alt

মুক্ত আলোচনা

অনিরাপদ খাদ্য সুস্থ জীবনের অন্তরায়

মিজানুর রহমান পলাশ

: মঙ্গলবার, ২৯ জুন ২০২১

বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ খাদ্য অত্যন্ত জরুরি। খাদ্য ও স্বাস্থ্য একটি আরেকটির পরিপূরক। টেকসই জীবন ও সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নেই। অনিরাপদ খাদ্য স্বাস্থ্য ঝুঁকির অন্যতম কারণ। অনেক জটিল এবং দূরারোগ্য ব্যাধির জন্য দায়ী অনিরাপদ খাদ্য।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৬০ কোটি মানুষ দূষিত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয় এবং প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মানুষ মারা যায়। এছাড়া, ৫ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশুদের ৪৩ শতাংশই অনিরাপদ খাবারজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে প্রতিবছর মারা যায় ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু।

রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরের ফুটপাত, পার্ক, রেল ও বাস স্ট্রেশন এবং জনাকীর্ণ এলাকায় খোলা আকাশের নীচে প্রচুর খাবারের দোকান দেখতে পাওয়া যায়। ফুটপাতে বিভিন্ন ধরনের লোভনীয় খাবার পথচারীদের আকৃষ্ট করে। গরমের সময় বেশি দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের সরবত বিক্রি করতে। পথচারী এবং শিশুরা ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিবৃত্ত করতে কখনো আবার লোভনীয় খাবারে আকৃষ্ট হয়ে কম দামে রাস্তার অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে থাকে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব শ্রেণির মানুষের পছন্দ হলেও স্বাস্থ্যের জন্য নানা ঝুঁকি তৈরি করে এসব রাস্তার খাবার। চিকেন ফ্রাই, ফ্রেন্স ফ্রাই, নুডুলস, বার্গার, সিঙ্গারা, সমুচা, ফ্রাইড রাইসের মতো বিলাসবহুল খাবারও রাস্তার দোকানগুলোতে পাওয়া যায়। আর দৃষ্টিনন্দন এসব খাবারে আকৃষ্ট হয়ে খায় ভোক্তারাও। কোথায়, কীভাবে তৈরি হয় এসব খাবার, তার খোঁজ কেউ রাখে না। আবার অনেকে নিরুপায় হয়ে এসব খাবার খায়। রাস্তার পাশে ডিম ভাত এবং ডিম খিচুড়ি রিক্সা, ভ্যান চালকসহ নিম্নআয়ের মানুষের নিত্যদিনের একমাত্র অবলম্বন। রাস্তার পাশে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি করা হচ্ছে এসব খাবার। কোনো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা বা ভোক্তাদের স্বাস্থ্যের বিষয় উপেক্ষিত থেকে যায়।

রাস্তায় তৈরি ও পরিবেশিত খাবারকে স্ট্রিট ফুড বলে। সস্তা, সহজলভ্য, মুখরোচক খাবার হিসেবে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্ট্রিট ফুড বেশ জনপ্রিয়। উন্নত দেশের স্ট্রিট ফুড স্বাস্থ্যসম্মত, উপাদেয় ও আকর্ষণীয় হলেও আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে রাস্তায় যেসব খাবার তৈরি ও বিক্রি হয় তা বেশিরভাগই বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। স্ট্রিট ফুড অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রস্তুত ও পরিবেশিত হয় বলে তা বিভিন্ন জটিল ও মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে। খোলা আকাশের নিচে, উন্মুক্ত অবস্থায় তৈরি ও বিক্রি করা খাবার পোকামাকড় ও মাছি দ্বারা দূষিত হয়। বাতাসে ভাসমান ধুলা-ময়লাও এতে পড়ে। সাধারণত সস্তা, তৈলাক্ত ও ঝাল হওয়ার কারণে রাস্তার খাবারের বেশ কদর রয়েছে সব শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে। এ ধরনের খাবারে যেসব রোগে আক্রান্ত হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিসসহ বিভিন্ন রোগ। এছাড়া হৃদরোগ, কিডনির সমস্যা এবং বিকল হওয়াসহ ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগেও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে চিকিৎসকগণ মনে করেন। রাস্তায় তৈরি এসব খাবার খাওয়ার ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে শিঙ্গাড়া, সমুচা, বেগুনি, আলুর চপ, ডালপুরি, ফুচকা, চটপটি, বিভিন্ন ধরনের আচার, হালিম, ঝালমুড়ি, লেবুর শরবত, আইসক্রিম, আখের রস ইত্যাদি হরহামেশা বিক্রি হয়। শিশুদের কাছে এসব খাবার অত্যন্ত পছন্দের। রাস্তার খাবারের পুষ্টিগুণ থাকে অতি সামান্য এবং শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব থাকে বেশি। শিশুরা এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফুটপাতের খাবারে ক্ষতিকর রং মিশিয়ে আকর্ষণীয় করা হয়। সন্তানের আবদার মিটাতে অভিভাবকরাও এসব খাবার কিনে দেন। এসব খাবারের বেশিরভাগই বিএসটিআই কর্তৃক মান নির্ধারিত নয়। করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবার শিশুদের এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্তের হার অনেক কম। মা-বাবার উচিত সবসময় শিশুদের ঘরে তৈরি খাবার খাওয়ানো। শিশুদের সুন্দর ও সুস্বাস্থ্যের জন্য অস্বাস্থ্যকর খাবার অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে।

রাস্তার খাবার তৈরি হয় নিম্নমানের আটা, বেসন ও তেল দিয়ে। দিনের পর দিন একই তেল ব্যবহার করায় তা পুড়ে মানহীন হয়ে পড়ে। তাছাড়া ডুবো তেলে ভাজা খাবার এবং টেস্টিং সল্ট স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন কাপড়-চোপড়, ময়লা ও জীবাণুযুক্ত হাতে রাস্তায় খাবার তৈরি করা হয় বলে এসব খাবার ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। খাবার তৈরিতে প্রায়ই ব্যবহার করা হয় দূষিত পানি। যে পাত্রে খাবার পরিবেশিত হয়, সেগুলোতে প্রায়ই ক্ষতিকর জীবাণু থাকে। অপরিষ্কার অবস্থায় একই পাত্রে বিভিন্ন ব্যক্তিকে খাবার পরিবেশন করে খাওয়ানো হয়।

এখন ফলের মৌসুম। বিভিন্ন ধরনের ফলে বাজার, ফুটপাত ভরে আছে। ফল এখন সহজলভ্যও বটে। রাস্তায় তৈরি বিভিন্ন ফলের রসে থাকে অসংখ্য জীবাণু। যেসব যন্ত্রপাতি বা আনুষঙ্গিক সামগ্রী দিয়ে ফলের রস তৈরি করা হয় এবং যেসব পাত্রে তা পরিবেশিত হয়, সেগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করা হয় না। তবে এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো খাবার স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে তৈরি ও বিক্রি হয় ঠিকই, যার সংখ্যা অতি নগণ্য।

দেশে খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির চ্যালেঞ্জও বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের কারণে বাংলাদেশে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৫ হাজার ৭৭৬ জন মানুষ মারা গেছে। খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের প্রধান উৎস ডালডা বা নিম্নমানের তেল। এগুলো সাধারণত বেকারি পণ্য, প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য, স্ন্যাকস, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও খোলা জায়গায় খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

বর্তমান সরকার সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের পাশাপাশি জনগণের নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ভেজাল ও দূষণমুক্ত নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকরণে সরকার ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ প্রণয়ন করে ২০১৫ সালে ‘বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠা করেছ। প্রতিষ্ঠানটি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে এরইমধ্যে প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান প্রণয়নসহ জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি, ভেজাল ও দূষণ বিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে। দেশে ৪৮৬টি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ৬৪টি জেলা ও আটটি বিভাগীয় শহরে ৭৪টি নিরাপদ খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য আইন মেনে চলার জন্য নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তৎপর রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত দায়ী ব্যক্তিদের বিরদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করছে।

নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ তে খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদ- এবং ২০ লাখ টাকা অর্থদ-ের বিধান রয়েছে। তবে বর্তমানে খাদ্যে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান রাখার বিষয়ে অনেকেই সোচ্চার হয়েছেন।

বর্তমান সরকার ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়ন করছে এবং ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়নে এগিয়ে চলেছে। করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার উন্নত প্রজাতির বীজ ও সেচের সাথে সাথে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের ওপর ব্যাপক জোর দিয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের খাদ্যাভ্যাসে শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, মাংস ও দুধের পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে জোর দেয়া হচ্ছে। বিশ্বায়নের যুগে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, খাদ্যের বহুমুখিতা এবং নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নেই। তাই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের দিকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। নিরাপদ খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে জাপান বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে।

সুষম স্বাস্থ্যকর খাবার আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। পরিমিত শর্করা, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, বিশুদ্ধ পানি, আঁশশজাতীয় খাবার নিত্যদিনের খাবারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এছাড়া প্রতিদিনের খাদ্যে শাকসবজি-ফলমূল রাখতে হবে। শাকসবজি-ফলমূল হলো ভিটামিন, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, খনিজ পদার্থ এবং আঁশজাতীয় দ্রব্যের অফুরন্ত ভান্ডার। শাকসবজি-ফলমূল, আঁশযুক্ত খাবার শরীরের ওজন, হৃদরোগ, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কোলেস্টরেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিরাট ভূমিকা রাখে। তাই শিশুকাল থেকেই ছেলে-মেয়েদের শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়ানোর অভ্যাস করতে হবে পাশাপাশি বাইরের খাবার বর্জন করতে হবে।

সরকার দেশের নাগরিকের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতে সচেষ্ট রয়েছে। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। অনিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে। সরকারের পাশাপাশি অস্বাস্থ্যকর খাদ্য বর্জনে প্রত্যেকের ভূমিকা রাখতে হবে। বর্তমান করোনা পরিস্তিতিতে জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অনিরাপদ খাদ্য অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে। সবার আগে প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম নিবন্ধ)

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

অনিরাপদ খাদ্য সুস্থ জীবনের অন্তরায়

মিজানুর রহমান পলাশ

মঙ্গলবার, ২৯ জুন ২০২১

বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ খাদ্য অত্যন্ত জরুরি। খাদ্য ও স্বাস্থ্য একটি আরেকটির পরিপূরক। টেকসই জীবন ও সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নেই। অনিরাপদ খাদ্য স্বাস্থ্য ঝুঁকির অন্যতম কারণ। অনেক জটিল এবং দূরারোগ্য ব্যাধির জন্য দায়ী অনিরাপদ খাদ্য।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৬০ কোটি মানুষ দূষিত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয় এবং প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মানুষ মারা যায়। এছাড়া, ৫ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশুদের ৪৩ শতাংশই অনিরাপদ খাবারজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে প্রতিবছর মারা যায় ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু।

রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরের ফুটপাত, পার্ক, রেল ও বাস স্ট্রেশন এবং জনাকীর্ণ এলাকায় খোলা আকাশের নীচে প্রচুর খাবারের দোকান দেখতে পাওয়া যায়। ফুটপাতে বিভিন্ন ধরনের লোভনীয় খাবার পথচারীদের আকৃষ্ট করে। গরমের সময় বেশি দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের সরবত বিক্রি করতে। পথচারী এবং শিশুরা ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিবৃত্ত করতে কখনো আবার লোভনীয় খাবারে আকৃষ্ট হয়ে কম দামে রাস্তার অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে থাকে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব শ্রেণির মানুষের পছন্দ হলেও স্বাস্থ্যের জন্য নানা ঝুঁকি তৈরি করে এসব রাস্তার খাবার। চিকেন ফ্রাই, ফ্রেন্স ফ্রাই, নুডুলস, বার্গার, সিঙ্গারা, সমুচা, ফ্রাইড রাইসের মতো বিলাসবহুল খাবারও রাস্তার দোকানগুলোতে পাওয়া যায়। আর দৃষ্টিনন্দন এসব খাবারে আকৃষ্ট হয়ে খায় ভোক্তারাও। কোথায়, কীভাবে তৈরি হয় এসব খাবার, তার খোঁজ কেউ রাখে না। আবার অনেকে নিরুপায় হয়ে এসব খাবার খায়। রাস্তার পাশে ডিম ভাত এবং ডিম খিচুড়ি রিক্সা, ভ্যান চালকসহ নিম্নআয়ের মানুষের নিত্যদিনের একমাত্র অবলম্বন। রাস্তার পাশে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি করা হচ্ছে এসব খাবার। কোনো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা বা ভোক্তাদের স্বাস্থ্যের বিষয় উপেক্ষিত থেকে যায়।

রাস্তায় তৈরি ও পরিবেশিত খাবারকে স্ট্রিট ফুড বলে। সস্তা, সহজলভ্য, মুখরোচক খাবার হিসেবে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্ট্রিট ফুড বেশ জনপ্রিয়। উন্নত দেশের স্ট্রিট ফুড স্বাস্থ্যসম্মত, উপাদেয় ও আকর্ষণীয় হলেও আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে রাস্তায় যেসব খাবার তৈরি ও বিক্রি হয় তা বেশিরভাগই বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। স্ট্রিট ফুড অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রস্তুত ও পরিবেশিত হয় বলে তা বিভিন্ন জটিল ও মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে। খোলা আকাশের নিচে, উন্মুক্ত অবস্থায় তৈরি ও বিক্রি করা খাবার পোকামাকড় ও মাছি দ্বারা দূষিত হয়। বাতাসে ভাসমান ধুলা-ময়লাও এতে পড়ে। সাধারণত সস্তা, তৈলাক্ত ও ঝাল হওয়ার কারণে রাস্তার খাবারের বেশ কদর রয়েছে সব শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে। এ ধরনের খাবারে যেসব রোগে আক্রান্ত হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিসসহ বিভিন্ন রোগ। এছাড়া হৃদরোগ, কিডনির সমস্যা এবং বিকল হওয়াসহ ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগেও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে চিকিৎসকগণ মনে করেন। রাস্তায় তৈরি এসব খাবার খাওয়ার ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে শিঙ্গাড়া, সমুচা, বেগুনি, আলুর চপ, ডালপুরি, ফুচকা, চটপটি, বিভিন্ন ধরনের আচার, হালিম, ঝালমুড়ি, লেবুর শরবত, আইসক্রিম, আখের রস ইত্যাদি হরহামেশা বিক্রি হয়। শিশুদের কাছে এসব খাবার অত্যন্ত পছন্দের। রাস্তার খাবারের পুষ্টিগুণ থাকে অতি সামান্য এবং শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব থাকে বেশি। শিশুরা এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফুটপাতের খাবারে ক্ষতিকর রং মিশিয়ে আকর্ষণীয় করা হয়। সন্তানের আবদার মিটাতে অভিভাবকরাও এসব খাবার কিনে দেন। এসব খাবারের বেশিরভাগই বিএসটিআই কর্তৃক মান নির্ধারিত নয়। করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবার শিশুদের এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্তের হার অনেক কম। মা-বাবার উচিত সবসময় শিশুদের ঘরে তৈরি খাবার খাওয়ানো। শিশুদের সুন্দর ও সুস্বাস্থ্যের জন্য অস্বাস্থ্যকর খাবার অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে।

রাস্তার খাবার তৈরি হয় নিম্নমানের আটা, বেসন ও তেল দিয়ে। দিনের পর দিন একই তেল ব্যবহার করায় তা পুড়ে মানহীন হয়ে পড়ে। তাছাড়া ডুবো তেলে ভাজা খাবার এবং টেস্টিং সল্ট স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন কাপড়-চোপড়, ময়লা ও জীবাণুযুক্ত হাতে রাস্তায় খাবার তৈরি করা হয় বলে এসব খাবার ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। খাবার তৈরিতে প্রায়ই ব্যবহার করা হয় দূষিত পানি। যে পাত্রে খাবার পরিবেশিত হয়, সেগুলোতে প্রায়ই ক্ষতিকর জীবাণু থাকে। অপরিষ্কার অবস্থায় একই পাত্রে বিভিন্ন ব্যক্তিকে খাবার পরিবেশন করে খাওয়ানো হয়।

এখন ফলের মৌসুম। বিভিন্ন ধরনের ফলে বাজার, ফুটপাত ভরে আছে। ফল এখন সহজলভ্যও বটে। রাস্তায় তৈরি বিভিন্ন ফলের রসে থাকে অসংখ্য জীবাণু। যেসব যন্ত্রপাতি বা আনুষঙ্গিক সামগ্রী দিয়ে ফলের রস তৈরি করা হয় এবং যেসব পাত্রে তা পরিবেশিত হয়, সেগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করা হয় না। তবে এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো খাবার স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে তৈরি ও বিক্রি হয় ঠিকই, যার সংখ্যা অতি নগণ্য।

দেশে খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির চ্যালেঞ্জও বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের কারণে বাংলাদেশে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৫ হাজার ৭৭৬ জন মানুষ মারা গেছে। খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের প্রধান উৎস ডালডা বা নিম্নমানের তেল। এগুলো সাধারণত বেকারি পণ্য, প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য, স্ন্যাকস, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও খোলা জায়গায় খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

বর্তমান সরকার সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের পাশাপাশি জনগণের নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ভেজাল ও দূষণমুক্ত নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকরণে সরকার ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ প্রণয়ন করে ২০১৫ সালে ‘বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠা করেছ। প্রতিষ্ঠানটি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে এরইমধ্যে প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান প্রণয়নসহ জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি, ভেজাল ও দূষণ বিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে। দেশে ৪৮৬টি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ৬৪টি জেলা ও আটটি বিভাগীয় শহরে ৭৪টি নিরাপদ খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য আইন মেনে চলার জন্য নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তৎপর রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত দায়ী ব্যক্তিদের বিরদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করছে।

নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ তে খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদ- এবং ২০ লাখ টাকা অর্থদ-ের বিধান রয়েছে। তবে বর্তমানে খাদ্যে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান রাখার বিষয়ে অনেকেই সোচ্চার হয়েছেন।

বর্তমান সরকার ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়ন করছে এবং ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়নে এগিয়ে চলেছে। করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার উন্নত প্রজাতির বীজ ও সেচের সাথে সাথে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের ওপর ব্যাপক জোর দিয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের খাদ্যাভ্যাসে শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, মাংস ও দুধের পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে জোর দেয়া হচ্ছে। বিশ্বায়নের যুগে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, খাদ্যের বহুমুখিতা এবং নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নেই। তাই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের দিকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। নিরাপদ খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে জাপান বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে।

সুষম স্বাস্থ্যকর খাবার আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। পরিমিত শর্করা, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, বিশুদ্ধ পানি, আঁশশজাতীয় খাবার নিত্যদিনের খাবারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এছাড়া প্রতিদিনের খাদ্যে শাকসবজি-ফলমূল রাখতে হবে। শাকসবজি-ফলমূল হলো ভিটামিন, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, খনিজ পদার্থ এবং আঁশজাতীয় দ্রব্যের অফুরন্ত ভান্ডার। শাকসবজি-ফলমূল, আঁশযুক্ত খাবার শরীরের ওজন, হৃদরোগ, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কোলেস্টরেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিরাট ভূমিকা রাখে। তাই শিশুকাল থেকেই ছেলে-মেয়েদের শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়ানোর অভ্যাস করতে হবে পাশাপাশি বাইরের খাবার বর্জন করতে হবে।

সরকার দেশের নাগরিকের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতে সচেষ্ট রয়েছে। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। অনিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে। সরকারের পাশাপাশি অস্বাস্থ্যকর খাদ্য বর্জনে প্রত্যেকের ভূমিকা রাখতে হবে। বর্তমান করোনা পরিস্তিতিতে জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অনিরাপদ খাদ্য অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে। সবার আগে প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম নিবন্ধ)

back to top