কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় প্রকল্প থেকে পাওয়া মাশরুম ঘর -সংবাদ
মাশরুম চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্প ভয়াবহ লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। ভুয়া বিল ভাউচার বানিয়ে টাকা উত্তোলন, ডিপিপি অনুযায়ী তালিকার জিনিসপত্র সরবরাহ না করা, সরবাহকৃত জিনিসপত্র খুবই নিম্নমানের, প্রকল্প সুবিধাভোগীদের কৃষি অফিসার ও সহকারীদের দিয়ে নানাভাবে হয়রানির কারণে মাশরুম চাষিরা প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এমন নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে ‘অঙ্কুরেই বিনষ্ট’ হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
একদম ভাঙাচোরা পুরাতন ভ্যান, একটা ভ্যান দিচে (দিয়েছে) ওই ভ্যাঙাচোরা ভ্যানটি নিয়ে আমার উঠানের ওপরই রং করছে। তিন দিকে টিন দিয়া ঢাকি দিছে ওইটা কী করবো আমি! : কুড়িগ্রাম সদরের রাহেলা বেগম
বড় ফ্রেম, ছোট ফ্রেম, এক্সজস্ট ফ্যান, কুলিং প্যাড, চাষ ঘরের বড় ফ্রেম, ছোট ফ্রেম, ত্রিপল, টেমকেয়ার (পিইপি), এক্সজস্ট ফ্যান, কুলিং প্যাড ও কন্টেইনার পাননি রংপুরের রুবেল মিয়া।
‘আমার বলার মতো কিছু নাই। মাশরুম চাষ ছেড়েই দিতে হবে!’ : ফরিদপুরের সুরুজ
জানা যায়, উপজেলা কৃষি অফিসারের অনুকূলে ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে প্রতিটি স্পন ও মাশরুম প্রদর্শনীর জন্য ৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রতিটি প্রদর্শনী প্রকল্পে ইনকুবেশন কক্ষ, চাষঘর, স্টেবিলাইজেশন কাম ইনকুলেশন চেম্বার স্থাপন ছাড়াও মালামাল রক্ষণের জন্য র্যাক ও পরিবহনের জন্য ব্যাটারিচালিত ভ্যানের বিপরীতে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু বরাদ্দকৃত ওই অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় করা হয়নি।
কুড়িগ্রাম সদরের রাহেলা বেগম। ’৯২ সালে এইচএসসি পাস করার পর আর পড়ালেখা করতে পারেননি। কিন্তু তার মনে ছিল আদম্য ইচ্ছা শক্তি। সব সময় তিনি নতুন কিছু করার চেষ্টা করতেন। কখনো গরুর খামার আবার কখনো মুরগির খামার। আয়ও করেছেন। আবার নিজ উদ্যোগেই শুরু করেছেন মাশরুম চাষ। এই বয়সে নিজেই সেই মাশরুম মার্কেটিং করে সফলও হয়েছেন। তখন কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাশরুম চাষ প্রকল্পের আওতায় ট্রেনিং নেন। প্রায় এক বছর ট্রেনিং নেয়া হলেও তার সেই মাশরুমের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি।
তিনি বলেন, ‘কোরবানির ঈদের আগেই আমার ঘর কম্পিলিট করলেও আমি এখনও চাষ শুরু করতে পারিনি। ‘তার অভিযোগ, অন্য সব চাষি মাশরুম চাষের জন্য দুইটি ঘর পেলেও তিনি একটি ঘর পেয়েছেন। তবে, তার ঘরটি অন্যদের তুলনায় একটু বড় বলেও সরল স্বীকারোক্তি তার। তিনি মাশরুম চাষের জন্য ২টি বড় আর ২টি ছোট র্যাক পেয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘পুরাতন মানে একদম ভাঙাচোরা ভ্যান একটা ভ্যান দিচে (দিয়েছে)। ওই ভ্যাঙাচোরা ভ্যানটি নিয়ে আমার উঠানের ওপরই রং করছে। ওইটা কী করবো আমি, তিন দিকে ঢাকি দিয়ে টিন দিয়া।’ ভ্যানের বিষয়ে প্রকল্পের পিডি
আপাকে অনেকদিন ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি বলে অভিযোগ রাহেলার।
কুড়িগ্রাম সদরের উপজেলা কৃষি অফিসার মোছা. নাহিদা আফরীন পুরাতন ভ্যান দেয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘৪০ হাজার টাকায় নতুন ভ্যান দেয়া পাওয়া যায় না এজন্য পুরাতন ভ্যানটি দেয়া হয়েছে।’ অথচ প্রকল্পের ডিপিপিতে বরাদ্ধ ৪৫ হাজার টাকা। আর বাস্তবে একটি নতুন ভ্যানের দাম ১২-১৫ হাজার টাকারও কম। আর পুরাতন ভ্যান ৬-৮ হাজার টাকা।
রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার বড় পাহাড়পুর গ্রামের রুবেল মিয়া। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘আমার কাজ করা শেষ করে দিছে। কিন্তু আমার ব্যাচের কোনো জায়গায় ১২টা র্যাক পাইছে আর আমি ৪টা র্যাক পাইছি। উপ-সহকারীর নিকট জানতে চাইলে বলে, ‘তোমাকে যা দিছি সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকো, কাউকে কিছু বলার দরকার নাই। এজন্য আমি কাউকে কিছু বলি নাই।’ তবে সেখানকার কৃষি অফিসার ওই প্রকল্প তদারকি করতে কখনো যায়নি বলে অভিযোগ রুবেলের।
রুবেল মিয়ার পাওয়া না পাওয়ার তালিকা সংবাদের নিকট পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, প্রকল্পের ডিপিপি বিবরণ অনুযায়ী ইনকুবেশন কক্ষের বিবরণ অনুযায়ী বড় ফ্রেম, ছোট ফ্রেম, এক্সজস্ট ফ্যান, কুলিং প্যাড তাকে দেয়া হয়নি। অন্যদিকে চাষ ঘরের বড় ফ্রেম, ছোট ফ্রেম, ত্রিপল, টেমকেয়ার (পিইপি), এক্সজস্ট ফ্যান, কুলিং প্যাড ও কন্টেইনার পাননি তিনি। এছাড়া পিভিসি পাইপও সরবরাহ করা হয়নি তাকে। তিনি যে মার্কেটিং এর জন্য যে ভ্যানটি পেয়েছেন তার দাম সর্বোচ্চ ১৭ হাজার টাকা। আর যেসব পেয়েছেন তা ডিপিপি অনুযায়ী নিম্নমানের।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার সাবেক উপজেলা কৃষি অফিসার মো. সাদেকুজ্জামান সরকার চালেঞ্জ করে বলেন, ‘আমি যেভাবে ঘর নির্মাণ করছি সেভাবে কেউ ঘর নির্মাণ করে দেখাক।’
ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার মাশরুম চাষি সুরুজ। ৫ বছর ধরে নিজ উদ্যোগেই মাশরুম চাষ করেন। ভালোই চলছিল। আরও বড় কিছু করার স্বপ্নে প্রকল্পের আওতায় এক বছর আগে প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন, কিন্তু কৃষি কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে তার স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। তিনি বলেন, ‘ঘর দেয়ার কথা সেটা করেও দিচ্ছে না আমি আর চাষ করতেও পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘ট্রেনিংয়ের পর ঘুরতে ঘুরতে গত ১০-১৫ দিন আগে ফ্লোর করার জন্য ৩০ হাজার টাকা দিয়েছে বলছে ফ্লোর দুইটা কম্পিলিট করেন। ওই টাকায় করতে পারি নাই আমার আরও নিজের টাকা খরচ হয়েছে।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার বলার মতো কিছু নাই। মাশরুম চাষ ছেড়েই দিতে হবে!’
মধুখালী উপজেলার কৃষি অফিসার মাহাবুব এলাহীর নিকট সুরুজ মিয়াকে টাকা দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করেন। বলেন, ‘আমি কেন টাকা দিবো।’ পরে ৩০ হাজার টাকা দেয়ার বিষয়টি বললে টাকা দেয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির জন্য সুরুজ মিয়ার কাজটি শেষ করা যায়নি।’ কৃষি কর্মকর্তারা মনে করেন, গত জুনেই শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ৩০ হাজার টাকা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছেন সংশ্লিষ্ট কৃষি অফিসার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাশরুম চাষের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) আখতার জাহান কাঁকন সংবাদকে বলেন, ‘এ রকম হওয়ার কথা না। ডিপিপিতে যা আছে সবই পাবে। র্যাকের ক্ষেত্রে দুই একটা কম হতে পারে তবে ১২টার জায়গায় ৪টা হতে পারে না। টিনের চালের মধ্যে টেমকেয়ার (পিইপি)অবশ্যই থাকবে।
ঘরের বেড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সংশোধনে বিষয়গুলো ক্লিয়ার করার কথা বলেন তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রদর্শনী প্রকল্পের ব্যয় বরাদ্দ সূত্রে জানা যায়, প্রতিটি প্রদর্শনী প্রকল্পে ইনকুবেশন কক্ষ ও তার আনুষঙ্গিক ব্যয় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৫০০ টাকা, চাষঘর ও তার আনুষঙ্গিক ব্যয় ১ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ টাকা, স্টেরিলাইজেশন কাম ইনোকুলেশন চেম্বারের আনুষঙ্গিক ব্যয় ৩০ হাজার টাকা, সাইনবোর্ড বাবদ ২ হাজার টাকা, মার্কেটিংয়ের ভ্যান ক্রয় বাবদ ৪৫ হাজার টাকা, সেটিং ও পরিবহন খরচ বাবদ ৫ হাজার টাকাসহ মোট ৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ একটি অডিট রিপোর্টে প্রকল্পের সীমাহীন লুটপাটের তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে চাষিদের অভিযোগ, মাশরুম চাষে নতুন তাদের আর্থিক আয় তুলনামূলকভাবে অনেক কম, এমনকি অনেক চাষির মাশরুম থেকে আয় হয় না বললেই চলে। এছাড়া উদ্যোক্তা ও সাধারণ চাষি নির্বাচনে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক পরিচয়, স্বজনপ্রীতি (উদ্যোক্তার পছন্দমতো দল গঠন করায়) ইত্যাদি বিবেচনায় নির্বাচন করা হয়েছে। ফলে আগ্রহী বা প্রত্যাশী চাষিদের অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাচন করা হয়নি যার জন্য দলের বেশিরভাগ চাষিরাই মাশরুম চাষে আগ্রহী হচ্ছে না বা দল ত্যাগ করছেন।
প্রকল্পে একের পর এক অসঙ্গতি, অনিয়ম ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ধরা পড়েছে খোদ সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে। মাঠপর্যায়ের কৃষকরা প্রকৃত উপকারভোগী না হয়ে বরং হয়েছেন বঞ্চিত, আর দুর্বল পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ফলে সরকারের বিপুল অর্থ বিনিয়োগের সুফল দৃশ্যমান নয়।
আইএমইডির প্রকল্প পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ কার্যক্রম কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। প্রকল্প এলাকার বড় অংশে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম হয়েছে অনুপযুক্ত সময়ে ও এলোমেলো পদ্ধতিতে, যার ফলে কৃষকের মাঝে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো দক্ষতা তৈরি হয়নি। প্রকল্পে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের তালিকা, কৃষকের নাম ও পরিচয় নিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অসামঞ্জস্যতা ধরা পড়েছে। বাস্তবে যারা প্রশিক্ষণ পাননি, তাদের নামও তালিকায় আছে। অনেক এলাকায় স্থানীয় রাজনৈতিক চাপ ও দালালচক্রের মাধ্যমে প্রকৃত কৃষকের পরিবর্তে প্রভাবশালী ও অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। প্রকল্প এলাকার অধিকাংশ কৃষকের মতে, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তারা শুধু উদ্বোধন অনুষ্ঠান বা ছবি তোলা পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন, এরপর আর খোঁজ রাখেননি।
আইএমইডি পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পে প্রশিক্ষণ, জনসচেতনতা ও অবকাঠামো খাতে যেভাবে ব্যয় দেখানো হয়েছে, তা বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। স্থানীয় কৃষি অফিসগুলো থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, প্রকল্প-পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ এলাকায় উৎপাদনশীলতা বাড়ার কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় প্রকল্প থেকে পাওয়া মাশরুম ঘর -সংবাদ
শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫
মাশরুম চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্প ভয়াবহ লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। ভুয়া বিল ভাউচার বানিয়ে টাকা উত্তোলন, ডিপিপি অনুযায়ী তালিকার জিনিসপত্র সরবরাহ না করা, সরবাহকৃত জিনিসপত্র খুবই নিম্নমানের, প্রকল্প সুবিধাভোগীদের কৃষি অফিসার ও সহকারীদের দিয়ে নানাভাবে হয়রানির কারণে মাশরুম চাষিরা প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এমন নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে ‘অঙ্কুরেই বিনষ্ট’ হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
একদম ভাঙাচোরা পুরাতন ভ্যান, একটা ভ্যান দিচে (দিয়েছে) ওই ভ্যাঙাচোরা ভ্যানটি নিয়ে আমার উঠানের ওপরই রং করছে। তিন দিকে টিন দিয়া ঢাকি দিছে ওইটা কী করবো আমি! : কুড়িগ্রাম সদরের রাহেলা বেগম
বড় ফ্রেম, ছোট ফ্রেম, এক্সজস্ট ফ্যান, কুলিং প্যাড, চাষ ঘরের বড় ফ্রেম, ছোট ফ্রেম, ত্রিপল, টেমকেয়ার (পিইপি), এক্সজস্ট ফ্যান, কুলিং প্যাড ও কন্টেইনার পাননি রংপুরের রুবেল মিয়া।
‘আমার বলার মতো কিছু নাই। মাশরুম চাষ ছেড়েই দিতে হবে!’ : ফরিদপুরের সুরুজ
জানা যায়, উপজেলা কৃষি অফিসারের অনুকূলে ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে প্রতিটি স্পন ও মাশরুম প্রদর্শনীর জন্য ৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রতিটি প্রদর্শনী প্রকল্পে ইনকুবেশন কক্ষ, চাষঘর, স্টেবিলাইজেশন কাম ইনকুলেশন চেম্বার স্থাপন ছাড়াও মালামাল রক্ষণের জন্য র্যাক ও পরিবহনের জন্য ব্যাটারিচালিত ভ্যানের বিপরীতে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু বরাদ্দকৃত ওই অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় করা হয়নি।
কুড়িগ্রাম সদরের রাহেলা বেগম। ’৯২ সালে এইচএসসি পাস করার পর আর পড়ালেখা করতে পারেননি। কিন্তু তার মনে ছিল আদম্য ইচ্ছা শক্তি। সব সময় তিনি নতুন কিছু করার চেষ্টা করতেন। কখনো গরুর খামার আবার কখনো মুরগির খামার। আয়ও করেছেন। আবার নিজ উদ্যোগেই শুরু করেছেন মাশরুম চাষ। এই বয়সে নিজেই সেই মাশরুম মার্কেটিং করে সফলও হয়েছেন। তখন কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাশরুম চাষ প্রকল্পের আওতায় ট্রেনিং নেন। প্রায় এক বছর ট্রেনিং নেয়া হলেও তার সেই মাশরুমের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি।
তিনি বলেন, ‘কোরবানির ঈদের আগেই আমার ঘর কম্পিলিট করলেও আমি এখনও চাষ শুরু করতে পারিনি। ‘তার অভিযোগ, অন্য সব চাষি মাশরুম চাষের জন্য দুইটি ঘর পেলেও তিনি একটি ঘর পেয়েছেন। তবে, তার ঘরটি অন্যদের তুলনায় একটু বড় বলেও সরল স্বীকারোক্তি তার। তিনি মাশরুম চাষের জন্য ২টি বড় আর ২টি ছোট র্যাক পেয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘পুরাতন মানে একদম ভাঙাচোরা ভ্যান একটা ভ্যান দিচে (দিয়েছে)। ওই ভ্যাঙাচোরা ভ্যানটি নিয়ে আমার উঠানের ওপরই রং করছে। ওইটা কী করবো আমি, তিন দিকে ঢাকি দিয়ে টিন দিয়া।’ ভ্যানের বিষয়ে প্রকল্পের পিডি
আপাকে অনেকদিন ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি বলে অভিযোগ রাহেলার।
কুড়িগ্রাম সদরের উপজেলা কৃষি অফিসার মোছা. নাহিদা আফরীন পুরাতন ভ্যান দেয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘৪০ হাজার টাকায় নতুন ভ্যান দেয়া পাওয়া যায় না এজন্য পুরাতন ভ্যানটি দেয়া হয়েছে।’ অথচ প্রকল্পের ডিপিপিতে বরাদ্ধ ৪৫ হাজার টাকা। আর বাস্তবে একটি নতুন ভ্যানের দাম ১২-১৫ হাজার টাকারও কম। আর পুরাতন ভ্যান ৬-৮ হাজার টাকা।
রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার বড় পাহাড়পুর গ্রামের রুবেল মিয়া। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘আমার কাজ করা শেষ করে দিছে। কিন্তু আমার ব্যাচের কোনো জায়গায় ১২টা র্যাক পাইছে আর আমি ৪টা র্যাক পাইছি। উপ-সহকারীর নিকট জানতে চাইলে বলে, ‘তোমাকে যা দিছি সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকো, কাউকে কিছু বলার দরকার নাই। এজন্য আমি কাউকে কিছু বলি নাই।’ তবে সেখানকার কৃষি অফিসার ওই প্রকল্প তদারকি করতে কখনো যায়নি বলে অভিযোগ রুবেলের।
রুবেল মিয়ার পাওয়া না পাওয়ার তালিকা সংবাদের নিকট পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, প্রকল্পের ডিপিপি বিবরণ অনুযায়ী ইনকুবেশন কক্ষের বিবরণ অনুযায়ী বড় ফ্রেম, ছোট ফ্রেম, এক্সজস্ট ফ্যান, কুলিং প্যাড তাকে দেয়া হয়নি। অন্যদিকে চাষ ঘরের বড় ফ্রেম, ছোট ফ্রেম, ত্রিপল, টেমকেয়ার (পিইপি), এক্সজস্ট ফ্যান, কুলিং প্যাড ও কন্টেইনার পাননি তিনি। এছাড়া পিভিসি পাইপও সরবরাহ করা হয়নি তাকে। তিনি যে মার্কেটিং এর জন্য যে ভ্যানটি পেয়েছেন তার দাম সর্বোচ্চ ১৭ হাজার টাকা। আর যেসব পেয়েছেন তা ডিপিপি অনুযায়ী নিম্নমানের।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার সাবেক উপজেলা কৃষি অফিসার মো. সাদেকুজ্জামান সরকার চালেঞ্জ করে বলেন, ‘আমি যেভাবে ঘর নির্মাণ করছি সেভাবে কেউ ঘর নির্মাণ করে দেখাক।’
ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার মাশরুম চাষি সুরুজ। ৫ বছর ধরে নিজ উদ্যোগেই মাশরুম চাষ করেন। ভালোই চলছিল। আরও বড় কিছু করার স্বপ্নে প্রকল্পের আওতায় এক বছর আগে প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন, কিন্তু কৃষি কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে তার স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। তিনি বলেন, ‘ঘর দেয়ার কথা সেটা করেও দিচ্ছে না আমি আর চাষ করতেও পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘ট্রেনিংয়ের পর ঘুরতে ঘুরতে গত ১০-১৫ দিন আগে ফ্লোর করার জন্য ৩০ হাজার টাকা দিয়েছে বলছে ফ্লোর দুইটা কম্পিলিট করেন। ওই টাকায় করতে পারি নাই আমার আরও নিজের টাকা খরচ হয়েছে।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার বলার মতো কিছু নাই। মাশরুম চাষ ছেড়েই দিতে হবে!’
মধুখালী উপজেলার কৃষি অফিসার মাহাবুব এলাহীর নিকট সুরুজ মিয়াকে টাকা দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করেন। বলেন, ‘আমি কেন টাকা দিবো।’ পরে ৩০ হাজার টাকা দেয়ার বিষয়টি বললে টাকা দেয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির জন্য সুরুজ মিয়ার কাজটি শেষ করা যায়নি।’ কৃষি কর্মকর্তারা মনে করেন, গত জুনেই শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ৩০ হাজার টাকা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছেন সংশ্লিষ্ট কৃষি অফিসার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাশরুম চাষের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) আখতার জাহান কাঁকন সংবাদকে বলেন, ‘এ রকম হওয়ার কথা না। ডিপিপিতে যা আছে সবই পাবে। র্যাকের ক্ষেত্রে দুই একটা কম হতে পারে তবে ১২টার জায়গায় ৪টা হতে পারে না। টিনের চালের মধ্যে টেমকেয়ার (পিইপি)অবশ্যই থাকবে।
ঘরের বেড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সংশোধনে বিষয়গুলো ক্লিয়ার করার কথা বলেন তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রদর্শনী প্রকল্পের ব্যয় বরাদ্দ সূত্রে জানা যায়, প্রতিটি প্রদর্শনী প্রকল্পে ইনকুবেশন কক্ষ ও তার আনুষঙ্গিক ব্যয় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৫০০ টাকা, চাষঘর ও তার আনুষঙ্গিক ব্যয় ১ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ টাকা, স্টেরিলাইজেশন কাম ইনোকুলেশন চেম্বারের আনুষঙ্গিক ব্যয় ৩০ হাজার টাকা, সাইনবোর্ড বাবদ ২ হাজার টাকা, মার্কেটিংয়ের ভ্যান ক্রয় বাবদ ৪৫ হাজার টাকা, সেটিং ও পরিবহন খরচ বাবদ ৫ হাজার টাকাসহ মোট ৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ একটি অডিট রিপোর্টে প্রকল্পের সীমাহীন লুটপাটের তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে চাষিদের অভিযোগ, মাশরুম চাষে নতুন তাদের আর্থিক আয় তুলনামূলকভাবে অনেক কম, এমনকি অনেক চাষির মাশরুম থেকে আয় হয় না বললেই চলে। এছাড়া উদ্যোক্তা ও সাধারণ চাষি নির্বাচনে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক পরিচয়, স্বজনপ্রীতি (উদ্যোক্তার পছন্দমতো দল গঠন করায়) ইত্যাদি বিবেচনায় নির্বাচন করা হয়েছে। ফলে আগ্রহী বা প্রত্যাশী চাষিদের অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাচন করা হয়নি যার জন্য দলের বেশিরভাগ চাষিরাই মাশরুম চাষে আগ্রহী হচ্ছে না বা দল ত্যাগ করছেন।
প্রকল্পে একের পর এক অসঙ্গতি, অনিয়ম ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ধরা পড়েছে খোদ সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে। মাঠপর্যায়ের কৃষকরা প্রকৃত উপকারভোগী না হয়ে বরং হয়েছেন বঞ্চিত, আর দুর্বল পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ফলে সরকারের বিপুল অর্থ বিনিয়োগের সুফল দৃশ্যমান নয়।
আইএমইডির প্রকল্প পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ কার্যক্রম কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। প্রকল্প এলাকার বড় অংশে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম হয়েছে অনুপযুক্ত সময়ে ও এলোমেলো পদ্ধতিতে, যার ফলে কৃষকের মাঝে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো দক্ষতা তৈরি হয়নি। প্রকল্পে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের তালিকা, কৃষকের নাম ও পরিচয় নিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অসামঞ্জস্যতা ধরা পড়েছে। বাস্তবে যারা প্রশিক্ষণ পাননি, তাদের নামও তালিকায় আছে। অনেক এলাকায় স্থানীয় রাজনৈতিক চাপ ও দালালচক্রের মাধ্যমে প্রকৃত কৃষকের পরিবর্তে প্রভাবশালী ও অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। প্রকল্প এলাকার অধিকাংশ কৃষকের মতে, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তারা শুধু উদ্বোধন অনুষ্ঠান বা ছবি তোলা পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন, এরপর আর খোঁজ রাখেননি।
আইএমইডি পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পে প্রশিক্ষণ, জনসচেতনতা ও অবকাঠামো খাতে যেভাবে ব্যয় দেখানো হয়েছে, তা বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। স্থানীয় কৃষি অফিসগুলো থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, প্রকল্প-পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ এলাকায় উৎপাদনশীলতা বাড়ার কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই।