মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প গত শনিবার ঘোষণা দিয়েছেন, ভেনেজুয়েলার আকাশসীমা ‘বন্ধ’ বলে বিবেচিত হবে। তবে তিনি এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলেননি। এ ঘোষণার পর ওয়াশিংটন ও কারাকাসের মধ্যকার উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভেনেজুয়েলা বলছে, এমন ঘোষণার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকার জন্য ‘উপনিবেশিক হুমকি’ তৈরি করছে। ভেনেজুয়েলার লাখ লাখ মানুষ উদ্বেগের মধ্যে আছে। সম্ভাব্য হামলা মোকাবিলায় কয়েক সপ্তাহ ধরে ভেনেজুয়েলা নিয়মিত সামরিক মহড়া চালাচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসন গত সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকে ক্যারিবীয় সাগরে সন্দেহজনক মাদকবাহী নৌযানের ওপর ধারাবাহিক হামলা চালিয়েছে। তারা দক্ষিণ ক্যারিবীয় অঞ্চলে বড় আকারে নৌ-সামরিক শক্তি মোতায়েন করেছে। হামলার শিকার হওয়া নৌযানগুলো মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত কি না, সে বিষয়ে ওয়াশিংটন এখনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি। এসব হামলায় অন্তত ৮৩ জন নিহত হয়েছেন।
গত সপ্তাহে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোর ওপর চাপ বৃদ্ধি করতে ওয়াশিংটন ভেনেজুয়েলায় ‘কার্টেল দে লস সোলেস’ নামে পরিচিত গোষ্ঠীকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, তারা মাদক পাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ হিসেবে ভেনেজুয়েলাকে লক্ষ্যবস্তু করছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও মানবাধিকার পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, ওয়াশিংটন মাদুরোকে অবৈধভাবে ক্ষমতাচ্যুত করার পথ তৈরি করতে পারে।
ভেনেজুয়েলার আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণা করার পর এখন কি ট্রাম্প দেশটিতে হামলা চালাবেন? যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান কি আইনগতভাবে যুক্তিযুক্ত হবে? ঠিক কী কারণে মাদুরোর বিরুদ্ধে ট্রাম্প এত কঠোর হচ্ছেন? এমন নানা প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র কি ভেনেজুয়েলার সঙ্গে যুদ্ধ করবে: জানুয়ারিতে ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরোর বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় কথা বলে আসছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে মাদক পাচার ও অভিবাসী ঢলের জন্য ভেনেজুয়েলাকে দায়ী করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার তেল কেনে, এমন দেশগুলোর ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। তিনি মাদুরোকে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেতা’ ঘোষণা করেন এবং তাঁকে গ্রেপ্তারে সহায়ক তথ্য চেয়ে পাঁচ কোটি ডলারের পুরস্কার ঘোষণা করেন। এ পুরস্কারের অর্থের পরিমাণ পূর্বঘোষিত পুরস্কারের দ্বিগুণ।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় ট্রাম্প নিশ্চিত করেছেন, তিনি সিআইএকে ভেনেজুয়েলায় গোপন অভিযান চালানোর অনুমতি দিয়েছেন। তাঁর প্রশাসন ক্যারিবীয় অঞ্চলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড, অন্যান্য যুদ্ধজাহাজ, হাজার হাজার সেনা ও এফ-৩৫ স্টেলথ জেট বিমান মোতায়েন করেছে। বৃহস্পতিবার ট্রাম্প বলেছেন, দেশটির ভেতরে শিগগিরই স্থল অভিযান চালানো হতে পারে।
পররাষ্ট্রনীতি–বিষয়ক বিশ্লেষকদের মতে, ভেনেজুয়েলা সরকারের প্রতি ট্রাম্পের আগ্রাসী নীতির মূল কারণ হলো কারাকাসের বিশাল তেলভান্ডার। এখানেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেলের মজুত আছে বলে মনে করা হয়। তা ছাড়া এমন আগ্রাসী নীতির মধ্য দিয়ে পশ্চিম গোলার্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চান ট্রাম্প।
নিউইয়র্ক টাইমস ও দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভেনেজুয়েলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উত্তেজনা চলার মধ্যে ট্রাম্প গত সপ্তাহে মাদুরোর সঙ্গে কথা বলেছেন। কার্টেল দে লস সোলেসকে যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করার আগে এ আলাপ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, মাদুরো কার্টেল দে লস সোলেসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। গত ২৫ নভেম্বর এয়ার ফোর্স ওয়ান উড়োজাহাজে সাংবাদিকেরা ট্রাম্পকে প্রশ্ন করেন, তিনি কি মাদুরোর সঙ্গে কথা বলার পরিকল্পনা করছেন কি না। ট্রাম্প তখন বলেন, ‘আমি হয়তো তাঁর সঙ্গে কথা বলব। দেখব, কী হয়। আমরা এটা নিয়ে বিভিন্ন কর্মীর সঙ্গে আলোচনা করছি। হয়তো কথা বলব।’ সাংবাদিকেরা জিজ্ঞাসা করেন, ট্রাম্প কেন ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’-এর নেতার সঙ্গে কথা বলতে চান? জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘যদি আমরা জীবন বাঁচাতে পারি, তাহলে সহজ উপায়ে কাজ করাটা ঠিক আছে। আর যদি কঠিন উপায়ে করতে হয়, তা–ও ঠিক আছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পদক্ষেপ কি আইনগতভাবে বৈধ: ট্রাম্প প্রশাসনের সমালোচকেরা বলছেন, এই সামরিক পদক্ষেপ মার্কিন সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন উভয়েরই লঙ্ঘন। মানবাধিকার পর্যবেক্ষক ও আইনি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জাহাজে হামলার ঘটনা ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ ও ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’-এর শামিল।
ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেগসেথ সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ক্যারিবীয় সাগরে কোনো জাহাজ মাদক বহন করছে বলে সন্দেহ হলেই যেন সেখানে থাকা সব যাত্রীর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। হেগসেথ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি প্রতিবেদনটিকে ‘মিথ্যা সংবাদ’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর দাবি, দেশ রক্ষায় লড়াইরত মার্কিন সেনাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতেই এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। ক্যারিবীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের চালানো বিভিন্ন হামলাকে ‘আইনগতভাবে বৈধ’ বলেও দাবি করেছেন তিনি।
জাহাজে হামলার ঘটনা নিয়ে মার্কিন কংগ্রেস শনিবার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসন ভেনেজুয়েলায় ‘কার্টেল দে লস সোলেস’ গোষ্ঠীকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করেছে। এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন বোঝাতে চাইছে যে এটি আর দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধ নয় যে এর জন্য কংগ্রেসের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। বরং এটি অরাষ্ট্রীয় কোনো সত্তার বিরুদ্ধে চালানো সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান।
যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, কার্টেল দে লস সোলেস মাদক পাচারের সঙ্গে যুক্ত এবং ভেনেজুয়েলার নেতা মাদুরো এর নেতৃত্ব দেন। ভেনেজুয়েলায় ১৯৯০-এর দশকে কার্টেল দে লস সোলেসের উত্থান ঘটে। কার্টেল দে লস সোলেস দিয়ে ভেনেজুয়েলার সামরিক কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মকর্তাদের যাঁরা দুর্নীতি ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িত, তাঁদের বোঝানো হয়।
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্টের প্রতিক্রিয়া কী: ভেনেজুয়েলার আকাশসীমা বন্ধ বিবেচিত হবে বলে ট্রাম্প যে ঘোষণা দিয়েছেন, তার নিন্দা জানিয়েছে কারাকাস। ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ট্রাম্প এ ধরনের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ভেনেজুয়েলার আকাশসীমার সার্বভৌমত্বের ওপর প্রভাব ফেলতে চাইছেন। তিনি ট্রাম্পের এমন পদক্ষেপকে ভেনেজুয়েলার জনগণের ওপর আরেকটি অবৈধ ও অন্যায্য আগ্রাসন বলে উল্লেখ করেছেন।
মাদুরো জুলাইয়ের নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু ওয়াশিংটন তাঁকে স্বীকৃতি দেয়নি। মাদুরো শান্তির আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি যুদ্ধকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সব সময় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রকাশ্যে শান্তি ও সমঝোতার পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। স্প্যানিশ ও ইংরেজি মিশিয়ে মাদুরো বলেছেন, যুদ্ধ নয়ৃ চিরতরে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক। ১৫ নভেম্বর সমর্থকদের নিয়ে আয়োজিত এক সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় জন লেননের গাওয়া ‘ইমাজিন’ গান থেকে কিছু কথা উদ্ধৃত করেন মাদুরো। বলেন, জন লেনন যেমনটা বলতেন, ‘শান্তির জন্য সবকিছু করো। সব মানুষের কথা ভাবো।’ দুই দিন পর মাদুরো বললেন, হ্যাঁ, আলোচনা হোক, সৌজন্য সাক্ষাৎ হোক, শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক। যুদ্ধ নয়, কখনোই যুদ্ধ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত সপ্তাহে মাদুরো বলেছেন, কোনো ‘সাম্রাজ্যবাদী হুমকি’ তৈরি হলে তিনি দেশ রক্ষায় লড়াই করবেন। ফুয়ের্তে তিউনা সামরিক একাডেমিতে উপস্থিত মানুষদের উদ্দেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় মাদুরো পুরোপুরি সামরিক পোশাকে ছিলেন। তিনি তখন ভেনেজুয়েলার জাতীয় নায়ক সিমন বলিভারের ব্যবহৃত একটি তলোয়ার হাতে নিয়ে নাড়াচ্ছিলেন।
ট্রাম্পের মাদুরোবিরোধী নীতির কারণ কী: পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক বিশ্লেষকদের মতে, ভেনেজুয়েলা সরকারের প্রতি ট্রাম্পের আগ্রাসী নীতির মূল কারণ হলো কারাকাসের বিশাল তেলভান্ডার। এখানেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেলের মজুত আছে বলে মনে করা হয়। তা ছাড়া এমন আগ্রাসী নীতির মধ্য দিয়ে পশ্চিম গোলার্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চান ট্রাম্প। লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান সালভাদর সান্তিনো রেজিলমে বলেন, ওয়াশিংটন চায়, ভেনেজুয়েলা যেন চীন, রাশিয়া বা ইরানের বদলে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলে।
১৯৭০-এর দশকে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্য মিত্র বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু ১৯৯৮ সালে ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুগো চাভেজ ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টিই বর্তমানে ভেনেজুয়েলার শাসনক্ষমতায় আছে। ২০০২ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টার পর চাভেজ যুক্তরাষ্ট্রের মাদকবিরোধী সংস্থাকে সহযোগিতা বন্ধ করে দেন এবং মার্কিন সামরিক উপদেষ্টাদের বহিষ্কার করেন। তেল খাতকে জাতীয়করণের পর এক্সনমোবিল ও কনোকোফিলিপসের মতো বড় বড় মার্কিন কোম্পানিকে দেশ থেকে বের করে দেন। তবে আরেক মার্কিন প্রতিষ্ঠান শেভরন এখনো ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মঙ্গলবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৫
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প গত শনিবার ঘোষণা দিয়েছেন, ভেনেজুয়েলার আকাশসীমা ‘বন্ধ’ বলে বিবেচিত হবে। তবে তিনি এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলেননি। এ ঘোষণার পর ওয়াশিংটন ও কারাকাসের মধ্যকার উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভেনেজুয়েলা বলছে, এমন ঘোষণার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকার জন্য ‘উপনিবেশিক হুমকি’ তৈরি করছে। ভেনেজুয়েলার লাখ লাখ মানুষ উদ্বেগের মধ্যে আছে। সম্ভাব্য হামলা মোকাবিলায় কয়েক সপ্তাহ ধরে ভেনেজুয়েলা নিয়মিত সামরিক মহড়া চালাচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসন গত সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকে ক্যারিবীয় সাগরে সন্দেহজনক মাদকবাহী নৌযানের ওপর ধারাবাহিক হামলা চালিয়েছে। তারা দক্ষিণ ক্যারিবীয় অঞ্চলে বড় আকারে নৌ-সামরিক শক্তি মোতায়েন করেছে। হামলার শিকার হওয়া নৌযানগুলো মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত কি না, সে বিষয়ে ওয়াশিংটন এখনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি। এসব হামলায় অন্তত ৮৩ জন নিহত হয়েছেন।
গত সপ্তাহে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোর ওপর চাপ বৃদ্ধি করতে ওয়াশিংটন ভেনেজুয়েলায় ‘কার্টেল দে লস সোলেস’ নামে পরিচিত গোষ্ঠীকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, তারা মাদক পাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ হিসেবে ভেনেজুয়েলাকে লক্ষ্যবস্তু করছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও মানবাধিকার পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, ওয়াশিংটন মাদুরোকে অবৈধভাবে ক্ষমতাচ্যুত করার পথ তৈরি করতে পারে।
ভেনেজুয়েলার আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণা করার পর এখন কি ট্রাম্প দেশটিতে হামলা চালাবেন? যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান কি আইনগতভাবে যুক্তিযুক্ত হবে? ঠিক কী কারণে মাদুরোর বিরুদ্ধে ট্রাম্প এত কঠোর হচ্ছেন? এমন নানা প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র কি ভেনেজুয়েলার সঙ্গে যুদ্ধ করবে: জানুয়ারিতে ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরোর বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় কথা বলে আসছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে মাদক পাচার ও অভিবাসী ঢলের জন্য ভেনেজুয়েলাকে দায়ী করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার তেল কেনে, এমন দেশগুলোর ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। তিনি মাদুরোকে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেতা’ ঘোষণা করেন এবং তাঁকে গ্রেপ্তারে সহায়ক তথ্য চেয়ে পাঁচ কোটি ডলারের পুরস্কার ঘোষণা করেন। এ পুরস্কারের অর্থের পরিমাণ পূর্বঘোষিত পুরস্কারের দ্বিগুণ।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় ট্রাম্প নিশ্চিত করেছেন, তিনি সিআইএকে ভেনেজুয়েলায় গোপন অভিযান চালানোর অনুমতি দিয়েছেন। তাঁর প্রশাসন ক্যারিবীয় অঞ্চলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড, অন্যান্য যুদ্ধজাহাজ, হাজার হাজার সেনা ও এফ-৩৫ স্টেলথ জেট বিমান মোতায়েন করেছে। বৃহস্পতিবার ট্রাম্প বলেছেন, দেশটির ভেতরে শিগগিরই স্থল অভিযান চালানো হতে পারে।
পররাষ্ট্রনীতি–বিষয়ক বিশ্লেষকদের মতে, ভেনেজুয়েলা সরকারের প্রতি ট্রাম্পের আগ্রাসী নীতির মূল কারণ হলো কারাকাসের বিশাল তেলভান্ডার। এখানেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেলের মজুত আছে বলে মনে করা হয়। তা ছাড়া এমন আগ্রাসী নীতির মধ্য দিয়ে পশ্চিম গোলার্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চান ট্রাম্প।
নিউইয়র্ক টাইমস ও দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভেনেজুয়েলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উত্তেজনা চলার মধ্যে ট্রাম্প গত সপ্তাহে মাদুরোর সঙ্গে কথা বলেছেন। কার্টেল দে লস সোলেসকে যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করার আগে এ আলাপ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, মাদুরো কার্টেল দে লস সোলেসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। গত ২৫ নভেম্বর এয়ার ফোর্স ওয়ান উড়োজাহাজে সাংবাদিকেরা ট্রাম্পকে প্রশ্ন করেন, তিনি কি মাদুরোর সঙ্গে কথা বলার পরিকল্পনা করছেন কি না। ট্রাম্প তখন বলেন, ‘আমি হয়তো তাঁর সঙ্গে কথা বলব। দেখব, কী হয়। আমরা এটা নিয়ে বিভিন্ন কর্মীর সঙ্গে আলোচনা করছি। হয়তো কথা বলব।’ সাংবাদিকেরা জিজ্ঞাসা করেন, ট্রাম্প কেন ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’-এর নেতার সঙ্গে কথা বলতে চান? জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘যদি আমরা জীবন বাঁচাতে পারি, তাহলে সহজ উপায়ে কাজ করাটা ঠিক আছে। আর যদি কঠিন উপায়ে করতে হয়, তা–ও ঠিক আছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পদক্ষেপ কি আইনগতভাবে বৈধ: ট্রাম্প প্রশাসনের সমালোচকেরা বলছেন, এই সামরিক পদক্ষেপ মার্কিন সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন উভয়েরই লঙ্ঘন। মানবাধিকার পর্যবেক্ষক ও আইনি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জাহাজে হামলার ঘটনা ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ ও ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’-এর শামিল।
ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেগসেথ সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ক্যারিবীয় সাগরে কোনো জাহাজ মাদক বহন করছে বলে সন্দেহ হলেই যেন সেখানে থাকা সব যাত্রীর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। হেগসেথ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি প্রতিবেদনটিকে ‘মিথ্যা সংবাদ’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর দাবি, দেশ রক্ষায় লড়াইরত মার্কিন সেনাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতেই এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। ক্যারিবীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের চালানো বিভিন্ন হামলাকে ‘আইনগতভাবে বৈধ’ বলেও দাবি করেছেন তিনি।
জাহাজে হামলার ঘটনা নিয়ে মার্কিন কংগ্রেস শনিবার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসন ভেনেজুয়েলায় ‘কার্টেল দে লস সোলেস’ গোষ্ঠীকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করেছে। এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন বোঝাতে চাইছে যে এটি আর দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধ নয় যে এর জন্য কংগ্রেসের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। বরং এটি অরাষ্ট্রীয় কোনো সত্তার বিরুদ্ধে চালানো সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান।
যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, কার্টেল দে লস সোলেস মাদক পাচারের সঙ্গে যুক্ত এবং ভেনেজুয়েলার নেতা মাদুরো এর নেতৃত্ব দেন। ভেনেজুয়েলায় ১৯৯০-এর দশকে কার্টেল দে লস সোলেসের উত্থান ঘটে। কার্টেল দে লস সোলেস দিয়ে ভেনেজুয়েলার সামরিক কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মকর্তাদের যাঁরা দুর্নীতি ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িত, তাঁদের বোঝানো হয়।
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্টের প্রতিক্রিয়া কী: ভেনেজুয়েলার আকাশসীমা বন্ধ বিবেচিত হবে বলে ট্রাম্প যে ঘোষণা দিয়েছেন, তার নিন্দা জানিয়েছে কারাকাস। ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ট্রাম্প এ ধরনের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ভেনেজুয়েলার আকাশসীমার সার্বভৌমত্বের ওপর প্রভাব ফেলতে চাইছেন। তিনি ট্রাম্পের এমন পদক্ষেপকে ভেনেজুয়েলার জনগণের ওপর আরেকটি অবৈধ ও অন্যায্য আগ্রাসন বলে উল্লেখ করেছেন।
মাদুরো জুলাইয়ের নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু ওয়াশিংটন তাঁকে স্বীকৃতি দেয়নি। মাদুরো শান্তির আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি যুদ্ধকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সব সময় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রকাশ্যে শান্তি ও সমঝোতার পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। স্প্যানিশ ও ইংরেজি মিশিয়ে মাদুরো বলেছেন, যুদ্ধ নয়ৃ চিরতরে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক। ১৫ নভেম্বর সমর্থকদের নিয়ে আয়োজিত এক সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় জন লেননের গাওয়া ‘ইমাজিন’ গান থেকে কিছু কথা উদ্ধৃত করেন মাদুরো। বলেন, জন লেনন যেমনটা বলতেন, ‘শান্তির জন্য সবকিছু করো। সব মানুষের কথা ভাবো।’ দুই দিন পর মাদুরো বললেন, হ্যাঁ, আলোচনা হোক, সৌজন্য সাক্ষাৎ হোক, শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক। যুদ্ধ নয়, কখনোই যুদ্ধ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত সপ্তাহে মাদুরো বলেছেন, কোনো ‘সাম্রাজ্যবাদী হুমকি’ তৈরি হলে তিনি দেশ রক্ষায় লড়াই করবেন। ফুয়ের্তে তিউনা সামরিক একাডেমিতে উপস্থিত মানুষদের উদ্দেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় মাদুরো পুরোপুরি সামরিক পোশাকে ছিলেন। তিনি তখন ভেনেজুয়েলার জাতীয় নায়ক সিমন বলিভারের ব্যবহৃত একটি তলোয়ার হাতে নিয়ে নাড়াচ্ছিলেন।
ট্রাম্পের মাদুরোবিরোধী নীতির কারণ কী: পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক বিশ্লেষকদের মতে, ভেনেজুয়েলা সরকারের প্রতি ট্রাম্পের আগ্রাসী নীতির মূল কারণ হলো কারাকাসের বিশাল তেলভান্ডার। এখানেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেলের মজুত আছে বলে মনে করা হয়। তা ছাড়া এমন আগ্রাসী নীতির মধ্য দিয়ে পশ্চিম গোলার্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চান ট্রাম্প। লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান সালভাদর সান্তিনো রেজিলমে বলেন, ওয়াশিংটন চায়, ভেনেজুয়েলা যেন চীন, রাশিয়া বা ইরানের বদলে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলে।
১৯৭০-এর দশকে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্য মিত্র বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু ১৯৯৮ সালে ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুগো চাভেজ ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টিই বর্তমানে ভেনেজুয়েলার শাসনক্ষমতায় আছে। ২০০২ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টার পর চাভেজ যুক্তরাষ্ট্রের মাদকবিরোধী সংস্থাকে সহযোগিতা বন্ধ করে দেন এবং মার্কিন সামরিক উপদেষ্টাদের বহিষ্কার করেন। তেল খাতকে জাতীয়করণের পর এক্সনমোবিল ও কনোকোফিলিপসের মতো বড় বড় মার্কিন কোম্পানিকে দেশ থেকে বের করে দেন। তবে আরেক মার্কিন প্রতিষ্ঠান শেভরন এখনো ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে।