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণী, ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণী, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে।
সময় স্বল্পতার কারণে এখনই সব বিষয়ের ওপর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে না। প্রাথমিক পর্যায়ে ‘নামমাত্র’ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে অধিকতর প্রশিক্ষণের আওতায় নেয়া হবে বলে মাউশির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
২০১২ সালে সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনা হয়। এর আগে ১৯৯৫ ও ১৯৭৬ সালে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়। সরকার ২০১০ সালে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ প্রণয়ন করলেও এর অনেক কিছুই বাস্তবায়নের বাকি রয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রম
বৃহস্পতিবার, ০৫ জানুয়ারী ২০২৩
দেশের সব স্কুলে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই এখনও পৌঁছেনি। নতুন শিক্ষাক্রমের বই ছাপাও পুরোপুরি শেষ হয়নি। তবে নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষক প্রশিক্ষণ শুরু হচ্ছে আজ। পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন শিক্ষকরা।
মাত্র পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ ‘অভিজ্ঞাভিত্তিক শিখনে ভালো’ ফল দেবে না বলে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। তারা বলেন, যেখানে ‘মাস্টার ট্রেইনার’রা নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর ছয়দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তারা উপজেলাভিত্তিক ‘ট্রেইনার’দেরও ছয় দিনের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এখন উপজেলার ‘ট্রেইনার’রা সাধারণ শিক্ষকদের পাঁচদিনে কীভাবে নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর পূর্ণ ধারণা দেবেন?
শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেবেন সদ্য প্রশিক্ষণ পাওয়া ‘মাস্টার ট্রেইনার বা উপজেলাভিত্তিক ট্রেইনাররা’। তারা ছয় দিনের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ‘কোর ট্রেইনার’দের কাছ থেকে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, মাউশির আঞ্চলিক পরিচালক ও উপপরিচালকদের প্রধান অতিথি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এছাড়া উপজেলার একাডেমিক সুপারভাইজার এবং প্রশিক্ষণ ভেন্যুর প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন। এ ক্ষেত্রে উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার যদি প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি কোর্স সমন্বয়ক হতে পারবেন না।
প্রশিক্ষণ কোর্স আয়োজনের জন্য ভেন্যু নির্বাচন হবে পর্যাপ্ত কক্ষ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত আলো বাতাসের সুবিধা সংবলিত প্রতিষ্ঠানে। নিজ উপজেলা ব্যতীত অন্য উপজেলার প্রশিক্ষকদের জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করার নির্দেশনা দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।
জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও মাউশির প্রশিক্ষণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক তাসলিমা বেগম সংবাদকে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণীকক্ষে মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের ৯৫/৯৬ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। অনেক স্কুলেই দেখা গেছে ২১টি শিক্ষকের পদের ১১টিই শূন্য। সরকারি স্কুলেও শিক্ষক সংকট রয়েছে।’
এই পরিস্থিতিতে কোনভাবেই শ্রেণীকক্ষে নতুন শিক্ষাক্রমের ‘যথার্থ’ মূল্যায়ন হবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘তুলনামূলক অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিক্ষকদের মাস্টার ট্রেইনার বানানো হয়। তাদের যদি নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর ধারণা পেতে ছয় দিন প্রশিক্ষণ নিতে হয় তারা কীভাবে সাধারণ শিক্ষকদের তা পাঁচদিনে যথাযথ ধারণা দেবেন?’ ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সাবেক এই অধ্যক্ষ বলেন, ‘শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মেধা, দক্ষতা, শিখন ও যোগ্যতার যথার্থ মূল্যায়ন ভালো ফল দেবে না। আমরা যখন সৃজনশীল বিষয় চালু করেছিলাম, তখন শিক্ষক মাস্টার ট্রেইনারদের ১২ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। তাদের দিয়েই সাধারণ শিক্ষকদের তিনদিন বা পাঁচদিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। এর ফলে সৃজনশীল শিক্ষা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ শিক্ষকরাই তা ঠিকমত বুঝতে পারেনি।’
এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, সারাদেশের মোট ৪৩২টি উপজেলা বা কেন্দ্রে একযোগে শিক্ষক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এর আগে ‘কোর ট্রেইনার’ (প্রশিক্ষকের প্রশিক্ষক) দিয়ে ছয় দিনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এক হাজার ৫৬ জন মাস্টার ট্রেইনার (শিক্ষক প্রশিক্ষক) তৈরি করা হয়। তারা প্রতি উপজেলা থেকে ‘বাছাই করা’ ৩৩ জন শিক্ষককে (মোট ১৭ হাজার ২০০ জন) ছয় দিনের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তারাই আজ থেকে সাধারণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন।
মাউশির তথ্য অনুযায়ী, ৬ ও ৭ জানুয়ারি, ১৩ জানুয়ারি (শুক্রবার) ও ১৪ জানুয়ারি এবং ১৫ জানুয়ারি (রোববার) মোট পাঁচ দিন নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর প্রশিক্ষণ পাবেন শিক্ষকরা।
প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলবে। দুপুরের মধ্যাহ্ন ভোজ ও নামাজের বিরতি এক ঘণ্টা এবং ১৫ মিনিট করে দুই দফায় মোট ৩০ মিনিটের রিফ্রেশমেন্টের বিরতি থাকবে। বিধি মোতাবেক ভ্যাট এবং কর কর্তন করে সব প্রশিক্ষণার্থীকে দুপুরের খাবারের টাকা নগদ দেয়া হবে।
প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু দিন সকাল ১১টার মধ্যে প্রশিক্ষণার্থীদের স্কিম কর্তৃক সরবরাহকৃত রেজিস্ট্রেশন শিট পূরণপূর্বক উপস্থিত মোট প্রশিক্ষণার্থীর তালিকা সংশ্লিষ্ট জেলা শিক্ষা অফিসে পাঠাতে হবে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের। তা ইমেইলে বা ‘ডিসেমিনেশন অফ নিউ কারিকুলাম স্কিমে’ ই-মেইলে পাঠাতে হবে।
নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই ছাপায় বিলম্ব
২০২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হয়েছে। নতুন শিক্ষাবর্ষের এক সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষার্থী পাঠ্যবই হাতে পায়নি।
এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বৃহস্পতিবার (৫ জানুয়ারি) সংবাদকে বলেন, এখন পর্যন্ত মাধ্যমিকের ৮২ শতাংশের বেশি এবং প্রাথমিকের ৮০ শতাংশের মতো বই ছাপা শেষ হয়েছে। বাকি বইও দ্রুততম সময়ের মধ্য উপজেলা পর্যায়ে পাঠানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। পুরোদমে ছাপা, বাঁধাই ও বিতরণ কার্যক্রম চলছে।
চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পাঠ্যবই মুদ্রণ কার্যক্রম সম্পন্ন হতে পারে বলে গত ৪ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানিয়েছেন। যদিও গত ১ জানুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন জানান, পাঠ্যবই ছাপা শেষ হতে একমাস লাগবে।
পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে এই বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যে শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ হচ্ছে। অর্থ সংকট, সমন্বয়নহীনতা ও কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে এতদিন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জটিলতায় পড়েছিল।
প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষকদের সম্মানী
প্রতিদিনের প্রশিক্ষণের জন্য ৫০০ টাকা করে সম্মানী এবং দূরবর্তী জেলা থেকে প্রশিক্ষণ নিতে আসা শিক্ষকরা ২৫০ টাকা করে যাতায়াত ভাড়াও পাবেন। সারাদেশের প্রায় দুই লাখ ৮১ হাজার শিক্ষক বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন। সম্মানী, ভ্যানু ভাড়া, আপ্যায়ন এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ কেনা বাবদ সরকারের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
মাউশির প্রশিক্ষণ শাখার পরিচালক ও ‘ডিসেমিনেশন অফ নিউ কারিকুলাম স্কিম’র পরিচালক অধ্যাপক প্রবীর কুমার ভট্টাটার্য জানিয়েছেন, পাঁচ দিন ৪০৮টি উপজেলা ও ২৫টি থানায় প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়েছে। এতে দুই লাখ ৮০ হাজারের বেশি শিক্ষক অংশ নিচ্ছেন।
মাউশি কর্তৃপক্ষ প্রথমে ৬, ৭, ১৩, ১৪ ও ২০ জানুয়ারি প্রশিক্ষণ পরিচালনার নির্দেশনা দিয়েছিল। এরপর একদিনের প্রশিক্ষণের সময় পরিবর্তন করা হয়। ২০ জানুয়ারির প্রশিক্ষণ ১৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে।
মাউশি থেকে জানা গেছে, উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ গত ১৭ ডিসেম্বর শুরু হওয়ার কথা ছিল। যথাসময়ে ‘অর্থের যোগান’ না হওয়ায় সেটি হয়নি। পরবর্তীতে ২৬ ডিসেম্বর এই প্রশিক্ষণ শুরু করার কথা ছিল, তাও হয়নি। এরপর ২৭ ডিসেম্বর এই অনলাইনে শিক্ষক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। কিন্তু বেশিরভাগই শিক্ষকই ওইদিন প্রশিক্ষণের সময়সূচি জানতে পারেনি। ওই সময় ছয়দিনের প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। মাউশির অধীনে বাস্তবায়ন হওয়া ‘সেসিপ’ প্রকল্প থেকে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে।
২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যদান হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে মোট ১০টি করে বই থাকছে। বইগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা, ধর্ম এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।
এরপর ২০২৪ সালে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণী এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণী, ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণী, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে।
সময় স্বল্পতার কারণে এখনই সব বিষয়ের ওপর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে না। প্রাথমিক পর্যায়ে ‘নামমাত্র’ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে অধিকতর প্রশিক্ষণের আওতায় নেয়া হবে বলে মাউশির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
২০১২ সালে সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনা হয়। এর আগে ১৯৯৫ ও ১৯৭৬ সালে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়। সরকার ২০১০ সালে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ প্রণয়ন করলেও এর অনেক কিছুই বাস্তবায়নের বাকি রয়েছে।