আগুনে পুড়ে গেছে পাথারিয়া বনাঞ্চলের একাংশ -সংবাদ
মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তরেখার মধ্যবর্তী চারটি বনবিট নিয়ে গঠিত পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্ট। এই বনাঞ্চলের বনভূমির প্রায় এক হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা দখল করে নিয়েছে এক শ্রেণীর প্রভাবশালী মহল। তাদের দৌরাত্ম্যে হুমকিতে আছে পরিবেশ।
নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এখনও টিকে আছে অন্তত ৩৮ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, খাবার সংকটে তারা ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে
পাথারিয়া পাহাড়ের ১৩৫ বর্গ কিলোমিটার মোট আয়তনের প্রায় ৮৮ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশে, আর ৪৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে ভারতে
জানা গেছে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম সৃষ্টি মৌলভীবাজারের উত্তর ও পূর্বে পাথারিয়া পাহাড় অঞ্চল। উত্তর-দক্ষিণে পঁচিশ মাইল বিস্তৃত। পাথারিয়ার চিরহরিৎ বনাঞ্চল বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ। বড়লেখার পাথারিয়া বনভূমি থেকে হাকালুকি হাওর যেন বড়লেখা থানার পূর্ব-পশ্চিম পাড়ের গীতিময় কথোপকথন। পাথারিয়া পাহাড়ে আছে তিনটি উল্লেখযোগ্য শৃঙ্গ। যথাক্রমে দূরবীনটিলা, গগনটিলা ও রাজবাড়ি টিলা।
এই পাহাড় প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। পাথারিয়া পাহাড়ে আছে তেলকূপ। এখান থেকে তেল উত্তোলনের জন্য বার্মা অয়েল কোম্পানি (বিওসি) ১৯৩৩ সালে তেলকূপ খননের চেষ্টা চালানোর সময় পাইপ ফেটে যায়। তেলের ঊর্ধ্বচাপে তা’ উপত্যকা ও পাশ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে জনমনে ভীতির সঞ্চার হয়। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে।
পাথারিয়া পাহাড়ের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে এই এলাকারই বাসিন্দা বিশিষ্ট উদ্ভিদবিদ অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। তিনি পাথারিয়ার ফুল-ফসলের নানা বর্ণনা তুলে ধরেছেন তার অনেক লেখায়।
পাথারিয়া পাহাড়ের বুকে সৃষ্ট বড়লেখার ঐতিহ্য মাধবতীর্থ মাধবকুণ্ড দেশের তথা বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। মাধবছড়া পাথারিয়া পাহাড়ের গঙ্গামারা থেকে গড়িয়ে আসা জল প্রায় দুই শত ফুট উঁচু থেকে নিচে খাড়াভাবে গড়িয়ে পড়ছে।
কিন্তু এ নৈসর্গিক সৌন্দর্য ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। এক শ্রেণীর প্রভাবশালী লোক জন এখানকার জমি দখল করে নিয়মবহির্ভূতভাবে জনবসতি গড়ে তুলছে। গত অর্ধশত বছরে পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্ট বনাঞ্চলের আয়তন ১ হাজার ১৫২ বর্গ কিলোমিটার থেকে মাত্র ১৩৫ বর্গ কিলোমিটারে নেমে এসেছে বলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। যা বন্যপ্রাণী ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আবাসস্থল সংকটে ইতোমধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে এই বনের বিভিন্ন প্রজাতির জীববৈচিত্র্য। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এখনও টিকে আছে প্রায় ৩৮ প্রজাতির স্থন্যপায়ী প্রাণী। এগুলোও খাবার সংকটে বন ছেড়ে ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। বনাঞ্চল রক্ষা ও বন্যপ্রাণীর আবাস্থল নিরাপদ রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়ায় বর্তমানে যেটুকু আছে সেটিও হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য হটস্পটের মিশ্র চিরসবুজ বনাঞ্চল পাথারিয়া হিলস্ রিজার্ভ ফরেস্টের পূর্ব দিকে ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ, উত্তরে শাহবাজপুর আর দক্ষিণ ও পশ্চিমে চা-বাগান। পাহাড়ের মাঝে মাঝে মানুষের বসতি। অতি পরিচিত
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত পাথারিয়া পাহাড়ে পরিবেশগতভাবে মিশ্র চিরসবুজ বনাঞ্চলের এ অংশটি ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য হটস্পটের অংশ।
সেই ১৯২০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে এই বনকে ‘সংরক্ষিত বন’ ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সালে পাথারিয়া পাহাড়ের আয়তন ১ হাজার ১৫২ বর্গ কিলোমিটার ছিল বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে। ক্রমশ মানুষের বসতি বেড়ে এই বনের আয়তন দিন দিন কমছে। বর্তমানে পাথারিয়া পাহাড়ের সম্মিলিত আয়তন মাত্র ১৩৫ বর্গ কিলোমিটারে এসেছে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৮৮ বর্গ কিলোমিটার আর ৪৭ বর্গ কিলোমিটার পড়েছে ভারত অংশে।
পাথারিয়া বনে বুনো মোষ, বাঘ, জলার হরিণ, গণ্ডারসহ বড় আকারের অনেক বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ছিল।
বিগত দুই বছর আগেও ক্যামেরা ট্র্যাপিং করে এই বনে এশীয় হাতি, বিপন্ন ফেরেট ব্যাজার, বাঁশ ভাল্লুক, সজারু, হলদে গলা মারটেন, আসামি বানরসহ অনেক বিপন্ন প্রাণী দেখা গেছে।
স্থানীয় মধু শিকারিরা স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, বিগত ২০১৭-১৮ সালের দিকে ভারত থেকে এক দল আদিবাসী শিকারি বাংলাদেশ অংশে এসে পাখি, বানর, গুইসাপ, চশমাপরা ও মুখপোড়া হনুমানসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাণী শিকার করলেও, তখন বন বিভাগ নীরব ভূমিকা পালন করে।
পাথারিয়ায় মাত্র চারটি মেয়ে বন্যহাতি সংগ্রাম করে টিকে আছে। কখনও বনে তাদের পদচিহ্ন দেখে তাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। এই দলের একটি হাতি বৃদ্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয়রা গণমাধ্যম কর্মীদের বলেছেন, পুরুষ হাতি না পেলে শিগগিরই হাতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হাতিগুলোর বিলুপ্তি ঠেকাতে এখনই পাথারিয়া পাহাড়ে অন্তত একটি পুরুষ হাতি অবমুক্ত করা প্রয়োজন।
বিগত ২০২২-২৩ সালে দেখা গেছে, অস্বাভাবিকভাবে বন্যপ্রাণীরা বন ছেড়ে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। এতে মানুষের সঙ্গে সংঘাতের পাশাপাশি বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে প্রাণীরা নিয়মিত মারা যায়। তাদের চিরচেনা প্রিয় আবাস্থল ছেড়ে লোকালয়ে আসার কারণ হিসেবে জানা গেছে, বনের মূল ভূখণ্ডে বন বিভাগের কৃত্রিম বনায়ন। এসব কারণে তাদের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। স্থানান্তরিত হতে গিয়ে বন্যপ্রাণীরা অস্থিত্ব হারাচ্ছে। বনের প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধস্থানে ২০২০ সালের জরিপে দেখা গেছে চারটি উল্লুকের পরিবার। কিন্তু বনায়নের কারণে বিভিন্ন ফলজ গাছ এবং লতাগুল্ম কেটে ফেলার কারণে বন্যপ্রাণীদের খাবারের সংকট দেখা দেয়।
সুরমা বাঁশমহালের বনায়নকৃত এই এলাকায় এখন আর কোনো বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে না। গত ২০২৩ সালের ১১ মার্চ মিশ্র চিরসবুজ সমনভাগ বিটের ধলছড়ি ও মাকাল জোরা এলাকায় প্রায় ৪০ হেক্টর বন ভূমি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এক পাশে এখন দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন।
এ দিকে বনের একপাশে অবাধে চলছে বাঁশ কাটার মহোৎসব। প্রায় ৪০ জন শ্রমিক দিয়ে সরকারি সম্পত্তিগুলোকে নষ্ট করা হয় বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে ।
বড়লেখার সাবেক এক প্রভাবশালী মন্ত্রী, তার ছেলে আত্মীয়-স্বজন ও অনুসারীরা মিলে বন ধ্বংস করতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ও বন পুড়িয়ে দখলে নিয়েছেন হাজার হাজার একর সরকারি ভূমি। আবার কেউ কেউ আইনের তোয়াক্কা না করে সাবাড় করছেন বনের গাছ। গত কয়েক বছর পূর্বে জুড়ীর পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্টের আওতাধীন সমনভাগ বিটের ধলছড়ি ও মাকালজোড়ায় ৪০ হেক্টর বনভূমি আগুনে পুড়ে যায়। প্রায় চার দিন বনে আগুন জ্বললেও তৎকালীন পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর কোনো নড়চড় হয়নি। সে সময় মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে প্রকাশিত পাতাকুঁড়ির দেশ ১ অক্টোবর ২০২৪ সালে ‘সাবেক পরিবেশ মন্ত্রীর ছেলে ও স্বজনরা মিলে হরিলুট, হাজার কোটি টাকা লুপাট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
বন আগুনে পোড়ানোর প্রতিবাদে সামাজিক সংগঠন পাথারিয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ টিমের মানববন্ধনে বাধা দেয় তখনকার মন্ত্রীর অনুসারী, ভূমি-বন দখলদাররা।
বন্যপ্রাণী গবেষকদের মতে, এই বনের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল যতটুকু এখনও টিকে আছে, সঠিকভাবে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিলে এসব প্রাণীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। মাধবছড়া ও লাঠিটিলা বনবিটের সীমান্তবর্তী প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের সঙ্গে সমনবাগের কিছু এলাকাজুড়ে, এখনই সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করতে হবে। বন্যপ্রাণী শিকারি ও গাছ চোরা কারবারিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়াও জরুরি।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণী গবেষক ড. এম এ আজিজকে উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছে যে, পাথারিয়া পাহাড়ে মানুষের আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। একে ছেড়ে দিতে হবে প্রকৃতির ওপর। এতে যে পাথারিয়া ধীরে ধীরে বিরল বন্যপ্রাণীর শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে উঠবে, এটি নিশ্চিত করে বলা যায়।
আগুনে পুড়ে গেছে পাথারিয়া বনাঞ্চলের একাংশ -সংবাদ
রোববার, ১১ মে ২০২৫
মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তরেখার মধ্যবর্তী চারটি বনবিট নিয়ে গঠিত পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্ট। এই বনাঞ্চলের বনভূমির প্রায় এক হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা দখল করে নিয়েছে এক শ্রেণীর প্রভাবশালী মহল। তাদের দৌরাত্ম্যে হুমকিতে আছে পরিবেশ।
নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এখনও টিকে আছে অন্তত ৩৮ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, খাবার সংকটে তারা ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে
পাথারিয়া পাহাড়ের ১৩৫ বর্গ কিলোমিটার মোট আয়তনের প্রায় ৮৮ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশে, আর ৪৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে ভারতে
জানা গেছে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম সৃষ্টি মৌলভীবাজারের উত্তর ও পূর্বে পাথারিয়া পাহাড় অঞ্চল। উত্তর-দক্ষিণে পঁচিশ মাইল বিস্তৃত। পাথারিয়ার চিরহরিৎ বনাঞ্চল বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ। বড়লেখার পাথারিয়া বনভূমি থেকে হাকালুকি হাওর যেন বড়লেখা থানার পূর্ব-পশ্চিম পাড়ের গীতিময় কথোপকথন। পাথারিয়া পাহাড়ে আছে তিনটি উল্লেখযোগ্য শৃঙ্গ। যথাক্রমে দূরবীনটিলা, গগনটিলা ও রাজবাড়ি টিলা।
এই পাহাড় প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। পাথারিয়া পাহাড়ে আছে তেলকূপ। এখান থেকে তেল উত্তোলনের জন্য বার্মা অয়েল কোম্পানি (বিওসি) ১৯৩৩ সালে তেলকূপ খননের চেষ্টা চালানোর সময় পাইপ ফেটে যায়। তেলের ঊর্ধ্বচাপে তা’ উপত্যকা ও পাশ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে জনমনে ভীতির সঞ্চার হয়। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে।
পাথারিয়া পাহাড়ের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে এই এলাকারই বাসিন্দা বিশিষ্ট উদ্ভিদবিদ অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। তিনি পাথারিয়ার ফুল-ফসলের নানা বর্ণনা তুলে ধরেছেন তার অনেক লেখায়।
পাথারিয়া পাহাড়ের বুকে সৃষ্ট বড়লেখার ঐতিহ্য মাধবতীর্থ মাধবকুণ্ড দেশের তথা বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। মাধবছড়া পাথারিয়া পাহাড়ের গঙ্গামারা থেকে গড়িয়ে আসা জল প্রায় দুই শত ফুট উঁচু থেকে নিচে খাড়াভাবে গড়িয়ে পড়ছে।
কিন্তু এ নৈসর্গিক সৌন্দর্য ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। এক শ্রেণীর প্রভাবশালী লোক জন এখানকার জমি দখল করে নিয়মবহির্ভূতভাবে জনবসতি গড়ে তুলছে। গত অর্ধশত বছরে পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্ট বনাঞ্চলের আয়তন ১ হাজার ১৫২ বর্গ কিলোমিটার থেকে মাত্র ১৩৫ বর্গ কিলোমিটারে নেমে এসেছে বলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। যা বন্যপ্রাণী ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আবাসস্থল সংকটে ইতোমধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে এই বনের বিভিন্ন প্রজাতির জীববৈচিত্র্য। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এখনও টিকে আছে প্রায় ৩৮ প্রজাতির স্থন্যপায়ী প্রাণী। এগুলোও খাবার সংকটে বন ছেড়ে ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। বনাঞ্চল রক্ষা ও বন্যপ্রাণীর আবাস্থল নিরাপদ রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়ায় বর্তমানে যেটুকু আছে সেটিও হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য হটস্পটের মিশ্র চিরসবুজ বনাঞ্চল পাথারিয়া হিলস্ রিজার্ভ ফরেস্টের পূর্ব দিকে ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ, উত্তরে শাহবাজপুর আর দক্ষিণ ও পশ্চিমে চা-বাগান। পাহাড়ের মাঝে মাঝে মানুষের বসতি। অতি পরিচিত
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত পাথারিয়া পাহাড়ে পরিবেশগতভাবে মিশ্র চিরসবুজ বনাঞ্চলের এ অংশটি ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য হটস্পটের অংশ।
সেই ১৯২০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে এই বনকে ‘সংরক্ষিত বন’ ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সালে পাথারিয়া পাহাড়ের আয়তন ১ হাজার ১৫২ বর্গ কিলোমিটার ছিল বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে। ক্রমশ মানুষের বসতি বেড়ে এই বনের আয়তন দিন দিন কমছে। বর্তমানে পাথারিয়া পাহাড়ের সম্মিলিত আয়তন মাত্র ১৩৫ বর্গ কিলোমিটারে এসেছে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৮৮ বর্গ কিলোমিটার আর ৪৭ বর্গ কিলোমিটার পড়েছে ভারত অংশে।
পাথারিয়া বনে বুনো মোষ, বাঘ, জলার হরিণ, গণ্ডারসহ বড় আকারের অনেক বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ছিল।
বিগত দুই বছর আগেও ক্যামেরা ট্র্যাপিং করে এই বনে এশীয় হাতি, বিপন্ন ফেরেট ব্যাজার, বাঁশ ভাল্লুক, সজারু, হলদে গলা মারটেন, আসামি বানরসহ অনেক বিপন্ন প্রাণী দেখা গেছে।
স্থানীয় মধু শিকারিরা স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, বিগত ২০১৭-১৮ সালের দিকে ভারত থেকে এক দল আদিবাসী শিকারি বাংলাদেশ অংশে এসে পাখি, বানর, গুইসাপ, চশমাপরা ও মুখপোড়া হনুমানসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাণী শিকার করলেও, তখন বন বিভাগ নীরব ভূমিকা পালন করে।
পাথারিয়ায় মাত্র চারটি মেয়ে বন্যহাতি সংগ্রাম করে টিকে আছে। কখনও বনে তাদের পদচিহ্ন দেখে তাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। এই দলের একটি হাতি বৃদ্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয়রা গণমাধ্যম কর্মীদের বলেছেন, পুরুষ হাতি না পেলে শিগগিরই হাতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হাতিগুলোর বিলুপ্তি ঠেকাতে এখনই পাথারিয়া পাহাড়ে অন্তত একটি পুরুষ হাতি অবমুক্ত করা প্রয়োজন।
বিগত ২০২২-২৩ সালে দেখা গেছে, অস্বাভাবিকভাবে বন্যপ্রাণীরা বন ছেড়ে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। এতে মানুষের সঙ্গে সংঘাতের পাশাপাশি বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে প্রাণীরা নিয়মিত মারা যায়। তাদের চিরচেনা প্রিয় আবাস্থল ছেড়ে লোকালয়ে আসার কারণ হিসেবে জানা গেছে, বনের মূল ভূখণ্ডে বন বিভাগের কৃত্রিম বনায়ন। এসব কারণে তাদের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। স্থানান্তরিত হতে গিয়ে বন্যপ্রাণীরা অস্থিত্ব হারাচ্ছে। বনের প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধস্থানে ২০২০ সালের জরিপে দেখা গেছে চারটি উল্লুকের পরিবার। কিন্তু বনায়নের কারণে বিভিন্ন ফলজ গাছ এবং লতাগুল্ম কেটে ফেলার কারণে বন্যপ্রাণীদের খাবারের সংকট দেখা দেয়।
সুরমা বাঁশমহালের বনায়নকৃত এই এলাকায় এখন আর কোনো বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে না। গত ২০২৩ সালের ১১ মার্চ মিশ্র চিরসবুজ সমনভাগ বিটের ধলছড়ি ও মাকাল জোরা এলাকায় প্রায় ৪০ হেক্টর বন ভূমি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এক পাশে এখন দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন।
এ দিকে বনের একপাশে অবাধে চলছে বাঁশ কাটার মহোৎসব। প্রায় ৪০ জন শ্রমিক দিয়ে সরকারি সম্পত্তিগুলোকে নষ্ট করা হয় বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে ।
বড়লেখার সাবেক এক প্রভাবশালী মন্ত্রী, তার ছেলে আত্মীয়-স্বজন ও অনুসারীরা মিলে বন ধ্বংস করতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ও বন পুড়িয়ে দখলে নিয়েছেন হাজার হাজার একর সরকারি ভূমি। আবার কেউ কেউ আইনের তোয়াক্কা না করে সাবাড় করছেন বনের গাছ। গত কয়েক বছর পূর্বে জুড়ীর পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্টের আওতাধীন সমনভাগ বিটের ধলছড়ি ও মাকালজোড়ায় ৪০ হেক্টর বনভূমি আগুনে পুড়ে যায়। প্রায় চার দিন বনে আগুন জ্বললেও তৎকালীন পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর কোনো নড়চড় হয়নি। সে সময় মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে প্রকাশিত পাতাকুঁড়ির দেশ ১ অক্টোবর ২০২৪ সালে ‘সাবেক পরিবেশ মন্ত্রীর ছেলে ও স্বজনরা মিলে হরিলুট, হাজার কোটি টাকা লুপাট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
বন আগুনে পোড়ানোর প্রতিবাদে সামাজিক সংগঠন পাথারিয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ টিমের মানববন্ধনে বাধা দেয় তখনকার মন্ত্রীর অনুসারী, ভূমি-বন দখলদাররা।
বন্যপ্রাণী গবেষকদের মতে, এই বনের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল যতটুকু এখনও টিকে আছে, সঠিকভাবে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিলে এসব প্রাণীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। মাধবছড়া ও লাঠিটিলা বনবিটের সীমান্তবর্তী প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের সঙ্গে সমনবাগের কিছু এলাকাজুড়ে, এখনই সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করতে হবে। বন্যপ্রাণী শিকারি ও গাছ চোরা কারবারিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়াও জরুরি।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণী গবেষক ড. এম এ আজিজকে উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছে যে, পাথারিয়া পাহাড়ে মানুষের আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। একে ছেড়ে দিতে হবে প্রকৃতির ওপর। এতে যে পাথারিয়া ধীরে ধীরে বিরল বন্যপ্রাণীর শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে উঠবে, এটি নিশ্চিত করে বলা যায়।