অনুমোদনহীন অনেক রেস্তোরাঁয় সজ্জিত রাজধানীর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে অগ্নিকাণ্ডে হুঁশ ফিরল সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর। সোমবার (৪ মার্চ) পৃথকভাবে অভিযান শুরু করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এর আগেই পৃথক অভিযান চালায় পুলিশও।
রাজউক অভিযান চালিয়ে ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কের গাউসিয়া টুইন পিক ভবনের ছাদে একটি রেস্তোরাঁ ভেঙে ফেলে। ওই ভবনের ১২টি রেস্তোরাঁ সিলগালাও করে দিয়েছে। পৃথক অভিযানে জিগাতলার ‘কেয়ারি ক্রিসেন্ট প্লাজা’ সিলগালা করে দেয় ডিএসসিসি। ১৫ তলার এই ভবনে ১১টি রেস্তোরাঁ ছিল।
এছাড়া গতকাল রোববার রাতে গুলশান, মিরপুর ও উত্তরার প্রায় অর্ধশত রেস্তোরাঁয় অভিযান চালায় পুলিশ। ওই অভিযানে কয়েকটি রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক, কর্মীসহ অন্তত ২২ জনকে আটক করে পুলিশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পৃথকভাবে অভিযান অব্যাহত থাকবে।
যদিও এমন পদক্ষেপকে ‘খণ্ডিত’ হিসেবে দেখছেন একজন নগর পরিকল্পনাবিদ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান সোমবার সংবাদকে বলেন, ‘প্রত্যেকটা দুর্ঘটনার পরই এমন তৎপরতা লক্ষ্য করে আসছি। কিন্তু কয়েকদিন গেলে আবার যেই সেই হয়ে যায়। তখন আর কারো এ নিয়ে মাথা ব্যথা থাকে না। এবারও ব্যতিক্রম কিছু হবে কিনা সেটাই প্রশ্ন।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশ অভিযান চালিয়ে রেস্তোরাঁর কিছু সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আটক করেছে। অথচ রেস্তোরাঁর মালিক বা ভবনের মালিকদের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেই। রাজউক সিটি করপোরেশনও অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু এই রেস্তোরাঁ কীভাবে গড়ে উঠল, কারা এর পেছনে, এগুলোর মালিক কারা, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। এগুলো আসলে খণ্ডিত অভিযান।’
‘বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের পর গণমাধ্যমে লেখালিখি হচ্ছে। এ কারণেই এমন অভিযান চালানো হচ্ছে। এটি অতীতেও ঘটেছে। এবারও হয়ত এমনই হবে।’
গত বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের একটি ভবনে অগ্নিকা-ের ঘটনায় ৪৬ জন প্রাণ হারান। ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ নামের সাত তলা ওই ভবনে একটি তলা ছাড়া বাকি সব তলায় রেস্তোরাঁ ছিল। এতো রেস্তোরাঁর কারণেই আগুন ভয়াবহ রূপ নেয় বলে অনেকেরই ধারণা।
ফায়ার সার্ভিসও জানায়, ভবনটিতে কোনো অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে তিনবার চিঠিও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। রাজউকও বলছে, ভবনটি নির্মাণেই অনিয়ম ছিল। ব্যবহারেরও অনুমতি ছিল না। এ কারণে নোটিশ দেয়ার পাশাপাশি অভিযানও চালিয়েছিল।
দেখা যায় রাজধানী জুড়েই এমন ভবন রয়েছে। বিশেষজ্ঞদেরও মত, রেস্তোরাঁয় ঠাঁসা এমন ভবনগুলো অনেকটা ‘টাইম বোমা’র মতো। কিন্তু এই নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলে নগরবিদরা বলছেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই অভিযান চালাচ্ছে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তরগুলো।
টুইন পিকের রুফটপ রেস্তোরাঁ গুঁড়িয়ে দিল রাজউক, ১২ রেস্তোরাঁ সিলগালা
রাজধানীর ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কের গাউসিয়া টুইন পিক ভবন। বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি’র মতো এই এক ভবনেই পরিচালিত হচ্ছে ১২টি রেস্তোরাঁ। ছিল একটি রুফটপ রেস্তোরাঁও। তবে সোমবার অভিযান চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় রুফটপ রেস্তোরাঁটি। ভবনের অন্য রেস্তোরাঁগুলোও সিলগালা করে দেয়া হয়। আর যেসব রেস্তোরাঁয় কর্তৃপক্ষ পাওয়া যায়, তাদের জরিমানাও করা হয়। রাজউক জানায়, তাদের এমন অভিযান চলমান থাকবে।
এদিন বেলা ১১টার পর অভিযান শুরু হয়। এরআগে ভবনের রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ ছিল। রাজউকের অঞ্চল-৩ এর পরিচালক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজিনা সারোয়ার এই অভিযান পরিচালনা করেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, ভবনটিতে অফিস করার অনুমতি থাকলেও রেস্তোরাঁ করার অনুমতি ছিল না। গতবছর ২৩ মে এই ভবন পরিদর্শনে এসে নোটিশ দিয়েছিল রাজউক।
ম্যাজিস্ট্রেট তাজিনা সারোয়ার বলেন, ‘টুইন পিক ভবনটিতে এফ-১ এর অনুমোদন ছিল বলে জানিয়েছেন। অর্থাৎ ভবনটি অফিস হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু রেস্তোরাঁ হিসেবে নয়। এছাড়া কোনো রেস্তোরাঁই ব্যবসার জন্য জেলা প্রশাসনের অনুমোদন নেয়নি। যেসব সিলগালা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেগুলোর আদেশ ঢাকা জেলা প্রশাসনে বরাবর পাঠানো হবে। তারা পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেবে।’
অভিযানে স্পাইস হারবস নামের একটি রেস্তোরাঁকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মালিক রাইসুল আলম খান বলেন, ‘রেস্টুরেন্ট করা যাবে না, তা জানতাম না। জেলা প্রশাসনের অনুমোদনও জানা ছিল না। বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে রেস্তোরাঁ করেছি। আমাদের দোষটা কোথায়? এখন আমরা কী করব?’
গাউসিয়া টুইন পিক ভবনের ডেভেলপার কর্তৃপক্ষের লজিস্টিক ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘স্থপতি যেভাবে ভবন নকশা করেছেন, সেভাবেই চলছে। তারা বাণিজ্যিক হিসেবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে রেস্তোরাঁর অনুমোদন নিয়েছেন। তবে সেখানে রাজউকের নকশার শর্ত ছিল। রাজউক এফ-১ এর অনুমোদন দেয়। সারা ঢাকায় এফ-১ হলেও রেস্তোরাঁ করা যায়, সেটা স্থপতিই বলেছেন।’
লজিস্টিক ম্যানেজার আরও জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শুধু এই ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। তারপর এটি ভবন মালিকদের বুঝিয়ে দেয়া হয়। ভবনের মালিক বেশ কয়েকজন। তারা নিজেদের মতো করে রেস্তোরাঁ ভাড়া দিয়েছেন।
১৫ তলা ভবনে ১১ রেস্তোরাঁ, সিলগালা জিগাতলার কেয়ারি প্লাজা
এদিকে রাজধানীর জিগাতলায় সাতমসজিদ সড়কের পাশের ১৫ তলার কেয়ারি ক্রিসেন্ট প্লাজাটিতে ১১টি রেস্তোরাঁ খোজে পায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। পরে অগ্নিনিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে ভবনটি সিলগালা করে দেয়া হয়।
ডিএসসিসি জানায়, ওই ভবনের দুটো সিঁড়ির একটি বন্ধ, সেখানে রাখা হয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার। আর ভবনের ছাদে তালা লাগানো। ভবনে আগুন লাগলে কারও পক্ষে ছাদে যাওয়া সম্ভব নয়।
সোমবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলে ভবনটিতে ওই অবস্থা দেখা যায়।
ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এটি ১৫ তলা ভবন। ১২ তলা পর্যন্ত প্রায় সব তলাতেই রেস্তোরাঁ আছে। এ ছাড়া দুটো ভবনে ভিসা প্রসেসিং অফিস আছে। ভবনের দুটো সিঁড়ি; তার একটি বন্ধ, ব্যবহার উপযোগী না। সেখানে গ্যাসের সিলিন্ডার রাখা। ছাদও বন্ধ, দুর্ঘটনা ঘটলে কেউ সেখানে যেতে পারবে না।’
ভবনটি সিলগালা করা ছাড়াও সেখানে থাকা ভিসা প্রসেসিং অফিস থেকে ৩ জন কর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানান ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, তারা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত, তাই তাদের আটক ও জরিমানা করা হয়েছে। ভবনের রেস্তোরাঁগুলোয় কোনো মালিক বা কর্তৃপক্ষের কাউকে পাওয়া যায়নি।
অভিযানে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও ছিলেন। ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক তানহার ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখানে ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না। তাই ব্যানার টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে।’
অভিযানের পর জিগাতলার কেয়ারি ক্রিসেন্ট প্লাজার সামনে গিয়ে দেখা যায়, ঢোকার মুখেই একটি কাগজ ঝোলানো, তাতে লেখা, ‘সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকবে’।
ঢাকায় অর্ধশত রেস্তোরাঁয় পুলিশের অভিযান
রাজউক ও সিটি করপোরেশনের অভিযান চালানোর আগে রোববার রাতে রাজধানীর গুলশান, ধানমন্ডি, মিরপুর ও উত্তরার প্রায় অর্ধশত রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। ওইদিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এসব খাবারের দোকানে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে কয়েকটি রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক, কর্মীসহ অন্তত ২২ জনকে আটক করেছে পুলিশ।
পুলিশ বলছে, নগরবাসীর নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় রেখে এসব রেস্তোরাঁ ভবনে জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি ও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা রয়েছে কিনা, তা দেখতেই অভিযান চালানো হয়। ধানমন্ডি এলাকার ১৯টি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি না থাকা, সিঁড়ি আটকে রান্নাঘর বসানো ও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা না থাকায় এসব খাবারের দোকানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
ওইদিন রাজধানীর গুলশান এলাকায় প্রায় ১০টি খাবারের দোকানে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। তবে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। উত্তরা এলাকার অন্তত ২০টি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে তিনজনকে আটক করার কথা জানিয়েছে পুলিশ। তাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানানো হয়েছে।
সব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তথ্য অনলাইনে প্রকাশের অনুরোধ
যে উদ্দেশ্যে ভবন তৈরি করা হয়েছে, তা ওই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা, তা যাচাই করতে ঢাকার সব ভবনের তথ্য অনলাইনে দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে নগর-পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)।
সোমবার রাজধানীর বাংলামোটরে সংগঠনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন সংগঠনের নেতারা বলেন, ‘এই তথ্য প্রকাশ করা হলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো সাধারণ মানুষই চিহ্নিত করতে পারবে। সেই সঙ্গে, কোনো ভবনের মালিকের বিরুদ্ধে কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ নোটিশ দিয়ে থাকলে তা ভবনের সামনে টাঙিয়ে রাখা উচিত।’
‘বেইলি রোডের অগ্নিকা- এবং ভবনে জীবনের নিরাপত্তা : বিআইপির পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাবনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের শুধুমাত্র অফিসিয়াল স্পেস হিসেবে ব্যবহারে রাজউকের অনুমোদন ছিল। কিন্তু নিয়ম ভঙ্গ করে এখানে আটটি রেস্টুরেন্ট, একটি জুস বার, কফি শপ ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রীর দোকান ভাড়া দেয়া হয়েছিল। ভবন নির্মাণ বিধিমালা ও নগর পরিকল্পনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে এটা করা হয়েছে।’
লিখিত বক্তব্যে আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘ভবনটিতে কার্যকর কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ও পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ভবনমালিক ও ভবনের ব্যবহারকারীদেরকে বারবার নোটিশ দিয়েই দায় সেরেছে।’
ভবনটিতে কোনো জানালা এবং বাতাস চলাচলের পর্যাপ্ত পথ না থাকায় সর্বাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ভবনটির একমাত্র সিঁড়িটিও গ্যাস সিলিন্ডারে ভরা থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নকশা, নির্মাণ এবং পরিচালনা সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি আইন ও নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন ভবনটির মালিক।’
এ ঘটনায় রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও বিস্ফোরক পরিদপ্তরের দায় থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আগের আগুনের ঘটনায় কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে দায়িত্বে অবহেলার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। একের পর এক এ ধরনের ঘটনার পেছনে এটি আরেকটি বড় কারণ।’
সোমবার, ০৪ মার্চ ২০২৪
অনুমোদনহীন অনেক রেস্তোরাঁয় সজ্জিত রাজধানীর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে অগ্নিকাণ্ডে হুঁশ ফিরল সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর। সোমবার (৪ মার্চ) পৃথকভাবে অভিযান শুরু করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এর আগেই পৃথক অভিযান চালায় পুলিশও।
রাজউক অভিযান চালিয়ে ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কের গাউসিয়া টুইন পিক ভবনের ছাদে একটি রেস্তোরাঁ ভেঙে ফেলে। ওই ভবনের ১২টি রেস্তোরাঁ সিলগালাও করে দিয়েছে। পৃথক অভিযানে জিগাতলার ‘কেয়ারি ক্রিসেন্ট প্লাজা’ সিলগালা করে দেয় ডিএসসিসি। ১৫ তলার এই ভবনে ১১টি রেস্তোরাঁ ছিল।
এছাড়া গতকাল রোববার রাতে গুলশান, মিরপুর ও উত্তরার প্রায় অর্ধশত রেস্তোরাঁয় অভিযান চালায় পুলিশ। ওই অভিযানে কয়েকটি রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক, কর্মীসহ অন্তত ২২ জনকে আটক করে পুলিশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পৃথকভাবে অভিযান অব্যাহত থাকবে।
যদিও এমন পদক্ষেপকে ‘খণ্ডিত’ হিসেবে দেখছেন একজন নগর পরিকল্পনাবিদ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান সোমবার সংবাদকে বলেন, ‘প্রত্যেকটা দুর্ঘটনার পরই এমন তৎপরতা লক্ষ্য করে আসছি। কিন্তু কয়েকদিন গেলে আবার যেই সেই হয়ে যায়। তখন আর কারো এ নিয়ে মাথা ব্যথা থাকে না। এবারও ব্যতিক্রম কিছু হবে কিনা সেটাই প্রশ্ন।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশ অভিযান চালিয়ে রেস্তোরাঁর কিছু সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আটক করেছে। অথচ রেস্তোরাঁর মালিক বা ভবনের মালিকদের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেই। রাজউক সিটি করপোরেশনও অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু এই রেস্তোরাঁ কীভাবে গড়ে উঠল, কারা এর পেছনে, এগুলোর মালিক কারা, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। এগুলো আসলে খণ্ডিত অভিযান।’
‘বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের পর গণমাধ্যমে লেখালিখি হচ্ছে। এ কারণেই এমন অভিযান চালানো হচ্ছে। এটি অতীতেও ঘটেছে। এবারও হয়ত এমনই হবে।’
গত বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের একটি ভবনে অগ্নিকা-ের ঘটনায় ৪৬ জন প্রাণ হারান। ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ নামের সাত তলা ওই ভবনে একটি তলা ছাড়া বাকি সব তলায় রেস্তোরাঁ ছিল। এতো রেস্তোরাঁর কারণেই আগুন ভয়াবহ রূপ নেয় বলে অনেকেরই ধারণা।
ফায়ার সার্ভিসও জানায়, ভবনটিতে কোনো অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে তিনবার চিঠিও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। রাজউকও বলছে, ভবনটি নির্মাণেই অনিয়ম ছিল। ব্যবহারেরও অনুমতি ছিল না। এ কারণে নোটিশ দেয়ার পাশাপাশি অভিযানও চালিয়েছিল।
দেখা যায় রাজধানী জুড়েই এমন ভবন রয়েছে। বিশেষজ্ঞদেরও মত, রেস্তোরাঁয় ঠাঁসা এমন ভবনগুলো অনেকটা ‘টাইম বোমা’র মতো। কিন্তু এই নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলে নগরবিদরা বলছেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই অভিযান চালাচ্ছে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তরগুলো।
টুইন পিকের রুফটপ রেস্তোরাঁ গুঁড়িয়ে দিল রাজউক, ১২ রেস্তোরাঁ সিলগালা
রাজধানীর ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কের গাউসিয়া টুইন পিক ভবন। বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি’র মতো এই এক ভবনেই পরিচালিত হচ্ছে ১২টি রেস্তোরাঁ। ছিল একটি রুফটপ রেস্তোরাঁও। তবে সোমবার অভিযান চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় রুফটপ রেস্তোরাঁটি। ভবনের অন্য রেস্তোরাঁগুলোও সিলগালা করে দেয়া হয়। আর যেসব রেস্তোরাঁয় কর্তৃপক্ষ পাওয়া যায়, তাদের জরিমানাও করা হয়। রাজউক জানায়, তাদের এমন অভিযান চলমান থাকবে।
এদিন বেলা ১১টার পর অভিযান শুরু হয়। এরআগে ভবনের রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ ছিল। রাজউকের অঞ্চল-৩ এর পরিচালক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজিনা সারোয়ার এই অভিযান পরিচালনা করেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, ভবনটিতে অফিস করার অনুমতি থাকলেও রেস্তোরাঁ করার অনুমতি ছিল না। গতবছর ২৩ মে এই ভবন পরিদর্শনে এসে নোটিশ দিয়েছিল রাজউক।
ম্যাজিস্ট্রেট তাজিনা সারোয়ার বলেন, ‘টুইন পিক ভবনটিতে এফ-১ এর অনুমোদন ছিল বলে জানিয়েছেন। অর্থাৎ ভবনটি অফিস হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু রেস্তোরাঁ হিসেবে নয়। এছাড়া কোনো রেস্তোরাঁই ব্যবসার জন্য জেলা প্রশাসনের অনুমোদন নেয়নি। যেসব সিলগালা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেগুলোর আদেশ ঢাকা জেলা প্রশাসনে বরাবর পাঠানো হবে। তারা পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেবে।’
অভিযানে স্পাইস হারবস নামের একটি রেস্তোরাঁকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মালিক রাইসুল আলম খান বলেন, ‘রেস্টুরেন্ট করা যাবে না, তা জানতাম না। জেলা প্রশাসনের অনুমোদনও জানা ছিল না। বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে রেস্তোরাঁ করেছি। আমাদের দোষটা কোথায়? এখন আমরা কী করব?’
গাউসিয়া টুইন পিক ভবনের ডেভেলপার কর্তৃপক্ষের লজিস্টিক ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘স্থপতি যেভাবে ভবন নকশা করেছেন, সেভাবেই চলছে। তারা বাণিজ্যিক হিসেবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে রেস্তোরাঁর অনুমোদন নিয়েছেন। তবে সেখানে রাজউকের নকশার শর্ত ছিল। রাজউক এফ-১ এর অনুমোদন দেয়। সারা ঢাকায় এফ-১ হলেও রেস্তোরাঁ করা যায়, সেটা স্থপতিই বলেছেন।’
লজিস্টিক ম্যানেজার আরও জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শুধু এই ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। তারপর এটি ভবন মালিকদের বুঝিয়ে দেয়া হয়। ভবনের মালিক বেশ কয়েকজন। তারা নিজেদের মতো করে রেস্তোরাঁ ভাড়া দিয়েছেন।
১৫ তলা ভবনে ১১ রেস্তোরাঁ, সিলগালা জিগাতলার কেয়ারি প্লাজা
এদিকে রাজধানীর জিগাতলায় সাতমসজিদ সড়কের পাশের ১৫ তলার কেয়ারি ক্রিসেন্ট প্লাজাটিতে ১১টি রেস্তোরাঁ খোজে পায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। পরে অগ্নিনিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে ভবনটি সিলগালা করে দেয়া হয়।
ডিএসসিসি জানায়, ওই ভবনের দুটো সিঁড়ির একটি বন্ধ, সেখানে রাখা হয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার। আর ভবনের ছাদে তালা লাগানো। ভবনে আগুন লাগলে কারও পক্ষে ছাদে যাওয়া সম্ভব নয়।
সোমবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলে ভবনটিতে ওই অবস্থা দেখা যায়।
ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এটি ১৫ তলা ভবন। ১২ তলা পর্যন্ত প্রায় সব তলাতেই রেস্তোরাঁ আছে। এ ছাড়া দুটো ভবনে ভিসা প্রসেসিং অফিস আছে। ভবনের দুটো সিঁড়ি; তার একটি বন্ধ, ব্যবহার উপযোগী না। সেখানে গ্যাসের সিলিন্ডার রাখা। ছাদও বন্ধ, দুর্ঘটনা ঘটলে কেউ সেখানে যেতে পারবে না।’
ভবনটি সিলগালা করা ছাড়াও সেখানে থাকা ভিসা প্রসেসিং অফিস থেকে ৩ জন কর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানান ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, তারা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত, তাই তাদের আটক ও জরিমানা করা হয়েছে। ভবনের রেস্তোরাঁগুলোয় কোনো মালিক বা কর্তৃপক্ষের কাউকে পাওয়া যায়নি।
অভিযানে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও ছিলেন। ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক তানহার ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখানে ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না। তাই ব্যানার টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে।’
অভিযানের পর জিগাতলার কেয়ারি ক্রিসেন্ট প্লাজার সামনে গিয়ে দেখা যায়, ঢোকার মুখেই একটি কাগজ ঝোলানো, তাতে লেখা, ‘সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকবে’।
ঢাকায় অর্ধশত রেস্তোরাঁয় পুলিশের অভিযান
রাজউক ও সিটি করপোরেশনের অভিযান চালানোর আগে রোববার রাতে রাজধানীর গুলশান, ধানমন্ডি, মিরপুর ও উত্তরার প্রায় অর্ধশত রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। ওইদিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এসব খাবারের দোকানে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে কয়েকটি রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক, কর্মীসহ অন্তত ২২ জনকে আটক করেছে পুলিশ।
পুলিশ বলছে, নগরবাসীর নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় রেখে এসব রেস্তোরাঁ ভবনে জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি ও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা রয়েছে কিনা, তা দেখতেই অভিযান চালানো হয়। ধানমন্ডি এলাকার ১৯টি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি না থাকা, সিঁড়ি আটকে রান্নাঘর বসানো ও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা না থাকায় এসব খাবারের দোকানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
ওইদিন রাজধানীর গুলশান এলাকায় প্রায় ১০টি খাবারের দোকানে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। তবে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। উত্তরা এলাকার অন্তত ২০টি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে তিনজনকে আটক করার কথা জানিয়েছে পুলিশ। তাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানানো হয়েছে।
সব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তথ্য অনলাইনে প্রকাশের অনুরোধ
যে উদ্দেশ্যে ভবন তৈরি করা হয়েছে, তা ওই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা, তা যাচাই করতে ঢাকার সব ভবনের তথ্য অনলাইনে দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে নগর-পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)।
সোমবার রাজধানীর বাংলামোটরে সংগঠনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন সংগঠনের নেতারা বলেন, ‘এই তথ্য প্রকাশ করা হলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো সাধারণ মানুষই চিহ্নিত করতে পারবে। সেই সঙ্গে, কোনো ভবনের মালিকের বিরুদ্ধে কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ নোটিশ দিয়ে থাকলে তা ভবনের সামনে টাঙিয়ে রাখা উচিত।’
‘বেইলি রোডের অগ্নিকা- এবং ভবনে জীবনের নিরাপত্তা : বিআইপির পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাবনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের শুধুমাত্র অফিসিয়াল স্পেস হিসেবে ব্যবহারে রাজউকের অনুমোদন ছিল। কিন্তু নিয়ম ভঙ্গ করে এখানে আটটি রেস্টুরেন্ট, একটি জুস বার, কফি শপ ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রীর দোকান ভাড়া দেয়া হয়েছিল। ভবন নির্মাণ বিধিমালা ও নগর পরিকল্পনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে এটা করা হয়েছে।’
লিখিত বক্তব্যে আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘ভবনটিতে কার্যকর কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ও পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ভবনমালিক ও ভবনের ব্যবহারকারীদেরকে বারবার নোটিশ দিয়েই দায় সেরেছে।’
ভবনটিতে কোনো জানালা এবং বাতাস চলাচলের পর্যাপ্ত পথ না থাকায় সর্বাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ভবনটির একমাত্র সিঁড়িটিও গ্যাস সিলিন্ডারে ভরা থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নকশা, নির্মাণ এবং পরিচালনা সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি আইন ও নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন ভবনটির মালিক।’
এ ঘটনায় রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও বিস্ফোরক পরিদপ্তরের দায় থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আগের আগুনের ঘটনায় কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে দায়িত্বে অবহেলার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। একের পর এক এ ধরনের ঘটনার পেছনে এটি আরেকটি বড় কারণ।’