#ক্লিনটনের অনুষ্ঠানে ইউনূস,কোলাকুলি
#মাহফুজের পরিচয় দিলেন আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’
# বাইডেন দুই সরকারের মধ্যে ‘আরও সম্পৃক্ততাকে’ স্বাগত জানিয়েছেন
# ক্লিনটনের সঙ্গে পরিচয়, সম্পর্কের প্রথম দিনের গল্প, যুক্তরাষ্ট্রে গ্রামীণ ব্যাংক এবং ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের নানা বিষয় তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা
বলা হচ্ছে বৈঠকটি বিরল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তো বটেই, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের তেমন নজির নেই। তবে গত মঙ্গলবার জাতিসংঘে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেস্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক হয়েছে। আর সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেস্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে কাছে পেয়ে বুকে টেনে নেন।
বলা হচ্ছে বৈঠকের সময় নিরধারিত ছিল ১৫ মিনিট। তবে তা ৩০ মিনিট স্থায়ী হয়। আর সেখানে বাইডেন, ইউনূসের হাতে হাত রেখে বলেন, বাংলাদেশের সংস্কারের যে লক্ষ্য শান্তিতে নোবেল পাওয়া মুহাম্মদ ইউনূস ঠিক করেছেন, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে ‘সব ধরনের সহযোগিতা’ করবে ওয়াশিংটনের সেই সাদা ভবন (হোয়াইট হাউস)।
বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার ফেইসবুক পেইজে দুই শীর্ষ নেতার সেই ‘বিরল’ বৈঠকের ছবি ও খবর প্রচার করা হয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকালে আর বাংলাদেশ সময় রাতে বৈঠকটি হয়।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, বৈঠকে মুহাম্মদ ইউনূস বিগত সরকারের আমলে সব ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সাহসী ভূমিকা ও বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তাদের ‘গুরুত্বপূর্ণ অবদানের’ কথা জো বাইডেনকে জানান। ইউনূস জোর দিয়ে এও বলেন, ‘দেশ পুনর্গঠনে তার সরকারকে অবশ্যই সফল হতে হবে’। এ সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনও ‘যেকোনো সাহায্যে বাংলাদেশ সরকারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন’।
ওই ‘বিরল’ বৈঠক নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে হোয়াইট হাউস। এতে বলা হয়, বাইডেন বাংলাদেশের নতুন সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে মার্কিন সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হওয়ায় তাকে অভিনন্দন জানাতে তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সেখানে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন দুই সরকারের মধ্যে ‘আরও সম্পৃক্ততাকে’ স্বাগত জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের কয়েকজন কূটনীতিক যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা জাতিসংঘে কাজ করেছেন তারা বলছেন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলার ফাঁকে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দ্বিপক্ষীয় সাক্ষাৎ প্রায় বিরল। সেই কথা বলেছেন বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেস্টার প্রেস সচিবও।
কূটনীতিকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সাধারণত জাতিসংঘ অধিবেশনে নির্ধারিত বক্তৃতার দিন সকালে নিউইয়র্কে পৌঁছান। সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তৃতা দেন। এরপর বিকেলে সেখানে অন্যান্য রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সম্মানে সংবর্ধনার আয়োজন করেন।
তাদের ধারণা, চিরাচরিত প্রথা ভেঙে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিচ্ছে যে, হোয়াইট হাউস বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনকে ‘সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত’।
ক্লিনটনের অনুষ্ঠানে ইউনূস, কোলাকুলি
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠক বা সৌজন্য সাক্ষাত করেছেন আরও কয়েকটি দেশের সরকার বা রাষ্ট্র প্রধানের সাথে। তবে সব ছাপিয়ে আরেকটি সাক্ষাত নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
ওইদিন মঙ্গলবারই নিউইয়র্কে মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের প্রতিষ্ঠান ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’–এর একটি আয়োজনে অংশ নেন মুহাম্মদ ইউনূস।
সেখানে দুই বন্ধু তাদের সম্পরকের স্মৃতিচারণা করেন। ক্লিনটনের সঙ্গে ইউনূস তার পরিচয় ও সম্পর্কের প্রথম দিনের গল্প, যুক্তরাষ্ট্রে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কাহিনি এবং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের নানা বিষয় তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই ক্লিনটন বাংলাদেশের তরুণ নাগরিকদের ডাকে সাড়া দিয়ে দায়িত্বগ্রহণকারী নেতা বলে পরিচয় করিয়ে দেন ইউনূসকে। এ সময় পুরো হল করতালিতে ফেটে পড়ে। আর তখন দুই নেতা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেন, করেন কোলাকুলি।
ইউনূস শুরুতেই ক্লিনটনের সঙ্গে তার প্রথম যোগাযোগের ঘটনা উল্লেখ করেন, বলেন, ‘তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলেন (১৯৮৬ সালে), যা তাকে অবাক করেছিল। আরকানসাসের একজন গভর্নর (সে সময় ক্লিনটন এই অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ছিলেন) ওই চিঠি পাঠান। চিঠিতে তাঁর সঙ্গে দ্রুত দেখা করতে চান বলে তিনি লিখেছিলেন।‘
ইউনূস এও জানান ক্লিনটন প্রথমবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নিজের নাম ঘোষণা করার সময় ইউনূস যেন উপস্থিত থাকেন সেই অনুরোধ করেছিলেন। তারপর হিলারি ক্লিনটন, তাদের মেয়ে চেলসির সঙ্গে পরিচয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন।
‘এভাবেই আমার ও বিলের, বিলের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমরা অনেকটা পথ এগিয়ে যাই। এটি আমাকে কিছু করার প্রেরণা দেয়। আমি এর পর থেকে নিয়মিত সিজিআইয়ের (ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ) অনুষ্ঠানে অংশ নিতে থাকি এবং হঠাৎই যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। এখানে ফিরতে পেরে আমি খুবই খুশি।’
ক্লিনটন সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইউনূস বলেন, ‘আমি তার, হিলারি ও চেলসির বন্ধু হতে পেরে খুবই গর্বিত। এটি চমৎকার একটি সম্পর্ক।’
এরপর ক্লিনটন চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে ইউনূসকে জড়িয়ে ধরেন। হল আবার করতালিতে ফেটে পড়ে। আর তখন ক্লিনটন বলেন, ‘আমার জানামতে, আপনিই একমাত্র বয়স্ক ব্যক্তি, যাকে দেশের তরুণেরা তার নিজের অসাধারণ অর্জনের জন্য ক্ষমতায় বসিয়েছে।’
মাহফুজের পরিচয় দিলেন আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’
ক্লিনটনের ওই অনুষ্ঠানের মঞ্চে ইউনূস তার দীর্ঘদিনের বন্ধুর সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলার ফাঁকে সফরসঙ্গীদের তিনজনকে পরিচয় করিয়ে দেন। তার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমকে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরে সরকার পতনের আন্দোলনের ‘কারিগর’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
মাহফুজকে সামনে এগিয়ে দিয়ে ইউনূস বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পেছনের মাস্টারমাইন্ড মাহফুজ। যদিও মাহফুজ সব সময় বলে, সে একা নয়, আরও অনেকে আছে। যদিও সে গণ-অভ্যুত্থানের পেছনের কারিগর হিসেবে পরিচিত।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির একজন সমন্বয়ক ছিলেন মাহফুজ, যিনি মাহফুজ আবদুল্লাহ নামেও পরিচিত।
অনুষ্ঠানে শান্তিতে নোবেল পাওয়া ইউনূস বলেন, ‘এটি (শিক্ষার্থীদের আন্দোলন) খুব গোছালো ছিল। এমনকি লোকজন জানতেন না, কারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাই, আপনি একজনকে ধরে ফেলে বলতে পারবেন না, ঠিক আছে, আন্দোলন শেষ। তারা (আন্দোলনের তরুণরা) যেভাবে কথা বলেছেন, তা সারা বিশ্বের তরুণদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই।’
এক পর্যায়ে ক্লিনটনের হাত ধরে ইউনূস বলেন, ‘এটি বাস্তবায়নে (তরুণদের আকাঙ্ক্ষা) যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের সমর্থন পেয়ে আমি খুব খুশি। আমরা আরও এগিয়ে যেতে চাই। নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই। তাঁরা (তরুণেরা) বলেছেন আমরা ‘‘রিসেট বাটন’’ চেপেছি। সব পুরোনো শেষ হয়েছে। এখন আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ব।’
দেশে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ইউনূস তাঁদের কথাও বলেন। তিনি তাদের মঞ্চে ডেকে নেন।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ইউনূস
নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। বিদেশি বন্ধুদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তরুণদের আত্মত্যাগ আমাদের সামনে বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমরা এই সুযোগ হারাতে চাই না। বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে তরুণেরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে চায়। এটি বাস্তবায়নে আপনাদের সবার সমর্থন প্রয়োজন।’
জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপ্রাপ্তির ৫০তম বছর উদ্যাপন উপলক্ষে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। এতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ; যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দেন। বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আরও ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ আবদুল মুহিত, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি–বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম প্রমুখ।
বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
#ক্লিনটনের অনুষ্ঠানে ইউনূস,কোলাকুলি
#মাহফুজের পরিচয় দিলেন আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’
# বাইডেন দুই সরকারের মধ্যে ‘আরও সম্পৃক্ততাকে’ স্বাগত জানিয়েছেন
# ক্লিনটনের সঙ্গে পরিচয়, সম্পর্কের প্রথম দিনের গল্প, যুক্তরাষ্ট্রে গ্রামীণ ব্যাংক এবং ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের নানা বিষয় তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা
বলা হচ্ছে বৈঠকটি বিরল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তো বটেই, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের তেমন নজির নেই। তবে গত মঙ্গলবার জাতিসংঘে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেস্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক হয়েছে। আর সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেস্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে কাছে পেয়ে বুকে টেনে নেন।
বলা হচ্ছে বৈঠকের সময় নিরধারিত ছিল ১৫ মিনিট। তবে তা ৩০ মিনিট স্থায়ী হয়। আর সেখানে বাইডেন, ইউনূসের হাতে হাত রেখে বলেন, বাংলাদেশের সংস্কারের যে লক্ষ্য শান্তিতে নোবেল পাওয়া মুহাম্মদ ইউনূস ঠিক করেছেন, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে ‘সব ধরনের সহযোগিতা’ করবে ওয়াশিংটনের সেই সাদা ভবন (হোয়াইট হাউস)।
বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার ফেইসবুক পেইজে দুই শীর্ষ নেতার সেই ‘বিরল’ বৈঠকের ছবি ও খবর প্রচার করা হয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকালে আর বাংলাদেশ সময় রাতে বৈঠকটি হয়।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, বৈঠকে মুহাম্মদ ইউনূস বিগত সরকারের আমলে সব ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সাহসী ভূমিকা ও বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তাদের ‘গুরুত্বপূর্ণ অবদানের’ কথা জো বাইডেনকে জানান। ইউনূস জোর দিয়ে এও বলেন, ‘দেশ পুনর্গঠনে তার সরকারকে অবশ্যই সফল হতে হবে’। এ সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনও ‘যেকোনো সাহায্যে বাংলাদেশ সরকারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন’।
ওই ‘বিরল’ বৈঠক নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে হোয়াইট হাউস। এতে বলা হয়, বাইডেন বাংলাদেশের নতুন সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে মার্কিন সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হওয়ায় তাকে অভিনন্দন জানাতে তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সেখানে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন দুই সরকারের মধ্যে ‘আরও সম্পৃক্ততাকে’ স্বাগত জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের কয়েকজন কূটনীতিক যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা জাতিসংঘে কাজ করেছেন তারা বলছেন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলার ফাঁকে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দ্বিপক্ষীয় সাক্ষাৎ প্রায় বিরল। সেই কথা বলেছেন বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেস্টার প্রেস সচিবও।
কূটনীতিকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সাধারণত জাতিসংঘ অধিবেশনে নির্ধারিত বক্তৃতার দিন সকালে নিউইয়র্কে পৌঁছান। সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তৃতা দেন। এরপর বিকেলে সেখানে অন্যান্য রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সম্মানে সংবর্ধনার আয়োজন করেন।
তাদের ধারণা, চিরাচরিত প্রথা ভেঙে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিচ্ছে যে, হোয়াইট হাউস বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনকে ‘সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত’।
ক্লিনটনের অনুষ্ঠানে ইউনূস, কোলাকুলি
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠক বা সৌজন্য সাক্ষাত করেছেন আরও কয়েকটি দেশের সরকার বা রাষ্ট্র প্রধানের সাথে। তবে সব ছাপিয়ে আরেকটি সাক্ষাত নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
ওইদিন মঙ্গলবারই নিউইয়র্কে মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের প্রতিষ্ঠান ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’–এর একটি আয়োজনে অংশ নেন মুহাম্মদ ইউনূস।
সেখানে দুই বন্ধু তাদের সম্পরকের স্মৃতিচারণা করেন। ক্লিনটনের সঙ্গে ইউনূস তার পরিচয় ও সম্পর্কের প্রথম দিনের গল্প, যুক্তরাষ্ট্রে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কাহিনি এবং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের নানা বিষয় তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই ক্লিনটন বাংলাদেশের তরুণ নাগরিকদের ডাকে সাড়া দিয়ে দায়িত্বগ্রহণকারী নেতা বলে পরিচয় করিয়ে দেন ইউনূসকে। এ সময় পুরো হল করতালিতে ফেটে পড়ে। আর তখন দুই নেতা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেন, করেন কোলাকুলি।
ইউনূস শুরুতেই ক্লিনটনের সঙ্গে তার প্রথম যোগাযোগের ঘটনা উল্লেখ করেন, বলেন, ‘তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলেন (১৯৮৬ সালে), যা তাকে অবাক করেছিল। আরকানসাসের একজন গভর্নর (সে সময় ক্লিনটন এই অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ছিলেন) ওই চিঠি পাঠান। চিঠিতে তাঁর সঙ্গে দ্রুত দেখা করতে চান বলে তিনি লিখেছিলেন।‘
ইউনূস এও জানান ক্লিনটন প্রথমবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নিজের নাম ঘোষণা করার সময় ইউনূস যেন উপস্থিত থাকেন সেই অনুরোধ করেছিলেন। তারপর হিলারি ক্লিনটন, তাদের মেয়ে চেলসির সঙ্গে পরিচয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন।
‘এভাবেই আমার ও বিলের, বিলের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমরা অনেকটা পথ এগিয়ে যাই। এটি আমাকে কিছু করার প্রেরণা দেয়। আমি এর পর থেকে নিয়মিত সিজিআইয়ের (ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ) অনুষ্ঠানে অংশ নিতে থাকি এবং হঠাৎই যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। এখানে ফিরতে পেরে আমি খুবই খুশি।’
ক্লিনটন সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইউনূস বলেন, ‘আমি তার, হিলারি ও চেলসির বন্ধু হতে পেরে খুবই গর্বিত। এটি চমৎকার একটি সম্পর্ক।’
এরপর ক্লিনটন চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে ইউনূসকে জড়িয়ে ধরেন। হল আবার করতালিতে ফেটে পড়ে। আর তখন ক্লিনটন বলেন, ‘আমার জানামতে, আপনিই একমাত্র বয়স্ক ব্যক্তি, যাকে দেশের তরুণেরা তার নিজের অসাধারণ অর্জনের জন্য ক্ষমতায় বসিয়েছে।’
মাহফুজের পরিচয় দিলেন আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’
ক্লিনটনের ওই অনুষ্ঠানের মঞ্চে ইউনূস তার দীর্ঘদিনের বন্ধুর সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলার ফাঁকে সফরসঙ্গীদের তিনজনকে পরিচয় করিয়ে দেন। তার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমকে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরে সরকার পতনের আন্দোলনের ‘কারিগর’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
মাহফুজকে সামনে এগিয়ে দিয়ে ইউনূস বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পেছনের মাস্টারমাইন্ড মাহফুজ। যদিও মাহফুজ সব সময় বলে, সে একা নয়, আরও অনেকে আছে। যদিও সে গণ-অভ্যুত্থানের পেছনের কারিগর হিসেবে পরিচিত।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির একজন সমন্বয়ক ছিলেন মাহফুজ, যিনি মাহফুজ আবদুল্লাহ নামেও পরিচিত।
অনুষ্ঠানে শান্তিতে নোবেল পাওয়া ইউনূস বলেন, ‘এটি (শিক্ষার্থীদের আন্দোলন) খুব গোছালো ছিল। এমনকি লোকজন জানতেন না, কারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাই, আপনি একজনকে ধরে ফেলে বলতে পারবেন না, ঠিক আছে, আন্দোলন শেষ। তারা (আন্দোলনের তরুণরা) যেভাবে কথা বলেছেন, তা সারা বিশ্বের তরুণদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই।’
এক পর্যায়ে ক্লিনটনের হাত ধরে ইউনূস বলেন, ‘এটি বাস্তবায়নে (তরুণদের আকাঙ্ক্ষা) যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের সমর্থন পেয়ে আমি খুব খুশি। আমরা আরও এগিয়ে যেতে চাই। নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই। তাঁরা (তরুণেরা) বলেছেন আমরা ‘‘রিসেট বাটন’’ চেপেছি। সব পুরোনো শেষ হয়েছে। এখন আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ব।’
দেশে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ইউনূস তাঁদের কথাও বলেন। তিনি তাদের মঞ্চে ডেকে নেন।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ইউনূস
নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। বিদেশি বন্ধুদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তরুণদের আত্মত্যাগ আমাদের সামনে বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমরা এই সুযোগ হারাতে চাই না। বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে তরুণেরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে চায়। এটি বাস্তবায়নে আপনাদের সবার সমর্থন প্রয়োজন।’
জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপ্রাপ্তির ৫০তম বছর উদ্যাপন উপলক্ষে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। এতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ; যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দেন। বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আরও ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ আবদুল মুহিত, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি–বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম প্রমুখ।