alt

জাতীয়

পাথারিয়ায় বনভূমি দখল, জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে

সংগ্রাম দত্ত, শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) : রোববার, ১১ মে ২০২৫

আগুনে পুড়ে গেছে পাথারিয়া বনাঞ্চলের একাংশ -সংবাদ

মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তরেখার মধ্যবর্তী চারটি বনবিট নিয়ে গঠিত পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্ট। এই বনাঞ্চলের বনভূমির প্রায় এক হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা দখল করে নিয়েছে এক শ্রেণীর প্রভাবশালী মহল। তাদের দৌরাত্ম্যে হুমকিতে আছে পরিবেশ।

নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এখনও টিকে আছে অন্তত ৩৮ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, খাবার সংকটে তারা ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে

পাথারিয়া পাহাড়ের ১৩৫ বর্গ কিলোমিটার মোট আয়তনের প্রায় ৮৮ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশে, আর ৪৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে ভারতে

জানা গেছে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম সৃষ্টি মৌলভীবাজারের উত্তর ও পূর্বে পাথারিয়া পাহাড় অঞ্চল। উত্তর-দক্ষিণে পঁচিশ মাইল বিস্তৃত। পাথারিয়ার চিরহরিৎ বনাঞ্চল বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ। বড়লেখার পাথারিয়া বনভূমি থেকে হাকালুকি হাওর যেন বড়লেখা থানার পূর্ব-পশ্চিম পাড়ের গীতিময় কথোপকথন। পাথারিয়া পাহাড়ে আছে তিনটি উল্লেখযোগ্য শৃঙ্গ। যথাক্রমে দূরবীনটিলা, গগনটিলা ও রাজবাড়ি টিলা।

এই পাহাড় প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। পাথারিয়া পাহাড়ে আছে তেলকূপ। এখান থেকে তেল উত্তোলনের জন্য বার্মা অয়েল কোম্পানি (বিওসি) ১৯৩৩ সালে তেলকূপ খননের চেষ্টা চালানোর সময় পাইপ ফেটে যায়। তেলের ঊর্ধ্বচাপে তা’ উপত্যকা ও পাশ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে জনমনে ভীতির সঞ্চার হয়। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে।

পাথারিয়া পাহাড়ের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে এই এলাকারই বাসিন্দা বিশিষ্ট উদ্ভিদবিদ অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। তিনি পাথারিয়ার ফুল-ফসলের নানা বর্ণনা তুলে ধরেছেন তার অনেক লেখায়।

পাথারিয়া পাহাড়ের বুকে সৃষ্ট বড়লেখার ঐতিহ্য মাধবতীর্থ মাধবকুণ্ড দেশের তথা বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। মাধবছড়া পাথারিয়া পাহাড়ের গঙ্গামারা থেকে গড়িয়ে আসা জল প্রায় দুই শত ফুট উঁচু থেকে নিচে খাড়াভাবে গড়িয়ে পড়ছে।

কিন্তু এ নৈসর্গিক সৌন্দর্য ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। এক শ্রেণীর প্রভাবশালী লোক জন এখানকার জমি দখল করে নিয়মবহির্ভূতভাবে জনবসতি গড়ে তুলছে। গত অর্ধশত বছরে পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্ট বনাঞ্চলের আয়তন ১ হাজার ১৫২ বর্গ কিলোমিটার থেকে মাত্র ১৩৫ বর্গ কিলোমিটারে নেমে এসেছে বলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। যা বন্যপ্রাণী ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আবাসস্থল সংকটে ইতোমধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে এই বনের বিভিন্ন প্রজাতির জীববৈচিত্র্য। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এখনও টিকে আছে প্রায় ৩৮ প্রজাতির স্থন্যপায়ী প্রাণী। এগুলোও খাবার সংকটে বন ছেড়ে ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। বনাঞ্চল রক্ষা ও বন্যপ্রাণীর আবাস্থল নিরাপদ রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়ায় বর্তমানে যেটুকু আছে সেটিও হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য হটস্পটের মিশ্র চিরসবুজ বনাঞ্চল পাথারিয়া হিলস্ রিজার্ভ ফরেস্টের পূর্ব দিকে ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ, উত্তরে শাহবাজপুর আর দক্ষিণ ও পশ্চিমে চা-বাগান। পাহাড়ের মাঝে মাঝে মানুষের বসতি। অতি পরিচিত

মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত পাথারিয়া পাহাড়ে পরিবেশগতভাবে মিশ্র চিরসবুজ বনাঞ্চলের এ অংশটি ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য হটস্পটের অংশ।

সেই ১৯২০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে এই বনকে ‘সংরক্ষিত বন’ ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সালে পাথারিয়া পাহাড়ের আয়তন ১ হাজার ১৫২ বর্গ কিলোমিটার ছিল বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে। ক্রমশ মানুষের বসতি বেড়ে এই বনের আয়তন দিন দিন কমছে। বর্তমানে পাথারিয়া পাহাড়ের সম্মিলিত আয়তন মাত্র ১৩৫ বর্গ কিলোমিটারে এসেছে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৮৮ বর্গ কিলোমিটার আর ৪৭ বর্গ কিলোমিটার পড়েছে ভারত অংশে।

পাথারিয়া বনে বুনো মোষ, বাঘ, জলার হরিণ, গণ্ডারসহ বড় আকারের অনেক বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ছিল।

বিগত দুই বছর আগেও ক্যামেরা ট্র্যাপিং করে এই বনে এশীয় হাতি, বিপন্ন ফেরেট ব্যাজার, বাঁশ ভাল্লুক, সজারু, হলদে গলা মারটেন, আসামি বানরসহ অনেক বিপন্ন প্রাণী দেখা গেছে।

স্থানীয় মধু শিকারিরা স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, বিগত ২০১৭-১৮ সালের দিকে ভারত থেকে এক দল আদিবাসী শিকারি বাংলাদেশ অংশে এসে পাখি, বানর, গুইসাপ, চশমাপরা ও মুখপোড়া হনুমানসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাণী শিকার করলেও, তখন বন বিভাগ নীরব ভূমিকা পালন করে।

পাথারিয়ায় মাত্র চারটি মেয়ে বন্যহাতি সংগ্রাম করে টিকে আছে। কখনও বনে তাদের পদচিহ্ন দেখে তাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। এই দলের একটি হাতি বৃদ্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয়রা গণমাধ্যম কর্মীদের বলেছেন, পুরুষ হাতি না পেলে শিগগিরই হাতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হাতিগুলোর বিলুপ্তি ঠেকাতে এখনই পাথারিয়া পাহাড়ে অন্তত একটি পুরুষ হাতি অবমুক্ত করা প্রয়োজন।

বিগত ২০২২-২৩ সালে দেখা গেছে, অস্বাভাবিকভাবে বন্যপ্রাণীরা বন ছেড়ে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। এতে মানুষের সঙ্গে সংঘাতের পাশাপাশি বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে প্রাণীরা নিয়মিত মারা যায়। তাদের চিরচেনা প্রিয় আবাস্থল ছেড়ে লোকালয়ে আসার কারণ হিসেবে জানা গেছে, বনের মূল ভূখণ্ডে বন বিভাগের কৃত্রিম বনায়ন। এসব কারণে তাদের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। স্থানান্তরিত হতে গিয়ে বন্যপ্রাণীরা অস্থিত্ব হারাচ্ছে। বনের প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধস্থানে ২০২০ সালের জরিপে দেখা গেছে চারটি উল্লুকের পরিবার। কিন্তু বনায়নের কারণে বিভিন্ন ফলজ গাছ এবং লতাগুল্ম কেটে ফেলার কারণে বন্যপ্রাণীদের খাবারের সংকট দেখা দেয়।

সুরমা বাঁশমহালের বনায়নকৃত এই এলাকায় এখন আর কোনো বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে না। গত ২০২৩ সালের ১১ মার্চ মিশ্র চিরসবুজ সমনভাগ বিটের ধলছড়ি ও মাকাল জোরা এলাকায় প্রায় ৪০ হেক্টর বন ভূমি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এক পাশে এখন দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন।

এ দিকে বনের একপাশে অবাধে চলছে বাঁশ কাটার মহোৎসব। প্রায় ৪০ জন শ্রমিক দিয়ে সরকারি সম্পত্তিগুলোকে নষ্ট করা হয় বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে ।

বড়লেখার সাবেক এক প্রভাবশালী মন্ত্রী, তার ছেলে আত্মীয়-স্বজন ও অনুসারীরা মিলে বন ধ্বংস করতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ও বন পুড়িয়ে দখলে নিয়েছেন হাজার হাজার একর সরকারি ভূমি। আবার কেউ কেউ আইনের তোয়াক্কা না করে সাবাড় করছেন বনের গাছ। গত কয়েক বছর পূর্বে জুড়ীর পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্টের আওতাধীন সমনভাগ বিটের ধলছড়ি ও মাকালজোড়ায় ৪০ হেক্টর বনভূমি আগুনে পুড়ে যায়। প্রায় চার দিন বনে আগুন জ্বললেও তৎকালীন পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর কোনো নড়চড় হয়নি। সে সময় মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে প্রকাশিত পাতাকুঁড়ির দেশ ১ অক্টোবর ২০২৪ সালে ‘সাবেক পরিবেশ মন্ত্রীর ছেলে ও স্বজনরা মিলে হরিলুট, হাজার কোটি টাকা লুপাট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

বন আগুনে পোড়ানোর প্রতিবাদে সামাজিক সংগঠন পাথারিয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ টিমের মানববন্ধনে বাধা দেয় তখনকার মন্ত্রীর অনুসারী, ভূমি-বন দখলদাররা।

বন্যপ্রাণী গবেষকদের মতে, এই বনের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল যতটুকু এখনও টিকে আছে, সঠিকভাবে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিলে এসব প্রাণীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। মাধবছড়া ও লাঠিটিলা বনবিটের সীমান্তবর্তী প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের সঙ্গে সমনবাগের কিছু এলাকাজুড়ে, এখনই সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করতে হবে। বন্যপ্রাণী শিকারি ও গাছ চোরা কারবারিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়াও জরুরি।

বিভিন্ন পত্রপত্রিকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণী গবেষক ড. এম এ আজিজকে উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছে যে, পাথারিয়া পাহাড়ে মানুষের আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। একে ছেড়ে দিতে হবে প্রকৃতির ওপর। এতে যে পাথারিয়া ধীরে ধীরে বিরল বন্যপ্রাণীর শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে উঠবে, এটি নিশ্চিত করে বলা যায়।

ছবি

আসন্ন বৈঠক ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতূহল, আলোচনায় নির্বাচনী প্রসঙ্গ

ছবি

শোকবার্তা পাঠালেন মুহাম্মদ ইউনূস এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান বিধ্বস্তে প্রাণহানি

ছবি

দেশের কিছু অঞ্চলে মৃদু তাপপ্রবাহ, কোথাও কোথাও হতে পারে বৃষ্টি

ছবি

এক মাসেই ৬৫৮ জন নিহত, দুর্ঘটনায় শীর্ষে ঢাকা বিভাগ

ছবি

২৫ জুলাইয়ের মধ্যে এসএসসির ফল প্রকাশের প্রস্তুতি

ছবি

দুই সপ্তাহ পর আংশিক চালু চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা, শনিবার থেকে পুরোপুরি চালুর সম্ভাবনা

ছবি

ইউনূসকে সাক্ষাৎ দিচ্ছেন না ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্টারমার

ছবি

যুক্তরাজ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী জাবেদের সম্পত্তি জব্দ

ছবি

‘দেশ ও রাজনীতির নিরাপত্তার স্বার্থে’ আ.লীগের কার্যক্রম ‘স্থগিত’, দল নিষিদ্ধ নয় : মুহাম্মদ ইউনূস

ছবি

নির্বাচন শেষেই বিদায়—পরবর্তী সরকারের অংশ হওয়ার ইচ্ছা নেই: মুহাম্মদ ইউনূস

ছবি

বাড়ছে করোনার সংক্রমণ, প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১১ নির্দেশনা

ছবি

বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্বে আগ্রহী এয়ারবাস ও মেনজিস

ছবি

তাপপ্রবাহ কিছুটা কমতে পারে, ভ্যাপসা গরম থাকবে: আবহাওয়া অফিস

ছবি

মেট্রোরেলে যাত্রীদের মাস্ক পরার অনুরোধ

ছবি

হাজিদের ফিরতি ফ্লাইট শুরু আজ, চলবে ১০ জুলাই পর্যন্ত

ছবি

লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ও তারেক রহমানের সম্ভাব্য বৈঠক ১৩ জুন

যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে দেশ ছাড়লেন প্রধান উপদেষ্টা

ছবি

করোনার নতুন ধরন নিয়ে সতর্কতা, ভারতসহ আক্রান্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ এড়ানোর পরামর্শ

ছবি

৩৩ জেলায় তাপপ্রবাহ, বুধবার থেকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বস্তিদায়ক হতে পারে

ছবি

ইউনূস-মোদীর মধ্যে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়

ছবি

‘নির্দোষরা যেন সাজা না পায়’—সাবেক রাষ্ট্রপতি হামিদ ইস্যুতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ছবি

চার দিনের সফরে আজ যুক্তরাজ্যে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা

ছবি

মধ্য রাতে দেশে ফিরলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ

এ কে খন্দকারের স্ত্রী ফরিদা খন্দকারের ইন্তেকাল

ছবি

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন, ইউনূসের সাক্ষাৎ চেয়ে চিঠি দিয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক

ছবি

ঈদের ফিরতি যাত্রায় ট্রেনযাত্রীদের মাস্ক পরার অনুরোধ

ছবি

ঈদের ছুটিতে বৃষ্টির পরও ঢাকায় ‘অস্বাস্থ্যকর’ বাতাস

ছবি

২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় ২৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রি

ছবি

ঈদের দিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সেনা ও নৌবাহিনী প্রধানের সাক্ষাৎ

ছবি

কোরবানির পশু কাটতে গিয়ে শতাধিক ব্যক্তি আহত

ছবি

উৎসবের আমেজে উদযাপিত হচ্ছে ঈদুল আজহা

ছবি

ঢাকাসহ ৬ বিভাগে হালকা বৃষ্টির আভাস

ছবি

দেশের মঙ্গলে সবার দোয়া চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা

ছবি

জাতীয় ঈদগাহে ঈদুল আজহার প্রধান জামাত, দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনা

আজ ঈদুল আজহা

সব অংশীদারকে এই প্রক্রিয়ায় গঠনমূলকভাবে জড়িত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইইউ

tab

জাতীয়

পাথারিয়ায় বনভূমি দখল, জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে

সংগ্রাম দত্ত, শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার)

আগুনে পুড়ে গেছে পাথারিয়া বনাঞ্চলের একাংশ -সংবাদ

রোববার, ১১ মে ২০২৫

মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তরেখার মধ্যবর্তী চারটি বনবিট নিয়ে গঠিত পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্ট। এই বনাঞ্চলের বনভূমির প্রায় এক হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা দখল করে নিয়েছে এক শ্রেণীর প্রভাবশালী মহল। তাদের দৌরাত্ম্যে হুমকিতে আছে পরিবেশ।

নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এখনও টিকে আছে অন্তত ৩৮ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, খাবার সংকটে তারা ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে

পাথারিয়া পাহাড়ের ১৩৫ বর্গ কিলোমিটার মোট আয়তনের প্রায় ৮৮ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশে, আর ৪৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে ভারতে

জানা গেছে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম সৃষ্টি মৌলভীবাজারের উত্তর ও পূর্বে পাথারিয়া পাহাড় অঞ্চল। উত্তর-দক্ষিণে পঁচিশ মাইল বিস্তৃত। পাথারিয়ার চিরহরিৎ বনাঞ্চল বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ। বড়লেখার পাথারিয়া বনভূমি থেকে হাকালুকি হাওর যেন বড়লেখা থানার পূর্ব-পশ্চিম পাড়ের গীতিময় কথোপকথন। পাথারিয়া পাহাড়ে আছে তিনটি উল্লেখযোগ্য শৃঙ্গ। যথাক্রমে দূরবীনটিলা, গগনটিলা ও রাজবাড়ি টিলা।

এই পাহাড় প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। পাথারিয়া পাহাড়ে আছে তেলকূপ। এখান থেকে তেল উত্তোলনের জন্য বার্মা অয়েল কোম্পানি (বিওসি) ১৯৩৩ সালে তেলকূপ খননের চেষ্টা চালানোর সময় পাইপ ফেটে যায়। তেলের ঊর্ধ্বচাপে তা’ উপত্যকা ও পাশ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে জনমনে ভীতির সঞ্চার হয়। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে।

পাথারিয়া পাহাড়ের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে এই এলাকারই বাসিন্দা বিশিষ্ট উদ্ভিদবিদ অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। তিনি পাথারিয়ার ফুল-ফসলের নানা বর্ণনা তুলে ধরেছেন তার অনেক লেখায়।

পাথারিয়া পাহাড়ের বুকে সৃষ্ট বড়লেখার ঐতিহ্য মাধবতীর্থ মাধবকুণ্ড দেশের তথা বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। মাধবছড়া পাথারিয়া পাহাড়ের গঙ্গামারা থেকে গড়িয়ে আসা জল প্রায় দুই শত ফুট উঁচু থেকে নিচে খাড়াভাবে গড়িয়ে পড়ছে।

কিন্তু এ নৈসর্গিক সৌন্দর্য ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। এক শ্রেণীর প্রভাবশালী লোক জন এখানকার জমি দখল করে নিয়মবহির্ভূতভাবে জনবসতি গড়ে তুলছে। গত অর্ধশত বছরে পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্ট বনাঞ্চলের আয়তন ১ হাজার ১৫২ বর্গ কিলোমিটার থেকে মাত্র ১৩৫ বর্গ কিলোমিটারে নেমে এসেছে বলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। যা বন্যপ্রাণী ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আবাসস্থল সংকটে ইতোমধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে এই বনের বিভিন্ন প্রজাতির জীববৈচিত্র্য। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এখনও টিকে আছে প্রায় ৩৮ প্রজাতির স্থন্যপায়ী প্রাণী। এগুলোও খাবার সংকটে বন ছেড়ে ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। বনাঞ্চল রক্ষা ও বন্যপ্রাণীর আবাস্থল নিরাপদ রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়ায় বর্তমানে যেটুকু আছে সেটিও হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য হটস্পটের মিশ্র চিরসবুজ বনাঞ্চল পাথারিয়া হিলস্ রিজার্ভ ফরেস্টের পূর্ব দিকে ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ, উত্তরে শাহবাজপুর আর দক্ষিণ ও পশ্চিমে চা-বাগান। পাহাড়ের মাঝে মাঝে মানুষের বসতি। অতি পরিচিত

মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত পাথারিয়া পাহাড়ে পরিবেশগতভাবে মিশ্র চিরসবুজ বনাঞ্চলের এ অংশটি ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য হটস্পটের অংশ।

সেই ১৯২০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে এই বনকে ‘সংরক্ষিত বন’ ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সালে পাথারিয়া পাহাড়ের আয়তন ১ হাজার ১৫২ বর্গ কিলোমিটার ছিল বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে। ক্রমশ মানুষের বসতি বেড়ে এই বনের আয়তন দিন দিন কমছে। বর্তমানে পাথারিয়া পাহাড়ের সম্মিলিত আয়তন মাত্র ১৩৫ বর্গ কিলোমিটারে এসেছে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৮৮ বর্গ কিলোমিটার আর ৪৭ বর্গ কিলোমিটার পড়েছে ভারত অংশে।

পাথারিয়া বনে বুনো মোষ, বাঘ, জলার হরিণ, গণ্ডারসহ বড় আকারের অনেক বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ছিল।

বিগত দুই বছর আগেও ক্যামেরা ট্র্যাপিং করে এই বনে এশীয় হাতি, বিপন্ন ফেরেট ব্যাজার, বাঁশ ভাল্লুক, সজারু, হলদে গলা মারটেন, আসামি বানরসহ অনেক বিপন্ন প্রাণী দেখা গেছে।

স্থানীয় মধু শিকারিরা স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, বিগত ২০১৭-১৮ সালের দিকে ভারত থেকে এক দল আদিবাসী শিকারি বাংলাদেশ অংশে এসে পাখি, বানর, গুইসাপ, চশমাপরা ও মুখপোড়া হনুমানসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাণী শিকার করলেও, তখন বন বিভাগ নীরব ভূমিকা পালন করে।

পাথারিয়ায় মাত্র চারটি মেয়ে বন্যহাতি সংগ্রাম করে টিকে আছে। কখনও বনে তাদের পদচিহ্ন দেখে তাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। এই দলের একটি হাতি বৃদ্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয়রা গণমাধ্যম কর্মীদের বলেছেন, পুরুষ হাতি না পেলে শিগগিরই হাতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হাতিগুলোর বিলুপ্তি ঠেকাতে এখনই পাথারিয়া পাহাড়ে অন্তত একটি পুরুষ হাতি অবমুক্ত করা প্রয়োজন।

বিগত ২০২২-২৩ সালে দেখা গেছে, অস্বাভাবিকভাবে বন্যপ্রাণীরা বন ছেড়ে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। এতে মানুষের সঙ্গে সংঘাতের পাশাপাশি বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে প্রাণীরা নিয়মিত মারা যায়। তাদের চিরচেনা প্রিয় আবাস্থল ছেড়ে লোকালয়ে আসার কারণ হিসেবে জানা গেছে, বনের মূল ভূখণ্ডে বন বিভাগের কৃত্রিম বনায়ন। এসব কারণে তাদের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। স্থানান্তরিত হতে গিয়ে বন্যপ্রাণীরা অস্থিত্ব হারাচ্ছে। বনের প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধস্থানে ২০২০ সালের জরিপে দেখা গেছে চারটি উল্লুকের পরিবার। কিন্তু বনায়নের কারণে বিভিন্ন ফলজ গাছ এবং লতাগুল্ম কেটে ফেলার কারণে বন্যপ্রাণীদের খাবারের সংকট দেখা দেয়।

সুরমা বাঁশমহালের বনায়নকৃত এই এলাকায় এখন আর কোনো বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে না। গত ২০২৩ সালের ১১ মার্চ মিশ্র চিরসবুজ সমনভাগ বিটের ধলছড়ি ও মাকাল জোরা এলাকায় প্রায় ৪০ হেক্টর বন ভূমি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এক পাশে এখন দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন।

এ দিকে বনের একপাশে অবাধে চলছে বাঁশ কাটার মহোৎসব। প্রায় ৪০ জন শ্রমিক দিয়ে সরকারি সম্পত্তিগুলোকে নষ্ট করা হয় বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে ।

বড়লেখার সাবেক এক প্রভাবশালী মন্ত্রী, তার ছেলে আত্মীয়-স্বজন ও অনুসারীরা মিলে বন ধ্বংস করতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ও বন পুড়িয়ে দখলে নিয়েছেন হাজার হাজার একর সরকারি ভূমি। আবার কেউ কেউ আইনের তোয়াক্কা না করে সাবাড় করছেন বনের গাছ। গত কয়েক বছর পূর্বে জুড়ীর পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্টের আওতাধীন সমনভাগ বিটের ধলছড়ি ও মাকালজোড়ায় ৪০ হেক্টর বনভূমি আগুনে পুড়ে যায়। প্রায় চার দিন বনে আগুন জ্বললেও তৎকালীন পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর কোনো নড়চড় হয়নি। সে সময় মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে প্রকাশিত পাতাকুঁড়ির দেশ ১ অক্টোবর ২০২৪ সালে ‘সাবেক পরিবেশ মন্ত্রীর ছেলে ও স্বজনরা মিলে হরিলুট, হাজার কোটি টাকা লুপাট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

বন আগুনে পোড়ানোর প্রতিবাদে সামাজিক সংগঠন পাথারিয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ টিমের মানববন্ধনে বাধা দেয় তখনকার মন্ত্রীর অনুসারী, ভূমি-বন দখলদাররা।

বন্যপ্রাণী গবেষকদের মতে, এই বনের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল যতটুকু এখনও টিকে আছে, সঠিকভাবে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিলে এসব প্রাণীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। মাধবছড়া ও লাঠিটিলা বনবিটের সীমান্তবর্তী প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের সঙ্গে সমনবাগের কিছু এলাকাজুড়ে, এখনই সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করতে হবে। বন্যপ্রাণী শিকারি ও গাছ চোরা কারবারিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়াও জরুরি।

বিভিন্ন পত্রপত্রিকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণী গবেষক ড. এম এ আজিজকে উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছে যে, পাথারিয়া পাহাড়ে মানুষের আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। একে ছেড়ে দিতে হবে প্রকৃতির ওপর। এতে যে পাথারিয়া ধীরে ধীরে বিরল বন্যপ্রাণীর শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে উঠবে, এটি নিশ্চিত করে বলা যায়।

back to top