সারাবিশ্বে বেড়েই চলেছে মূল্যস্ফীতি। কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ঋণ নেয়ার সক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। এতে কমছে বিনিয়োগ। এসব কারণে সামনে বড় মন্দার ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব- আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এমন আশঙ্কা করছে।
বাংলাদেশও এড়াতে পারবে না এই মন্দার ধাক্কা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেই আশঙ্কার কথাই শুনিয়েছেন। আর বিশ্বব্যাংক বলছে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক এক শতাংশ নেমে আসতে পারে। সংস্থাটির এই প্রবৃদ্ধি আগের দেয়া পূর্বাভাসের চেয়ে দশমিক ৬ শতাংশ পয়েন্ট কম।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা জানিয়েছেন, আগামী বছরের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন অর্থাৎ পূর্বাভাস কমিয়ে দেবে তারা। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক আগামী ২০২৩ সালের বিশ্ব প্রবৃদ্ধির যে পূর্বাভাস আগে দিয়েছিল তা কমিয়ে দিয়েছে।
আইএমএফ প্রধান বলছেন, ‘অর্থনৈতিক দুরবস্থার অন্ধকার নেমে আসতে পারে আগামী বছর। একাধিক ধাক্কা, তার মধ্যে আবার বুদ্ধিহীন যুদ্ধ অর্থনৈতিক চিত্রকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। অস্থায়ী হওয়ার বদলে মূল্যস্ফীতি আরও স্থায়ী হয়েছে।’
বিশ্বের অর্থনৈতিক দুর্দশার একটি ভয়াবহ চিত্র বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে রাশিয়ান গ্যাসের মূল্য টের পাচ্ছে ইউরোপ। গভীর মন্দার সম্মুখীন হচ্ছে চীনের বাজার। মূল্যস্ফীতি আর ক্রমবর্ধমান সুদের হার ভোক্তাদের মনে সংশয় সৃষ্টি করছে। বিনিয়োগ আটকে দেয়ার কারণে মার্কিন অর্থনীতিও গতি হারাচ্ছে। উদীয়মান বাজার এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলো খাদ্য ও জ্বালানির উচ্চ দামের মোকাবিলা করার জন্য আরও খারাপ অবস্থানে রয়েছে, বিশেষ করে তাদের রপ্তানির চাহিদা কমে যাওয়ায়।’
আইএমএফ প্রধান জর্জিয়েভার মতে, ২০২৬ সালের মধ্যে প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে, যা জার্মানির জাতীয় অর্থনীতির সমান। নিঃসন্দেহে এটি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বিশাল ধাক্কা হতে যাচ্ছে। এমনকি এই পরিস্থিতি ভালো হওয়ার বদলে উল্টো খারাপ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
বিশ্ব আগামী বছর ‘দুর্ভিক্ষের মতো খারাপ পরিস্থিতির’ মুখোমুখি হতে পারে বলে বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) এক সংবাদ সম্মেলনে সতর্ক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
বাংলাদেশে কিছুদিন ধরেই কমছে রিজার্ভ। আর দীর্ঘদিন পর গত মাসে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমেছে। এগুলো মন্দার পূর্বাভাস কি না তা নিয়ে আলোচনা আছে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে। তবে দেশে এই সম্ভাব্য মন্দা মোকাবিলা করতে আর্থিক খাতে সংস্কার ও রপ্তানি বাণিজ্যের সমস্যাগুলো সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
আগাম প্রস্তুতি হিসেবে দেশের সার্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে সংস্কার করতে হবে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন তিনি সংবাদকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আমরা তো তা ঠেকাতে পারবো না। তবে আমরা আমাদের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে পারি।’
আসন্ন মন্দা মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথমত, দেশের রপ্তানি খাত যেন ব্যাহত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বিশেষ করে, রপ্তানির সঙ্গে জড়িতে যেকোন লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে হবে। আমাদের অক্ষমতার কারণে যেন কোন বিদেশি ক্রেতা মুখ ফিরিয়ে না নেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশের আর্থিক খাত সুশৃঙ্খল করতে হবে। যেকোন অনিয়ম, বিশেষ করে ব্যাংক খাতে অনিয়ম কঠোর হাতে দমন করতে হবে। এটি করতে না পারলে দেশের অর্থনীতি ঠিক হবে না। আর অভ্যন্তরীণ আর্থিক খাত ঠিক না হলে এর প্রভাব সব খাতেই পড়বে।’
দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া এবং সার্বিক অর্থনীতিতে সংকটের এক বড় কারণ সম্প্রতি ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া। তাই ডলারের দাম যেন স্থিতিশীল থাকে এবং ডলার লেনদেন খাতটি যেন ঠিক থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘ডলার সংকটের কারণে এলসি নিষ্পত্তি করতে সমস্যা হচ্ছে। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। বিদেশি ব্যাংকগুলো সুদহার বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই এই খাতে ঠিক করা না হলে রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
বড় অর্থনীতির সংকোচন হবে
আইএমএফের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় এক তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণে রাখা দেশগুলো ২০২২ বা ২০২৩ সালের পরপর দুই চতুর্থাংশ সংকোচনের সম্মুখীন হবে। এমনকি যখন প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হয়, তখন প্রকৃত আয় সংকুচিত বা কমে যায় এবং ক্রমবর্ধমান দামের কারণে মন্দার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে। এখন পর্যন্ত আইএমএফ তিনবার তার বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির অনুমান কমিয়েছে। ২০২২ এর জন্য এই বৃদ্ধি ৩.২ শতাংশ এবং ২০২৩ এর জন্য এটি ২.৯ শতাংশ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে সংস্থাটির এক আলোচনায় নীতিনির্ধারকরা উচ্চ সুদহারের প্রভাবের জন্য প্রস্তুতি, মুদ্রাস্ফীতির চাপ এবং মন্দার ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য কিভাবে করতে হবে সেগুলো নিয়ে কথা বলেন।
আইএমএফ ট্রেজারি সেক্রেটারি জ্যানেট এল. ইয়েলেন বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রথম কাজ হলো স্থিতিশীল দামের পরিবেশে ফিরে আসা। তবে তা সহজ নয়। যদি ঋণ সংকট দেখা দেয়, আইএমএফ এবং বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংকগুলোকে উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোকে সহায়তা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এছাড়া অনেক উদীয়মান বাজারের জন্য উল্লেখযোগ্য ঋণ ত্রাণ প্রয়োজন হতে পারে।’
প্রবৃদ্ধি কমিয়েছে বিশ্বব্যাংকও
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সারা বিশ্বের প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন বা পূর্বাভাস কমিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের বিষয়ে সংস্থাটি বলছে, চলতি অর্থবছরে (২০২৩ সালের জুন শেষে) মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক এক শতাংশ নেমে আসতে পারে।
সংস্থাটির এই প্রবৃদ্ধি আগের দেয়া পূর্বাভাসের চেয়ে দশমিক ৬ শতাংশ পয়েন্ট কম। বাংলাদেশসহ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর আর্থিক বছর হিসাব করা হয় জুন-জুলাই। সে হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে নেপালের প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক এক শতাংশ। এছাড়া ভুটানে ৪ দশমিক এক শতাংশ, পাকিস্তানে ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে।
এদিকে বাংলাদেশ সরকার চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে। আর গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪ শতাংশে আটকে রাখতে চেয়েছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় বাংলাদেশে। গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ।
রপ্তানি, রেমিট্যান্স, রিজার্ভ কমেছে
দীর্ঘদিন পর গত মাসে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমেছে। আর এর প্রভাবে কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ। সাত মাস পর সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স এসেছে গত সেপ্টেম্বরে। অন্যদিকে ১৩ মাস পর রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধিতে লেগেছে হোঁচট। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। তবে সেপ্টেম্বরে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এই দুই সূচকে নেতিবাচক ধারার কারণে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ নেমেছে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। রোববার দিন শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৬ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার।
পোশাক রপ্তানি কমার বিষয়ে বিজিএমইএ পরিচালক ও মুখপাত্র মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘কোভিড-পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী খুচরা বাজার বিভিন্ন সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে কনটেইনারের অপ্রতুলতা এবং সাপ্লাই চেইন সংকট, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে পূর্বাভাস অনুযায়ী মন্দার আবির্ভাব। এসব কারণে খুচরা বিক্রিতে ধস নেমেছে। ক্রেতাদের পোশাকের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে। এই মন্দা কবে নাগাদ শেষ হবে তা বলা যাচ্ছে না।’
শুক্রবার, ০৭ অক্টোবর ২০২২
সারাবিশ্বে বেড়েই চলেছে মূল্যস্ফীতি। কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ঋণ নেয়ার সক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। এতে কমছে বিনিয়োগ। এসব কারণে সামনে বড় মন্দার ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব- আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এমন আশঙ্কা করছে।
বাংলাদেশও এড়াতে পারবে না এই মন্দার ধাক্কা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেই আশঙ্কার কথাই শুনিয়েছেন। আর বিশ্বব্যাংক বলছে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক এক শতাংশ নেমে আসতে পারে। সংস্থাটির এই প্রবৃদ্ধি আগের দেয়া পূর্বাভাসের চেয়ে দশমিক ৬ শতাংশ পয়েন্ট কম।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা জানিয়েছেন, আগামী বছরের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন অর্থাৎ পূর্বাভাস কমিয়ে দেবে তারা। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক আগামী ২০২৩ সালের বিশ্ব প্রবৃদ্ধির যে পূর্বাভাস আগে দিয়েছিল তা কমিয়ে দিয়েছে।
আইএমএফ প্রধান বলছেন, ‘অর্থনৈতিক দুরবস্থার অন্ধকার নেমে আসতে পারে আগামী বছর। একাধিক ধাক্কা, তার মধ্যে আবার বুদ্ধিহীন যুদ্ধ অর্থনৈতিক চিত্রকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। অস্থায়ী হওয়ার বদলে মূল্যস্ফীতি আরও স্থায়ী হয়েছে।’
বিশ্বের অর্থনৈতিক দুর্দশার একটি ভয়াবহ চিত্র বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে রাশিয়ান গ্যাসের মূল্য টের পাচ্ছে ইউরোপ। গভীর মন্দার সম্মুখীন হচ্ছে চীনের বাজার। মূল্যস্ফীতি আর ক্রমবর্ধমান সুদের হার ভোক্তাদের মনে সংশয় সৃষ্টি করছে। বিনিয়োগ আটকে দেয়ার কারণে মার্কিন অর্থনীতিও গতি হারাচ্ছে। উদীয়মান বাজার এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলো খাদ্য ও জ্বালানির উচ্চ দামের মোকাবিলা করার জন্য আরও খারাপ অবস্থানে রয়েছে, বিশেষ করে তাদের রপ্তানির চাহিদা কমে যাওয়ায়।’
আইএমএফ প্রধান জর্জিয়েভার মতে, ২০২৬ সালের মধ্যে প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে, যা জার্মানির জাতীয় অর্থনীতির সমান। নিঃসন্দেহে এটি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বিশাল ধাক্কা হতে যাচ্ছে। এমনকি এই পরিস্থিতি ভালো হওয়ার বদলে উল্টো খারাপ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
বিশ্ব আগামী বছর ‘দুর্ভিক্ষের মতো খারাপ পরিস্থিতির’ মুখোমুখি হতে পারে বলে বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) এক সংবাদ সম্মেলনে সতর্ক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
বাংলাদেশে কিছুদিন ধরেই কমছে রিজার্ভ। আর দীর্ঘদিন পর গত মাসে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমেছে। এগুলো মন্দার পূর্বাভাস কি না তা নিয়ে আলোচনা আছে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে। তবে দেশে এই সম্ভাব্য মন্দা মোকাবিলা করতে আর্থিক খাতে সংস্কার ও রপ্তানি বাণিজ্যের সমস্যাগুলো সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
আগাম প্রস্তুতি হিসেবে দেশের সার্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে সংস্কার করতে হবে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন তিনি সংবাদকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আমরা তো তা ঠেকাতে পারবো না। তবে আমরা আমাদের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে পারি।’
আসন্ন মন্দা মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথমত, দেশের রপ্তানি খাত যেন ব্যাহত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বিশেষ করে, রপ্তানির সঙ্গে জড়িতে যেকোন লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে হবে। আমাদের অক্ষমতার কারণে যেন কোন বিদেশি ক্রেতা মুখ ফিরিয়ে না নেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশের আর্থিক খাত সুশৃঙ্খল করতে হবে। যেকোন অনিয়ম, বিশেষ করে ব্যাংক খাতে অনিয়ম কঠোর হাতে দমন করতে হবে। এটি করতে না পারলে দেশের অর্থনীতি ঠিক হবে না। আর অভ্যন্তরীণ আর্থিক খাত ঠিক না হলে এর প্রভাব সব খাতেই পড়বে।’
দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া এবং সার্বিক অর্থনীতিতে সংকটের এক বড় কারণ সম্প্রতি ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া। তাই ডলারের দাম যেন স্থিতিশীল থাকে এবং ডলার লেনদেন খাতটি যেন ঠিক থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘ডলার সংকটের কারণে এলসি নিষ্পত্তি করতে সমস্যা হচ্ছে। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। বিদেশি ব্যাংকগুলো সুদহার বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই এই খাতে ঠিক করা না হলে রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
বড় অর্থনীতির সংকোচন হবে
আইএমএফের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় এক তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণে রাখা দেশগুলো ২০২২ বা ২০২৩ সালের পরপর দুই চতুর্থাংশ সংকোচনের সম্মুখীন হবে। এমনকি যখন প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হয়, তখন প্রকৃত আয় সংকুচিত বা কমে যায় এবং ক্রমবর্ধমান দামের কারণে মন্দার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে। এখন পর্যন্ত আইএমএফ তিনবার তার বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির অনুমান কমিয়েছে। ২০২২ এর জন্য এই বৃদ্ধি ৩.২ শতাংশ এবং ২০২৩ এর জন্য এটি ২.৯ শতাংশ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে সংস্থাটির এক আলোচনায় নীতিনির্ধারকরা উচ্চ সুদহারের প্রভাবের জন্য প্রস্তুতি, মুদ্রাস্ফীতির চাপ এবং মন্দার ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য কিভাবে করতে হবে সেগুলো নিয়ে কথা বলেন।
আইএমএফ ট্রেজারি সেক্রেটারি জ্যানেট এল. ইয়েলেন বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রথম কাজ হলো স্থিতিশীল দামের পরিবেশে ফিরে আসা। তবে তা সহজ নয়। যদি ঋণ সংকট দেখা দেয়, আইএমএফ এবং বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংকগুলোকে উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোকে সহায়তা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এছাড়া অনেক উদীয়মান বাজারের জন্য উল্লেখযোগ্য ঋণ ত্রাণ প্রয়োজন হতে পারে।’
প্রবৃদ্ধি কমিয়েছে বিশ্বব্যাংকও
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সারা বিশ্বের প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন বা পূর্বাভাস কমিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের বিষয়ে সংস্থাটি বলছে, চলতি অর্থবছরে (২০২৩ সালের জুন শেষে) মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক এক শতাংশ নেমে আসতে পারে।
সংস্থাটির এই প্রবৃদ্ধি আগের দেয়া পূর্বাভাসের চেয়ে দশমিক ৬ শতাংশ পয়েন্ট কম। বাংলাদেশসহ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর আর্থিক বছর হিসাব করা হয় জুন-জুলাই। সে হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে নেপালের প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক এক শতাংশ। এছাড়া ভুটানে ৪ দশমিক এক শতাংশ, পাকিস্তানে ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে।
এদিকে বাংলাদেশ সরকার চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে। আর গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪ শতাংশে আটকে রাখতে চেয়েছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় বাংলাদেশে। গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ।
রপ্তানি, রেমিট্যান্স, রিজার্ভ কমেছে
দীর্ঘদিন পর গত মাসে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমেছে। আর এর প্রভাবে কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ। সাত মাস পর সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স এসেছে গত সেপ্টেম্বরে। অন্যদিকে ১৩ মাস পর রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধিতে লেগেছে হোঁচট। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। তবে সেপ্টেম্বরে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এই দুই সূচকে নেতিবাচক ধারার কারণে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ নেমেছে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। রোববার দিন শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৬ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার।
পোশাক রপ্তানি কমার বিষয়ে বিজিএমইএ পরিচালক ও মুখপাত্র মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘কোভিড-পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী খুচরা বাজার বিভিন্ন সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে কনটেইনারের অপ্রতুলতা এবং সাপ্লাই চেইন সংকট, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে পূর্বাভাস অনুযায়ী মন্দার আবির্ভাব। এসব কারণে খুচরা বিক্রিতে ধস নেমেছে। ক্রেতাদের পোশাকের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে। এই মন্দা কবে নাগাদ শেষ হবে তা বলা যাচ্ছে না।’