alt

জাতীয়

অনন্য দুঃসাহসী কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবু বকর বীর বিক্রম

সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট : মঙ্গলবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২১

মাত্র ১৮ বছরের একজন কিশোর, একাত্তরের কিংবদন্তি বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবু বকর। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত সর্ব কনিষ্ঠ বীর মুক্তিযোদ্ধা তিনি। এই অল্প বয়সে দেশের জন্য মায়ের জন্য মাটির জন্য তিনি যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা থেকেই বোঝা যায় আমাদের দেশের সন্তানরা দেশের জন্য কতটা নিবেদিত ছিলেন।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে একজন কিশোর নিজের বিনোদন, নিজস্ব ভাবনায়, আড্ডা, গান আর বই পড়ার মধ্যে থাকার কথা তখন ১৮ বছর বয়সেই নিজের মাতৃভূমিকে বাঁচাতে, একটি মুক্ত স্বদেশের টানে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন আবু বকর।

দেশ, মাটি, স্বাধীনতা এসব নিয়ে ১৮ বছরের একজন কিশোরের চিন্তার পরিসর কতটুকু বিস্তৃত হতে পারে, কতটুকু গভীরতা থাকতে পারে। অথচ সেই বয়সেই কিশোর আবু বকর শুধু দেশ নিয়ে ভাবেনইনি, মায়ের অনুমতি নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের মতো দুর্ভেদ্য জায়গায় টাইম বোমা নিয়ে ঢুকে হামলা চালিয়ে সফল হন। এবং আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া ফেলেন আর পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি নাড়িয়ে দেন। এমন অভিযান চালাতে হলে কতটা সাহস আর মনোবল থাকা দরকার তা আলাদা করে উল্লেখ করার দরকার হয় না।

১৯৫৩ সালের ৫ মে জন্ম নীলফামারীর সৈয়দপুরে জন্মগ্রহণ করেন আবু বকর। বাবা আবু জাফর সরকারি চাকরিজীবী, আর মা আনোয়ারা খাতুন গৃহিণী। বাবার চাকরির সুবাদে নীলফামারীতে জায়গা কিনে বাড়ি করলেও ১৯৬৯ সালে সৈয়দপুরের বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে ঢাকার গুলশানে মামা আবু বকরের কাছ থেকে জায়গা কিনে বাড়ি করেন আবু জাফর। আবু বকররা ছিলেন সাত ভাই, তিন বোন। তার শিক্ষা জীবন শুরু হয় নীলফামারীতেই। ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব মেধাবী ছিলেন তিনি। নীলফামারীতে মাধ্যমিক পাস করার পরে ঢাকায় ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৭০ সালে তৎকালীন কায়েদে আজম কলেজে ভর্তি হন তিনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার্স কোর্সে যোগদানের অপেক্ষায় ছিলেন।

পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যা ধর্ষণ, পাষন্ডতা দেখে বিবেকের দায়ে দংশিত হন আবু বকর। ছোট্ট মনেই ঠিক করে নেন কিছু একটা করতেই হবে। দেশকে বাঁচাতে হবে হানাদারদের কবল থেকে। তখন মে মাসের শেষ সপ্তাহ। আবু বকর, তার ছোট ভাই কর্নেল রেজার ছেলে তালাহ রেজা বসে সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন। মুক্তিযুদ্ধ করতে চাইলে তো প্রশিক্ষণ লাগবে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন ভারতের আগরতলায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সুতরাং ভারতের আগরতলায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এই কিশোর।

মা ভক্ত বকর চুপি চুপি যুদ্ধে যাবেন না বলে মায়ের কাছে সব খুলে বলেন, অনুমতি চান। মা রাজী হন না। মাকে বহু বোঝানোর পর শেষমেশ অনুমতি পাওয়া গেল। তবে, শর্ত ছোট ভাই হায়দারকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। যেতে পারবেন তারা দুজন। এর মধ্যে বকরের মেজ ভাই ভারতে চলে গেছেন মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণ নিতে। অন্যদিকে আবু বকরের বড়ভাই তখন সৌদি আরবে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত। একজন পুরুষ মানুষ ঘরে না থাকলে সমস্যা তাই শেষ পর্যন্ত হায়দারকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ত্রিপুরার মেলাঘর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আবু বকর ফিরে আসেন দেড় মাস পরে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে।

মেলাঘর থেকে প্রশিক্ষণ শেষে অপারেশনের জন্য ঢাকায় এসে বকর বেশির ভাগ সময় নিজ বাড়িতেই থাকতেন। এরই মধ্যে আবু বকর যুক্ত হন ক্র্যাক প্লাটুনের সঙ্গে।

জুনের শেষে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের প্রথম অপারেশন চালান তিনি। দ্বিতীয় অপারেশনের জন্য পরিকল্পনা করা হলো এবং ততদিনে বেশ কয়েকটি অপারেশন করে হাত পাকিয়ে ফেলেছেন কিশোর বকর। ১১ আগস্টের দ্বিতীয় অপারেশনের নেতৃত্ব দেন তিনি। অনাগত সুন্দর জীবনকে তুচ্ছ করে মাত্র ১৮ বছরের এই তরুণ নেতৃত্ব দেন ভয়াবহ অপারেশন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের।

১১ আগস্ট। সকালে বায়তুল মোকাররম থেকে ৫৩ টাকা দিয়ে কেনা হলো একটি ব্রিফ কেস। তারপর এর ভেতর সাজানো হলো বিস্ফোরক- ২৮ পাউন্ড পিকে এবং ৫৫ মিনিট মেয়াদী টাইম পেন্সিল। বিকেলে আবু বকর, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, গাজী গোলাম দস্তগীর ও সামাদ গাড়িতে রওনা হলেন হোটেলের দিকে। মায়া আর গাজী হোটেল থেকে কিছু দূরে স্ট্যানগান নিয়ে গাড়িতে অপেক্ষা করতে থাকলেন।

এ দিন ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশনের আগে আবু বকর ও সামাদ রেকি করা শুরু করেন। রেকিওয়ার্কে প্রথমদিকে গেটে চেকিং করে ঢুকানো হলেও, পরবর্তীতে বিনা চেকিংয়েই ঢুকতে দিত তাদের। বকরের ওপর থেকে সন্দেহের চোখ কিছুটা নমনীয় হয়েছিল তার অল্প বয়সী সহজ সরল চেহারার জন্যে। তাছাড়া, বকর ভাল উর্দুও বলতে পারতেন বলে পাহারারতদের সঙ্গে উর্দুতে কথাবার্তা এমনকি দুষ্টামিও করতেন। এসব কারণে ওদের চলাচলের ওপর সন্দেহের চোখটা ছিল কম।

কয়েকদিনের রেকি করা হয়ে গেলে বকর আর সামাদ সিদ্ধান্ত নেন ‘সাকী বার’-এর বিপরীত দিকে পুরুষ টয়লেট রুমের একেবারে কোণার বাথরুমে বিস্ফোরক রাখা হবে। ১০ তারিখের মধ্যেই তারা গ্লো-সাইনের কাজ শেষ করেন।

হোটেলে লাউঞ্জে প্রবেশের জন্যে মূল দরজা দিয়ে না ঢুকে ‘সুইচ এয়ার’-এর অফিস কক্ষের দরজা দিয়ে সামাদকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে ঢোকেন আবু বকর। ওই অফিসেরই এক বন্ধু তাদের এ ব্যাপারে সহায়তা করেন। টয়লেটের মূল দরজায় সামাদকে পাহারায় রেখে ব্রিফকেস নিয়ে কোণার টয়লেটে ঢুকে পড়েন বকর, টয়লেটের দরজা ভেতর থেকে লক করে দেন। ব্রিফকেসটি রাখা হলো কমোডের পেছনে, তারপর টাইম পেন্সিল প্রেস করে টয়লেটের দরজা বন্ধ রেখে ওপর দিককার দেয়াল টপকে বেরিয়ে আসেন তিনি। প্রথমে সামাদকে বের করে দেন। এরপর বকর অতি দ্রুততার সঙ্গে হোটেল থেকে বেরিয়ে আসেন।

সন্ধ্যা ৫টা ৫৬ মিনিটে ঘটলো প্রচন্ড বিস্ফোরণ। হোটেল লাউঞ্জ, শপিং আর্কেড এবং আশপাশের কক্ষের কাচ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ল, ছিটকে গেল কক্ষের দরজা, ভেঙে পড়ল লাউঞ্জের লাগোয়া দেয়াল। আহত হন বেশ কয়েকজন।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতায় আরেকটি সংবাদ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। ক্র্যাক প্লাটুনের আরও কয়েকটি অপারেশনে বকর অংশ নিয়েছিলেন। চুপচাপ স্বভাবের ছিলেন বটে, কিন্তু সাহসীকতা তাকে করে তুলেছিল ব্যতিক্রম।

বেশ কয়েকটা অপারেশন করে ক্র্যাক প্লাটুন যখন সফল তখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী হয়ে ওঠে বেপরোয়া। ক্র্যাক প্লাটুন বা বিচ্ছু বাহিনীর সদস্যদের ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ক্র্যাক প্লাটুন সদস্যরা আড়ালে চলে গেলেও শেষ রক্ষা আর হলো না ’৭১ এর ২৯ আগস্ট দিবাগত রাত তিনটার দিকে রুমি আজাদদের মতো আবু বকরকেও ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এমপি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে পাকিস্থানি আর্মিরা অমানবিক নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হন আবু বকর, রুমি, বদিসহ সাতজন। তারপর তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে কেউই জানে না!

ছবি

বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে ৫টি চুক্তি ও ৫টি সমঝোতা স্মারক সই

ছবি

ঢাকা ছাড়লেন কাতারের আমির

ছবি

সোমালি জলদস্যুদের দ্বারা জব্দ করা জাহাজ সংযুক্ত আরব আমিরাতে পৌঁছেছে; ২৩ জন বাংলাদেশি নাবিকের সবাই নিরাপদ

ছবি

পদে থেকেই ইউপি চেয়ারম্যানরা উপজেলা নির্বাচন করতে পারবেন

ছবি

পদত্যাগ না করেই ইউপি চেয়ারম্যানরা উপজেলা নির্বাচন করতে পারবেন

ছবি

বান্দরবানের তিন উপজেলায় ভোট স্থগিত : ইসি সচিব

ছবি

তীব্র দাবদাহের মধ্যেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড , আছে লোড শেডিংও

ছবি

বাংলাদেশ-কাতার ১০ চুক্তি সই

ছবি

ঢাকা থেকে প্রধান ১৫টি রুটে ট্রেনের ভাড়া যত বাড়ল

ছবি

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে কাতারের আমির

ছবি

তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা বাড়লো আরও ৩ দিন, দুর্ভোগে সাধারণ মানুষ

ছবি

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক আর্মি কমান্ড এর যৌথ অংশগ্রহণে টিএল-২০২৪ উদ্বোধন

ছবি

শিশু অধিকার বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টিতে মিডিয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ--স্পীকার

ছবি

দু’দিনের সফরে কাতারের আমির ঢাকায়

ছবি

পাঁচ দিনের সফরে বুধবার থাইল্যান্ড যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

ছবি

৪ মে থেকে বাড়ছে ট্রেনের ভাড়া

ছবি

আনু মুহাম্মদের পায়ে ‌‘কম্বাইন্ড অপারেশন’ দরকার: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

ছবি

আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করেছি : শেখ হাসিনা

ছবি

তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা, বাড়লো আরও ৩ দিন

ছবি

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই কি এত তাপ?

ছবি

ভারতের উজানে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় তিস্তা মরা খালে পরিনত হয়েছে

ছবি

তাপদাহ : হাসপাতাল প্রস্তুত রাখার নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর

ছবি

পিছিয়ে নেই নারীরাও তামিলনাড়ু থেকে ট্রাক নিয়ে বেনাপোল এলেন অন্নপূর্ণা

ছবি

দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকা আসছেন কাতারের আমির, ১১ টি চুক্তি-সমঝোতা

ছবি

অন্যায় আবদারের কাছে মাথানত করবো না: ইসি আলমগীর

ছবি

তীব্র গরম : হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রাখতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশ

ছবি

দাবদাহ : হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখার নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর

ছবি

বোরো মৌসুমে ৩২ টাকা কেজি দরে ধান কিনবে সরকার

ছবি

ব্যারিস্টার খোকনকে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম থেকে অব্যাহতি

ছবি

‘মুজিব ব্যাটারি’ কমপ্লেক্স উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী

ছবি

দীর্ঘ ছুটি শেষে খুলেছে সুপ্রিম কোর্ট

ছবি

হিট অ্যালার্টের মধ্যেই ৬০ কি.মি. বেগে ঝড় বয়ে যেতে পারে

দাবদাহে ‘কপাল পোড়ার’ শঙ্কায় কৃষক, শুকিয়ে যাচ্ছে ধান ক্ষেত, মরছে সবজির গাছ

ছবি

সোমবার থেকে ৪ দিনব্যাপী ন্যাপ এক্সপো, উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী

ছবি

অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধ করে দেয়া হবে:প্রতিমন্ত্রী

ছবি

গরমের কারণে সব সরকারি স্কুল, কলেজ আরও ৭ দিন বন্ধ

tab

জাতীয়

অনন্য দুঃসাহসী কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবু বকর বীর বিক্রম

সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট

মঙ্গলবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২১

মাত্র ১৮ বছরের একজন কিশোর, একাত্তরের কিংবদন্তি বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবু বকর। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত সর্ব কনিষ্ঠ বীর মুক্তিযোদ্ধা তিনি। এই অল্প বয়সে দেশের জন্য মায়ের জন্য মাটির জন্য তিনি যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা থেকেই বোঝা যায় আমাদের দেশের সন্তানরা দেশের জন্য কতটা নিবেদিত ছিলেন।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে একজন কিশোর নিজের বিনোদন, নিজস্ব ভাবনায়, আড্ডা, গান আর বই পড়ার মধ্যে থাকার কথা তখন ১৮ বছর বয়সেই নিজের মাতৃভূমিকে বাঁচাতে, একটি মুক্ত স্বদেশের টানে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন আবু বকর।

দেশ, মাটি, স্বাধীনতা এসব নিয়ে ১৮ বছরের একজন কিশোরের চিন্তার পরিসর কতটুকু বিস্তৃত হতে পারে, কতটুকু গভীরতা থাকতে পারে। অথচ সেই বয়সেই কিশোর আবু বকর শুধু দেশ নিয়ে ভাবেনইনি, মায়ের অনুমতি নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের মতো দুর্ভেদ্য জায়গায় টাইম বোমা নিয়ে ঢুকে হামলা চালিয়ে সফল হন। এবং আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া ফেলেন আর পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি নাড়িয়ে দেন। এমন অভিযান চালাতে হলে কতটা সাহস আর মনোবল থাকা দরকার তা আলাদা করে উল্লেখ করার দরকার হয় না।

১৯৫৩ সালের ৫ মে জন্ম নীলফামারীর সৈয়দপুরে জন্মগ্রহণ করেন আবু বকর। বাবা আবু জাফর সরকারি চাকরিজীবী, আর মা আনোয়ারা খাতুন গৃহিণী। বাবার চাকরির সুবাদে নীলফামারীতে জায়গা কিনে বাড়ি করলেও ১৯৬৯ সালে সৈয়দপুরের বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে ঢাকার গুলশানে মামা আবু বকরের কাছ থেকে জায়গা কিনে বাড়ি করেন আবু জাফর। আবু বকররা ছিলেন সাত ভাই, তিন বোন। তার শিক্ষা জীবন শুরু হয় নীলফামারীতেই। ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব মেধাবী ছিলেন তিনি। নীলফামারীতে মাধ্যমিক পাস করার পরে ঢাকায় ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৭০ সালে তৎকালীন কায়েদে আজম কলেজে ভর্তি হন তিনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার্স কোর্সে যোগদানের অপেক্ষায় ছিলেন।

পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যা ধর্ষণ, পাষন্ডতা দেখে বিবেকের দায়ে দংশিত হন আবু বকর। ছোট্ট মনেই ঠিক করে নেন কিছু একটা করতেই হবে। দেশকে বাঁচাতে হবে হানাদারদের কবল থেকে। তখন মে মাসের শেষ সপ্তাহ। আবু বকর, তার ছোট ভাই কর্নেল রেজার ছেলে তালাহ রেজা বসে সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন। মুক্তিযুদ্ধ করতে চাইলে তো প্রশিক্ষণ লাগবে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন ভারতের আগরতলায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সুতরাং ভারতের আগরতলায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এই কিশোর।

মা ভক্ত বকর চুপি চুপি যুদ্ধে যাবেন না বলে মায়ের কাছে সব খুলে বলেন, অনুমতি চান। মা রাজী হন না। মাকে বহু বোঝানোর পর শেষমেশ অনুমতি পাওয়া গেল। তবে, শর্ত ছোট ভাই হায়দারকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। যেতে পারবেন তারা দুজন। এর মধ্যে বকরের মেজ ভাই ভারতে চলে গেছেন মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণ নিতে। অন্যদিকে আবু বকরের বড়ভাই তখন সৌদি আরবে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত। একজন পুরুষ মানুষ ঘরে না থাকলে সমস্যা তাই শেষ পর্যন্ত হায়দারকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ত্রিপুরার মেলাঘর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আবু বকর ফিরে আসেন দেড় মাস পরে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে।

মেলাঘর থেকে প্রশিক্ষণ শেষে অপারেশনের জন্য ঢাকায় এসে বকর বেশির ভাগ সময় নিজ বাড়িতেই থাকতেন। এরই মধ্যে আবু বকর যুক্ত হন ক্র্যাক প্লাটুনের সঙ্গে।

জুনের শেষে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের প্রথম অপারেশন চালান তিনি। দ্বিতীয় অপারেশনের জন্য পরিকল্পনা করা হলো এবং ততদিনে বেশ কয়েকটি অপারেশন করে হাত পাকিয়ে ফেলেছেন কিশোর বকর। ১১ আগস্টের দ্বিতীয় অপারেশনের নেতৃত্ব দেন তিনি। অনাগত সুন্দর জীবনকে তুচ্ছ করে মাত্র ১৮ বছরের এই তরুণ নেতৃত্ব দেন ভয়াবহ অপারেশন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের।

১১ আগস্ট। সকালে বায়তুল মোকাররম থেকে ৫৩ টাকা দিয়ে কেনা হলো একটি ব্রিফ কেস। তারপর এর ভেতর সাজানো হলো বিস্ফোরক- ২৮ পাউন্ড পিকে এবং ৫৫ মিনিট মেয়াদী টাইম পেন্সিল। বিকেলে আবু বকর, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, গাজী গোলাম দস্তগীর ও সামাদ গাড়িতে রওনা হলেন হোটেলের দিকে। মায়া আর গাজী হোটেল থেকে কিছু দূরে স্ট্যানগান নিয়ে গাড়িতে অপেক্ষা করতে থাকলেন।

এ দিন ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশনের আগে আবু বকর ও সামাদ রেকি করা শুরু করেন। রেকিওয়ার্কে প্রথমদিকে গেটে চেকিং করে ঢুকানো হলেও, পরবর্তীতে বিনা চেকিংয়েই ঢুকতে দিত তাদের। বকরের ওপর থেকে সন্দেহের চোখ কিছুটা নমনীয় হয়েছিল তার অল্প বয়সী সহজ সরল চেহারার জন্যে। তাছাড়া, বকর ভাল উর্দুও বলতে পারতেন বলে পাহারারতদের সঙ্গে উর্দুতে কথাবার্তা এমনকি দুষ্টামিও করতেন। এসব কারণে ওদের চলাচলের ওপর সন্দেহের চোখটা ছিল কম।

কয়েকদিনের রেকি করা হয়ে গেলে বকর আর সামাদ সিদ্ধান্ত নেন ‘সাকী বার’-এর বিপরীত দিকে পুরুষ টয়লেট রুমের একেবারে কোণার বাথরুমে বিস্ফোরক রাখা হবে। ১০ তারিখের মধ্যেই তারা গ্লো-সাইনের কাজ শেষ করেন।

হোটেলে লাউঞ্জে প্রবেশের জন্যে মূল দরজা দিয়ে না ঢুকে ‘সুইচ এয়ার’-এর অফিস কক্ষের দরজা দিয়ে সামাদকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে ঢোকেন আবু বকর। ওই অফিসেরই এক বন্ধু তাদের এ ব্যাপারে সহায়তা করেন। টয়লেটের মূল দরজায় সামাদকে পাহারায় রেখে ব্রিফকেস নিয়ে কোণার টয়লেটে ঢুকে পড়েন বকর, টয়লেটের দরজা ভেতর থেকে লক করে দেন। ব্রিফকেসটি রাখা হলো কমোডের পেছনে, তারপর টাইম পেন্সিল প্রেস করে টয়লেটের দরজা বন্ধ রেখে ওপর দিককার দেয়াল টপকে বেরিয়ে আসেন তিনি। প্রথমে সামাদকে বের করে দেন। এরপর বকর অতি দ্রুততার সঙ্গে হোটেল থেকে বেরিয়ে আসেন।

সন্ধ্যা ৫টা ৫৬ মিনিটে ঘটলো প্রচন্ড বিস্ফোরণ। হোটেল লাউঞ্জ, শপিং আর্কেড এবং আশপাশের কক্ষের কাচ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ল, ছিটকে গেল কক্ষের দরজা, ভেঙে পড়ল লাউঞ্জের লাগোয়া দেয়াল। আহত হন বেশ কয়েকজন।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতায় আরেকটি সংবাদ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। ক্র্যাক প্লাটুনের আরও কয়েকটি অপারেশনে বকর অংশ নিয়েছিলেন। চুপচাপ স্বভাবের ছিলেন বটে, কিন্তু সাহসীকতা তাকে করে তুলেছিল ব্যতিক্রম।

বেশ কয়েকটা অপারেশন করে ক্র্যাক প্লাটুন যখন সফল তখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী হয়ে ওঠে বেপরোয়া। ক্র্যাক প্লাটুন বা বিচ্ছু বাহিনীর সদস্যদের ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ক্র্যাক প্লাটুন সদস্যরা আড়ালে চলে গেলেও শেষ রক্ষা আর হলো না ’৭১ এর ২৯ আগস্ট দিবাগত রাত তিনটার দিকে রুমি আজাদদের মতো আবু বকরকেও ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এমপি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে পাকিস্থানি আর্মিরা অমানবিক নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হন আবু বকর, রুমি, বদিসহ সাতজন। তারপর তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে কেউই জানে না!

back to top