alt

মুক্ত আলোচনা

বাংলা নববর্ষ- ১৪২৯

আবদুল আলীম তালুকদার

: বুধবার, ১৩ এপ্রিল ২০২২

বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষের সূচনাক্ষণ এমন এক সময় আমাদের দ্বারে সমাসীন যখন সারা দেশজুড়ে দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী ঊর্ধ্বগতির দরুণ জনজীবনে নাভিশ্বাস অবস্থা বিরাজ করছে। তারমাঝে এখন চলছে রমযান মাস। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রধান ধর্মীয় উৎসব উদযাপনকে কেন্দ্র করে সে সব দেশে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর বিশেষ মূল্য ছাড়ের রেওয়াজ সুদীর্ঘকাল থেকে প্রচলিত রয়েছে। যাতে করে ধনি-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই সেসব সার্বজনীন উৎসব আনন্দের সাথে সাগ্রহে পালন করতে পারে। আর সেসব দেশের স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর লোকেরা সারাবছর ধরে তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের অপেক্ষায় থাকে এবং সে সময় তারা নিত্যব্যবহার্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী সাশ্রয়ী ও বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় কম মূল্যে ক্রয় করে থাকে। পক্ষান্তরে আমাদের দেশের ব্যবসায়িমহল সারাবছর ধরে তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকে কখন আসবে রমযান মাস, কখন আসবে ঈদ, কখন আসবে পহেলা বৈশাখ, কখন আসবে দুর্গোৎসব। এসব উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রত্যেকটি দ্রব্যসামগ্রীর অবিশ্বাস্য দাম বাড়িয়ে ক্রেতা সাধারনের ঘাড় কেটে অবৈধ মুনাফা লুটবে; এটা এখন আমাদের দেশের ব্যবসায়ি সমাজ রেওয়াজে পরিণত করেছে আর আমরা ক্রেতাসাধারণ তা ভাগ্যের লিখন বলে মেনে নিয়েছি।

বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর জীবনে বছরের যে কয়েকটি দিন সকল প্রকার

দুঃখ-কষ্ট-বেদনা, পুরাতন-জীর্ণতা, গ্লানিকে ভুলিয়ে অন্তরের অন্তঃস্থলে এক নব আনন্দ-উচ্ছাসের সমাবেশ ঘটায়, সেই দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলা নববর্ষের সূচনাকালÑ পহেলা বৈশাখ। পৃথিবীর প্রতিটি জাতিসত্তার কাছেই সেই জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিগত নতুন বছরের সূচনাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথেই দেখা হয়। বাঙালিরাও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। তাই পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ প্রতিটি বাঙালির জীবনে সংস্কৃতিসমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যম-িত একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন।

বাংলা নববর্ষ সুদীর্ঘকাল ধরে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাঙালি সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক এবং বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রধান উপাদান। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে, পাতাঝরা উষ্ণতম রসকষহীন মাস চৈত্রের বিদায়বার্তা বহণকারী চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখের সূচনার মধ্য দিয়ে বাঙালি নতুন বছরকে আপন মনে বরণ করে নেয়। বর্ষবরণের অনাবিল আনন্দে উদ্ভাসিত বাঙালির জীবন পুরাতন বছরের সকল দুঃখ ও গ্লানির কথা বেমালুম ভুলে নতুন করে বাঁচার আশায় বুক বাঁধতে থাকে।

বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে নববর্ষ অত্যন্ত আনন্দ-উল্লাসের সাথে উদযাপিত হয়ে থাকে। শিশু-যুবা-বৃদ্ধসহ সব বয়সের সব শ্রেণি-পেশার সব সম্প্রদায়ের জনগণ এ উৎসবমুখর দিনটি অতি আগ্রহের সাথে উদযাপন করে থাকে। এ উৎসবে প্রধান অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা। এছাড়া আমানি উৎসব, হালখাতা, গাজনের গান, গাঙ্গিখেলা, ঘোড়ার দৌড় ইত্যাদি গ্রামীণ অনুষ্ঠান বিভিন্ন অঞ্চলভেদে এখনো উদযাপিত হয়।

মুঘল স¤্রাট জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবরের নবরতেœর অন্যতম, সুপ-িত ও রাজনীতিবিদ শেখ আবুল ফজল ইবনে মুবারক রচিত ইতিহাস গ্রন্থ ‘আইন-ই-আকবরী ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের একটি প্রামাণিক দলিল। এ গ্রন্থে বিক্রমাদিত্য নামে একজন প্রাচীন ভারতীয় নরপতির নাম পাওয়া যায়। তার সিংহাসনারোহণের দিন হতে তিনি একটি নতুন অব্দ প্রচলন করেছিলেন। স¤্রাট আকবরের রাজত্বের ৪০তম বর্ষে ওই সালটির ১৫১৭তম অব্দ চলছিলো। ধারণা করা হয়, এই প্রাচীন সালটিই আমাদের বর্তমান বাংলা সনের উৎস।

তবে অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তাদের মতে, বাংলা নবর্ষের সূচনা মুসলমানদের হাত ধরেই হয়েছিল এবং হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করেই বাংলা সনের উৎপত্তি। স¤্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) শাসনামলে বাংলার কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে হিজরি সনকে মূলভিত্তি ধরে প্রথম বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। ১৬১০ সালে যখন ঢাকাকে সর্বপ্রথম রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলা হয় তখন রাজস্ব আদায় আর ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ শুরু করার জন্য পহেলা বৈশাখকে স¤্রাট আকবরের অনুকরণে সুবেদার ইসলাম খান চিশতি তার বাসভবনের সামনে সব প্রজার শুভ কামনা করে মিষ্টি বিতরণ এবং বৈশাখী উৎসব পালন করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় এই পহেলা বৈশাখ আজো আমাদের কাছে অতুলনীয় আনন্দের একটি দিন।

তবে অন্যমতে, আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীর বাংলা সন প্রবর্তনের ভিত্তি ছিল শক বর্ষপঞ্জি বা শকাব্দ, সে পঞ্জিকা অনুসারে বাংলার ১২ মাস আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। শক বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস ছিল চৈত্র মাস, কিন্তু ৯৬৩ হিজরিতে ফতেহউল্লাহ সিরাজীর বর্ষপঞ্জি সংস্করণের সময় চন্দ্র সনের প্রথম মাস মুহাররম ছিল বাংলার বৈশাখ মাসে, তাই তখন থেকেই বৈশাখকে বাংলা বছরের প্রথম মাস হিসাবে গণনা করা শুরু হয়।

এখন যেমন বাংলা নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, একসময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল কৃষির। কারণ কৃষিকাজ ছিল বিশেষ ঋতুনির্ভর। ফসল বোনা, ফসলের সময়ভিত্তিক যতœ বা পরিচর্যা, ফসল কাটাসহ যাবতীয় কৃষিকাজ বাংলা সন-তারিখ পঞ্জিকা অনুযায়ী নিষ্পন্ন করা হতো। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে অনুষ্ঠিত হরেক রকম মেলার দিন-তারিখও নির্ধারিত ছিল বাংলা সনের সঙ্গে। শুধু ফসল আর উৎসব নয়, বাঙালি কৃষকের পারিবারিক ও সামাজিক কাজকর্ম, বিবাহ, জন্ম-মৃত্যুসহ জীবনের সব বিষয়েই বাংলা সন ছিল একক ও অনন্য।

বাংলা নববর্ষের যাত্রা খুব বেশি প্রাচীন নয়। স¤্রাট আকবর সিংহাসন আরোহনের বছর ৯৬৩ হিজরি (১৫৫৬ খ্রি.) সনকে শুরুর বছর ধরে ফসলি সন নামে যে সন প্রবর্তন করেন যা কালক্রমে বাংলা সন নামে পরিচিতি লাভ করে। বাংলা বছর নির্ধারণ নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ের প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে পরীক্ষামূলকভাবে এই গণনা পদ্ধতিকে কার্যকর ধরা হয় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর তারিখ থেকে অর্থাৎ স¤্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের তারিখ থেকে। সেই থেকে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা ও শুল্ক পরিশোধ করা হতো। খাজনা নিতে জমির মালিকরা হিসাবের একটি খাতা তৈরি করতেন। খাতায় খাজনা ও শুল্ক পরিশোধকারীদের নাম ও হালনাগাদ হিসাব লিখে রাখা হতো; যা পরবর্তীতে ‘হালখাতা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

মূলত মুঘল শাসনামলে হিজরি সনের ভিত্তিতে এ দেশে বছর গণনা হতো। হিজরি বছর সৌর বছর থেকে ১১ দিন ছোট হওয়ায় এ দেশের ঋতু পরিবর্তনের সাথে হিজরি বছরের মিল হয় না। এতে কৃষকদের ফসলি সন গণনায় সমস্যা দেখা দেয়; অধিকন্তু কৃষকের কাছ থেকে জমিদারের খাজনা আদায়ের সমস্যা দেখা দেয়। কৃষক ও জমিদারের সমস্যা দূর করতে জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে মূলত বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। বাংলা নববর্ষ বাঙালির হলেও উৎসবের আমেজটা কৃষকের একটু বেশিই।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, হিজরি সন গণনা করা হয় ইসলামের নবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর জন্মভূমি মক্কা থেকে মদিনা হিজরতকে কেন্দ্র করে। খোলাফায়ে রাশেদার দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.) রাসূল (স.)-এর হিজরতকে স্মরণীয় করে রাখতে হিজরি সনের প্রবর্তন করেন। পরে মুঘল স¤্রাট আকবর তার সভাষদ জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীর পরামর্শে হিজরি ৯৬৩ সনকে বাংলা ৯৬২ সন ধরে বাংলা সন গণনার নির্দেশ দেন। তবে বঙ্গাব্দের সাথে স¤্রাট আকবর প্রবর্তিত ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ সম্পৃক্ততার বিষয়ে কতিপয় ইতিহাসবিদ দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাদের মতে, রাজা শশাঙ্কই হলেন বঙ্গাব্দের মূল প্রবর্তক এবং রাজা শশাঙ্কের রাজ্যাভিষেকের দিন (৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল, পহেলা বৈশাখ রোজ সোমবার) থেকে এই অব্দ চালু হয়েছিল। ওই দিনেই শশাঙ্ক গৌড়বঙ্গে স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করেছিলেন।

ইতিহাস পর্যলোচনায় দেখা যায়, স¤্রাট আকবরের আমল থেকেই বাংলায় নববর্ষ উৎসবের শুরু হয়। তবে সে সময় এটি ছিল প্রধানত খাজনা আদায়ের উৎসব। নববর্ষ উপলক্ষে বাংলা বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ বৈশাখ মাসের ১ তারিখে কিছু উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো যাকে রাজপুণ্যাহ্ বা রাজকর আদায়ের উৎসবও বলা যায়। তখন প্রজারা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে ফেলে আসা বছরের বকেয়া খাজনা মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকতেন এবং জমিদারের কাছারি থেকে নতুন বছরের বন্দোবস্ত গ্রহণ করতেন। ভূস্বামী ও জমিদারেরা এই দিনটিতে প্রজাদের নিয়ে পুণ্যাহ করতেন। সেই আমলে রাজপুণ্যাহ আর নববর্ষ ছিল সমার্থক। তাই জমিদারগণ পরের দিন অর্থাৎ ১লা বৈশাখ প্রজাদের মিষ্টিমুখ করানোর সাথে সাথে গান-বাজনা, যাত্রা, মেলা প্রভৃতি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে প্রকৃতপক্ষে তাদের অর্থশোক ভোলানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথার বিলোপ হলে সেই সাথে বন্ধ হয়ে যায় পহেলা বৈশাখের এই রাজপুণ্যাহ উৎসব। শুধু রয়ে যায় খাওয়া দাওয়া আর উৎসবের অংশটুকু, তবে সেই যুগের রাজপুণ্যাহ যে বর্তমান হালখাতা হিসাবে আজও বাঙালির জীবনে অমলিন হয়েই রয়ে গেছে তাতো এখন বলাই বাহুল্য। পরবর্তীকালে সময়ের বিবর্তনে পহেলা বৈশাখ পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলেমিশে আরও আনন্দময় ও উৎসবমুখর হয়ে ওঠেছে এবং সেই সাথে বাংলা নববর্ষ প্রতিটি বাঙালির জীবনে কল্যাণ ও নব জীবনের প্রতীক হয়ে বছরের একটি অন্যতম শুভ ও কল্যাণময় দিন হিসেবেও উদযাপন হয়ে আসছে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলা মাসের নামগুলো বিভিন্ন তারকারাজির নাম থেকে নেয়া হয়েছে। যেমন: বিশাখা থেকে বৈশাখ, জেষ্ঠ্যা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রইহনী থেকে অগ্রহায়ণ, পূষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফল্গুনি থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র। আগেকার দিনে অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটা শুরু হতো বলে এই মাসকে বছরের প্রথম মাস ধরা হতো। তাই এই মাসের নামই রাখা হয় অগ্রহায়ণ। অগ্র অর্থ প্রথম আর হায়ন অর্থ বর্ষ বা ধান। ‘ফসলি সন’ যখন প্রবর্তিত হয়, তখন কিন্তু ১২ মাসের নাম ছিল: কারওয়াদিন, আরদিভিহিসু, খারদাদ, তীর, আমরারদাদ, শাহরিয়ার, মিহির, আবান, আয়ুব, দায়, বাহমান ও ইসকান্দার মিয। পরবর্তী পর্যায়ে সেগুলো বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ ইত্যাদিতে রূপান্তরিত হয়।

বাংলা দিনপঞ্জির সাথে হিজরি ও খ্রিস্টীয় সালের মৌলিক পার্থক্য হলো হিজরি সাল চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সাল সূর্যের আবর্তনের হিসাবে চলে। এ কারণে হিজরি সালে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যাকালে নতুন চাঁদের আগমনে। খ্রিস্টীয় তারিখ শুরু হয় মধ্যরাতে। আর বাংলা সনের দিন শুরু হয় সূর্যোদয়ের সাথে সাথে। কাজেই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বর্তমান পরিচিতি পাওয়া পান্তা-ইলিশ খাওয়া বাঙালির পহেলা বৈশাখের উৎসব।

পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ইতোপূর্বে দেশে উৎসবের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় নানা অপশক্তি-অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হতে দেখা গেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা; যা ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নববর্ষ উদযাপন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সার্বজনীন উৎসবে। পহেলা বৈশাখের ভোরে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আয়োজনে মেতে ওঠে সারাদেশ। বিশ্বব্যাপি করোনা পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসায় এবার মনে হচ্ছে বৈশাখী উৎসবে মাতবে পুরোদেশ।

বরাবরের মতো বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে আজো বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে-শহরে বৈশাখী মেলা বসে। এসব মেলায় কৃষিজপণ্য, কুটিরশিল্প পণ্য, বাঁশের বেতের তৈজষপত্র, মৃৎ ও হস্তশিল্প পণ্যসহ নানা ধরনের আসবাবপত্র, মিষ্টান্ন, খেলনা সামগ্রী ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের ধুম পড়ে যায়। এছাড়াও মেলার সময় নাগরদোলা, সার্কাস, পুতুল নাচ, যাদুখেলা, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, বলী-কুস্তি খেলা, হা-ডু-ডু খেলা, লাঠি খেলা ইত্যাদি বিনোদন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে।

সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত ও যুগোপযোগী হিজরিভিত্তিক বাংলা সন নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য গৌরবের। আর বাঙালি জাতি হিসেবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ আমাদের প্রেরণার উৎস হিসেবে চির জাগরুক থাকুক এই প্রত্যাশা নিরন্তর।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

বাংলা নববর্ষ- ১৪২৯

আবদুল আলীম তালুকদার

বুধবার, ১৩ এপ্রিল ২০২২

বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষের সূচনাক্ষণ এমন এক সময় আমাদের দ্বারে সমাসীন যখন সারা দেশজুড়ে দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী ঊর্ধ্বগতির দরুণ জনজীবনে নাভিশ্বাস অবস্থা বিরাজ করছে। তারমাঝে এখন চলছে রমযান মাস। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রধান ধর্মীয় উৎসব উদযাপনকে কেন্দ্র করে সে সব দেশে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর বিশেষ মূল্য ছাড়ের রেওয়াজ সুদীর্ঘকাল থেকে প্রচলিত রয়েছে। যাতে করে ধনি-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই সেসব সার্বজনীন উৎসব আনন্দের সাথে সাগ্রহে পালন করতে পারে। আর সেসব দেশের স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর লোকেরা সারাবছর ধরে তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের অপেক্ষায় থাকে এবং সে সময় তারা নিত্যব্যবহার্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী সাশ্রয়ী ও বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় কম মূল্যে ক্রয় করে থাকে। পক্ষান্তরে আমাদের দেশের ব্যবসায়িমহল সারাবছর ধরে তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকে কখন আসবে রমযান মাস, কখন আসবে ঈদ, কখন আসবে পহেলা বৈশাখ, কখন আসবে দুর্গোৎসব। এসব উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রত্যেকটি দ্রব্যসামগ্রীর অবিশ্বাস্য দাম বাড়িয়ে ক্রেতা সাধারনের ঘাড় কেটে অবৈধ মুনাফা লুটবে; এটা এখন আমাদের দেশের ব্যবসায়ি সমাজ রেওয়াজে পরিণত করেছে আর আমরা ক্রেতাসাধারণ তা ভাগ্যের লিখন বলে মেনে নিয়েছি।

বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর জীবনে বছরের যে কয়েকটি দিন সকল প্রকার

দুঃখ-কষ্ট-বেদনা, পুরাতন-জীর্ণতা, গ্লানিকে ভুলিয়ে অন্তরের অন্তঃস্থলে এক নব আনন্দ-উচ্ছাসের সমাবেশ ঘটায়, সেই দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলা নববর্ষের সূচনাকালÑ পহেলা বৈশাখ। পৃথিবীর প্রতিটি জাতিসত্তার কাছেই সেই জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিগত নতুন বছরের সূচনাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথেই দেখা হয়। বাঙালিরাও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। তাই পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ প্রতিটি বাঙালির জীবনে সংস্কৃতিসমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যম-িত একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন।

বাংলা নববর্ষ সুদীর্ঘকাল ধরে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাঙালি সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক এবং বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রধান উপাদান। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে, পাতাঝরা উষ্ণতম রসকষহীন মাস চৈত্রের বিদায়বার্তা বহণকারী চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখের সূচনার মধ্য দিয়ে বাঙালি নতুন বছরকে আপন মনে বরণ করে নেয়। বর্ষবরণের অনাবিল আনন্দে উদ্ভাসিত বাঙালির জীবন পুরাতন বছরের সকল দুঃখ ও গ্লানির কথা বেমালুম ভুলে নতুন করে বাঁচার আশায় বুক বাঁধতে থাকে।

বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে নববর্ষ অত্যন্ত আনন্দ-উল্লাসের সাথে উদযাপিত হয়ে থাকে। শিশু-যুবা-বৃদ্ধসহ সব বয়সের সব শ্রেণি-পেশার সব সম্প্রদায়ের জনগণ এ উৎসবমুখর দিনটি অতি আগ্রহের সাথে উদযাপন করে থাকে। এ উৎসবে প্রধান অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা। এছাড়া আমানি উৎসব, হালখাতা, গাজনের গান, গাঙ্গিখেলা, ঘোড়ার দৌড় ইত্যাদি গ্রামীণ অনুষ্ঠান বিভিন্ন অঞ্চলভেদে এখনো উদযাপিত হয়।

মুঘল স¤্রাট জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবরের নবরতেœর অন্যতম, সুপ-িত ও রাজনীতিবিদ শেখ আবুল ফজল ইবনে মুবারক রচিত ইতিহাস গ্রন্থ ‘আইন-ই-আকবরী ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের একটি প্রামাণিক দলিল। এ গ্রন্থে বিক্রমাদিত্য নামে একজন প্রাচীন ভারতীয় নরপতির নাম পাওয়া যায়। তার সিংহাসনারোহণের দিন হতে তিনি একটি নতুন অব্দ প্রচলন করেছিলেন। স¤্রাট আকবরের রাজত্বের ৪০তম বর্ষে ওই সালটির ১৫১৭তম অব্দ চলছিলো। ধারণা করা হয়, এই প্রাচীন সালটিই আমাদের বর্তমান বাংলা সনের উৎস।

তবে অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তাদের মতে, বাংলা নবর্ষের সূচনা মুসলমানদের হাত ধরেই হয়েছিল এবং হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করেই বাংলা সনের উৎপত্তি। স¤্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) শাসনামলে বাংলার কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে হিজরি সনকে মূলভিত্তি ধরে প্রথম বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। ১৬১০ সালে যখন ঢাকাকে সর্বপ্রথম রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলা হয় তখন রাজস্ব আদায় আর ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ শুরু করার জন্য পহেলা বৈশাখকে স¤্রাট আকবরের অনুকরণে সুবেদার ইসলাম খান চিশতি তার বাসভবনের সামনে সব প্রজার শুভ কামনা করে মিষ্টি বিতরণ এবং বৈশাখী উৎসব পালন করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় এই পহেলা বৈশাখ আজো আমাদের কাছে অতুলনীয় আনন্দের একটি দিন।

তবে অন্যমতে, আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীর বাংলা সন প্রবর্তনের ভিত্তি ছিল শক বর্ষপঞ্জি বা শকাব্দ, সে পঞ্জিকা অনুসারে বাংলার ১২ মাস আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। শক বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস ছিল চৈত্র মাস, কিন্তু ৯৬৩ হিজরিতে ফতেহউল্লাহ সিরাজীর বর্ষপঞ্জি সংস্করণের সময় চন্দ্র সনের প্রথম মাস মুহাররম ছিল বাংলার বৈশাখ মাসে, তাই তখন থেকেই বৈশাখকে বাংলা বছরের প্রথম মাস হিসাবে গণনা করা শুরু হয়।

এখন যেমন বাংলা নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, একসময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল কৃষির। কারণ কৃষিকাজ ছিল বিশেষ ঋতুনির্ভর। ফসল বোনা, ফসলের সময়ভিত্তিক যতœ বা পরিচর্যা, ফসল কাটাসহ যাবতীয় কৃষিকাজ বাংলা সন-তারিখ পঞ্জিকা অনুযায়ী নিষ্পন্ন করা হতো। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে অনুষ্ঠিত হরেক রকম মেলার দিন-তারিখও নির্ধারিত ছিল বাংলা সনের সঙ্গে। শুধু ফসল আর উৎসব নয়, বাঙালি কৃষকের পারিবারিক ও সামাজিক কাজকর্ম, বিবাহ, জন্ম-মৃত্যুসহ জীবনের সব বিষয়েই বাংলা সন ছিল একক ও অনন্য।

বাংলা নববর্ষের যাত্রা খুব বেশি প্রাচীন নয়। স¤্রাট আকবর সিংহাসন আরোহনের বছর ৯৬৩ হিজরি (১৫৫৬ খ্রি.) সনকে শুরুর বছর ধরে ফসলি সন নামে যে সন প্রবর্তন করেন যা কালক্রমে বাংলা সন নামে পরিচিতি লাভ করে। বাংলা বছর নির্ধারণ নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ের প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে পরীক্ষামূলকভাবে এই গণনা পদ্ধতিকে কার্যকর ধরা হয় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর তারিখ থেকে অর্থাৎ স¤্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের তারিখ থেকে। সেই থেকে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা ও শুল্ক পরিশোধ করা হতো। খাজনা নিতে জমির মালিকরা হিসাবের একটি খাতা তৈরি করতেন। খাতায় খাজনা ও শুল্ক পরিশোধকারীদের নাম ও হালনাগাদ হিসাব লিখে রাখা হতো; যা পরবর্তীতে ‘হালখাতা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

মূলত মুঘল শাসনামলে হিজরি সনের ভিত্তিতে এ দেশে বছর গণনা হতো। হিজরি বছর সৌর বছর থেকে ১১ দিন ছোট হওয়ায় এ দেশের ঋতু পরিবর্তনের সাথে হিজরি বছরের মিল হয় না। এতে কৃষকদের ফসলি সন গণনায় সমস্যা দেখা দেয়; অধিকন্তু কৃষকের কাছ থেকে জমিদারের খাজনা আদায়ের সমস্যা দেখা দেয়। কৃষক ও জমিদারের সমস্যা দূর করতে জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে মূলত বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। বাংলা নববর্ষ বাঙালির হলেও উৎসবের আমেজটা কৃষকের একটু বেশিই।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, হিজরি সন গণনা করা হয় ইসলামের নবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর জন্মভূমি মক্কা থেকে মদিনা হিজরতকে কেন্দ্র করে। খোলাফায়ে রাশেদার দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.) রাসূল (স.)-এর হিজরতকে স্মরণীয় করে রাখতে হিজরি সনের প্রবর্তন করেন। পরে মুঘল স¤্রাট আকবর তার সভাষদ জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীর পরামর্শে হিজরি ৯৬৩ সনকে বাংলা ৯৬২ সন ধরে বাংলা সন গণনার নির্দেশ দেন। তবে বঙ্গাব্দের সাথে স¤্রাট আকবর প্রবর্তিত ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ সম্পৃক্ততার বিষয়ে কতিপয় ইতিহাসবিদ দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাদের মতে, রাজা শশাঙ্কই হলেন বঙ্গাব্দের মূল প্রবর্তক এবং রাজা শশাঙ্কের রাজ্যাভিষেকের দিন (৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল, পহেলা বৈশাখ রোজ সোমবার) থেকে এই অব্দ চালু হয়েছিল। ওই দিনেই শশাঙ্ক গৌড়বঙ্গে স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করেছিলেন।

ইতিহাস পর্যলোচনায় দেখা যায়, স¤্রাট আকবরের আমল থেকেই বাংলায় নববর্ষ উৎসবের শুরু হয়। তবে সে সময় এটি ছিল প্রধানত খাজনা আদায়ের উৎসব। নববর্ষ উপলক্ষে বাংলা বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ বৈশাখ মাসের ১ তারিখে কিছু উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো যাকে রাজপুণ্যাহ্ বা রাজকর আদায়ের উৎসবও বলা যায়। তখন প্রজারা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে ফেলে আসা বছরের বকেয়া খাজনা মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকতেন এবং জমিদারের কাছারি থেকে নতুন বছরের বন্দোবস্ত গ্রহণ করতেন। ভূস্বামী ও জমিদারেরা এই দিনটিতে প্রজাদের নিয়ে পুণ্যাহ করতেন। সেই আমলে রাজপুণ্যাহ আর নববর্ষ ছিল সমার্থক। তাই জমিদারগণ পরের দিন অর্থাৎ ১লা বৈশাখ প্রজাদের মিষ্টিমুখ করানোর সাথে সাথে গান-বাজনা, যাত্রা, মেলা প্রভৃতি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে প্রকৃতপক্ষে তাদের অর্থশোক ভোলানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথার বিলোপ হলে সেই সাথে বন্ধ হয়ে যায় পহেলা বৈশাখের এই রাজপুণ্যাহ উৎসব। শুধু রয়ে যায় খাওয়া দাওয়া আর উৎসবের অংশটুকু, তবে সেই যুগের রাজপুণ্যাহ যে বর্তমান হালখাতা হিসাবে আজও বাঙালির জীবনে অমলিন হয়েই রয়ে গেছে তাতো এখন বলাই বাহুল্য। পরবর্তীকালে সময়ের বিবর্তনে পহেলা বৈশাখ পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলেমিশে আরও আনন্দময় ও উৎসবমুখর হয়ে ওঠেছে এবং সেই সাথে বাংলা নববর্ষ প্রতিটি বাঙালির জীবনে কল্যাণ ও নব জীবনের প্রতীক হয়ে বছরের একটি অন্যতম শুভ ও কল্যাণময় দিন হিসেবেও উদযাপন হয়ে আসছে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলা মাসের নামগুলো বিভিন্ন তারকারাজির নাম থেকে নেয়া হয়েছে। যেমন: বিশাখা থেকে বৈশাখ, জেষ্ঠ্যা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রইহনী থেকে অগ্রহায়ণ, পূষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফল্গুনি থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র। আগেকার দিনে অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটা শুরু হতো বলে এই মাসকে বছরের প্রথম মাস ধরা হতো। তাই এই মাসের নামই রাখা হয় অগ্রহায়ণ। অগ্র অর্থ প্রথম আর হায়ন অর্থ বর্ষ বা ধান। ‘ফসলি সন’ যখন প্রবর্তিত হয়, তখন কিন্তু ১২ মাসের নাম ছিল: কারওয়াদিন, আরদিভিহিসু, খারদাদ, তীর, আমরারদাদ, শাহরিয়ার, মিহির, আবান, আয়ুব, দায়, বাহমান ও ইসকান্দার মিয। পরবর্তী পর্যায়ে সেগুলো বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ ইত্যাদিতে রূপান্তরিত হয়।

বাংলা দিনপঞ্জির সাথে হিজরি ও খ্রিস্টীয় সালের মৌলিক পার্থক্য হলো হিজরি সাল চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সাল সূর্যের আবর্তনের হিসাবে চলে। এ কারণে হিজরি সালে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যাকালে নতুন চাঁদের আগমনে। খ্রিস্টীয় তারিখ শুরু হয় মধ্যরাতে। আর বাংলা সনের দিন শুরু হয় সূর্যোদয়ের সাথে সাথে। কাজেই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বর্তমান পরিচিতি পাওয়া পান্তা-ইলিশ খাওয়া বাঙালির পহেলা বৈশাখের উৎসব।

পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ইতোপূর্বে দেশে উৎসবের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় নানা অপশক্তি-অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হতে দেখা গেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা; যা ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নববর্ষ উদযাপন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সার্বজনীন উৎসবে। পহেলা বৈশাখের ভোরে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আয়োজনে মেতে ওঠে সারাদেশ। বিশ্বব্যাপি করোনা পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসায় এবার মনে হচ্ছে বৈশাখী উৎসবে মাতবে পুরোদেশ।

বরাবরের মতো বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে আজো বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে-শহরে বৈশাখী মেলা বসে। এসব মেলায় কৃষিজপণ্য, কুটিরশিল্প পণ্য, বাঁশের বেতের তৈজষপত্র, মৃৎ ও হস্তশিল্প পণ্যসহ নানা ধরনের আসবাবপত্র, মিষ্টান্ন, খেলনা সামগ্রী ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের ধুম পড়ে যায়। এছাড়াও মেলার সময় নাগরদোলা, সার্কাস, পুতুল নাচ, যাদুখেলা, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, বলী-কুস্তি খেলা, হা-ডু-ডু খেলা, লাঠি খেলা ইত্যাদি বিনোদন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে।

সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত ও যুগোপযোগী হিজরিভিত্তিক বাংলা সন নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য গৌরবের। আর বাঙালি জাতি হিসেবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ আমাদের প্রেরণার উৎস হিসেবে চির জাগরুক থাকুক এই প্রত্যাশা নিরন্তর।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ]

back to top