বনেই বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল নিশ্চিত করতে হবে
বনভূমি এবং বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা দিতে সুস্পষ্টভাবে ব্যর্থ হয়েছে বন বিভাগ। ২০২১ সালেই ৩৪টি হাতির অপমৃত্যু হয়েছে। হাতির মৃত্যুতে বনে অবৈধ দখলদারদের সম্পৃক্ততা সুস্পষ্ট। বনভূমি থেকে অবৈধ দখলদারদের সরিয়ে বনের জায়গায় বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল নিশ্চিত করতে না পারলে পরিবেশ ভারসম্যহীন হয়ে পড়বে।
৩৩টি পরিবেশবাদী সংগঠনের সমন্বিত প্রয়াস বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোট (বিএনসিএ) সাম্প্রতিক সময়ে হাতির অপমৃত্যু নিয়ে একটি ছায়া তদন্ত করে। এই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ উপলক্ষে মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে তদন্ত প্রতিবেদন পড়ে শোনান বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোটের (বিএনসিএ) আহ্বায়ক ও পরিবেশবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। জোটের অংশীদার সেভ আওয়ার সি’র মহাসচিব মুহাম্মদ আনোয়ারুল হকের উপস্থাপনায় সংবাদ সম্মেলনে বিশেষজ্ঞ হিসেবে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. গুলশান আরা লতিফা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জসীম উদ্দিন, প্রতিবেশ বিশেষজ্ঞ আবদুল ওহাব। তদন্ত দলের সদস্য এনভায়রনমেন্ট পিপলের সভাপতি রাশেদ উল মাজীদ, জোটের সদস্য নোঙরের সভাপতি শামস সুমন প্রমুখ।
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, হাতি আমাদের জায়গায় আসেনি। আমরা মূলত হাতির করিডোরে ঢুকে পড়েছি। হাতি রক্ষায় বন বিভাগ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় বন বিভাগের কার্যক্রম কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। হাতির মতো এত বড় প্রাণীকে অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারার অর্থই হলো অন্য প্রাণীগুলোও খুবই হুমকিতে রয়েছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে আমাদের পরিবেশে। চলতি বছরে দেশজুড়ে হাতিসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর সঙ্গে মানুষের নৃশংস আচারণের অগণিত চিত্র উঠে এসেছে। এছাড়া দেশের বন উজার, নদী-খাল দখল, পরিবেশ দূষণের হার চরম মাত্রায় বেড়েছে। বনের পতাকাধারী প্রাণী হাতি ২০২১ সালে প্রাণ হারিয়েছে ৩৪টি।
তিনি আরও বলেন, বন এখন আর শুধু বৃক্ষ এবং বন্যপ্রাণীর জন্য নেই। বনভূমি এখন অনেক মানুষের হীন স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। বন, বনভূমি এবং বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা দিতে বন বিভাগের ক্রমাগত ব্যর্থতার চিত্র ফুটে উঠছে। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় এতদিন তারা বনভূমি বেদখলে সহযোগিতা করেছে। বনকে নিজেরাও বাণিজ্যমুখী করেছে। যার কারণে আজকের পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। বন-বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এই বিভাগের মূল ম্যান্ডেট হওয়ার কথা অথচ তারা প্রকল্প দিয়ে বন-বন্যপ্রাণী রক্ষার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেটাও লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। প্রকল্প শেষ হলেই ক্ষতিতে পড়ছে বন্যপ্রাণী। টাকা ফুরালেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের অক্সিজেন চেম্বার, হারাচ্ছে বনের রক্ষক বন্যপ্রাণী। বর্তমানে বনভূমির যেই অবস্থান এতে সৃষ্ট সংকট বন অধিদপ্তরের একার পক্ষে সমাধান করা অসম্ভব। সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনায় বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগের বিকল্প নেই।
বিএনসিএ কক্সাবাজারে ছায়া তদন্তে গিয়ে দেখতে পায়, কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের পানেরছড়া ও ধোয়াপালং রেঞ্জের ১৩,০৬৫ একর বনভূমির মধ্যে অর্ধেকের বেশি অবৈধ দখলে চলে গেছে। যদিও বন বিভাগ বনভূমি বেদখলের পরিমাণ উল্লেখ করছে ১২০২ একর। এর ওপর চারপাশে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা বনভূমির ওপর বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনায় হাতি চলাচলের পথ (করিডোর) ও আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ায় আনুমানিক ১০০ একর জায়গায় প্রায় ৪০টির মতো হাতি আটকা পড়েছে।
বনভূমিতে অবৈধ বসতবাড়ি, পানের বরজ, বিভিন্ন খেতখামার, ঘের, বিদ্যুৎ সংযোগসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডে হাতিসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর জন্য চরম হুমকি তৈরি করেছে। সেখানেও হাতির নিরাপদ আবাস, খাদ্য ও পানির সংকট তীব্র হওয়ায় এসব হাতি এক প্রকার উপায়হীন হয়ে মানুষের বসতবাড়ি ও খেত-খামারে প্রায় প্রতিদিন হানা দিচ্ছে। এতে ওই এলাকায় হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার কারণে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে হাতি হত্যার মতো ঘটনায় জড়িয়ে যাচ্ছে।
ধোয়াপালং ও পানেরছড়া রেঞ্জের ১৩,০৬৫ একর বনভূমি সুরক্ষা, নিয়মিত টহল, বনায়ন সৃজন, অফিসিয়াল দৈনন্দিন কার্য সম্পাদনসহ বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করছে মাত্র ১৬ জন জনবল, যা পর্যাপ্ত নয়। যে কারণে হাতিসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় সক্ষমতার ব্যাপক ঘাটতি পরিলক্ষিত হয় সরকারি এ দপ্তরটির। এছাড়া এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম (ইআরটি) সদস্যদের কোন সম্মানীর ব্যবস্থা না থাকায় তাদেরও সঠিক সময়ে সাড়া পাওয়া যায় না।
এছাড়া ধোয়াপালং রেঞ্জের পাশের পানেরছড়া রেঞ্জের তুলাবাগান বন বিট এলাকায় ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর একটি হাতিকে বিদ্যুতায়িত করে মারা হয়। এ ঘটনায় তিনজনকে আসামি করে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে রামু থানায় একটি মামলা দায়ের করে বন বিভাগ। কিন্তু তদন্ত করে মামলার অভিযোগপত্র দেয়ার সময় মামলার বাদী সংশ্লিষ্ট বন কর্মকর্তা এক আসামির সঙ্গে যোগসাজশে অভিযোগপত্র থেকে এক আসামিকে বাদ দেয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়ার অভিযোগ উঠে। এ ঘটনায় ওই বন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছে কক্সবাজার সচেতন নাগরিক আন্দোলন নামের একটি সংগঠন।
অন্যদিকে শেরপুরের শ্রীবরদী এবং ঝিনাইগাতি এলাকায় ছায়া তদন্তে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার বনভূমিতে ব্যপক মানুষের অবৈধ বসবাস রয়েছে। অবৈধ বসবাসকারীদের মাঝে হাতিবিদ্বেষী মনোভাবও আমাদের নজরে এসেছে। অধ্যাপক ড. গুলশান আরা লতিফা বলেন, সীমান্ত এলাকায় সরকারিভাবে বনায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে বন্যপ্রাণীর জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর বনের জায়গার প্রতি যাদের লোভ রয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। অধ্যাপক ড. মো. জসীম উদ্দিন বলেন, হাতির জন্য ঘন বনভূমি দরকার। হাতির খাবার উপযোগী বনায়ন না থাকলে হাতি লোকালয়ে চলে আসবে।
প্রতিবেশ বিশেষজ্ঞ আবদুল ওহাব বলেন, বাংলাদেশে হাতি বর্তমানে বিপদাপন্ন প্রাণী। তার আবাস ও প্রতিবেশের ওপর জোর দিতে হবে। তার পাশাপাশি হাতির খাবারের ওপরও জোর দিতে হবে। তদন্ত দলের সদস্য রাশেদ উল মাজীদ বলেন, কক্সবাজারে হাতির করিডোরের মধ্যেই হাতিগুলোকে হত্যা করা হয়। মেরিন ড্রাইভ, ক্যান্টনমেন্ট এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে হাতির চলাচলে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।
নোঙরের সভাপতি শামস সুমন বলেন, আমাদের বাঁচার স্বার্থেই দখল-দূষণ বন্ধ করা জরুরি। এর জন্য যেমন রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি তেমনি বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় দায়িত্ব প্রাপ্তদের যথাযথ দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করতে হবে।
বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় বিএনসিএ ১১ দফা পরামর্শ তুলে ধরা হয়। সেগুলো হচ্ছে : ১. বন, বনভূমি এবং বন্যপ্রাণীর সুরক্ষায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনা ২. বিচারের আওতায় না আসা হাতি হত্যার ঘটনাগুলো সিআইডি বা পিবিআইকে দিয়ে তদন্ত করিয়ে দোষীদের বিচার নিশ্চিত করা, ৩. বনভূমি থেকে অবৈধ দখলদারদের সরানো। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানান্তর করা, ৪. বন-বন্যপ্রাণী রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনিক বডিগুলোর সমন্বয়হীনতা দূর করা, ৫. বাণিজ্য ছেড়ে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল রক্ষা বন বিভাগের মূল ম্যান্ডেট নির্ধারণ করা, ৬. প্রকল্পভিত্তিক সংরক্ষণ বাতিল করে বন্যপ্রাণী রক্ষায় বন বিভাগকে নিয়মিত বাজেটে বরাদ্দ দেয়া, ৭. বন্যপ্রাণী রক্ষায় জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য গণমাধ্যমকে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করা, ৮. সংরক্ষিত বন ও হাতির কোরিডোরের ভেতর বিদ্যুৎ লাইন, সড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণে বরাদ্দ বন্ধ করা এবং অতীতে দেয়া সড়ক ও বিদ্যুৎ সংযোগ দ্রুত বিচ্ছিন্ন করা, ৯. হাতি হত্যার আসামিদের জামিন বন্ধ করে এবং সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা, ১০. বন বিভাগে দ্রুত পর্যাপ্ত জনবলসহ সব প্রয়োজনীয় সুবিধা যুক্ত করা ও অ্যালিফেন্ট রেসপন্স টিমকে বেতনভুক্ত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং ১১. সংরক্ষিত বনকে আর কোন সরকারি, বেসরকারি সংস্থা বা ব্যক্তির জন্য বরাদ্দ না দেয়া।
বনেই বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল নিশ্চিত করতে হবে
মঙ্গলবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২২
বনভূমি এবং বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা দিতে সুস্পষ্টভাবে ব্যর্থ হয়েছে বন বিভাগ। ২০২১ সালেই ৩৪টি হাতির অপমৃত্যু হয়েছে। হাতির মৃত্যুতে বনে অবৈধ দখলদারদের সম্পৃক্ততা সুস্পষ্ট। বনভূমি থেকে অবৈধ দখলদারদের সরিয়ে বনের জায়গায় বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল নিশ্চিত করতে না পারলে পরিবেশ ভারসম্যহীন হয়ে পড়বে।
৩৩টি পরিবেশবাদী সংগঠনের সমন্বিত প্রয়াস বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোট (বিএনসিএ) সাম্প্রতিক সময়ে হাতির অপমৃত্যু নিয়ে একটি ছায়া তদন্ত করে। এই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ উপলক্ষে মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে তদন্ত প্রতিবেদন পড়ে শোনান বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোটের (বিএনসিএ) আহ্বায়ক ও পরিবেশবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। জোটের অংশীদার সেভ আওয়ার সি’র মহাসচিব মুহাম্মদ আনোয়ারুল হকের উপস্থাপনায় সংবাদ সম্মেলনে বিশেষজ্ঞ হিসেবে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. গুলশান আরা লতিফা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জসীম উদ্দিন, প্রতিবেশ বিশেষজ্ঞ আবদুল ওহাব। তদন্ত দলের সদস্য এনভায়রনমেন্ট পিপলের সভাপতি রাশেদ উল মাজীদ, জোটের সদস্য নোঙরের সভাপতি শামস সুমন প্রমুখ।
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, হাতি আমাদের জায়গায় আসেনি। আমরা মূলত হাতির করিডোরে ঢুকে পড়েছি। হাতি রক্ষায় বন বিভাগ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় বন বিভাগের কার্যক্রম কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। হাতির মতো এত বড় প্রাণীকে অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারার অর্থই হলো অন্য প্রাণীগুলোও খুবই হুমকিতে রয়েছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে আমাদের পরিবেশে। চলতি বছরে দেশজুড়ে হাতিসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর সঙ্গে মানুষের নৃশংস আচারণের অগণিত চিত্র উঠে এসেছে। এছাড়া দেশের বন উজার, নদী-খাল দখল, পরিবেশ দূষণের হার চরম মাত্রায় বেড়েছে। বনের পতাকাধারী প্রাণী হাতি ২০২১ সালে প্রাণ হারিয়েছে ৩৪টি।
তিনি আরও বলেন, বন এখন আর শুধু বৃক্ষ এবং বন্যপ্রাণীর জন্য নেই। বনভূমি এখন অনেক মানুষের হীন স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। বন, বনভূমি এবং বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা দিতে বন বিভাগের ক্রমাগত ব্যর্থতার চিত্র ফুটে উঠছে। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় এতদিন তারা বনভূমি বেদখলে সহযোগিতা করেছে। বনকে নিজেরাও বাণিজ্যমুখী করেছে। যার কারণে আজকের পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। বন-বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এই বিভাগের মূল ম্যান্ডেট হওয়ার কথা অথচ তারা প্রকল্প দিয়ে বন-বন্যপ্রাণী রক্ষার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেটাও লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। প্রকল্প শেষ হলেই ক্ষতিতে পড়ছে বন্যপ্রাণী। টাকা ফুরালেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের অক্সিজেন চেম্বার, হারাচ্ছে বনের রক্ষক বন্যপ্রাণী। বর্তমানে বনভূমির যেই অবস্থান এতে সৃষ্ট সংকট বন অধিদপ্তরের একার পক্ষে সমাধান করা অসম্ভব। সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনায় বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগের বিকল্প নেই।
বিএনসিএ কক্সাবাজারে ছায়া তদন্তে গিয়ে দেখতে পায়, কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের পানেরছড়া ও ধোয়াপালং রেঞ্জের ১৩,০৬৫ একর বনভূমির মধ্যে অর্ধেকের বেশি অবৈধ দখলে চলে গেছে। যদিও বন বিভাগ বনভূমি বেদখলের পরিমাণ উল্লেখ করছে ১২০২ একর। এর ওপর চারপাশে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা বনভূমির ওপর বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনায় হাতি চলাচলের পথ (করিডোর) ও আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ায় আনুমানিক ১০০ একর জায়গায় প্রায় ৪০টির মতো হাতি আটকা পড়েছে।
বনভূমিতে অবৈধ বসতবাড়ি, পানের বরজ, বিভিন্ন খেতখামার, ঘের, বিদ্যুৎ সংযোগসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডে হাতিসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর জন্য চরম হুমকি তৈরি করেছে। সেখানেও হাতির নিরাপদ আবাস, খাদ্য ও পানির সংকট তীব্র হওয়ায় এসব হাতি এক প্রকার উপায়হীন হয়ে মানুষের বসতবাড়ি ও খেত-খামারে প্রায় প্রতিদিন হানা দিচ্ছে। এতে ওই এলাকায় হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার কারণে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে হাতি হত্যার মতো ঘটনায় জড়িয়ে যাচ্ছে।
ধোয়াপালং ও পানেরছড়া রেঞ্জের ১৩,০৬৫ একর বনভূমি সুরক্ষা, নিয়মিত টহল, বনায়ন সৃজন, অফিসিয়াল দৈনন্দিন কার্য সম্পাদনসহ বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করছে মাত্র ১৬ জন জনবল, যা পর্যাপ্ত নয়। যে কারণে হাতিসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় সক্ষমতার ব্যাপক ঘাটতি পরিলক্ষিত হয় সরকারি এ দপ্তরটির। এছাড়া এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম (ইআরটি) সদস্যদের কোন সম্মানীর ব্যবস্থা না থাকায় তাদেরও সঠিক সময়ে সাড়া পাওয়া যায় না।
এছাড়া ধোয়াপালং রেঞ্জের পাশের পানেরছড়া রেঞ্জের তুলাবাগান বন বিট এলাকায় ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর একটি হাতিকে বিদ্যুতায়িত করে মারা হয়। এ ঘটনায় তিনজনকে আসামি করে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে রামু থানায় একটি মামলা দায়ের করে বন বিভাগ। কিন্তু তদন্ত করে মামলার অভিযোগপত্র দেয়ার সময় মামলার বাদী সংশ্লিষ্ট বন কর্মকর্তা এক আসামির সঙ্গে যোগসাজশে অভিযোগপত্র থেকে এক আসামিকে বাদ দেয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়ার অভিযোগ উঠে। এ ঘটনায় ওই বন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছে কক্সবাজার সচেতন নাগরিক আন্দোলন নামের একটি সংগঠন।
অন্যদিকে শেরপুরের শ্রীবরদী এবং ঝিনাইগাতি এলাকায় ছায়া তদন্তে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার বনভূমিতে ব্যপক মানুষের অবৈধ বসবাস রয়েছে। অবৈধ বসবাসকারীদের মাঝে হাতিবিদ্বেষী মনোভাবও আমাদের নজরে এসেছে। অধ্যাপক ড. গুলশান আরা লতিফা বলেন, সীমান্ত এলাকায় সরকারিভাবে বনায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে বন্যপ্রাণীর জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর বনের জায়গার প্রতি যাদের লোভ রয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। অধ্যাপক ড. মো. জসীম উদ্দিন বলেন, হাতির জন্য ঘন বনভূমি দরকার। হাতির খাবার উপযোগী বনায়ন না থাকলে হাতি লোকালয়ে চলে আসবে।
প্রতিবেশ বিশেষজ্ঞ আবদুল ওহাব বলেন, বাংলাদেশে হাতি বর্তমানে বিপদাপন্ন প্রাণী। তার আবাস ও প্রতিবেশের ওপর জোর দিতে হবে। তার পাশাপাশি হাতির খাবারের ওপরও জোর দিতে হবে। তদন্ত দলের সদস্য রাশেদ উল মাজীদ বলেন, কক্সবাজারে হাতির করিডোরের মধ্যেই হাতিগুলোকে হত্যা করা হয়। মেরিন ড্রাইভ, ক্যান্টনমেন্ট এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে হাতির চলাচলে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।
নোঙরের সভাপতি শামস সুমন বলেন, আমাদের বাঁচার স্বার্থেই দখল-দূষণ বন্ধ করা জরুরি। এর জন্য যেমন রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি তেমনি বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় দায়িত্ব প্রাপ্তদের যথাযথ দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করতে হবে।
বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় বিএনসিএ ১১ দফা পরামর্শ তুলে ধরা হয়। সেগুলো হচ্ছে : ১. বন, বনভূমি এবং বন্যপ্রাণীর সুরক্ষায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনা ২. বিচারের আওতায় না আসা হাতি হত্যার ঘটনাগুলো সিআইডি বা পিবিআইকে দিয়ে তদন্ত করিয়ে দোষীদের বিচার নিশ্চিত করা, ৩. বনভূমি থেকে অবৈধ দখলদারদের সরানো। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানান্তর করা, ৪. বন-বন্যপ্রাণী রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনিক বডিগুলোর সমন্বয়হীনতা দূর করা, ৫. বাণিজ্য ছেড়ে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল রক্ষা বন বিভাগের মূল ম্যান্ডেট নির্ধারণ করা, ৬. প্রকল্পভিত্তিক সংরক্ষণ বাতিল করে বন্যপ্রাণী রক্ষায় বন বিভাগকে নিয়মিত বাজেটে বরাদ্দ দেয়া, ৭. বন্যপ্রাণী রক্ষায় জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য গণমাধ্যমকে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করা, ৮. সংরক্ষিত বন ও হাতির কোরিডোরের ভেতর বিদ্যুৎ লাইন, সড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণে বরাদ্দ বন্ধ করা এবং অতীতে দেয়া সড়ক ও বিদ্যুৎ সংযোগ দ্রুত বিচ্ছিন্ন করা, ৯. হাতি হত্যার আসামিদের জামিন বন্ধ করে এবং সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা, ১০. বন বিভাগে দ্রুত পর্যাপ্ত জনবলসহ সব প্রয়োজনীয় সুবিধা যুক্ত করা ও অ্যালিফেন্ট রেসপন্স টিমকে বেতনভুক্ত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং ১১. সংরক্ষিত বনকে আর কোন সরকারি, বেসরকারি সংস্থা বা ব্যক্তির জন্য বরাদ্দ না দেয়া।