alt

জাতীয়

জ্বালানি তেলের দামের প্রভাব : জীবনযাত্রার ব্যয়ে চাপ, ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ

জাহিদা পারভেজ ছন্দা ও শাফিউল ইমরান : রোববার, ০৭ আগস্ট ২০২২

বিলকিস বানু থাকেন মীরপুরের পল্লবীতে। ৮ বছরের ছেলে আয়াত মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ে। রোজকার মতো রোববারও (৭ আগস্ট) ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিতে গিয়ে পড়েন বিপাকে। বৃহস্পতিবারও (৪ আগস্ট) রিকশাভাড়া ছিল ৪০ টাকা। কিন্তু রোববার ওই ভাড়ায় কেউ যেতে রাজি হচ্ছিলেন না। তিনি কমপক্ষে ১০ জন রিকশাচালককে ৪০ টাকায় স্কুলে যাওয়ার জন্য বলেও রাজি করাতে পারেননি। সবাই ২০ থেকে ৩০ টাকা বেশি চাইছে। বাধ্য হয়ে ৬০ টাকায় রিকশায় করে সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দেন বলে সংবাদকে জানান বিলকিস।

দুই দিনে রিকশা ভাড়া কেন দেড়গুণ গেল? বিলকিস বলেন, ‘আমি রিকশাওয়ালাকে বললাম, আপনারা ভাড়া বেশি চাচ্ছেন কেন?’ উত্তরে রিকশাচালক বলেন, ‘আপা, তেলের দাম বাড়ছে এই জন্য।’

কিন্তু বিলকিসের প্রশ্ন রিকশা তো তেলে চলে না, ‘তো ভাড়া বাড়াইছেন ক্যান?’।

আর তখনই রিকশাচালকের কণ্ঠে ক্ষোভ, ‘তেলের দাম বাড়ার জন্য বাস, ট্রাক, পিকআপের ভাড়া বাড়ছে এজন্য চাল-ডাল, তরিতরকারীরও দাম বাড়ছে। আমরা তো মাছ-মাংসের বাজারেই যাই না। লবণ-মরিচ ভর্তা কইরা যে ভাত খামু সেই মরিচের দামও এমন বাড়া বাড়ছে কিনবার পারি না। এখন আপনে কন, ভাড়া বেশি না নিয়া কী করুম।’

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিলকিস বলেন, ‘রিকশাচালক, বাসের মালিক কিংবা সবজিওয়ালা তো দাম বাড়িয়ে দেয় কিন্তু আমাদের বেতন তো বাড়ে না! আমরা চলবো কী করে, মাথায় আসে না।’

রহিম মিয়া, ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালান, যা রাইডার সার্ভিস নামেই পরিচিত। বছর দুয়েক আগে করোনা মহামারীতে চাকরি খুইয়েছেন। পরে ধার-দেনা করে মোটরসাইকেল কিনেছেন। কোনমতে চলছিল সংসার। তবে তিনি বলছেন এবারকার জ্বালানি তেলের বাড়তি দাম তাকে ‘ভীষণ বিপাকে’ ফেলেছে।

রোববার রাজধানীর বাংলামোটরে রহিম মিয়া সংবাদকে বলেন, ‘রোববার (শনিবার) শুধু তেল কিনতেই ৫০০ টাকা বেশি দিতে হয়েছে। কিন্ত বেশি ভাড়া চাওয়ার কারণে যাত্রীদের সঙ্গে তর্ক করতে হয়।’

তিনি বলেন, ‘সরকার হঠাৎ তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়েছে। এখন যাত্রীদের কাছে বেশি ভাড়া চাইলে তারা যেতে চাইছে না। মোটরসাইকেল চালিয়ে আর জীবিকা নির্বাহ করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না।’

‘করোনাকালীন চাকরি চলে যাওয়ায় ধার-দেনা করে একটা মোটরসাইকেল কিনেছি। দুইটা সন্তানকে যেন শহরের স্কুলে পড়াইতে পারি। কিন্তু এখন ঢাকা ছেড়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় দেখছি না,’ বলেন রহিম মিয়া।

এই হতাশা, ক্ষোভ শুধু বিলকিস বানু বা রহিম মিয়ার নয়, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের অনেক মানুষেরই প্রশ্ন সামনে জীবন চালাবেন কিভাবে? এই বাড়তি ব্যয় কোথা থেকে যোগাড় করবেন?

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিরত হালিম মিয়া বলেন, ‘সরকারি চাকরিজীবীদের বছরে বছরে বেতন-ভাতা বাড়লেও সাধারণ মানুষের আয় তো আর বাড়েনি। আমাদের মতো মানুষের আয় না বাড়লেও সরকারের নতুন নতুন সিদ্ধান্তের কারণে ব্যয় বেড়েই চলেছে। ব্যয়ের বোঝা যতই বাড়ছে আমাদের সংসারের বোঝাও বেড়েই চলছে। এই অবস্থায় কী করে সংসার চালাবো?’

রাজধানীর মৎস্য ভবনের সামনে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আগে যেখানে যাতায়াতের কারণে আমার ৭০০ টাকা হলেই হয়ে যেত আজ (রোববার) সেখানে ১২০০ টাকা গুণতে হলো। বাড়তি ৫০০ টাকা বেশি লাগার কারণে আমার প্রতিটি পণ্যের ৫-১০ টাকা দাম না বাড়ালে আমি পোষাতে পারবো না।’

রংপুরের রিকশাচালক রফিক মিয়া বলেন, ‘তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের গ্যারেজে রিকশার ৩০ টাকা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। গ্রামে বাবার ভিটে-মাটি নাই, তাই মরে যাওয়া ছাড়া কোন পথ দেখছি না।’

রংপুরের কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি শতক জমি চাষ করতে ১২ টাকা লাগলেও তেলের দাম বাড়ার কারণে তা ১৫ টাকা শতকে গিয়ে ঠেকছে। আরও দাম বাড়ার আশঙ্কা তাদের। সেইসঙ্গে যোগ হয়েছে সারের দামের বাড়তি বোঝা। কৃষকরা মনে করেন, বোরো মৌসুমের ধানের দাম দেড় হাজার টাকা না হলে তাদের উৎপাদন খরচ উঠবে না।

রংপুরের পীরগঞ্জের কৃষক লোকনাথ রায় জানান, ডিজেলের দাম বাড়ানো ফলে কৃষিতে কাজের খরচ অনেক বেড়ে যাবে।

কাঁচা বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব

রাজধানীর কাঁচা বাজারগুলোতেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কিছু সবজির দাম অপরিবর্তিত থাকলেও কাঁচা মরিচের দাম খুচরা বাজারে কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে ৩০০ টাকা ছাড়িয়েছে।

মোহাম্মদপুরের মিনার মসজিদের সামনের মুদি দোকানি নূরুল আলম সংবাদকে বলেন, ‘আমার দোকানের মাল বেশিরভাগ কোম্পানিরা এসে দিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত কোন পণ্যের দাম বৃদ্ধি করেনি। তবে, দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছি।’ ওই দোকানের এক ক্রেতা বলেন, শুক্রবারেই কাঁচা মরিচ যে টাকায় কিনেছি আজ কেজিতে ৫০ টাকা বেড়ে গেছে।

মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে ভ্যানে সবজি বিক্রেতা নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আজ সকালে কারওয়ান বাজারে যেসব জিনিস বিক্রির জন্য কিনেছি সেগুলোর প্রতিটির দাম বেশি। বেশি দামে কেনার কারণে ক্রেতাদের কাছে তা বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। এজন্য বিক্রি করতে কিছুটা সমস্যায় পড়তেও হচ্ছে কারণ রোববারের তুলনায় দাম বেশি চাওয়ার কারণে অনেকের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হচ্ছে।’

রাজধানীর কাওরান বাজারের আড়তদার সিরাজুল ইসলাম জানান, তেলের দাম বাড়ার কারণে তাদের সবজি আগের তুলনায় বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।

পরিবহনে ঝামেলা

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেড়েছে পরিবহন ভাড়া। আর এ বাড়তি ভাড়ার কারণে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষ পড়ছেন বিপাকে, পড়ছেন যাতায়াত সংকটে। রোববারও পরিবহন সংকটও ছিল। আর ছিল যাত্রী ও বাসচালক, কন্ডাকটরের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক, বাগবিতন্ডা। দু-এক জায়গায় হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এসবের একটাই কারণ অতিরিক্ত ভাড়া আদায়। সব মিলিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন যাত্রীরা। ক্ষোভ প্রকাশ করেন যাত্রী, চালক থেকে শুরু করে কন্ডাকটর পর্যন্ত।

রকিবুল ইসলাম মুকুল নামে একজন তার ফেইসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘বাস ভাড়া কিলোমিটারে বেড়েছে ৩৫ পয়সা। বনশ্রী থেকে রামপুরা ব্রিজ সর্বোচ্চ দেড় কিলোমিটার। আগে ভাড়া নিত ১০ টাকা। আজ থেকে ১৫ টাকা। তাহলে কিলোতে কত বাড়ল.....’

মিরপুর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলে অটো পরিবহনের বাস। এই বাসে উঠলে দেখা যায়, নির্ধারিত নতুন ভাড়ার চেয়ে পাঁচ টাকা বেশি নিচ্ছেন হেলপার। এ নিয়ে হেলপারের সঙ্গে যাত্রীদের কথা কাটাকাটিও হয়।

শাহবাগে কয়েকজন যাত্রী নামেন আবার কয়েকজন ওঠেন। শাহবাগে ওঠা নতুন যাত্রী রফিকুল ইসলাম পল্টন যাবেন, তার কাছে ১৫ টাকা চাইলে তিনি রেগে প্রায় মারতে যান কন্ডাকটরকে। রফিকুল বলেন, ‘শাহবাগ থেকে পল্টনের দূরত্ব কত, কেন আমি এত টাকা দেবো।’ কন্ডাকটরও বলতে থাকে, ‘আমি কী করবো, সরকারকে বলেন।’

এ সময় অন্য এক যাত্রী বলেন, ‘দিয়ে দেন, সরকারের রাজস্ব আদায় করতে পারে না। এখন সাধারণ জনগণের পকেটে হাত।’

আরেকজন বলেন, ‘তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে বাড়ছে শুধু বাস ভাড়াই না, সব কিছুর দাম। আমাদের বেতন বাড়ায় দিক, সরকার বলুক সবার বেতন বাড়ায় দেন।’

এই প্রতিবেদক ফার্মগেট থেকে প্রেসক্লাবে ভাড়া ১০ টাকা দিলে বিআরটিসির কন্ডাকটর বেশ রাগি রাগি চেহেরায় বলেন ‘আজ দিলেন কাল থেকে আর পারবেন না।’ কি মনে হলো কন্ডাকটর কিছুক্ষণ পর বিনয়ের সুরে বলেন, ‘কী করবো বলেন, আমাদেরও তো চলতে হবে। তেলের দাম যেভাবে বাড়ছে, আমাদের হাত পা বাধা।’

ছবি

একদিনে করোনায় আক্রান্ত ১৬ জন

ছবি

তাপপ্রবাহ নিয়ে ৭২ ঘণ্টার সতর্ক বার্তা আবহাওয়া অধিদপ্তরের

ছবি

বঙ্গবন্ধু টানেলে টোল ফ্রি সুবিধা পেল যেসব গাড়ি

ছবি

সারাদেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি

ছবি

জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাস আর নেই

ছবি

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করা হবে : আরাফাত

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং মুজিবনগর দিবস সম্পর্কে নতুন প্রজন্মেকে জানাতে হবে

ছবি

স্থানীয় সরকার নির্বাচ‌নে ভোটার উপ‌স্থি‌তি সংসদ নির্বাচ‌নের ‌চে‌য়ে বে‌শি থাকবে

ছবি

প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

ছবি

থাইল্যান্ড সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

জুন-জুলাইয়ে দেশে ইনফ্লুয়েঞ্জার হার বেশি

মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির ওপর নজর রাখতে বললেন প্রধানমন্ত্রী

এথেন্স সম্মেলনে দায়িত্বশীল ও টেকসই সমুদ্র ব্যবস্থাপনায় সম্মিলিত প্রয়াসের আহ্বান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর

ছবি

কৃষকরাই অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি: স্পিকার

ছবি

মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির ওপর নজর রাখার তাগিদ প্রধানমন্ত্রীর

ছবি

লালমনিরহাট সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে সাবেক ইউপি সদস্য গুলিবিদ্ধ

ছবি

তৃতীয় ধাপে ১১২ উপজেলায় ভোট ২৯ মে

ছবি

এমভি আবদুল্লাহ : ২১ নাবিক দেশে ফিরবেন জাহাজে, বাকি দুজন বিমানে

ছবি

৯৬ হাজার ৭৩৬ শিক্ষক নিয়োগে প্রক্রিয়া শুরু, আবেদনের নিয়ম

ছবি

ঢাকায় গ্রিসের দূতাবাস স্থাপন ও জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা

ছবি

টিসিবির তালিকা হালনাগাদ করতে চাই:বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী

ছবি

লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে গমের আবাদ কম

ছবি

ভোজ্য তেলের দাম বাড়াতে চায় ব্যবসায়ীরা আপত্তি বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর

ছবি

অনিবন্ধিত অনলাইনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবো : তথ্য প্রতিমন্ত্রী

ছবি

জলবায়ু পরিবর্তনে দেশে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিখাত : মন্ত্রী

ছবি

দেশে ফিরতে আরও ১০ দিন সময় লাগবে নাবিকদের

ছবি

মুক্ত এমভি আবদুল্লাহর ৩ ছবি প্রকাশ

ছবি

২ মে বসছে সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশন

ছবি

কারো যাতে ডেঙ্গু না হয় সেজন্য সবাইকে কাজ করতে হবে : স্বাস্থ্যমন্ত্রী

ছবি

মুক্তিপণ দেওয়ার ছবি নিয়ে যা বললেন নৌ প্রতিমন্ত্রী

ছবি

লঞ্চে বেড়েছে ঢাকায় ফেরা যাত্রীর চাপ

ছবি

নববর্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সমৃদ্ধ ও স্মার্ট ভবিষ্যৎ নির্মাণে একযোগে কাজ করার আহ্বান অর্থ প্রতিমন্ত্রীর

ছবি

জিম্মি জাহাজটি কীভাবে মুক্ত হলো, জানাল মালিকপক্ষ

ছবি

সোমানিয়ান জলদস্যুদের কবল থেকে এমভি আব্দুল্লাহ মুক্ত ২৩ নাবিক অক্ষত

ছবি

মুক্তিপণ নিয়ে তীরে উঠেই ৮ জলদস্যু গ্রেপ্তার

ছবি

দেশের প্রতি ভালোবাসার বার্তা এমভি আব্দুল্লাহর নাবিকদের

tab

জাতীয়

জ্বালানি তেলের দামের প্রভাব : জীবনযাত্রার ব্যয়ে চাপ, ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ

জাহিদা পারভেজ ছন্দা ও শাফিউল ইমরান

রোববার, ০৭ আগস্ট ২০২২

বিলকিস বানু থাকেন মীরপুরের পল্লবীতে। ৮ বছরের ছেলে আয়াত মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ে। রোজকার মতো রোববারও (৭ আগস্ট) ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিতে গিয়ে পড়েন বিপাকে। বৃহস্পতিবারও (৪ আগস্ট) রিকশাভাড়া ছিল ৪০ টাকা। কিন্তু রোববার ওই ভাড়ায় কেউ যেতে রাজি হচ্ছিলেন না। তিনি কমপক্ষে ১০ জন রিকশাচালককে ৪০ টাকায় স্কুলে যাওয়ার জন্য বলেও রাজি করাতে পারেননি। সবাই ২০ থেকে ৩০ টাকা বেশি চাইছে। বাধ্য হয়ে ৬০ টাকায় রিকশায় করে সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দেন বলে সংবাদকে জানান বিলকিস।

দুই দিনে রিকশা ভাড়া কেন দেড়গুণ গেল? বিলকিস বলেন, ‘আমি রিকশাওয়ালাকে বললাম, আপনারা ভাড়া বেশি চাচ্ছেন কেন?’ উত্তরে রিকশাচালক বলেন, ‘আপা, তেলের দাম বাড়ছে এই জন্য।’

কিন্তু বিলকিসের প্রশ্ন রিকশা তো তেলে চলে না, ‘তো ভাড়া বাড়াইছেন ক্যান?’।

আর তখনই রিকশাচালকের কণ্ঠে ক্ষোভ, ‘তেলের দাম বাড়ার জন্য বাস, ট্রাক, পিকআপের ভাড়া বাড়ছে এজন্য চাল-ডাল, তরিতরকারীরও দাম বাড়ছে। আমরা তো মাছ-মাংসের বাজারেই যাই না। লবণ-মরিচ ভর্তা কইরা যে ভাত খামু সেই মরিচের দামও এমন বাড়া বাড়ছে কিনবার পারি না। এখন আপনে কন, ভাড়া বেশি না নিয়া কী করুম।’

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিলকিস বলেন, ‘রিকশাচালক, বাসের মালিক কিংবা সবজিওয়ালা তো দাম বাড়িয়ে দেয় কিন্তু আমাদের বেতন তো বাড়ে না! আমরা চলবো কী করে, মাথায় আসে না।’

রহিম মিয়া, ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালান, যা রাইডার সার্ভিস নামেই পরিচিত। বছর দুয়েক আগে করোনা মহামারীতে চাকরি খুইয়েছেন। পরে ধার-দেনা করে মোটরসাইকেল কিনেছেন। কোনমতে চলছিল সংসার। তবে তিনি বলছেন এবারকার জ্বালানি তেলের বাড়তি দাম তাকে ‘ভীষণ বিপাকে’ ফেলেছে।

রোববার রাজধানীর বাংলামোটরে রহিম মিয়া সংবাদকে বলেন, ‘রোববার (শনিবার) শুধু তেল কিনতেই ৫০০ টাকা বেশি দিতে হয়েছে। কিন্ত বেশি ভাড়া চাওয়ার কারণে যাত্রীদের সঙ্গে তর্ক করতে হয়।’

তিনি বলেন, ‘সরকার হঠাৎ তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়েছে। এখন যাত্রীদের কাছে বেশি ভাড়া চাইলে তারা যেতে চাইছে না। মোটরসাইকেল চালিয়ে আর জীবিকা নির্বাহ করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না।’

‘করোনাকালীন চাকরি চলে যাওয়ায় ধার-দেনা করে একটা মোটরসাইকেল কিনেছি। দুইটা সন্তানকে যেন শহরের স্কুলে পড়াইতে পারি। কিন্তু এখন ঢাকা ছেড়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় দেখছি না,’ বলেন রহিম মিয়া।

এই হতাশা, ক্ষোভ শুধু বিলকিস বানু বা রহিম মিয়ার নয়, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের অনেক মানুষেরই প্রশ্ন সামনে জীবন চালাবেন কিভাবে? এই বাড়তি ব্যয় কোথা থেকে যোগাড় করবেন?

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিরত হালিম মিয়া বলেন, ‘সরকারি চাকরিজীবীদের বছরে বছরে বেতন-ভাতা বাড়লেও সাধারণ মানুষের আয় তো আর বাড়েনি। আমাদের মতো মানুষের আয় না বাড়লেও সরকারের নতুন নতুন সিদ্ধান্তের কারণে ব্যয় বেড়েই চলেছে। ব্যয়ের বোঝা যতই বাড়ছে আমাদের সংসারের বোঝাও বেড়েই চলছে। এই অবস্থায় কী করে সংসার চালাবো?’

রাজধানীর মৎস্য ভবনের সামনে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আগে যেখানে যাতায়াতের কারণে আমার ৭০০ টাকা হলেই হয়ে যেত আজ (রোববার) সেখানে ১২০০ টাকা গুণতে হলো। বাড়তি ৫০০ টাকা বেশি লাগার কারণে আমার প্রতিটি পণ্যের ৫-১০ টাকা দাম না বাড়ালে আমি পোষাতে পারবো না।’

রংপুরের রিকশাচালক রফিক মিয়া বলেন, ‘তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের গ্যারেজে রিকশার ৩০ টাকা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। গ্রামে বাবার ভিটে-মাটি নাই, তাই মরে যাওয়া ছাড়া কোন পথ দেখছি না।’

রংপুরের কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি শতক জমি চাষ করতে ১২ টাকা লাগলেও তেলের দাম বাড়ার কারণে তা ১৫ টাকা শতকে গিয়ে ঠেকছে। আরও দাম বাড়ার আশঙ্কা তাদের। সেইসঙ্গে যোগ হয়েছে সারের দামের বাড়তি বোঝা। কৃষকরা মনে করেন, বোরো মৌসুমের ধানের দাম দেড় হাজার টাকা না হলে তাদের উৎপাদন খরচ উঠবে না।

রংপুরের পীরগঞ্জের কৃষক লোকনাথ রায় জানান, ডিজেলের দাম বাড়ানো ফলে কৃষিতে কাজের খরচ অনেক বেড়ে যাবে।

কাঁচা বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব

রাজধানীর কাঁচা বাজারগুলোতেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কিছু সবজির দাম অপরিবর্তিত থাকলেও কাঁচা মরিচের দাম খুচরা বাজারে কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে ৩০০ টাকা ছাড়িয়েছে।

মোহাম্মদপুরের মিনার মসজিদের সামনের মুদি দোকানি নূরুল আলম সংবাদকে বলেন, ‘আমার দোকানের মাল বেশিরভাগ কোম্পানিরা এসে দিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত কোন পণ্যের দাম বৃদ্ধি করেনি। তবে, দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছি।’ ওই দোকানের এক ক্রেতা বলেন, শুক্রবারেই কাঁচা মরিচ যে টাকায় কিনেছি আজ কেজিতে ৫০ টাকা বেড়ে গেছে।

মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে ভ্যানে সবজি বিক্রেতা নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আজ সকালে কারওয়ান বাজারে যেসব জিনিস বিক্রির জন্য কিনেছি সেগুলোর প্রতিটির দাম বেশি। বেশি দামে কেনার কারণে ক্রেতাদের কাছে তা বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। এজন্য বিক্রি করতে কিছুটা সমস্যায় পড়তেও হচ্ছে কারণ রোববারের তুলনায় দাম বেশি চাওয়ার কারণে অনেকের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হচ্ছে।’

রাজধানীর কাওরান বাজারের আড়তদার সিরাজুল ইসলাম জানান, তেলের দাম বাড়ার কারণে তাদের সবজি আগের তুলনায় বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।

পরিবহনে ঝামেলা

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেড়েছে পরিবহন ভাড়া। আর এ বাড়তি ভাড়ার কারণে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষ পড়ছেন বিপাকে, পড়ছেন যাতায়াত সংকটে। রোববারও পরিবহন সংকটও ছিল। আর ছিল যাত্রী ও বাসচালক, কন্ডাকটরের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক, বাগবিতন্ডা। দু-এক জায়গায় হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এসবের একটাই কারণ অতিরিক্ত ভাড়া আদায়। সব মিলিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন যাত্রীরা। ক্ষোভ প্রকাশ করেন যাত্রী, চালক থেকে শুরু করে কন্ডাকটর পর্যন্ত।

রকিবুল ইসলাম মুকুল নামে একজন তার ফেইসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘বাস ভাড়া কিলোমিটারে বেড়েছে ৩৫ পয়সা। বনশ্রী থেকে রামপুরা ব্রিজ সর্বোচ্চ দেড় কিলোমিটার। আগে ভাড়া নিত ১০ টাকা। আজ থেকে ১৫ টাকা। তাহলে কিলোতে কত বাড়ল.....’

মিরপুর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলে অটো পরিবহনের বাস। এই বাসে উঠলে দেখা যায়, নির্ধারিত নতুন ভাড়ার চেয়ে পাঁচ টাকা বেশি নিচ্ছেন হেলপার। এ নিয়ে হেলপারের সঙ্গে যাত্রীদের কথা কাটাকাটিও হয়।

শাহবাগে কয়েকজন যাত্রী নামেন আবার কয়েকজন ওঠেন। শাহবাগে ওঠা নতুন যাত্রী রফিকুল ইসলাম পল্টন যাবেন, তার কাছে ১৫ টাকা চাইলে তিনি রেগে প্রায় মারতে যান কন্ডাকটরকে। রফিকুল বলেন, ‘শাহবাগ থেকে পল্টনের দূরত্ব কত, কেন আমি এত টাকা দেবো।’ কন্ডাকটরও বলতে থাকে, ‘আমি কী করবো, সরকারকে বলেন।’

এ সময় অন্য এক যাত্রী বলেন, ‘দিয়ে দেন, সরকারের রাজস্ব আদায় করতে পারে না। এখন সাধারণ জনগণের পকেটে হাত।’

আরেকজন বলেন, ‘তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে বাড়ছে শুধু বাস ভাড়াই না, সব কিছুর দাম। আমাদের বেতন বাড়ায় দিক, সরকার বলুক সবার বেতন বাড়ায় দেন।’

এই প্রতিবেদক ফার্মগেট থেকে প্রেসক্লাবে ভাড়া ১০ টাকা দিলে বিআরটিসির কন্ডাকটর বেশ রাগি রাগি চেহেরায় বলেন ‘আজ দিলেন কাল থেকে আর পারবেন না।’ কি মনে হলো কন্ডাকটর কিছুক্ষণ পর বিনয়ের সুরে বলেন, ‘কী করবো বলেন, আমাদেরও তো চলতে হবে। তেলের দাম যেভাবে বাড়ছে, আমাদের হাত পা বাধা।’

back to top