সমীর কুমার সাহা
জাতিসংঘ কর্তৃক যে ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা গৃহীত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রদান করা।
প্রতি বছর ১২ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের তত্ত¦াবধানে সবার জন্য সমান ও টেকসই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা ও সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে সচেতনাতা সৃষ্টির জন্য ”সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস” পালন করা হয়। ২০১৭ সালের ১২ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১২ই ডিসেম্বরকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে।
এ বছর উক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ”কাউকে বাদ না রেখে সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করা”। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বলতে বোঝায় যে, সকল ব্যক্তি কোনো আর্থিক ভোগান্তি ছাড়াই মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা পাবে। তাই সবার জন্য শক্তিশালী স¦াস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশে^র অনেক দেশ মহামারী করোনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এই বছরের প্রতিপাদ্য বিষয়টি খুবই প্রাসংগিক ও তাৎপর্যপূর্ণ।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি এমনই একটি বিষয় যেটা নিশ্চিতকরণের দ¦ারা আমরা কাংক্ষিত বিশ^ লাভ করতে পারবো। এই ক্ষেত্রে শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়তে হলে ব্যাপক বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
বিশে^র শীর্ষ স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংগঠনসমূহ মনে করেন, মানুষকে সুরক্ষা করা, মারাতœক দারিদ্রের অবসান ঘটানো, জলবায়ু সংক্রান্ত বিরুপ প্রতিক্রিয়া মোকাবেলার সক্ষমতা অর্জন করা এবং মারাতœক মহামারী অবসান ঘটানো প্রভৃতি বিষয়ের সাথে সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার বিষয়টি সম্পর্কিত, কারণ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার মাধ্যমে উক্ত বিষয়গুলো অর্জন করা সম্ভব। ২০৩০ সালের মধ্যে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সকলের সম্মিলিত প্রয়াস দরকার।
স্বাস্থ্য অধিকার হচ্ছে মানবাধিকার। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার মাধ্যমে সকলের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির পথ সুগম হয়। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা’র সংবিধানে উল্লেখ আছে, সর্বোচ্চ মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি হচ্ছে মানবাধিকার। বিশে^র অধিকাংশ দেশ তাদের জাতীয় সংবিধানে স্বাস্থ্যসেবার অধিকার এর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংবিধানের ১৫ ধারার (ক) অনুচ্ছেদে এবং ১৮ ধারার (১) অনুচ্ছেদে স্বাস্থ্যসেবা ও জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রের প্রতি তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার অর্থ হলো উন্নত স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন অর্জন করা, কেউ যাতে অসুস্থ্যতাজনিত কারণে দারিদ্রের কবলে না পড়ে সেটা প্রতিরোধ করা, এবং মানুষকে স্বাস্থ্যবান ও অধিকতর উৎপাদনশীল জীবন-যাপনে সহায়তা করা। বলা হয়ে থাকে যে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বিনিয়োগ করা হলে ব্যাপক সুবিধা অর্জিত হয়। সহজে প্রাপ্তিসাধ্য ও মানসম্মত চিকিৎিসা সেবার অভাবে পরিবার ও জাতি দারিদ্রের কবলে পড়ে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষ্য হলো জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আলোকে উন্নত স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা। উক্ত লক্ষ্যমাত্রার (৩ নং পয়েন্টে) সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য আর্থিক ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা, মানসম্মত, কার্যকরী ও সহজে পাওয়া যায় এমন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। যে সমস্ত দেশসমূহ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তার দিয়েছে, তারা এর উপকারিতা লক্ষ্য করেছে। তারা অধিকতর স্বাস্থ্যবান সম্প্রদায় ও অধিকতর শক্তিশালী অর্থনীতি অর্জন করেছে।
স্বাস্থ্যখাতে সাফল্য অর্জন সত্ত্বেও আমরা এখনও সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারিনি। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ সুরক্ষার বাইরে রয়েছে এখনও।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে বিশ^জুড়ে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের মধ্যে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ স্বাস্থ্য সেবার ব্যয় মিটাতে গিয়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে এবং তারা দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ৪ কোটি ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থান করছে এবং প্রতিবছর অসুস্থ্যতার কারণে ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশে জনপ্রতি স্বাস্থ্যসেবার জন্য সরকারীভাবে ৩৭ ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে, কিন্তু প্রয়োজন ৮৫ থেকে ১১২ ডলার। অথচ পাশর্^বর্তী দেশগুলোয় এটি অনেক বেশী। এই বিষয়ে সরকারকে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে, অন্যথায় সব মানুষকে স্বাস্থ্য সুরক্ষ্রা আওতায় সম্ভব হবে না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট এর এক গবেষনায় জানা যায় যে, সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে বাংলাদেশের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে উচ্চ মাত্রায় ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয়। ব্যক্তির সিংহভাগ টাকা চলে যায় ওষুধের পিছনে। অর্থাৎ বছরে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে মোট ১০০ টাকা খরচ করলে তার মধ্যে ৬৪ টাকা চলে যায় ওষুধ কিনতে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারণায় ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে চিকিৎসা পেতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় এর ৬৭ শতাংশই রোগীকে বহন করতে হচ্ছে।
দেশের ৮৬% মানুষ চিকিৎসা নেয় বেসরকারী খাত হতে। এখানে চিকিৎসা খরচ অনেক বেশী এবং এই খাতে সরকারের প্রায় কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আরো দু:খজনক বিষয় হচ্ছে, সেবার মান বাড়ার পরেও দেশের সরকারী হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা ৯৩% রোগী কোনো ওষুধ পায় না।
সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। সেজন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রনয়ণ করা দরকার। স্বাস্থ্যেখাতের কয়েকটি ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন সত্ত্বেও করোনা মহামারীর কারণে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দুর্বলতা ফুটে উঠেছে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে ব্যক্তিকে তার প্রয়োজনের সময় মান সম্পন্ন চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এটা বাস্তবায়ন করতে হলে কেবলমাত্র সুযোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদেরকেই স্বাস্থ্য খাতে নিয়োগ দিতে হবে। রোগীর নিজ পকেটের ব্যয় হ্রাস ও রোগীকে আর্থিক বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, সরকারী হাসপাতালে সেবার মান বৃদ্ধি, ওষধের যৌক্তিক ব্যবহার বৃদ্ধি, জনবল বৃদ্ধি, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা হালনাগাদকরণ, বেসরকারী হাসপাতাল-ক্লিনিকে নজরদারী বাড়ানো দরকার বলে গবেষকগণ সুপারিশ করেন।
সন্তোষজনক সার্বিক মেডিক্যাল ম্যানেজমেন্ট এবং সরকারী স্বাস্থ্য বিভাগের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি। বর্তমান সরকারের আমলে চিকিৎসা সেবায় আধুনিক অবকাঠামো হয়েছে অনেক, কিন্তু এটাকে ধরে রাখার মতো দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। যার ফলে রোগীরা সুচিকিৎসা থেকে এবং মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে সঠিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে।
দক্ষ জনবল না থাকলে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য কাউকে পাওয়া যাবেনা। চালু করার পরও দক্ষ জনবলের অভাবে কোটি কোটি টাকার মূল্যবান এইসব যন্ত্রপাতি হাসপাতালে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে থাকে।
রাজধানী থেকে উপজেলা পর্যন্ত চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম নিয়মিত মনিটর করার কমিটি রয়েছে, কিন্তু এই কমিটি অনেকটাই নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া হাসপাতালগুলোতে আছে এক শ্রেণীর চিকিৎসকদের দলাদলি। স্ব স্ব সংসদীয় আসনের এমপিদের নেতৃত্বে স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন কমিটি আছে। কিছু কমিটি দায়িত্ব পালন করলেও অন্যরা সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেনা।
লন্ডন-ভিত্তিক মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেট এর এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাস্তবায়নের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বাজেট বরাদ্দ নেই। এই উদ্যোগে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতের অদক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী। স্বাস্থ্য জনবলের (চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান) ৯৪ শতাংশই অদক্ষ। স্বাস্থ্যকর্মীদের গ্রামাঞ্চলে কর্মক্ষেত্রে ধরে রাখা কঠিন।
ঐতিহ্যগত চিকিৎিসা পদ্ধতি (আয়ুর্বেদ, ইউনানী ও হোমিওপ্যাথি ) সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে। আশেপাশের উন্নয়নশীল দেশসমুহের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ তাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার জন্য এই ভেষজ ভিত্তিক ঐতিহ্যগত চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল।
ঐতিহ্যগত এই চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহারের একটি সুবিধা হলো এই যে, ব্যয়বহুল বিদেশী ঔষধ আমদানীর ওপর আমরা নির্ভরশীলতা কমিয়ে ফেলতে পারি, তার পরিবর্তে আমরা স্থানীয় সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেরাই কম খরচের ঔষধ তৈরী করতে পারি। এই পদ্ধতির মাধ্যমে যে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব সে বিষয়ে তা এখন পরীক্ষিত সত্য।
দেশের অনেকেই বিপুল অর্থ ব্যয় করে বিদেশে যান চিকিৎসার জন্য। দেশে স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা এটা প্রতিরোধ করতে পারি।
আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণ গরীব। তাই তাদের পক্ষে বিপুল অর্থ ব্যায় করে চিকিৎসা কাজ চালানো দুরূহ ব্যাপার। অথচ হাজার বছরের ঐতিহ্যগত চিকিৎসা পদ্ধতিতে অল্প খরচেই একজন মানুষ চিকিৎসা সুবিধা গ্রহন করতে পারে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের ইতিবাঁচক দৃষ্টিভংগী প্রয়োজন।
দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো এখন সময়ের দাবী। জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে দেশের প্রথিতযশা জনস্বাস্থ্যবিদদের অংশগ্রহন, সংযুক্তকরন, মতামত-পরামর্শ ইতিবাচক ভুমিকা রাখতে পারে। সর্বোপরি স্বাস্থ্য সেক্টরে দুর্নীতি প্রতিরোধ, যথাস্থানে যথা ব্যাক্তির পদায়নসহ নিয়মিত মনিটরিং সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করনে সহায়ক হবে বলে বিশ্বাস।
[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, পাবলিক হেল্থ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ]
সমীর কুমার সাহা
রোববার, ১২ ডিসেম্বর ২০২১
জাতিসংঘ কর্তৃক যে ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা গৃহীত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রদান করা।
প্রতি বছর ১২ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের তত্ত¦াবধানে সবার জন্য সমান ও টেকসই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা ও সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে সচেতনাতা সৃষ্টির জন্য ”সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস” পালন করা হয়। ২০১৭ সালের ১২ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১২ই ডিসেম্বরকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে।
এ বছর উক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ”কাউকে বাদ না রেখে সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করা”। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বলতে বোঝায় যে, সকল ব্যক্তি কোনো আর্থিক ভোগান্তি ছাড়াই মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা পাবে। তাই সবার জন্য শক্তিশালী স¦াস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশে^র অনেক দেশ মহামারী করোনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এই বছরের প্রতিপাদ্য বিষয়টি খুবই প্রাসংগিক ও তাৎপর্যপূর্ণ।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি এমনই একটি বিষয় যেটা নিশ্চিতকরণের দ¦ারা আমরা কাংক্ষিত বিশ^ লাভ করতে পারবো। এই ক্ষেত্রে শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়তে হলে ব্যাপক বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
বিশে^র শীর্ষ স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংগঠনসমূহ মনে করেন, মানুষকে সুরক্ষা করা, মারাতœক দারিদ্রের অবসান ঘটানো, জলবায়ু সংক্রান্ত বিরুপ প্রতিক্রিয়া মোকাবেলার সক্ষমতা অর্জন করা এবং মারাতœক মহামারী অবসান ঘটানো প্রভৃতি বিষয়ের সাথে সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার বিষয়টি সম্পর্কিত, কারণ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার মাধ্যমে উক্ত বিষয়গুলো অর্জন করা সম্ভব। ২০৩০ সালের মধ্যে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সকলের সম্মিলিত প্রয়াস দরকার।
স্বাস্থ্য অধিকার হচ্ছে মানবাধিকার। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার মাধ্যমে সকলের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির পথ সুগম হয়। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা’র সংবিধানে উল্লেখ আছে, সর্বোচ্চ মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি হচ্ছে মানবাধিকার। বিশে^র অধিকাংশ দেশ তাদের জাতীয় সংবিধানে স্বাস্থ্যসেবার অধিকার এর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংবিধানের ১৫ ধারার (ক) অনুচ্ছেদে এবং ১৮ ধারার (১) অনুচ্ছেদে স্বাস্থ্যসেবা ও জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রের প্রতি তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার অর্থ হলো উন্নত স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন অর্জন করা, কেউ যাতে অসুস্থ্যতাজনিত কারণে দারিদ্রের কবলে না পড়ে সেটা প্রতিরোধ করা, এবং মানুষকে স্বাস্থ্যবান ও অধিকতর উৎপাদনশীল জীবন-যাপনে সহায়তা করা। বলা হয়ে থাকে যে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বিনিয়োগ করা হলে ব্যাপক সুবিধা অর্জিত হয়। সহজে প্রাপ্তিসাধ্য ও মানসম্মত চিকিৎিসা সেবার অভাবে পরিবার ও জাতি দারিদ্রের কবলে পড়ে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষ্য হলো জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আলোকে উন্নত স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা। উক্ত লক্ষ্যমাত্রার (৩ নং পয়েন্টে) সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য আর্থিক ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা, মানসম্মত, কার্যকরী ও সহজে পাওয়া যায় এমন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। যে সমস্ত দেশসমূহ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তার দিয়েছে, তারা এর উপকারিতা লক্ষ্য করেছে। তারা অধিকতর স্বাস্থ্যবান সম্প্রদায় ও অধিকতর শক্তিশালী অর্থনীতি অর্জন করেছে।
স্বাস্থ্যখাতে সাফল্য অর্জন সত্ত্বেও আমরা এখনও সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারিনি। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ সুরক্ষার বাইরে রয়েছে এখনও।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে বিশ^জুড়ে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের মধ্যে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ স্বাস্থ্য সেবার ব্যয় মিটাতে গিয়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে এবং তারা দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ৪ কোটি ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থান করছে এবং প্রতিবছর অসুস্থ্যতার কারণে ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশে জনপ্রতি স্বাস্থ্যসেবার জন্য সরকারীভাবে ৩৭ ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে, কিন্তু প্রয়োজন ৮৫ থেকে ১১২ ডলার। অথচ পাশর্^বর্তী দেশগুলোয় এটি অনেক বেশী। এই বিষয়ে সরকারকে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে, অন্যথায় সব মানুষকে স্বাস্থ্য সুরক্ষ্রা আওতায় সম্ভব হবে না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট এর এক গবেষনায় জানা যায় যে, সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে বাংলাদেশের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে উচ্চ মাত্রায় ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয়। ব্যক্তির সিংহভাগ টাকা চলে যায় ওষুধের পিছনে। অর্থাৎ বছরে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে মোট ১০০ টাকা খরচ করলে তার মধ্যে ৬৪ টাকা চলে যায় ওষুধ কিনতে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারণায় ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে চিকিৎসা পেতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় এর ৬৭ শতাংশই রোগীকে বহন করতে হচ্ছে।
দেশের ৮৬% মানুষ চিকিৎসা নেয় বেসরকারী খাত হতে। এখানে চিকিৎসা খরচ অনেক বেশী এবং এই খাতে সরকারের প্রায় কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আরো দু:খজনক বিষয় হচ্ছে, সেবার মান বাড়ার পরেও দেশের সরকারী হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা ৯৩% রোগী কোনো ওষুধ পায় না।
সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। সেজন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রনয়ণ করা দরকার। স্বাস্থ্যেখাতের কয়েকটি ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন সত্ত্বেও করোনা মহামারীর কারণে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দুর্বলতা ফুটে উঠেছে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে ব্যক্তিকে তার প্রয়োজনের সময় মান সম্পন্ন চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এটা বাস্তবায়ন করতে হলে কেবলমাত্র সুযোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদেরকেই স্বাস্থ্য খাতে নিয়োগ দিতে হবে। রোগীর নিজ পকেটের ব্যয় হ্রাস ও রোগীকে আর্থিক বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, সরকারী হাসপাতালে সেবার মান বৃদ্ধি, ওষধের যৌক্তিক ব্যবহার বৃদ্ধি, জনবল বৃদ্ধি, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা হালনাগাদকরণ, বেসরকারী হাসপাতাল-ক্লিনিকে নজরদারী বাড়ানো দরকার বলে গবেষকগণ সুপারিশ করেন।
সন্তোষজনক সার্বিক মেডিক্যাল ম্যানেজমেন্ট এবং সরকারী স্বাস্থ্য বিভাগের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি। বর্তমান সরকারের আমলে চিকিৎসা সেবায় আধুনিক অবকাঠামো হয়েছে অনেক, কিন্তু এটাকে ধরে রাখার মতো দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। যার ফলে রোগীরা সুচিকিৎসা থেকে এবং মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে সঠিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে।
দক্ষ জনবল না থাকলে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য কাউকে পাওয়া যাবেনা। চালু করার পরও দক্ষ জনবলের অভাবে কোটি কোটি টাকার মূল্যবান এইসব যন্ত্রপাতি হাসপাতালে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে থাকে।
রাজধানী থেকে উপজেলা পর্যন্ত চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম নিয়মিত মনিটর করার কমিটি রয়েছে, কিন্তু এই কমিটি অনেকটাই নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া হাসপাতালগুলোতে আছে এক শ্রেণীর চিকিৎসকদের দলাদলি। স্ব স্ব সংসদীয় আসনের এমপিদের নেতৃত্বে স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন কমিটি আছে। কিছু কমিটি দায়িত্ব পালন করলেও অন্যরা সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেনা।
লন্ডন-ভিত্তিক মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেট এর এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাস্তবায়নের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বাজেট বরাদ্দ নেই। এই উদ্যোগে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতের অদক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী। স্বাস্থ্য জনবলের (চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান) ৯৪ শতাংশই অদক্ষ। স্বাস্থ্যকর্মীদের গ্রামাঞ্চলে কর্মক্ষেত্রে ধরে রাখা কঠিন।
ঐতিহ্যগত চিকিৎিসা পদ্ধতি (আয়ুর্বেদ, ইউনানী ও হোমিওপ্যাথি ) সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে। আশেপাশের উন্নয়নশীল দেশসমুহের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ তাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার জন্য এই ভেষজ ভিত্তিক ঐতিহ্যগত চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল।
ঐতিহ্যগত এই চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহারের একটি সুবিধা হলো এই যে, ব্যয়বহুল বিদেশী ঔষধ আমদানীর ওপর আমরা নির্ভরশীলতা কমিয়ে ফেলতে পারি, তার পরিবর্তে আমরা স্থানীয় সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেরাই কম খরচের ঔষধ তৈরী করতে পারি। এই পদ্ধতির মাধ্যমে যে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব সে বিষয়ে তা এখন পরীক্ষিত সত্য।
দেশের অনেকেই বিপুল অর্থ ব্যয় করে বিদেশে যান চিকিৎসার জন্য। দেশে স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা এটা প্রতিরোধ করতে পারি।
আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণ গরীব। তাই তাদের পক্ষে বিপুল অর্থ ব্যায় করে চিকিৎসা কাজ চালানো দুরূহ ব্যাপার। অথচ হাজার বছরের ঐতিহ্যগত চিকিৎসা পদ্ধতিতে অল্প খরচেই একজন মানুষ চিকিৎসা সুবিধা গ্রহন করতে পারে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের ইতিবাঁচক দৃষ্টিভংগী প্রয়োজন।
দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো এখন সময়ের দাবী। জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে দেশের প্রথিতযশা জনস্বাস্থ্যবিদদের অংশগ্রহন, সংযুক্তকরন, মতামত-পরামর্শ ইতিবাচক ভুমিকা রাখতে পারে। সর্বোপরি স্বাস্থ্য সেক্টরে দুর্নীতি প্রতিরোধ, যথাস্থানে যথা ব্যাক্তির পদায়নসহ নিয়মিত মনিটরিং সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করনে সহায়ক হবে বলে বিশ্বাস।
[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, পাবলিক হেল্থ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ]