বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ‘স্প্রেডশিট’ আকারে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়ে যে মতামত চাওয়া হয়েছে, তার অনেকগুলোই বিভ্রান্তিকর বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পাঠানো স্প্রেডশিটে ‘বিস্তর ফারাক’ তারা দেখতে পেয়েছেন। বৃহস্পতিবার,(১৭ এপ্রিল) জাতীয় সংসদের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপের বিরতিতে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই লক্ষ্য : কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ
এত সময় না নিই যাতে মানুষের পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা স্তিমিত হয়ে যায় : নজরুল ইসলাম খান
হ্যাঁ/না জবাবে মিস লিড করা হয়েছে; এটা উচিত হয়নি: সালাহউদ্দিন আহমেদ
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘আমাদের দফাওয়ারি আলোচনা চলছে। সংবিধানের প্রস্তাবনা হতে শুরু করে প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্রের মূলনীতিসহ সব বিষয়ে দফায় দফায় আলোচনা করব। বিস্তারিত অগ্রগতি পরে জানতে পারবেন। সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত মৌলিক প্রস্তাবের বিষয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চেষ্টা করব এক জায়গায় আসার জন্য।’
বৈঠক শুরু হয় সকাল সাড়ে ১০টায়। ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে বৈঠকে ছিলেন কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
সালাহউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধিদলে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহ ও কেন্দ্রীয় সদস্য ব্যরিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
বৃহস্পতিবার বিকেলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় আগামী রোববার বেলা ১১টায় বিএনপির সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের আলোচনায় বসবে কমিশন।
গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে
সংলাপের শুরুতে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, ‘বারবার আমরা দেখছি- এদেশে গণতন্ত্র হোঁচট খেয়েছে, ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ দেশে; সেগুলো যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে। এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো সংগ্রাম করেছে, বিএনপি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে জাতীয় সনদ তৈরি করা; যাতে বাংলাদেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারি।’
বিএনপিকে ধন্যবাদ
বৈঠকের আগে সাংবাদিকদের আলী রিয়াজ বলেন, ‘বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। পাঁচটি কমিশনের সুপারিশ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে স্প্রেডশিট দেয়া হয়েছিল দলগুলোকে। বিএনপিও সহযোগিতা করেছে, তাদের প্রতি সন্তুষ্টি, কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।’
এ সময় তিনি বলেন, ‘যখন সংস্কারের কথা কেউ ভাবেনি তখন থেকে বিএনপি সংস্কারের কথা বলেছে।’ রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রের বেশিরভাগ সংস্কার বিএনপি করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আলী রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও রাষ্ট্র সংস্কারে বিএনপি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে। আলোচনার মধ্য দিয়ে জাতীয় সনদ তৈরি করাই সরকারের লক্ষ্য। এ সময় সবাই মিলে জাতির আকাক্সক্ষা অনুযায়ী ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেন তিনি।
মিস লিড করা হয়েছে
বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘স্প্রেডশিটে সংক্ষিপ্ত হ্যাঁ/না জবাব দেয়ার জন্য যে কাগজগুলো দিলো, তাতে করে অনেকটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, মিস লিড করা হয়েছে। স্প্রেডশিট দিয়ে আমাদের উনারা বিভ্রান্ত করেছন, মিস লিড করেছ। এটা দেয়া উচিত হয়নি।’
বিএনপি এই আলোচনায় সংবিধান, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, নির্বাচন নিয়ে বিস্তারিত মতামত জমা দিয়েছে বলে জানান সালাহউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আজকে হার্ড কপি জমা দিয়েছি। এগুলোর ওপরে বিস্তারিত
আলোচনা চলছে। সংবিধান সংস্কার দিয়ে শুরু করেছি। তারপরে বিচার বিভাগ, নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হবে। তারপরও আলোচনা চলমান রাখতে চাই, আজকে শেষ না হলে পরেও আলোচনা হবে। আমরা বোঝাতে চাই বিএনপি সংস্কারের বিষয়ে কতটা সিরিয়াস।’
দফায় দফায় আলোচনা করব
সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিস্তারিত প্রতিবেদনে ১৩১টি প্রস্তাব থাকলেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের স্প্রেডশিটে ৭০ বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের দফাওয়ারি আলোচনা চলছে। সংবিধানের প্রস্তাবনা হতে শুরু করে প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্রের মূলনীতিসহ সব বিষয়ে দফায় দফায় আলোচনা করব। বিস্তারিত অগ্রগতি পরে জানতে পারবেন। সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত মৌলিক প্রস্তাবের বিষয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চেষ্টা করব এক জায়গায় আসার জন্য।’
তিনি জানান, বিএনপি সংবিধান সংস্কার কমিশনের ২৫টি প্রস্তাবে একমত, ২৫টির মতো বিষয়ে আংশিকভাবে একমত। বাকি বিষয়গুলোতে একমত হতে পারেনি।
সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমরা যে সমস্ত বিষয়ে বিস্তারিত মতামত দিয়েছি, সে বিষয়ে কমিশনকে যৌক্তিকভাবে বোঝাব এবং তাদের প্রস্তাবের বিষয়েও আমরা যৌক্তিকভাবে জানতে চাচ্ছি। যেটা যৌক্তিক, সেটা জাতির কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা অবশ্যই বিবেচনা করব।’
বিচার বিভাগের মতামত নিয়ে প্রতিবেদনে ‘মিস লিড’ করা হয়েছে মন্তব্য করে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিস্তারিত প্রতিবেদনের ১৫০টি মতামতের মধ্যে ৮৯টির বিষয়ে মতামত দিয়েছি। বাকিগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রে একমত হওয়া বা মন্তব্যসহ একমত হওয়ার কথা জানিয়েছি।’
*প্রতিবেদনে বিস্তর ফারাক*
যেসব বিষয়ে ‘হ্যাঁ/ না’ তে মতামত চাওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে বিস্তারিত প্রতিবেদনের ‘বিস্তর ফারাক’ দেখার কথা তুলে ধরে এই বিএনপি নেতা বলেন, ‘সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের সংশোধনী ব্যতিরেকে বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশ জারি করা ততক্ষণ পর্যন্ত অসাংবিধানিক হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা সংবিধানে গৃহীত হচ্ছে। ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা সংবিধানসম্মত হবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রইবে। বিচার বিভাগ কর্তৃক সংবিধান লঙ্ঘন সমুচিত হবে না।’
বিএনপি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চায় জানিয়ে সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘প্রক্রিয়া যাতে আইনানুগ ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে হয়, সেজন্য বিস্তারিত মতামত দেব। লিখিতও দিয়েছি।’ নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের অধিকাংশ বিষয় ‘সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত’ এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু বিষয়ে তারা এমন প্রস্তাব দিয়েছে, যা বাস্তবায়ন করলে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন সত্তা বজায় থাকবে না।’
বিএনপির সঙ্গে কমিশনের আলোচনা দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রয়োজনে আরও আলোচনা হবে। কারণ আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আগাচ্ছি।’
*বিএনপির চেয়ে বেশি সংস্কার কে করেছে*
সময়ের বাঁকবদলে রাষ্ট্রেরও যে সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পড়ে, সেই বাস্তবতার কথা ঐকমত্য কমিশনের কাছে তুলে ধরেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তবে তিনি বলেন, ‘কিন্তু খুব ভালো করার জন্য যেন আমরা এত সময় না নিই যাতে মানুষের পরিবর্তনের যে আকাক্সক্ষা সেটা স্তিমিত হয়ে যায়।’
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা কালকেও প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, বিএনপির চাইতে বেশি সংস্কার বাংলাদেশে কোন রাজনৈতিক দল করেছে? রাজনৈতিকভাবে বলেন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা তো বিএনপি করেছে। বহু দলীয় গণতন্ত্র তো বিএনপি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে, সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তো বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছে। তত্ত্বাবধায়ক শাসন ব্যবস্থা তো বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছে, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ তো অনেক ক্ষেত্রে করেছে। এমনকি বিএনপি তো গ্রাম সরকার প্রবর্তন করেছে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি সংস্কারের বিপক্ষে না, বিএনপি সংস্কারের দল।’
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘তার পরও কেউ কেউ নানা কথা বলেন, তারা যখন সংস্কারের ‘স’ উচ্চারণ করে নাই তখন তো দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভিশন ২০৩০ দিয়েছেন। কেউ যখন সংস্কারের কথা ভাবেনি, তখন শহীদ জিয়াউর রহমান ১৯ দফা কর্মসূচি দিয়েছেন। আমরা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি এবং আমরা এটা বলেছি, এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব থাকলে সেটা সাদরে গ্রহণ করব। কাজেই যদি ঐকমত্য কমিশনের সনদ নাও হয়, বিএনপির জন্য সনদ আছে একটা সংস্কারের সনদ। কাজেই আমরা সংস্কারের পক্ষে।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আমরা একটা জিনিস বলব, সব কিছুর উপরে জনগণ। জনগণ কার মাধ্যমে সম্মতি জানায়, আমরা জানি। আমরা বিশ্বাস করি, এমন যোগ্য মানুষরা এই কমিশনের দায়িত্ব পেয়েছেন, তাদের নেতৃত্বে এই কমিশন কাজ করেছে। তাদের সহযোগিতায় আমরা আাগামী দিনে আমাদের দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।’
*রাষ্ট্র সংস্কার*
শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশের দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে দুই ধাপে ১১টি কমিশন গঠন করে। কমিশনগুলোর সুপারিশ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম শুরু হয়। সেদিন ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের প্রথম বৈঠক হয়।
এরপর সংবিধান সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর ওপর ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মতামত জানতে চায় ঐকমত্য কমিশন। পরে মতামত তুলে ধরে ৩৪টি দল, যাদের সঙ্গে এখন আলাদা করে বৈঠক করছে কমিশন।
বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫
বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ‘স্প্রেডশিট’ আকারে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়ে যে মতামত চাওয়া হয়েছে, তার অনেকগুলোই বিভ্রান্তিকর বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পাঠানো স্প্রেডশিটে ‘বিস্তর ফারাক’ তারা দেখতে পেয়েছেন। বৃহস্পতিবার,(১৭ এপ্রিল) জাতীয় সংসদের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপের বিরতিতে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই লক্ষ্য : কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ
এত সময় না নিই যাতে মানুষের পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা স্তিমিত হয়ে যায় : নজরুল ইসলাম খান
হ্যাঁ/না জবাবে মিস লিড করা হয়েছে; এটা উচিত হয়নি: সালাহউদ্দিন আহমেদ
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘আমাদের দফাওয়ারি আলোচনা চলছে। সংবিধানের প্রস্তাবনা হতে শুরু করে প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্রের মূলনীতিসহ সব বিষয়ে দফায় দফায় আলোচনা করব। বিস্তারিত অগ্রগতি পরে জানতে পারবেন। সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত মৌলিক প্রস্তাবের বিষয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চেষ্টা করব এক জায়গায় আসার জন্য।’
বৈঠক শুরু হয় সকাল সাড়ে ১০টায়। ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে বৈঠকে ছিলেন কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
সালাহউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধিদলে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহ ও কেন্দ্রীয় সদস্য ব্যরিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
বৃহস্পতিবার বিকেলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় আগামী রোববার বেলা ১১টায় বিএনপির সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের আলোচনায় বসবে কমিশন।
গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে
সংলাপের শুরুতে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, ‘বারবার আমরা দেখছি- এদেশে গণতন্ত্র হোঁচট খেয়েছে, ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ দেশে; সেগুলো যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে। এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো সংগ্রাম করেছে, বিএনপি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে জাতীয় সনদ তৈরি করা; যাতে বাংলাদেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারি।’
বিএনপিকে ধন্যবাদ
বৈঠকের আগে সাংবাদিকদের আলী রিয়াজ বলেন, ‘বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। পাঁচটি কমিশনের সুপারিশ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে স্প্রেডশিট দেয়া হয়েছিল দলগুলোকে। বিএনপিও সহযোগিতা করেছে, তাদের প্রতি সন্তুষ্টি, কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।’
এ সময় তিনি বলেন, ‘যখন সংস্কারের কথা কেউ ভাবেনি তখন থেকে বিএনপি সংস্কারের কথা বলেছে।’ রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রের বেশিরভাগ সংস্কার বিএনপি করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আলী রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও রাষ্ট্র সংস্কারে বিএনপি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে। আলোচনার মধ্য দিয়ে জাতীয় সনদ তৈরি করাই সরকারের লক্ষ্য। এ সময় সবাই মিলে জাতির আকাক্সক্ষা অনুযায়ী ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেন তিনি।
মিস লিড করা হয়েছে
বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘স্প্রেডশিটে সংক্ষিপ্ত হ্যাঁ/না জবাব দেয়ার জন্য যে কাগজগুলো দিলো, তাতে করে অনেকটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, মিস লিড করা হয়েছে। স্প্রেডশিট দিয়ে আমাদের উনারা বিভ্রান্ত করেছন, মিস লিড করেছ। এটা দেয়া উচিত হয়নি।’
বিএনপি এই আলোচনায় সংবিধান, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, নির্বাচন নিয়ে বিস্তারিত মতামত জমা দিয়েছে বলে জানান সালাহউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আজকে হার্ড কপি জমা দিয়েছি। এগুলোর ওপরে বিস্তারিত
আলোচনা চলছে। সংবিধান সংস্কার দিয়ে শুরু করেছি। তারপরে বিচার বিভাগ, নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হবে। তারপরও আলোচনা চলমান রাখতে চাই, আজকে শেষ না হলে পরেও আলোচনা হবে। আমরা বোঝাতে চাই বিএনপি সংস্কারের বিষয়ে কতটা সিরিয়াস।’
দফায় দফায় আলোচনা করব
সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিস্তারিত প্রতিবেদনে ১৩১টি প্রস্তাব থাকলেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের স্প্রেডশিটে ৭০ বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের দফাওয়ারি আলোচনা চলছে। সংবিধানের প্রস্তাবনা হতে শুরু করে প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্রের মূলনীতিসহ সব বিষয়ে দফায় দফায় আলোচনা করব। বিস্তারিত অগ্রগতি পরে জানতে পারবেন। সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত মৌলিক প্রস্তাবের বিষয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চেষ্টা করব এক জায়গায় আসার জন্য।’
তিনি জানান, বিএনপি সংবিধান সংস্কার কমিশনের ২৫টি প্রস্তাবে একমত, ২৫টির মতো বিষয়ে আংশিকভাবে একমত। বাকি বিষয়গুলোতে একমত হতে পারেনি।
সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমরা যে সমস্ত বিষয়ে বিস্তারিত মতামত দিয়েছি, সে বিষয়ে কমিশনকে যৌক্তিকভাবে বোঝাব এবং তাদের প্রস্তাবের বিষয়েও আমরা যৌক্তিকভাবে জানতে চাচ্ছি। যেটা যৌক্তিক, সেটা জাতির কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা অবশ্যই বিবেচনা করব।’
বিচার বিভাগের মতামত নিয়ে প্রতিবেদনে ‘মিস লিড’ করা হয়েছে মন্তব্য করে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিস্তারিত প্রতিবেদনের ১৫০টি মতামতের মধ্যে ৮৯টির বিষয়ে মতামত দিয়েছি। বাকিগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রে একমত হওয়া বা মন্তব্যসহ একমত হওয়ার কথা জানিয়েছি।’
*প্রতিবেদনে বিস্তর ফারাক*
যেসব বিষয়ে ‘হ্যাঁ/ না’ তে মতামত চাওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে বিস্তারিত প্রতিবেদনের ‘বিস্তর ফারাক’ দেখার কথা তুলে ধরে এই বিএনপি নেতা বলেন, ‘সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের সংশোধনী ব্যতিরেকে বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশ জারি করা ততক্ষণ পর্যন্ত অসাংবিধানিক হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা সংবিধানে গৃহীত হচ্ছে। ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা সংবিধানসম্মত হবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রইবে। বিচার বিভাগ কর্তৃক সংবিধান লঙ্ঘন সমুচিত হবে না।’
বিএনপি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চায় জানিয়ে সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘প্রক্রিয়া যাতে আইনানুগ ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে হয়, সেজন্য বিস্তারিত মতামত দেব। লিখিতও দিয়েছি।’ নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের অধিকাংশ বিষয় ‘সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত’ এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু বিষয়ে তারা এমন প্রস্তাব দিয়েছে, যা বাস্তবায়ন করলে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন সত্তা বজায় থাকবে না।’
বিএনপির সঙ্গে কমিশনের আলোচনা দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রয়োজনে আরও আলোচনা হবে। কারণ আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আগাচ্ছি।’
*বিএনপির চেয়ে বেশি সংস্কার কে করেছে*
সময়ের বাঁকবদলে রাষ্ট্রেরও যে সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পড়ে, সেই বাস্তবতার কথা ঐকমত্য কমিশনের কাছে তুলে ধরেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তবে তিনি বলেন, ‘কিন্তু খুব ভালো করার জন্য যেন আমরা এত সময় না নিই যাতে মানুষের পরিবর্তনের যে আকাক্সক্ষা সেটা স্তিমিত হয়ে যায়।’
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা কালকেও প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, বিএনপির চাইতে বেশি সংস্কার বাংলাদেশে কোন রাজনৈতিক দল করেছে? রাজনৈতিকভাবে বলেন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা তো বিএনপি করেছে। বহু দলীয় গণতন্ত্র তো বিএনপি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে, সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তো বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছে। তত্ত্বাবধায়ক শাসন ব্যবস্থা তো বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছে, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ তো অনেক ক্ষেত্রে করেছে। এমনকি বিএনপি তো গ্রাম সরকার প্রবর্তন করেছে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি সংস্কারের বিপক্ষে না, বিএনপি সংস্কারের দল।’
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘তার পরও কেউ কেউ নানা কথা বলেন, তারা যখন সংস্কারের ‘স’ উচ্চারণ করে নাই তখন তো দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভিশন ২০৩০ দিয়েছেন। কেউ যখন সংস্কারের কথা ভাবেনি, তখন শহীদ জিয়াউর রহমান ১৯ দফা কর্মসূচি দিয়েছেন। আমরা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি এবং আমরা এটা বলেছি, এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব থাকলে সেটা সাদরে গ্রহণ করব। কাজেই যদি ঐকমত্য কমিশনের সনদ নাও হয়, বিএনপির জন্য সনদ আছে একটা সংস্কারের সনদ। কাজেই আমরা সংস্কারের পক্ষে।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আমরা একটা জিনিস বলব, সব কিছুর উপরে জনগণ। জনগণ কার মাধ্যমে সম্মতি জানায়, আমরা জানি। আমরা বিশ্বাস করি, এমন যোগ্য মানুষরা এই কমিশনের দায়িত্ব পেয়েছেন, তাদের নেতৃত্বে এই কমিশন কাজ করেছে। তাদের সহযোগিতায় আমরা আাগামী দিনে আমাদের দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।’
*রাষ্ট্র সংস্কার*
শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশের দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে দুই ধাপে ১১টি কমিশন গঠন করে। কমিশনগুলোর সুপারিশ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম শুরু হয়। সেদিন ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের প্রথম বৈঠক হয়।
এরপর সংবিধান সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর ওপর ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মতামত জানতে চায় ঐকমত্য কমিশন। পরে মতামত তুলে ধরে ৩৪টি দল, যাদের সঙ্গে এখন আলাদা করে বৈঠক করছে কমিশন।