নিরপেক্ষতার কারণে হয়েছেন আলোচিত-সমালোচিত
সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। প্রধান বিচারপতির দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। রাজনীতি না করলেও সংকট উত্তরণে রাজনীতি পরিবেষ্টিত হতে পিছপা হননি। তবে রাজনীতির দ্বন্দ্ব ও দলাদলি থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করেছেন। ক্ষমতার মোহ তাকে অন্ধ করতে পারেনি। নিরপেক্ষতার কারণে হয়েছেন প্রিয়-অপ্রিয়; আলোচিত-সমালোচিত।
শনিবার (১৯ মার্চ) সকালে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বার্ধ্যক্যজনিত বিভিন্ন অসুস্থতায় ভুগছিলেন। মাসখানেক আগে তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়।
শনিবার বিকেলে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় পাইকুড়া ইউনিয়নের নিজ গ্রাম পেমইতে প্রথম জানাজা শেষে সাহাবুদ্দীন আহমদের মরদেহ ঢাকায় আনা হয়। আজ জাতীয় ঈদগাহ মাঠে দ্বিতীয় জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে স্ত্রীর কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহাবুদ্দীন আহমদের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা। এছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক জানানো হয়েছে।
একাধিক রাজনীতিকের মতে, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ রাজনীতিক ছিলন না। দেশের পরিস্থিতির কারণে তাকে কিছু সময় রাজনীতি ও রাজনীতিক পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে হয়েছে। তিনি রাজনীতির দ্বন্দ্ব ও দলাদলি থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রাখার চেষ্টা করেছেন। নিরপেক্ষতার কারণে তিনি বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই দলের কাছেই অপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন দায়িত্ব পালনকালে। তবে এই নিরপেক্ষতার কারণেই সাধারণ মানুষের কাছে তিনি প্রিয়ভাজন হয়ে থাকবেন আজীবন।
যেভাবে বিচারপতি থেকে রাষ্ট্রপতি
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকার পতনের নাটকীয়তার মধ্যে আকস্মিকভাবে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে আসেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ।
এরশাদ পদত্যাগ করার পর রাষ্ট্রপতির পদে কে আসবে, নির্বাচন পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কে থাকবেন সেই প্রশ্নে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেয়া দলগুলো (তিন জোট) একমত হতে পারছিল না। পরে প্রধান বিচারপতিকে সেই দায়িত্ব দেয়ার বিষয়ে সমঝোতা হয়। আবার সুপ্রিম কোর্টে ফেরার শর্ত দিয়ে সাহাবুদ্দীন আহমদ তাতে রাজি হন। মওদুদ আহমেদ উপরাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দিলে সেই দায়িত্বে আসেন সাহাবুদ্দীন। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছাড়লে সাহাবুদ্দীন হন রাষ্ট্রপতি।
তার নেতৃত্বেই ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু (পঞ্চম সংসদ) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি বেশ কয়েকটি কঠোর আইন সংশোধন করেছিলেন, যা দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছিল। নব্বইয়ের ৬ ডিসেম্বর থেকে একানব্বইয়ের ৯ অক্টোবার পর্যন্ত প্রায় ১১ মাস অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও বঙ্গভবনে ছিলেন না সাহাবুদ্দীন আহমদ।
নির্বাচনের পর আবার প্রধান বিচারপতির পদে ফেরেন তিনি। তার সেই ফেরার জন্য দেশের সংবিধানেও পরিবর্তন আনতে হয়েছিল। ১৯৯৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসরে যান সাহাবুদ্দীন আহমদ।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর অনেক অনুরোধে তিনি সপ্তদশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। ওই বছর ৯ অক্টোবর থেকে ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি সেই দায়িত্বে ছিলেন। সে সময় তিনি বঙ্গভবনে ছিলেন।
বঙ্গভবন থেকে বিদায় নেয়ার পর ঢাকার গুলশানের বাড়িতে অনেকটা নিভৃত জীবন-যাপন করছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ।
নিরপেক্ষতার কারণে আলোচিত
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া হন প্রধানমন্ত্রী। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার প্রতি অবিচল আস্থাশীল সাহাবুদ্দীন আহমদ কখনোই সেই অধিকার প্রয়োগ করেননি।
তিনি চেয়েছেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা দেশ পরিচালিত হোক। তিনি দ্রুত নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেরও তাগিদ দিলেন। তখনও বিএনপির নীতিগত অবস্থান ছিল রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতির সরকারের পক্ষে। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী দলগুলো সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করার দাবি জানিয়ে আসছিল। এরই মধ্যে উচ্চপর্যায়ে নিয়োগসহ নানা বিষয়ে সরকারের সঙ্গে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির মতভেদ দেখা দেয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রকাশ্যে তার সমালোচনা করতে থাকেন।
১৯৯১ সালের ৫ জুন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সাহাবুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘সংবিধান মতে প্রধানমন্ত্রীসহ সব মন্ত্রী রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টামাত্র। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে জনপ্রতিনিধি নিয়ে গঠিত মন্ত্রিসভাকে যথেষ্ট ক্ষমতা ও দায়িত্ব অর্পণ করা আমি প্রয়োজন বলে মনে করি। তাই মন্ত্রিপরিষদের কোন কাজে আমি হস্তক্ষেপ করিনি। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালিত হোক, এটাই আমার সারা জীবনের স্বপ্ন ও সাধনা।’
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় একবার রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সাময়িক হলেও ছাত্ররাজনীতি বন্ধ রাখার কথা বলেছিলেন। দলের নেতারা এর প্রতিবাদ করলেন। পরে রাষ্ট্রপতি ছাত্ররাজনীতি নিয়ে আর কথা বলেননি।
তবে ২০০১ সালে নির্বাচনে হারের পর আওয়ামী লীগের সমালোচনার ?মুখে পড়েছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ।
জন্ম ও কর্মজীবন
সাহাবুদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার পেমই গ্রামে। তার বাবার নাম তালুকদার রিসাত আহমেদ।
সাহাবুদ্দীন ১৯৪৫ সালে নান্দাইলের চন্ডীপাশা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৮ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে আইএ পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫১ সালে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৫২ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন তিনি।
১৯৫৪ সালে পাকিস্তানি সিভিল সার্ভিসের (সিএসপি) প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কর্মজীবন শুরু হয় সাহাবুদ্দীনের। পরে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের একটি বিশেষ কোর্স সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবনে তিনি গোপালগঞ্জ ও নাটোরে সাব-ডিভিশনাল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে তিনি ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হন। ১৯৬০ সালে প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগে বদলি হন তিনি। ১৯৬৭ সালে ঢাকা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পান সাহাবুদ্দীন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। তিনি ১৯৭৮ সালের আগস্ট থেকে ১৯৮২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮০ সালে আপিল বিভাগে বিচারকের দায়িত্ব পান তিনি। তার এক দশক পর ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন তিনি।
সাহাবুদ্দীন আহমদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় ড. সিতারা পারভীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। ২০০৫ সালের ২৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। তার দুই ছেলে গুলশানের বাসায় বাবার সঙ্গেই থাকেন। এক মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এবং এক মেয়ে যুক্তরাজ্যে রয়েছেন।
বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে ২০১৮ সালে ৮০ বছর বয়সে মারা যান সাহাবুদ্দীন আহমদের স্ত্রী আনোয়ারা আহমদ। তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
বিচারপতি হিসেবে তার প্রদত্ত বহুসংখ্যক রায় প্রশংসিত। বাংলাদেশ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর ওপর তার দেয়া রায় দেশের শাসনতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃত।
১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। তবে তার বিস্তারিত প্রতিবেদন তৎকালীন সরকার কখনোই প্রকাশ করেনি।
সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে সাহাবুদ্দীন আহমদ এদেশের আইনের অঙ্গনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যে অবদান রেখেছেন, গণতন্ত্র উত্তরণে যে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন, জাতি তা অবনতমস্তকে স্মরণ করবে।
নিরপেক্ষতার কারণে হয়েছেন আলোচিত-সমালোচিত
শনিবার, ১৯ মার্চ ২০২২
সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। প্রধান বিচারপতির দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। রাজনীতি না করলেও সংকট উত্তরণে রাজনীতি পরিবেষ্টিত হতে পিছপা হননি। তবে রাজনীতির দ্বন্দ্ব ও দলাদলি থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করেছেন। ক্ষমতার মোহ তাকে অন্ধ করতে পারেনি। নিরপেক্ষতার কারণে হয়েছেন প্রিয়-অপ্রিয়; আলোচিত-সমালোচিত।
শনিবার (১৯ মার্চ) সকালে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বার্ধ্যক্যজনিত বিভিন্ন অসুস্থতায় ভুগছিলেন। মাসখানেক আগে তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়।
শনিবার বিকেলে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় পাইকুড়া ইউনিয়নের নিজ গ্রাম পেমইতে প্রথম জানাজা শেষে সাহাবুদ্দীন আহমদের মরদেহ ঢাকায় আনা হয়। আজ জাতীয় ঈদগাহ মাঠে দ্বিতীয় জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে স্ত্রীর কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহাবুদ্দীন আহমদের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা। এছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক জানানো হয়েছে।
একাধিক রাজনীতিকের মতে, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ রাজনীতিক ছিলন না। দেশের পরিস্থিতির কারণে তাকে কিছু সময় রাজনীতি ও রাজনীতিক পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে হয়েছে। তিনি রাজনীতির দ্বন্দ্ব ও দলাদলি থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রাখার চেষ্টা করেছেন। নিরপেক্ষতার কারণে তিনি বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই দলের কাছেই অপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন দায়িত্ব পালনকালে। তবে এই নিরপেক্ষতার কারণেই সাধারণ মানুষের কাছে তিনি প্রিয়ভাজন হয়ে থাকবেন আজীবন।
যেভাবে বিচারপতি থেকে রাষ্ট্রপতি
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকার পতনের নাটকীয়তার মধ্যে আকস্মিকভাবে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে আসেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ।
এরশাদ পদত্যাগ করার পর রাষ্ট্রপতির পদে কে আসবে, নির্বাচন পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কে থাকবেন সেই প্রশ্নে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেয়া দলগুলো (তিন জোট) একমত হতে পারছিল না। পরে প্রধান বিচারপতিকে সেই দায়িত্ব দেয়ার বিষয়ে সমঝোতা হয়। আবার সুপ্রিম কোর্টে ফেরার শর্ত দিয়ে সাহাবুদ্দীন আহমদ তাতে রাজি হন। মওদুদ আহমেদ উপরাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দিলে সেই দায়িত্বে আসেন সাহাবুদ্দীন। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছাড়লে সাহাবুদ্দীন হন রাষ্ট্রপতি।
তার নেতৃত্বেই ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু (পঞ্চম সংসদ) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি বেশ কয়েকটি কঠোর আইন সংশোধন করেছিলেন, যা দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছিল। নব্বইয়ের ৬ ডিসেম্বর থেকে একানব্বইয়ের ৯ অক্টোবার পর্যন্ত প্রায় ১১ মাস অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও বঙ্গভবনে ছিলেন না সাহাবুদ্দীন আহমদ।
নির্বাচনের পর আবার প্রধান বিচারপতির পদে ফেরেন তিনি। তার সেই ফেরার জন্য দেশের সংবিধানেও পরিবর্তন আনতে হয়েছিল। ১৯৯৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসরে যান সাহাবুদ্দীন আহমদ।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর অনেক অনুরোধে তিনি সপ্তদশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। ওই বছর ৯ অক্টোবর থেকে ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি সেই দায়িত্বে ছিলেন। সে সময় তিনি বঙ্গভবনে ছিলেন।
বঙ্গভবন থেকে বিদায় নেয়ার পর ঢাকার গুলশানের বাড়িতে অনেকটা নিভৃত জীবন-যাপন করছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ।
নিরপেক্ষতার কারণে আলোচিত
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া হন প্রধানমন্ত্রী। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার প্রতি অবিচল আস্থাশীল সাহাবুদ্দীন আহমদ কখনোই সেই অধিকার প্রয়োগ করেননি।
তিনি চেয়েছেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা দেশ পরিচালিত হোক। তিনি দ্রুত নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেরও তাগিদ দিলেন। তখনও বিএনপির নীতিগত অবস্থান ছিল রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতির সরকারের পক্ষে। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী দলগুলো সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করার দাবি জানিয়ে আসছিল। এরই মধ্যে উচ্চপর্যায়ে নিয়োগসহ নানা বিষয়ে সরকারের সঙ্গে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির মতভেদ দেখা দেয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রকাশ্যে তার সমালোচনা করতে থাকেন।
১৯৯১ সালের ৫ জুন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সাহাবুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘সংবিধান মতে প্রধানমন্ত্রীসহ সব মন্ত্রী রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টামাত্র। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে জনপ্রতিনিধি নিয়ে গঠিত মন্ত্রিসভাকে যথেষ্ট ক্ষমতা ও দায়িত্ব অর্পণ করা আমি প্রয়োজন বলে মনে করি। তাই মন্ত্রিপরিষদের কোন কাজে আমি হস্তক্ষেপ করিনি। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালিত হোক, এটাই আমার সারা জীবনের স্বপ্ন ও সাধনা।’
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় একবার রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সাময়িক হলেও ছাত্ররাজনীতি বন্ধ রাখার কথা বলেছিলেন। দলের নেতারা এর প্রতিবাদ করলেন। পরে রাষ্ট্রপতি ছাত্ররাজনীতি নিয়ে আর কথা বলেননি।
তবে ২০০১ সালে নির্বাচনে হারের পর আওয়ামী লীগের সমালোচনার ?মুখে পড়েছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ।
জন্ম ও কর্মজীবন
সাহাবুদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার পেমই গ্রামে। তার বাবার নাম তালুকদার রিসাত আহমেদ।
সাহাবুদ্দীন ১৯৪৫ সালে নান্দাইলের চন্ডীপাশা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৮ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে আইএ পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫১ সালে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৫২ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন তিনি।
১৯৫৪ সালে পাকিস্তানি সিভিল সার্ভিসের (সিএসপি) প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কর্মজীবন শুরু হয় সাহাবুদ্দীনের। পরে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের একটি বিশেষ কোর্স সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবনে তিনি গোপালগঞ্জ ও নাটোরে সাব-ডিভিশনাল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে তিনি ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হন। ১৯৬০ সালে প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগে বদলি হন তিনি। ১৯৬৭ সালে ঢাকা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পান সাহাবুদ্দীন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। তিনি ১৯৭৮ সালের আগস্ট থেকে ১৯৮২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮০ সালে আপিল বিভাগে বিচারকের দায়িত্ব পান তিনি। তার এক দশক পর ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন তিনি।
সাহাবুদ্দীন আহমদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় ড. সিতারা পারভীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। ২০০৫ সালের ২৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। তার দুই ছেলে গুলশানের বাসায় বাবার সঙ্গেই থাকেন। এক মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এবং এক মেয়ে যুক্তরাজ্যে রয়েছেন।
বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে ২০১৮ সালে ৮০ বছর বয়সে মারা যান সাহাবুদ্দীন আহমদের স্ত্রী আনোয়ারা আহমদ। তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
বিচারপতি হিসেবে তার প্রদত্ত বহুসংখ্যক রায় প্রশংসিত। বাংলাদেশ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর ওপর তার দেয়া রায় দেশের শাসনতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃত।
১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। তবে তার বিস্তারিত প্রতিবেদন তৎকালীন সরকার কখনোই প্রকাশ করেনি।
সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে সাহাবুদ্দীন আহমদ এদেশের আইনের অঙ্গনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যে অবদান রেখেছেন, গণতন্ত্র উত্তরণে যে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন, জাতি তা অবনতমস্তকে স্মরণ করবে।