সোমবার দক্ষিণ গাজা উপত্যকার খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালের বাইরে মুক্তিপ্রাপ্ত প্যালেস্টাইনিদের স্বাগত জানাতে মানুষের ভিড় -এএফপি
প্যালেস্টাইনি ছিটমহল গাজায় হামাস যে নিরাপত্তা অভিযান পরিচালনা করছে তার জন্য তাদের একটি সবুজ সংকেত দেয়া হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন। সোমবার,(১৩ অক্টোবর ২০২৫) এয়ার ফোর্স ওয়ান ফ্লাইটে করে ইসরায়েলে যাওয়ার সময় ট্রাম্প এমন মন্তব্য করেছেন বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে। এর অর্থ এখন গাজার নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব হামাসের।
গাজা যুদ্ধ শেষ করার জন্য ট্রাম্প যে পরিকল্পনা হাজির করেছেন তাতে সম্মতি দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ইসরায়েল ও হামাস। গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে জিম্মি-বন্দী বিনিময়ের মাধ্যমে ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম পর্ব বাস্তবায়িত হচ্ছে।
ট্রাম্পের এই পরিকল্পনার প্রস্তাব অনুযায়ী, গাজা যুদ্ধ শেষ করতে প্যালেস্টাইনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে অবশ্যই নিরস্ত্রীকরণ করতে হবে এবং গাজার শাসন ক্ষমতা থেকে তাদের সরে যেতে হবে। কিন্তু গত শুক্রবার থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর হামাস তাদের সাত হাজার যোদ্ধাকে ডেকে পাঠায় আর গাজায় যে অংশগুলো থেকে ইসরায়েলি বাহিনী সরে গেছে সেখানে নিজেদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন শুরু করে। এসব এলাকায় সামরিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন গভর্নরও নিয়োগ করেছে তারা। হামাস জানিয়েছে, তাদের লক্ষ্য হলো গাজায় নিরাপত্তা শূন্যতা ও লুটপাট ঠেকানো এবং অরাজকতা বন্ধ করা। হামাস পরিচালিত গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তাদের বাহিনীগুলো ছিটমহলটিতে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। ‘প্রতিরোধ বাহিনীর আওতার বাইরে কেউ কোনো সশস্ত্র তৎপরতা চালালে’ তা দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করা হবে বলে সতর্ক করেছে তারা। এয়ার ফোর্স ওয়ানে থাকাকালে এক সাংবাদিক মার্কিন প্রেসিডেন্টকে জানান, হামাস নিজেদের পুলিশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে আর প্রতিদ্বন্দ্বিদের গুলি করছে বলে খবর আসছে। এর জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘তারা সমস্যাগুলো থামাতে চায়। তারা এ ব্যাপারে খোলাখুলিভাবে কথা বলেছে আর আমরা একটি সময়কালের জন্য তাদের অনুমোদন দিয়েছি।’
ট্রাম্প আরও বলেছেন, ‘প্রায় ২০ লাখ মানুষ ধ্বংস করে দেয়া ভবনগুলোতে ফিরে যাচ্ছে। সেখানে অনেক খারাপ কিছু হতে পারে। তাই আমরা চাই এটা হোক- আমরা চাই এটা নিরাপদ হোক। আমার মনে হয় এটা ঠিক হয়ে যাবে। তবে নিশ্চিত কে জানে।’
গাজা যুদ্ধ শেষ হয়েছে: ট্রাম্প
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ছিটমহল গাজায় যুদ্ধ শেষ হয়েছে আর মধ্যপ্রাচ্য ‘স্বাভাবিক’ হতে যাচ্ছে। গতকাল রোববার ওয়াশিংটন ডিসি থেকে উড়ে ইসরায়েল যাওয়ার সময় বিমানে এসব কথা বলেছেন তিনি। খবর রয়টার্সের।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ এয়ারফোর্স ওয়ানে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, ‘যুদ্ধ শেষ, আপনারা তা বুঝতে পারছেন।’ ওই অঞ্চলের (মধ্যপ্রাচ্য) সম্ভাবনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা ধারণা এটি স্বাভাবিক হতে যাচ্ছে।’
যুদ্ধবিরতি যুদ্ধের অবসান ঘটাবে, এমন আশা নিয়ে গাজার হাজারো প্যালেস্টাইনি উত্তরে গাজা সিটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। গত দুই মাস ধরে এই শহরটি ইসরায়েলি হামলার মূল লক্ষ্যস্থল ছিল।
এক টেলিভিশন বিবৃতিতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গতকাল রোববার বলেছেন, ‘আগামীকাল একটি নতুন পথের সূচনা হচ্ছে। এ পথ নির্মাণের, এ পথ ক্ষত সারিয়ে তোলার, এবং আমার আশা- এ পথ হৃদয় একত্রিত করবে।’
ইসরায়েলের কারা পরিষেবা জানিয়েছে, তারা কিছু প্যালেস্টাইনি বন্দীকে কারাগার থেকে অন্য স্থাপনায় সরিয়ে নিয়েছে, সেখান থেকে তাদের মুক্তি দেয়ার কথা রয়েছে। ইসরায়েলের আইন মন্ত্রণালয় ২৫০ জন প্যালেস্টাইনি বন্দীর নাম প্রকাশ করেছে, যারা হত্যাসহ অন্য গুরুতর অপরাধের দায়ে দ-ভোগ করছিলেন। চুক্তি অনুযায়ী এদের মুক্তি দেয়া হচ্ছে।
জীবিত ১৩ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস
প্যালেস্টাইনি ছিটমহল গাজায় বন্দী থাকা জীবিত বাকি ১৩ জিম্মিকে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির হাতে তুলে দিয়েছে হামাস, এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার বরাতে জানিয়েছে রয়টার্স।
সোমবার এসব জিম্মিকে গাজার দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনিস এলাকা থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে বলে খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের। সেখান থেকেই রেডক্রসের গাড়িগুলো তাদের সংগ্রহ করে গাজায় অবস্থানরত ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে তুলে দেবে। এদিন মুক্তি পাওয়া জিম্মিদের দ্বিতীয় দল তারা। জিম্মিদের দ্বিতীয় এই দলটিকে হামাস রেডক্রসের কাছে হস্তান্তর করেছে বলে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী নিশ্চিত করেছে।
এর আগে সোমবার সকালে প্রথম সাত ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেয় হামাস। মুক্তি পাওয়া ওই ইসরায়েলিদের গাজার সীমান্ত পার করে নিজ দেশে নেয়া হয়েছে। সেখানে ইসরায়েলের এক সামরিক ঘাঁটিতে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার করা হয়। এরপর নিজ নিজ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হবেন গাজায় হামাসের বন্দীশালায় ৭৩৮ দিন কাটানোর পর ইসরায়েলে ফেরা এসব জিম্মিরা। নতুন মুক্তি পাওয়া ১৩ জিম্মিকেও একই প্রক্রিয়ায় ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইসরায়েলি জিম্মিদের মধ্যে যারা এখনও বেঁচে আছেন, তাদের বেশির ভাগই সেখানকার দক্ষিণাঞ্চলের কিবুৎজ রেইমের কাছে অনুষ্ঠিত নোভা সংগীত উৎসব থেকে অপহৃত হয়েছিলেন।
জিম্মিদের মধ্যে দুজন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সদস্য। তারা হলেন ম্যাটান আংগ্রেস্ট (২২) ও নিমরড কোহেন (২০)। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর প্রাথমিক সংঘর্ষের সময় হামাস যোদ্ধাদের হাতে তারা ধরা পড়েন। ৪৮ জন জিম্মির মধ্যে ৪ জন বিদেশি। তাদের মধ্যে তানজানিয়ার এক ছাত্র এবং থাইল্যান্ডের দুই শ্রমিককে নিখোঁজ অবস্থায় মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। আর নেপালের ছাত্র বিপিন যোশী এখনও নিখোঁজ।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের ফরেনসিক ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ২৬ জন জিম্মিকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে অংশ নেয়া একজন সেনা সদস্যও আছেন। অন্যরা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় সময় বন্দী হয়েছিলেন। সেদিন হামাস ২৫১ ইসরায়েলিকে জিম্মি করেছিল। অপহরণের সময়ই কিছু জিম্মি নিহত হয়েছিলেন। কয়েকজনকে অপহরণকারীরা হত্যা করেছে। কয়েকজন নিহত হন গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায়।
হামাস জানিয়েছে, লাশগুলো উদ্ধার করতে সময় লাগতে পারে। এজন্য বিশেষ আন্তর্জাতিক টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, যারা মরদেহগুলো শনাক্ত ও উদ্ধারকাজে সহায়তা করবে।
হামাস ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর সংঘর্ষে নিহত ২৭
গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল তা বাস্তবে পরিণত করে গাজা সিটিতে হামাসের নিরাপত্তা বাহিনী স্থানীয় দুগমুশ পরিবারের সশস্ত্র সদস্যদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, এতে অন্তত ২৭ জন নিহত হয়েছেন। বিবিসি জানিয়েছে, প্যালেস্টাইনি ছিটমহলটিতে ইসরায়েলের বড় অভিযানগুলো শেষ হওয়ার পর থেকে এটি গাজায় শুরু হওয়া অন্যতম সবচেয়ে সহিংস অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হামাসের মুখোশ পরা যোদ্ধারা নগরীর জর্ডানীয় হাসপাতালের কাছে ওই পরিবারের বন্দুকধারীদের সঙ্গে গুলি বিনিময় করেছে। হামাস শাসিত গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাদের নিরাপত্তা ইউনিটগুলো ওই বন্দুকধারীদের ঘেরাও করে তাদের আটক করার জন্য তীব্র লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। মন্ত্রণালয়টি জানিয়েছে, ‘একটি মিলিশিয়ার সশস্ত্র হামলায়’ তাদের বাহিনীর আট সদস্য নিহত হয়েছেন।
হামাস পরিচালিত গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তাদের বাহিনীগুলো ছিটমহলটিতে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। ‘প্রতিরোধ বাহিনীর আওতার বাইরে কেউ কোনো সশস্ত্র তৎপরতা চালালে’ তা দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করা হবে বলে সতর্ক করেছে তারা।
গাজার যেসব এলাকা থেকে ইসরায়েলি বাহিনী সরে গেছে সেখানে নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য হামাস তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রায় সাত হাজার সদস্যকে ডেকে পাঠিয়েছিল। প্যালেস্টাইনি স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি এসব এলাকায় পাঁচজন নতুন গভর্নর নিয়োগ করেছে এবং তাদের সবাই সামরিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বলে বিবিসি জানিয়েছে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েল প্যালেস্টাইনের আটক দুই চিকিৎসককে মুক্তি দেবে না। তাদের মধ্যে শিশুবিশেষজ্ঞ হুসাম আবু সাফিয়াও রয়েছেন। হামাসের এক কর্মকর্তা মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে এ তথ্য জানিয়েছেন। গত বছরের ডিসেম্বরে গাজার কামাল আদওয়ান হাসপাতালে ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানের সময় চিকিৎসক সাফিয়াকে মারধর ও অপহরণ করা হয়। কারণ তিনি অবরুদ্ধ রোগীদের ছেড়ে যেতে রাজি হননি। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, সাফিয়াকে ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে আটক রাখা হয়েছে। ‘সম্ভাব্য সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত’ থাকার অভিযোগে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তখন থেকেই চিকিৎসক সাফিয়াকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই আটক রাখা হয়েছে।
বিশ্বনেতাদের সম্মেলন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ‘শান্তি পরিকল্পনা’ মেনে জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হচ্ছে। ট্রাম্পের ওই পরিকল্পনার প্রথম ধাপ অনুযায়ী, গত শুক্রবার গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। এর চতুর্থ দিনে সোমবার মিশরের অবকাশযাপন কেন্দ্র শারম আল-শেখে ‘শান্তি’ সম্মেলনে বসেছেন বিশ্বনেতারা। সেখানে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে ইতোমধ্যে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে, তাতে ট্রাম্প সই করতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। পরে সেদিন থেকেই গাজায় টানা দুই বছর ধরে নৃশংসতা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। ৭ অক্টোবর হামাসের সদস্যরা হামলা চালিয়ে ইসরায়েল থেকে প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যান। এরপর পাল্টা হামলা চালাতে শুরু করে ইসরাইলি বাহিনী। সে হামলা গত দুই বছর ধরে চলেছে। এতে প্রায় ৬৭ হাজারের বেশি প্যালেস্টাইনি নিহত হয়েছেন। এরপর সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট গাজায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য ইসরাইল ও হামাসকে চুক্তি করার অনুরোধ জানান। এরপর গত শুক্রবার মিশরে দুই পক্ষ একটি সমঝোতায় উপনীত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় গাজায় আপাতত শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
সোমবার দক্ষিণ গাজা উপত্যকার খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালের বাইরে মুক্তিপ্রাপ্ত প্যালেস্টাইনিদের স্বাগত জানাতে মানুষের ভিড় -এএফপি
সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫
প্যালেস্টাইনি ছিটমহল গাজায় হামাস যে নিরাপত্তা অভিযান পরিচালনা করছে তার জন্য তাদের একটি সবুজ সংকেত দেয়া হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন। সোমবার,(১৩ অক্টোবর ২০২৫) এয়ার ফোর্স ওয়ান ফ্লাইটে করে ইসরায়েলে যাওয়ার সময় ট্রাম্প এমন মন্তব্য করেছেন বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে। এর অর্থ এখন গাজার নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব হামাসের।
গাজা যুদ্ধ শেষ করার জন্য ট্রাম্প যে পরিকল্পনা হাজির করেছেন তাতে সম্মতি দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ইসরায়েল ও হামাস। গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে জিম্মি-বন্দী বিনিময়ের মাধ্যমে ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম পর্ব বাস্তবায়িত হচ্ছে।
ট্রাম্পের এই পরিকল্পনার প্রস্তাব অনুযায়ী, গাজা যুদ্ধ শেষ করতে প্যালেস্টাইনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে অবশ্যই নিরস্ত্রীকরণ করতে হবে এবং গাজার শাসন ক্ষমতা থেকে তাদের সরে যেতে হবে। কিন্তু গত শুক্রবার থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর হামাস তাদের সাত হাজার যোদ্ধাকে ডেকে পাঠায় আর গাজায় যে অংশগুলো থেকে ইসরায়েলি বাহিনী সরে গেছে সেখানে নিজেদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন শুরু করে। এসব এলাকায় সামরিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন গভর্নরও নিয়োগ করেছে তারা। হামাস জানিয়েছে, তাদের লক্ষ্য হলো গাজায় নিরাপত্তা শূন্যতা ও লুটপাট ঠেকানো এবং অরাজকতা বন্ধ করা। হামাস পরিচালিত গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তাদের বাহিনীগুলো ছিটমহলটিতে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। ‘প্রতিরোধ বাহিনীর আওতার বাইরে কেউ কোনো সশস্ত্র তৎপরতা চালালে’ তা দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করা হবে বলে সতর্ক করেছে তারা। এয়ার ফোর্স ওয়ানে থাকাকালে এক সাংবাদিক মার্কিন প্রেসিডেন্টকে জানান, হামাস নিজেদের পুলিশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে আর প্রতিদ্বন্দ্বিদের গুলি করছে বলে খবর আসছে। এর জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘তারা সমস্যাগুলো থামাতে চায়। তারা এ ব্যাপারে খোলাখুলিভাবে কথা বলেছে আর আমরা একটি সময়কালের জন্য তাদের অনুমোদন দিয়েছি।’
ট্রাম্প আরও বলেছেন, ‘প্রায় ২০ লাখ মানুষ ধ্বংস করে দেয়া ভবনগুলোতে ফিরে যাচ্ছে। সেখানে অনেক খারাপ কিছু হতে পারে। তাই আমরা চাই এটা হোক- আমরা চাই এটা নিরাপদ হোক। আমার মনে হয় এটা ঠিক হয়ে যাবে। তবে নিশ্চিত কে জানে।’
গাজা যুদ্ধ শেষ হয়েছে: ট্রাম্প
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ছিটমহল গাজায় যুদ্ধ শেষ হয়েছে আর মধ্যপ্রাচ্য ‘স্বাভাবিক’ হতে যাচ্ছে। গতকাল রোববার ওয়াশিংটন ডিসি থেকে উড়ে ইসরায়েল যাওয়ার সময় বিমানে এসব কথা বলেছেন তিনি। খবর রয়টার্সের।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ এয়ারফোর্স ওয়ানে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, ‘যুদ্ধ শেষ, আপনারা তা বুঝতে পারছেন।’ ওই অঞ্চলের (মধ্যপ্রাচ্য) সম্ভাবনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা ধারণা এটি স্বাভাবিক হতে যাচ্ছে।’
যুদ্ধবিরতি যুদ্ধের অবসান ঘটাবে, এমন আশা নিয়ে গাজার হাজারো প্যালেস্টাইনি উত্তরে গাজা সিটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। গত দুই মাস ধরে এই শহরটি ইসরায়েলি হামলার মূল লক্ষ্যস্থল ছিল।
এক টেলিভিশন বিবৃতিতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গতকাল রোববার বলেছেন, ‘আগামীকাল একটি নতুন পথের সূচনা হচ্ছে। এ পথ নির্মাণের, এ পথ ক্ষত সারিয়ে তোলার, এবং আমার আশা- এ পথ হৃদয় একত্রিত করবে।’
ইসরায়েলের কারা পরিষেবা জানিয়েছে, তারা কিছু প্যালেস্টাইনি বন্দীকে কারাগার থেকে অন্য স্থাপনায় সরিয়ে নিয়েছে, সেখান থেকে তাদের মুক্তি দেয়ার কথা রয়েছে। ইসরায়েলের আইন মন্ত্রণালয় ২৫০ জন প্যালেস্টাইনি বন্দীর নাম প্রকাশ করেছে, যারা হত্যাসহ অন্য গুরুতর অপরাধের দায়ে দ-ভোগ করছিলেন। চুক্তি অনুযায়ী এদের মুক্তি দেয়া হচ্ছে।
জীবিত ১৩ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস
প্যালেস্টাইনি ছিটমহল গাজায় বন্দী থাকা জীবিত বাকি ১৩ জিম্মিকে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির হাতে তুলে দিয়েছে হামাস, এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার বরাতে জানিয়েছে রয়টার্স।
সোমবার এসব জিম্মিকে গাজার দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনিস এলাকা থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে বলে খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের। সেখান থেকেই রেডক্রসের গাড়িগুলো তাদের সংগ্রহ করে গাজায় অবস্থানরত ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে তুলে দেবে। এদিন মুক্তি পাওয়া জিম্মিদের দ্বিতীয় দল তারা। জিম্মিদের দ্বিতীয় এই দলটিকে হামাস রেডক্রসের কাছে হস্তান্তর করেছে বলে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী নিশ্চিত করেছে।
এর আগে সোমবার সকালে প্রথম সাত ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেয় হামাস। মুক্তি পাওয়া ওই ইসরায়েলিদের গাজার সীমান্ত পার করে নিজ দেশে নেয়া হয়েছে। সেখানে ইসরায়েলের এক সামরিক ঘাঁটিতে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার করা হয়। এরপর নিজ নিজ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হবেন গাজায় হামাসের বন্দীশালায় ৭৩৮ দিন কাটানোর পর ইসরায়েলে ফেরা এসব জিম্মিরা। নতুন মুক্তি পাওয়া ১৩ জিম্মিকেও একই প্রক্রিয়ায় ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইসরায়েলি জিম্মিদের মধ্যে যারা এখনও বেঁচে আছেন, তাদের বেশির ভাগই সেখানকার দক্ষিণাঞ্চলের কিবুৎজ রেইমের কাছে অনুষ্ঠিত নোভা সংগীত উৎসব থেকে অপহৃত হয়েছিলেন।
জিম্মিদের মধ্যে দুজন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সদস্য। তারা হলেন ম্যাটান আংগ্রেস্ট (২২) ও নিমরড কোহেন (২০)। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর প্রাথমিক সংঘর্ষের সময় হামাস যোদ্ধাদের হাতে তারা ধরা পড়েন। ৪৮ জন জিম্মির মধ্যে ৪ জন বিদেশি। তাদের মধ্যে তানজানিয়ার এক ছাত্র এবং থাইল্যান্ডের দুই শ্রমিককে নিখোঁজ অবস্থায় মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। আর নেপালের ছাত্র বিপিন যোশী এখনও নিখোঁজ।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের ফরেনসিক ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ২৬ জন জিম্মিকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে অংশ নেয়া একজন সেনা সদস্যও আছেন। অন্যরা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় সময় বন্দী হয়েছিলেন। সেদিন হামাস ২৫১ ইসরায়েলিকে জিম্মি করেছিল। অপহরণের সময়ই কিছু জিম্মি নিহত হয়েছিলেন। কয়েকজনকে অপহরণকারীরা হত্যা করেছে। কয়েকজন নিহত হন গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায়।
হামাস জানিয়েছে, লাশগুলো উদ্ধার করতে সময় লাগতে পারে। এজন্য বিশেষ আন্তর্জাতিক টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, যারা মরদেহগুলো শনাক্ত ও উদ্ধারকাজে সহায়তা করবে।
হামাস ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর সংঘর্ষে নিহত ২৭
গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল তা বাস্তবে পরিণত করে গাজা সিটিতে হামাসের নিরাপত্তা বাহিনী স্থানীয় দুগমুশ পরিবারের সশস্ত্র সদস্যদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, এতে অন্তত ২৭ জন নিহত হয়েছেন। বিবিসি জানিয়েছে, প্যালেস্টাইনি ছিটমহলটিতে ইসরায়েলের বড় অভিযানগুলো শেষ হওয়ার পর থেকে এটি গাজায় শুরু হওয়া অন্যতম সবচেয়ে সহিংস অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হামাসের মুখোশ পরা যোদ্ধারা নগরীর জর্ডানীয় হাসপাতালের কাছে ওই পরিবারের বন্দুকধারীদের সঙ্গে গুলি বিনিময় করেছে। হামাস শাসিত গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাদের নিরাপত্তা ইউনিটগুলো ওই বন্দুকধারীদের ঘেরাও করে তাদের আটক করার জন্য তীব্র লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। মন্ত্রণালয়টি জানিয়েছে, ‘একটি মিলিশিয়ার সশস্ত্র হামলায়’ তাদের বাহিনীর আট সদস্য নিহত হয়েছেন।
হামাস পরিচালিত গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তাদের বাহিনীগুলো ছিটমহলটিতে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। ‘প্রতিরোধ বাহিনীর আওতার বাইরে কেউ কোনো সশস্ত্র তৎপরতা চালালে’ তা দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করা হবে বলে সতর্ক করেছে তারা।
গাজার যেসব এলাকা থেকে ইসরায়েলি বাহিনী সরে গেছে সেখানে নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য হামাস তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রায় সাত হাজার সদস্যকে ডেকে পাঠিয়েছিল। প্যালেস্টাইনি স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি এসব এলাকায় পাঁচজন নতুন গভর্নর নিয়োগ করেছে এবং তাদের সবাই সামরিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বলে বিবিসি জানিয়েছে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েল প্যালেস্টাইনের আটক দুই চিকিৎসককে মুক্তি দেবে না। তাদের মধ্যে শিশুবিশেষজ্ঞ হুসাম আবু সাফিয়াও রয়েছেন। হামাসের এক কর্মকর্তা মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে এ তথ্য জানিয়েছেন। গত বছরের ডিসেম্বরে গাজার কামাল আদওয়ান হাসপাতালে ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানের সময় চিকিৎসক সাফিয়াকে মারধর ও অপহরণ করা হয়। কারণ তিনি অবরুদ্ধ রোগীদের ছেড়ে যেতে রাজি হননি। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, সাফিয়াকে ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে আটক রাখা হয়েছে। ‘সম্ভাব্য সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত’ থাকার অভিযোগে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তখন থেকেই চিকিৎসক সাফিয়াকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই আটক রাখা হয়েছে।
বিশ্বনেতাদের সম্মেলন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ‘শান্তি পরিকল্পনা’ মেনে জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হচ্ছে। ট্রাম্পের ওই পরিকল্পনার প্রথম ধাপ অনুযায়ী, গত শুক্রবার গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। এর চতুর্থ দিনে সোমবার মিশরের অবকাশযাপন কেন্দ্র শারম আল-শেখে ‘শান্তি’ সম্মেলনে বসেছেন বিশ্বনেতারা। সেখানে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে ইতোমধ্যে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে, তাতে ট্রাম্প সই করতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। পরে সেদিন থেকেই গাজায় টানা দুই বছর ধরে নৃশংসতা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। ৭ অক্টোবর হামাসের সদস্যরা হামলা চালিয়ে ইসরায়েল থেকে প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যান। এরপর পাল্টা হামলা চালাতে শুরু করে ইসরাইলি বাহিনী। সে হামলা গত দুই বছর ধরে চলেছে। এতে প্রায় ৬৭ হাজারের বেশি প্যালেস্টাইনি নিহত হয়েছেন। এরপর সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট গাজায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য ইসরাইল ও হামাসকে চুক্তি করার অনুরোধ জানান। এরপর গত শুক্রবার মিশরে দুই পক্ষ একটি সমঝোতায় উপনীত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় গাজায় আপাতত শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।