alt

মুক্ত আলোচনা

স্মরণ: আজন্ম বিপ্লবী জ্যোৎস্না নিয়োগী

মঞ্জুশ্রী নিয়োগী দাশগুপ্তা

: বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২২

উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত সাহিত্যিক সত্যেন সেন জ্যোৎস্না নিয়োগীর কর্মময় জীবন প্রত্যক্ষ করে ‘আশ্চর্য মেয়ে’ শিরোনামে একটি কাহিনী লিখে সংবাদ পত্রিকায় ছাপিয়েছিলেন। সত্যেন সেনের ‘আশ্চর্য মেয়ে’ জ্যোৎস্না নিয়োগী ১৯২৫ সালে বিক্রমপুর জেলার নয়না গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা প্রয়াত যোগেশ চন্দ্র মজুমদার জাতীয়তা বাদী কংগ্রেসী ডাক্তার ছিলেন। তার মাতার নাম অমিয়া মজুমদার।

জ্যোৎস্নার জীবনে ১২ বছর বয়সে চরম বিপর্যয় ঘটে যায়। কালব্যাধী বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে এক মাসের মধ্যে বাবা-মা, ঠাকুমা ও দুই বোনকে হারিয়ে দিশে হারা হয়ে পড়েন কিন্তু তিনি মনোবল হারান না। শৈশব কালে মা-বাবাকে হারিয়ে এক বছর বয়সী ছোট বোনের হাত ধরে জ্যোৎস্নাকে জীবন সংগ্রামে নামতে হয়েছিল এবং এভাবে স্বজন হারানোর বেদনা দুঃখের মধ্যে তিনি বেড়ে ওঠেন। আত্মীয় স্বজনের সহায়তায় জ্যোৎস্না কলকাতায় গুরুসদয় দত্ত প্রতিষ্ঠিত সরোজনলিনী স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে অধ্যয়নের মধ্যেই তিনি জীবনকে গড়ে তোলার সাংস্কৃতিক উপাদান পেয়ে যান। পারিবারিক ঐতিহ্যসূত্রে পাওয়া দেশপ্রেমের বীজমন্ত্র তাঁর মনে অংকুরিত হয় এই পাঠশালার শিক্ষার মধ্য দিয়েই। শৈশবের সেই দেশ প্রেমের মন্ত্র যৌবনে কমিউনিষ্ট স্বামী রবি নিয়োগী ও দেবর মনীন্দ্র চন্দ্র নিয়োগীর সহায়তায় আরো মূর্ত হয়ে ওঠে। মার্কসীয় দর্শন তাঁর জীবন চেতনায় পূর্ণতা আনে। সমাজে অবহেলিত নিরন্ন অসহায় মানুষের মধ্যে তিনি মানবতার পূর্ণরূপ দেখতে পান। মার্কসীয় দর্শনই তাঁকে করে তোলে সংস্কারমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, তাঁর মন থেকে হতাশা নৈরাজ্য দূর হয়ে তিনি হয়ে ওঠেন মানবকল্যাণময়ী একজন নারী।

স্কুলে পড়া শেষ হবার পর ১৯৪১ সালে প্রয়াত আন্দামান জেল ফেরত কমিউনিষ্ট নেতা রবি নিয়োগীর সাথে জ্যোৎস্না বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের এক মাসের মধ্যে রবি নিয়োগী নিরাপত্তা আইনে বন্দী হন। এমন অবস্থায় শ্বাশুরী সুরবালা নিয়োগীর অনুমতি ক্রমে জ্যোৎস্না নিজেকে স্বামীর রাজনৈতিক আদর্শে গড়ে তোলার জন্য সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে মার্কসবাদ, লেলিনবাদ অধ্যয়ন করা শুরু করেন এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডেও অংশ নিতে শুরু করেন। ১৯৪২ সনে জ্যোৎস্না নিয়োগী কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। সে সময় মার্কসবাদে শিক্ষিত না হলে এবং সক্রিয় ভাবে পার্টির কাজে আত্মনিয়োগ না করলে পার্টির সদস্য পদ লাভ করা সম্ভব ছিল না।

১৯৪২ সনে নিখিল বঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির শাখা পূর্ব বাংলায় গঠিত হয়। নাম রাখা হয় “মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি”। এই সংগঠনটি গড়ে তোলার কাজে জ্যোৎস্না নিয়োগী আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালান। তাঁর সাথে ছিলেন মনোরমা বসু, যুঁইফুল রায়, নির্মলা স্যান্যাল, মজিরুন্নেছা প্রমুখ নেত্রীরা। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির ময়মনসিংহ (বৃহত্তর) জেলা সম্মেলনে জ্যোৎস্না নিয়োগী সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত হন এবং এই দায়িত্বপালনে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য কলকাতা যান।

জ্যোৎস্না নিয়োগী বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি সংগঠিত করে বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে থাকেন। সারা পূর্ব বাংলায় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি মহিলা সমাজকে আন্দোলনে সংগঠিত করার পাশাপাশি মেয়েদের কর্মসংস্থানের জন্য কুটির শিল্প প্রকল্প, শিক্ষা বিস্তারের জন্য নিরক্ষরতা দূরিকরণ কেন্দ্র স্থাপন এবং অন্যান্য সেবা মূলক কাজ করেছিল। জ্যোৎস্না নিয়োগী নিজে উদ্যোগী হয়ে শেরপুরে একটি তাঁত কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে অনেক দুস্থ মেয়ের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নিরক্ষতা দূরীকরণ অভিযানও সংগঠিত করেছিলেন।

পঞ্চাশের মন্বন্তরে শেরপুর অঞ্চলে লঙ্গরখানা পরিচালনা, রিলিফ বন্টন ও মহামারী প্রতিরোধে সক্রিয় অংশ নিয়ে ছিলেন জ্যোৎস্না নিয়োগী।

১৯৪৩ সালে প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন এবং ১৯৪৫ সালে অনুষ্ঠিত নেত্রকোনায় সারা ভারত কৃষক সম্মেলনে কৃষক মহিলাদের সংগঠিত করে সম্মেলন স্থলে উপস্থিত করার দায়িত্বে ছিলেন জ্যোৎস্না নিয়োগী। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে ঐ সম্মেলন দুটিতে কৃষক মহিলাদের অংশগ্রহণ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে। সম্মেলন দুটিতে কৃষক মহিলাদের উপস্থিতি দেখে এবং জ্যোৎস্না নিয়োগীর কর্মদক্ষতায় উচ্ছ্বসিত হয়ে কমিউনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি. সি যোশী মন্তব্য করেছিলেন “She is a born Revolutionary”

১৯৪২ সালে শেরপুর পরগনা জুড়ে জমিদার তালুকদারদের সৃষ্ট ঘৃণ্য নানকার প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি ক্ষত্রিয় মহিলাদের মধ্যে আন্দোলনের বীজ বপন করতে সক্ষম হয়। ফলে ক্ষত্রিয় নারী পুরুষের যৌথ আন্দোলনে নানকার প্রথার অবসান ঘটে।

একই সময়ে শেরপুর পরগনার উত্তরাঞ্চলের ব্যাপক এলাকা জুড়ে বিশেষভাবে রাজবংশী প্রজাদের মধ্যে ভাওয়ালী প্রথা নামে একটি শোষণ ব্যবস্থা চালু ছিল। এই আন্দোলন চলাকালে জ্যোৎস্না নিয়োগীর নেতৃত্বে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির কর্মীরা রাজবংশী অধ্যুষিত এলাকার গ্রামে গ্রামে গিয়ে রাজবংশী কৃষক মহিলাদের সচেতন ও সংগঠিত করার চেষ্টা চালায়। ভাওয়ালী প্রথা অবসানের তীব্র আন্দোলনের মুখে এই প্রথার অবসান ঘটে।

১৯৪৬ সনে তেভাগা আন্দোলন শুরু হয় শেরপুর, নালিতাবাড়ী, হালুয়াঘাট, শ্রীবরর্দী প্রভৃতি এলাকায় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর প্রচন্ড দমননীতি চলতে থাকে। সর্ব্বেশ্বর ডালু পুলিশের গুলিতে নিহত হন। কৃষক আন্দোলনে সর্বপ্রথম রাশমনি নামে একজন কৃষক মহিলা পুলিশের সাথে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে শহীদ হন। শত শত নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়, অনেক নেতাকর্মী আত্মগোপনে থেকে আন্দোলনের কাজ চালাতে থাকেন। পুলিশের দমন অভিযান চলাকালে আন্দোলনকে চাঙ্গা রাখার জন্য কমিউনিষ্ট পার্টির নির্দেশে বিপদের ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে জ্যোৎস্না নিয়োগী, কণা বকসি, পূর্ণিমা বকসিকে সাথে নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পায়ে হেটে কাজ চালাতে থাকেন। তাদের কার্যকলাপের খবর পেয়ে তৎকালীন বৃটিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাদের গ্রেপ্তার করার প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সনে কমলাকান্দা, সুসং দুর্গাপুর, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী ও শেরপুরের বির্স্তীর্ণ এলাকাজুড়ে টঙ্ক চাষিরা টঙ্ক প্রথা উচ্ছেদের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনকারীরা পাকিস্তান ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে এই প্রচারণা চালিয়ে পাকিস্তানী পুলিশ বাহিনী আন্দোলনকারীদের উপর অকথ্য নির্যাতন শুরু করে। এই নির্যাতন প্রতিহত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়। রেবতী, শঙ্খমনি, সারথী নামে কয়েকজন মহিলা ও কমিউনিষ্ট নোতা শচী রায় মৃত্যুবরণ করেন। পাকিস্তানী সরকারের দমন পীড়নে টিকতে না পেরে সীমান্ত বর্তী হাজার হাজার কৃষক পরিবার জমি জামা ঘরবাড়ি ছেড়ে সীমান্তের অপর পাড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। সীমান্ত এলাকায় যখন পুলিশ বাহিনীর তান্ডবলীলা চলছিল তখন জ্যোৎস্না নিয়োগী অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে নিয়ে অসীম সাহসের সাথে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। আত্মগোপন অবস্থায় একদিন ননদের বর হারু চক্রবর্তীর সাথে ভোররাতে যখন শেরপুর ফিরছিলেন তখন পুলিশের হাতে তাঁরা দুজনেই গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে ১৯৫৩ সালের মাঝামাঝি প্রায় ছয় বছর পর্যন্ত তাঁকে নিরাপত্তা আইনে কারাভোগ করতে হয়। এসময় রবি নিয়োগীও জেলে ছিলেন।

১৯৫৪ সনে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের কিছুদিন পরই প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণী তাদের পরাজয়ের গ্লানির প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ৯২(ক) ধারা জারি করে এবং প্রগতিশীল শক্তিকে খতম করার লক্ষ্যে বহু সংখ্যক নেতা কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। এই সময় জ্যোৎস্না নিয়োগীকে ০৮ মাসের শিশুপুত্র কাজল নিয়োগীকে নিয়ে আবার জেলে যেতে হয়। জ্যোৎস্না নিয়োগীকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ নিয়োগী বাড়ির গরু বাছুর, আসবাবপত্রসহ বাড়ির সব জিনিস সীজ করে নেয়। স্বামী পলাতক, বাড়িতে অপরিণত বষস্ক দুই ছেলে এক মেয়েকে রেখে তিনি জেলে যান। এই সময় তাকে দুই বছর জেলে থাকতে হয়। জেলে থাকা অবস্থাতেও জ্যোৎস্না নিয়োগী সাধারণ বন্দীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অনশন করে আন্দোলন করেছেন।

রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও সম্পৃক্ত ছিলেন। জ্যোৎস্না নিয়োগী শেরপুরে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। জ্যোৎস্না নিয়োগী আড়াই আনী জমিদার বাড়ির তৎকালীন রিসিভার ক্ষিতিধর রায়ের কন্যাদের গৃহ শিক্ষিকা ছিলেন। সেই সুবাদে ক্ষিতিধর রায়ের নিকট থেকে চকবাজার শহীদ মিনার নির্মাণের জায়গা চেয়ে নেন এবং অতি সংগোপনে তারাহুড়া করে একটি শহীদ মিনার তৈরী করেন। বিশ্বনাথ চৌহান নামে একজন রাজমিস্ত্রি (কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য) ও ১২ বছর বয়স্ক বড় ছেলে প্রয়াত রণজিত নিয়োগীকে সর্বপ্রথম শহীদ মিনার নির্মানের কাজে লাগান। শহীদ মিনার তৈরী করার জন্য শেরপুরে একটি কমিটি হয়। সেই কমিটিতে তার মেয়ে মঞ্জুশ্রীকেও যুক্ত করেন। ১৯৫৪ সনের ২১ শে ফেব্রুয়ারী এই শহীদ মিনারে প্রথম পুষ্প স্তবক অর্পণ করা হয়। ২০ শে ফেব্রুয়ারী রাতের আধারে পুলিশের চোখ ফাকি দিয়ে জ্যোৎস্না নিয়োগী চালের গুড়া গুলে শহীদ মিনারের চার প্রান্তে আলপনা এঁকেছিলেন। এই দেশের শহীদ মিনারে আল্পনা আঁকার প্রচলন জ্যোৎস্না নিয়োগীই প্রথম প্রবর্তন করেছেন বলে মনে হয়।

জ্যোৎস্না নিয়োগীর অনুপ্রেরণা ও উৎসাহে শেরপুরে সাংস্কৃতিক অঙ্গণ গতিশীল ছিল। ছোট মেয়েদের যোগাড় করে ‘আমরা কজনা’ নাম দিয়ে তিনি একটি নাট্যদল গঠন করেন। ৫৭ সনে শেরপুরের বিশিষ্ট নাট্যপরিচালক প্রয়াত মোহিনী মোহন বল-এর পরিচালনায় এ নাট্যদল রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ শরৎচন্দ্রের ‘নিস্কৃতি’ নাটক মঞ্চস্থ কওে ভূয়ষী প্রসংশা অর্জন করে। এ সময় সংস্কৃতি সংসদ নামে একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠে। এ সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জ্যোৎস্না নিয়োগী।

শেরপুরে একটি সুষ্ঠু ধারার সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ পার্টির সদস্য প্রয়াত ইমদাদুল হক ও প্রয়াত আবুল কাশেমকে সামনে রেখে ১৯৬৮ সালে গড়ে তোলা হয় গণ সংস্কৃতি সংসদ নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠনটি গড়ে তোলার পেছনে জ্যোৎস্না নিয়োগীর অবদান ছিল অপরিসীম।

১৯৬৮ সনে শেরপুরে কিশোর সংগঠন পাতাবাহার খেলাঘর আসর জ্যোৎস্না নিয়োগীর পৃষ্ঠপোষকতায় তার নিজের বাসগৃহে গড়ে উঠেছিল।

শেরপুরে উদীচী সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারেও জ্যোৎস্না নিয়োগীর অবদান ভুলবার নয়। নিয়োগী বাড়ী থেকেই উদিচীর কার্যকলাপ পরিচালিত হতো জ্যোৎস্না নিয়োগীর বড় পুত্র প্রয়াত রণজিত নিয়োগীর মাধ্যমে। অনেক দিন পর্যন্ত উদিচীর নাটক, গান, কবিতার মহড়া, নিয়োগী বাড়ীতেই সংগঠিত হয়েছে। এককথায় শেরপুর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধাব্যাক্তিত্ব ছিলেন জ্যোৎস্না নিয়োগী।

নিরন্ন অসহায় পরিবারের শিশুদের আশ্রয়স্থল ছিলো নিয়োগী বাড়ি। এ খানে শিশুদের মুখে আহার তুলে দিয়ে জ্যোৎস্না নিয়োগী প্রতিদিন তাদের লেখাপড়া শেখাতেন। তাই তিনি নিরন্ন শিশুদের দিদিমণি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

১৯৭১ সালে ভারত বর্ষের মেঘালয় রাজ্যের বারেঙ্গাঁ পাড়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে প্রচারণা চালান জ্যোৎস্না নিয়োগী। সীমান্ত এলাকায় শরনার্থী শিবিরের শরনার্থীদের মনোবল চাঙ্গা রাখার কাজও তিনি করেছেন। জ্যোৎস্না নিয়োগী ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলো।

দেশ স্বাধীন হবার পর দেশে ফিরে জ্যোৎস্না নিয়োগী দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ৭১ সনে পাক বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনী নিয়োগী বাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করলেও নিয়োগী দ¤পতির মনোবল ভাঙতে পারেনি। দেশে ফিরে তারা প্রতিবেশী বাড়িতে আশ্রয় নেন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত শেরপুরকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার ব্যাপারে আÍনিয়োগ করেছিলেন।

১৯৭২ সালে জ্যোৎস্না নিয়োগী শেরপুরে মহিলা পরিষদ এর শাখা গড়ে তোলেন। তাঁর সুশৃঙ্খল নেত্রীত্বে শেরপুর মহিলা পরিষদ একটি শক্তিশালী সংগঠনে রূপান্তরিত হয়। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জ্যোৎস্না নিয়োগী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিরলস কাজ করে গেছেন।

জ্যোৎস্না নিয়োগীর স্বামী রবি নিয়োগী ৩৪ বছর কারাগারে ও অন্তরীণ অবস্থায় কাটিয়েছেন। ঘর সংসার প্রতিপালন সন্তানদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও কমিউনিষ্ট পার্টি সংগঠিত করার কাজ সবই জ্যোৎস্না নিয়োগী নিষ্ঠার সাথে সম্পাদন করেছেন। সমাজতন্ত্রের আদর্শে নিবেদিত সংগ্রামী নেত্রী জ্যোৎস্না নিয়োগী বিশ্বাস করতেন রাজনৈতিক সচেতনতা ও আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা থাকলে এমন কোন কঠিন কাজ নেই যা করা যায় না। জ্যোৎস্না নিয়োগী তার কাজের মধ্যে দিয়ে এই বিশ্বাস প্রমাণ করেছেন।

১৯৯০ সালে ২৭ জানুয়ারি ৬৫ বছর বয়সে পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত হয়ে জ্যোৎস্না নিয়োগী মৃত্যুবরণ করেন। সেসময় বাংলাদেশে এ রোগের সুচিকিৎসা না থাকায় প্রায় চিকিৎসাহীন অবস্থাতে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। এ ব্যাপারটিও কম দুঃখের নয়।

এই মহীয়সী রমণীর সংগ্রামমুখর জীবনের কথা বর্তমান প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাঁর প্রতি সম্মান জানানো আমাদের দায়িত্ব।

[লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলা বেতার শব্দসৈনিক এবং বিপ্লবী জ্যোৎস্না নিয়োগীর কন্যা।

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

স্মরণ: আজন্ম বিপ্লবী জ্যোৎস্না নিয়োগী

মঞ্জুশ্রী নিয়োগী দাশগুপ্তা

বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২২

উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত সাহিত্যিক সত্যেন সেন জ্যোৎস্না নিয়োগীর কর্মময় জীবন প্রত্যক্ষ করে ‘আশ্চর্য মেয়ে’ শিরোনামে একটি কাহিনী লিখে সংবাদ পত্রিকায় ছাপিয়েছিলেন। সত্যেন সেনের ‘আশ্চর্য মেয়ে’ জ্যোৎস্না নিয়োগী ১৯২৫ সালে বিক্রমপুর জেলার নয়না গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা প্রয়াত যোগেশ চন্দ্র মজুমদার জাতীয়তা বাদী কংগ্রেসী ডাক্তার ছিলেন। তার মাতার নাম অমিয়া মজুমদার।

জ্যোৎস্নার জীবনে ১২ বছর বয়সে চরম বিপর্যয় ঘটে যায়। কালব্যাধী বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে এক মাসের মধ্যে বাবা-মা, ঠাকুমা ও দুই বোনকে হারিয়ে দিশে হারা হয়ে পড়েন কিন্তু তিনি মনোবল হারান না। শৈশব কালে মা-বাবাকে হারিয়ে এক বছর বয়সী ছোট বোনের হাত ধরে জ্যোৎস্নাকে জীবন সংগ্রামে নামতে হয়েছিল এবং এভাবে স্বজন হারানোর বেদনা দুঃখের মধ্যে তিনি বেড়ে ওঠেন। আত্মীয় স্বজনের সহায়তায় জ্যোৎস্না কলকাতায় গুরুসদয় দত্ত প্রতিষ্ঠিত সরোজনলিনী স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে অধ্যয়নের মধ্যেই তিনি জীবনকে গড়ে তোলার সাংস্কৃতিক উপাদান পেয়ে যান। পারিবারিক ঐতিহ্যসূত্রে পাওয়া দেশপ্রেমের বীজমন্ত্র তাঁর মনে অংকুরিত হয় এই পাঠশালার শিক্ষার মধ্য দিয়েই। শৈশবের সেই দেশ প্রেমের মন্ত্র যৌবনে কমিউনিষ্ট স্বামী রবি নিয়োগী ও দেবর মনীন্দ্র চন্দ্র নিয়োগীর সহায়তায় আরো মূর্ত হয়ে ওঠে। মার্কসীয় দর্শন তাঁর জীবন চেতনায় পূর্ণতা আনে। সমাজে অবহেলিত নিরন্ন অসহায় মানুষের মধ্যে তিনি মানবতার পূর্ণরূপ দেখতে পান। মার্কসীয় দর্শনই তাঁকে করে তোলে সংস্কারমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, তাঁর মন থেকে হতাশা নৈরাজ্য দূর হয়ে তিনি হয়ে ওঠেন মানবকল্যাণময়ী একজন নারী।

স্কুলে পড়া শেষ হবার পর ১৯৪১ সালে প্রয়াত আন্দামান জেল ফেরত কমিউনিষ্ট নেতা রবি নিয়োগীর সাথে জ্যোৎস্না বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের এক মাসের মধ্যে রবি নিয়োগী নিরাপত্তা আইনে বন্দী হন। এমন অবস্থায় শ্বাশুরী সুরবালা নিয়োগীর অনুমতি ক্রমে জ্যোৎস্না নিজেকে স্বামীর রাজনৈতিক আদর্শে গড়ে তোলার জন্য সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে মার্কসবাদ, লেলিনবাদ অধ্যয়ন করা শুরু করেন এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডেও অংশ নিতে শুরু করেন। ১৯৪২ সনে জ্যোৎস্না নিয়োগী কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। সে সময় মার্কসবাদে শিক্ষিত না হলে এবং সক্রিয় ভাবে পার্টির কাজে আত্মনিয়োগ না করলে পার্টির সদস্য পদ লাভ করা সম্ভব ছিল না।

১৯৪২ সনে নিখিল বঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির শাখা পূর্ব বাংলায় গঠিত হয়। নাম রাখা হয় “মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি”। এই সংগঠনটি গড়ে তোলার কাজে জ্যোৎস্না নিয়োগী আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালান। তাঁর সাথে ছিলেন মনোরমা বসু, যুঁইফুল রায়, নির্মলা স্যান্যাল, মজিরুন্নেছা প্রমুখ নেত্রীরা। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির ময়মনসিংহ (বৃহত্তর) জেলা সম্মেলনে জ্যোৎস্না নিয়োগী সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত হন এবং এই দায়িত্বপালনে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য কলকাতা যান।

জ্যোৎস্না নিয়োগী বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি সংগঠিত করে বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে থাকেন। সারা পূর্ব বাংলায় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি মহিলা সমাজকে আন্দোলনে সংগঠিত করার পাশাপাশি মেয়েদের কর্মসংস্থানের জন্য কুটির শিল্প প্রকল্প, শিক্ষা বিস্তারের জন্য নিরক্ষরতা দূরিকরণ কেন্দ্র স্থাপন এবং অন্যান্য সেবা মূলক কাজ করেছিল। জ্যোৎস্না নিয়োগী নিজে উদ্যোগী হয়ে শেরপুরে একটি তাঁত কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে অনেক দুস্থ মেয়ের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নিরক্ষতা দূরীকরণ অভিযানও সংগঠিত করেছিলেন।

পঞ্চাশের মন্বন্তরে শেরপুর অঞ্চলে লঙ্গরখানা পরিচালনা, রিলিফ বন্টন ও মহামারী প্রতিরোধে সক্রিয় অংশ নিয়ে ছিলেন জ্যোৎস্না নিয়োগী।

১৯৪৩ সালে প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন এবং ১৯৪৫ সালে অনুষ্ঠিত নেত্রকোনায় সারা ভারত কৃষক সম্মেলনে কৃষক মহিলাদের সংগঠিত করে সম্মেলন স্থলে উপস্থিত করার দায়িত্বে ছিলেন জ্যোৎস্না নিয়োগী। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে ঐ সম্মেলন দুটিতে কৃষক মহিলাদের অংশগ্রহণ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে। সম্মেলন দুটিতে কৃষক মহিলাদের উপস্থিতি দেখে এবং জ্যোৎস্না নিয়োগীর কর্মদক্ষতায় উচ্ছ্বসিত হয়ে কমিউনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি. সি যোশী মন্তব্য করেছিলেন “She is a born Revolutionary”

১৯৪২ সালে শেরপুর পরগনা জুড়ে জমিদার তালুকদারদের সৃষ্ট ঘৃণ্য নানকার প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি ক্ষত্রিয় মহিলাদের মধ্যে আন্দোলনের বীজ বপন করতে সক্ষম হয়। ফলে ক্ষত্রিয় নারী পুরুষের যৌথ আন্দোলনে নানকার প্রথার অবসান ঘটে।

একই সময়ে শেরপুর পরগনার উত্তরাঞ্চলের ব্যাপক এলাকা জুড়ে বিশেষভাবে রাজবংশী প্রজাদের মধ্যে ভাওয়ালী প্রথা নামে একটি শোষণ ব্যবস্থা চালু ছিল। এই আন্দোলন চলাকালে জ্যোৎস্না নিয়োগীর নেতৃত্বে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির কর্মীরা রাজবংশী অধ্যুষিত এলাকার গ্রামে গ্রামে গিয়ে রাজবংশী কৃষক মহিলাদের সচেতন ও সংগঠিত করার চেষ্টা চালায়। ভাওয়ালী প্রথা অবসানের তীব্র আন্দোলনের মুখে এই প্রথার অবসান ঘটে।

১৯৪৬ সনে তেভাগা আন্দোলন শুরু হয় শেরপুর, নালিতাবাড়ী, হালুয়াঘাট, শ্রীবরর্দী প্রভৃতি এলাকায় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর প্রচন্ড দমননীতি চলতে থাকে। সর্ব্বেশ্বর ডালু পুলিশের গুলিতে নিহত হন। কৃষক আন্দোলনে সর্বপ্রথম রাশমনি নামে একজন কৃষক মহিলা পুলিশের সাথে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে শহীদ হন। শত শত নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়, অনেক নেতাকর্মী আত্মগোপনে থেকে আন্দোলনের কাজ চালাতে থাকেন। পুলিশের দমন অভিযান চলাকালে আন্দোলনকে চাঙ্গা রাখার জন্য কমিউনিষ্ট পার্টির নির্দেশে বিপদের ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে জ্যোৎস্না নিয়োগী, কণা বকসি, পূর্ণিমা বকসিকে সাথে নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পায়ে হেটে কাজ চালাতে থাকেন। তাদের কার্যকলাপের খবর পেয়ে তৎকালীন বৃটিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাদের গ্রেপ্তার করার প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সনে কমলাকান্দা, সুসং দুর্গাপুর, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী ও শেরপুরের বির্স্তীর্ণ এলাকাজুড়ে টঙ্ক চাষিরা টঙ্ক প্রথা উচ্ছেদের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনকারীরা পাকিস্তান ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে এই প্রচারণা চালিয়ে পাকিস্তানী পুলিশ বাহিনী আন্দোলনকারীদের উপর অকথ্য নির্যাতন শুরু করে। এই নির্যাতন প্রতিহত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়। রেবতী, শঙ্খমনি, সারথী নামে কয়েকজন মহিলা ও কমিউনিষ্ট নোতা শচী রায় মৃত্যুবরণ করেন। পাকিস্তানী সরকারের দমন পীড়নে টিকতে না পেরে সীমান্ত বর্তী হাজার হাজার কৃষক পরিবার জমি জামা ঘরবাড়ি ছেড়ে সীমান্তের অপর পাড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। সীমান্ত এলাকায় যখন পুলিশ বাহিনীর তান্ডবলীলা চলছিল তখন জ্যোৎস্না নিয়োগী অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে নিয়ে অসীম সাহসের সাথে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। আত্মগোপন অবস্থায় একদিন ননদের বর হারু চক্রবর্তীর সাথে ভোররাতে যখন শেরপুর ফিরছিলেন তখন পুলিশের হাতে তাঁরা দুজনেই গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে ১৯৫৩ সালের মাঝামাঝি প্রায় ছয় বছর পর্যন্ত তাঁকে নিরাপত্তা আইনে কারাভোগ করতে হয়। এসময় রবি নিয়োগীও জেলে ছিলেন।

১৯৫৪ সনে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের কিছুদিন পরই প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণী তাদের পরাজয়ের গ্লানির প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ৯২(ক) ধারা জারি করে এবং প্রগতিশীল শক্তিকে খতম করার লক্ষ্যে বহু সংখ্যক নেতা কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। এই সময় জ্যোৎস্না নিয়োগীকে ০৮ মাসের শিশুপুত্র কাজল নিয়োগীকে নিয়ে আবার জেলে যেতে হয়। জ্যোৎস্না নিয়োগীকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ নিয়োগী বাড়ির গরু বাছুর, আসবাবপত্রসহ বাড়ির সব জিনিস সীজ করে নেয়। স্বামী পলাতক, বাড়িতে অপরিণত বষস্ক দুই ছেলে এক মেয়েকে রেখে তিনি জেলে যান। এই সময় তাকে দুই বছর জেলে থাকতে হয়। জেলে থাকা অবস্থাতেও জ্যোৎস্না নিয়োগী সাধারণ বন্দীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অনশন করে আন্দোলন করেছেন।

রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও সম্পৃক্ত ছিলেন। জ্যোৎস্না নিয়োগী শেরপুরে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। জ্যোৎস্না নিয়োগী আড়াই আনী জমিদার বাড়ির তৎকালীন রিসিভার ক্ষিতিধর রায়ের কন্যাদের গৃহ শিক্ষিকা ছিলেন। সেই সুবাদে ক্ষিতিধর রায়ের নিকট থেকে চকবাজার শহীদ মিনার নির্মাণের জায়গা চেয়ে নেন এবং অতি সংগোপনে তারাহুড়া করে একটি শহীদ মিনার তৈরী করেন। বিশ্বনাথ চৌহান নামে একজন রাজমিস্ত্রি (কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য) ও ১২ বছর বয়স্ক বড় ছেলে প্রয়াত রণজিত নিয়োগীকে সর্বপ্রথম শহীদ মিনার নির্মানের কাজে লাগান। শহীদ মিনার তৈরী করার জন্য শেরপুরে একটি কমিটি হয়। সেই কমিটিতে তার মেয়ে মঞ্জুশ্রীকেও যুক্ত করেন। ১৯৫৪ সনের ২১ শে ফেব্রুয়ারী এই শহীদ মিনারে প্রথম পুষ্প স্তবক অর্পণ করা হয়। ২০ শে ফেব্রুয়ারী রাতের আধারে পুলিশের চোখ ফাকি দিয়ে জ্যোৎস্না নিয়োগী চালের গুড়া গুলে শহীদ মিনারের চার প্রান্তে আলপনা এঁকেছিলেন। এই দেশের শহীদ মিনারে আল্পনা আঁকার প্রচলন জ্যোৎস্না নিয়োগীই প্রথম প্রবর্তন করেছেন বলে মনে হয়।

জ্যোৎস্না নিয়োগীর অনুপ্রেরণা ও উৎসাহে শেরপুরে সাংস্কৃতিক অঙ্গণ গতিশীল ছিল। ছোট মেয়েদের যোগাড় করে ‘আমরা কজনা’ নাম দিয়ে তিনি একটি নাট্যদল গঠন করেন। ৫৭ সনে শেরপুরের বিশিষ্ট নাট্যপরিচালক প্রয়াত মোহিনী মোহন বল-এর পরিচালনায় এ নাট্যদল রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ শরৎচন্দ্রের ‘নিস্কৃতি’ নাটক মঞ্চস্থ কওে ভূয়ষী প্রসংশা অর্জন করে। এ সময় সংস্কৃতি সংসদ নামে একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠে। এ সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জ্যোৎস্না নিয়োগী।

শেরপুরে একটি সুষ্ঠু ধারার সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ পার্টির সদস্য প্রয়াত ইমদাদুল হক ও প্রয়াত আবুল কাশেমকে সামনে রেখে ১৯৬৮ সালে গড়ে তোলা হয় গণ সংস্কৃতি সংসদ নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠনটি গড়ে তোলার পেছনে জ্যোৎস্না নিয়োগীর অবদান ছিল অপরিসীম।

১৯৬৮ সনে শেরপুরে কিশোর সংগঠন পাতাবাহার খেলাঘর আসর জ্যোৎস্না নিয়োগীর পৃষ্ঠপোষকতায় তার নিজের বাসগৃহে গড়ে উঠেছিল।

শেরপুরে উদীচী সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারেও জ্যোৎস্না নিয়োগীর অবদান ভুলবার নয়। নিয়োগী বাড়ী থেকেই উদিচীর কার্যকলাপ পরিচালিত হতো জ্যোৎস্না নিয়োগীর বড় পুত্র প্রয়াত রণজিত নিয়োগীর মাধ্যমে। অনেক দিন পর্যন্ত উদিচীর নাটক, গান, কবিতার মহড়া, নিয়োগী বাড়ীতেই সংগঠিত হয়েছে। এককথায় শেরপুর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধাব্যাক্তিত্ব ছিলেন জ্যোৎস্না নিয়োগী।

নিরন্ন অসহায় পরিবারের শিশুদের আশ্রয়স্থল ছিলো নিয়োগী বাড়ি। এ খানে শিশুদের মুখে আহার তুলে দিয়ে জ্যোৎস্না নিয়োগী প্রতিদিন তাদের লেখাপড়া শেখাতেন। তাই তিনি নিরন্ন শিশুদের দিদিমণি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

১৯৭১ সালে ভারত বর্ষের মেঘালয় রাজ্যের বারেঙ্গাঁ পাড়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে প্রচারণা চালান জ্যোৎস্না নিয়োগী। সীমান্ত এলাকায় শরনার্থী শিবিরের শরনার্থীদের মনোবল চাঙ্গা রাখার কাজও তিনি করেছেন। জ্যোৎস্না নিয়োগী ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলো।

দেশ স্বাধীন হবার পর দেশে ফিরে জ্যোৎস্না নিয়োগী দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ৭১ সনে পাক বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনী নিয়োগী বাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করলেও নিয়োগী দ¤পতির মনোবল ভাঙতে পারেনি। দেশে ফিরে তারা প্রতিবেশী বাড়িতে আশ্রয় নেন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত শেরপুরকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার ব্যাপারে আÍনিয়োগ করেছিলেন।

১৯৭২ সালে জ্যোৎস্না নিয়োগী শেরপুরে মহিলা পরিষদ এর শাখা গড়ে তোলেন। তাঁর সুশৃঙ্খল নেত্রীত্বে শেরপুর মহিলা পরিষদ একটি শক্তিশালী সংগঠনে রূপান্তরিত হয়। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জ্যোৎস্না নিয়োগী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিরলস কাজ করে গেছেন।

জ্যোৎস্না নিয়োগীর স্বামী রবি নিয়োগী ৩৪ বছর কারাগারে ও অন্তরীণ অবস্থায় কাটিয়েছেন। ঘর সংসার প্রতিপালন সন্তানদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও কমিউনিষ্ট পার্টি সংগঠিত করার কাজ সবই জ্যোৎস্না নিয়োগী নিষ্ঠার সাথে সম্পাদন করেছেন। সমাজতন্ত্রের আদর্শে নিবেদিত সংগ্রামী নেত্রী জ্যোৎস্না নিয়োগী বিশ্বাস করতেন রাজনৈতিক সচেতনতা ও আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা থাকলে এমন কোন কঠিন কাজ নেই যা করা যায় না। জ্যোৎস্না নিয়োগী তার কাজের মধ্যে দিয়ে এই বিশ্বাস প্রমাণ করেছেন।

১৯৯০ সালে ২৭ জানুয়ারি ৬৫ বছর বয়সে পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত হয়ে জ্যোৎস্না নিয়োগী মৃত্যুবরণ করেন। সেসময় বাংলাদেশে এ রোগের সুচিকিৎসা না থাকায় প্রায় চিকিৎসাহীন অবস্থাতে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। এ ব্যাপারটিও কম দুঃখের নয়।

এই মহীয়সী রমণীর সংগ্রামমুখর জীবনের কথা বর্তমান প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাঁর প্রতি সম্মান জানানো আমাদের দায়িত্ব।

[লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলা বেতার শব্দসৈনিক এবং বিপ্লবী জ্যোৎস্না নিয়োগীর কন্যা।

back to top