alt

মুক্ত আলোচনা

মুজিবনগর সরকার ও তাজউদ্দীন আহমদ এর ভূমিকা

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : শনিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২২

১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় বাঙালি জাতির মনে রাষ্ট্রশাসনের অভিপ্রায় জাগ্রত করে। কিন্তু ক্ষমতালোভী পাকিস্তানি শাসকবর্গ বাঙালিদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে একের পর এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ৭ তারিখে বাঙলি জাতির অবিসংবাদিত নেতা তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তার এই ভাষণে তিনি সুকৌশলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং দশ লাখ লোকের ওই গণসমাবেশে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু সেদিন সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে পাকিস্তানি সরকার সমাবেশে গুলিবর্ষণ করে অসংখ্য মানুষ হত্যা করত। এমনই পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানিদের। বঙ্গবন্ধু নিজেও সে-সম্পর্কে অবগত ছিলেন। বস্তুুতপক্ষে, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পরেই বাংলাদেশ পুরোপুরি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে শুরু করে। বাংলার মানুষ বুঝে ফেলে পাকিস্তানি সামরিক সরকার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তাই তারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীনতা-সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু চুপ করে বসে থাকেননি। তিনি ভবিষ্যতের ভয়াবহ যুদ্ধের কথা নানা মাধ্যম থেকে আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত চার সহযোগী, পরবর্তীতে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে নিয়ে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড গঠন করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হামলা চালানোর পর একই বছরের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। এদিন ঘোষিত ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়। ঘোষণাপত্রে সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে প্রজাতন্ত্রের উপ রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও তাজউদ্দীন আহমদ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীর উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন, যা আকাশবাণী থেকে একাধিকবার প্রচারিত হয়। তাজউদ্দীনের ভাষণের মধ্যদিয়েই দেশ-বিদেশের মানুষ জানতে পারে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে একটি আইনানুগ সরকার গঠিত হয়েছে। পথ পরিক্রমায় ১৭ এপ্রিল সকালে মুজিবনগর আ¤্রকাননে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরের দিন দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা এবং সংবাদ মাধ্যমে যে খবরটি ছাপা হয় তা হলো- ১৭ এপ্রিল শপথগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক সূচনা বা আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধানদের গার্ড অব অনার দিয়েছেন স্থানীয় আনসার ক্যাম্পের ১২ জন সদস্য। ১৭ এপ্রিল বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও তাঁর মন্ত্রিসভা আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেন। স্থানটি ছিল তৎকালীন মেহেরপুর মহাকুমার আম্রকুঞ্জঘেরা বৈদ্যনাথতলা। সাংবাদিকেরা বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী কোথায়, জিজ্ঞেস করলে তাজউদ্দীন বলেন, মুজিবনগর। সেই থেকে ২২ ডিসেম্বর ঢাকায় স্থানান্তর না হওয়া পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল বাংলাদেশের ঘোষিত রাজধানী। আর সরকারও পরিচিতি লাভ করে মুজিবনগরের নামে। তার সবটাই ছিল প্রতীকী অর্থে। আসলে সরকার পরিচালিত হতো কলকাতা হতে। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম কর্তব্য হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা, প্রশিক্ষণ দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বর্হিবিশ্বের সমর্থন আদায় এবং ভারতের সহায়তা নিশ্চিত করা।

প্রথমেই নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক দলিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাওয়া হয়। অপূর্ব এক ভাবগম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল তখন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেছি এবং তার পরামর্শক্রমে আরও তিনজনকে মন্ত্রীরূপে নিয়োগ করেছি।’ তারপর ঘোষণা করেন প্রধান সেনাপতি পদে কর্নেল ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে কর্নেল আবদুর রবের নাম। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর তাজউদ্দীন আহমদ অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় বক্তৃতায় বলেন, ‘পাকিস্তানি আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন।’ আমাদের শীর্ষ দুই নেতার এই দিকনির্দেশনা মূলক ভাষণ ছিল ঐতিহাসিক এবং অনন্য।

বিভিন্ন দলিল ও গবেষণায় দেখা যায়, দ্রুত মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম প্রসারিত করা এবং বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সমর্থন আদায়ে তাজউদ্দীন আহমদ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি মোশতাক ছাড়া মন্ত্রিসভার বাকি সদস্যদের সহযোগিতা পেয়েছেন। বিশেষভাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সব কাজেই তাঁকে সমর্থন জুগিয়েছেন। তাজউদ্দীন আহমদ নিশ্চয়ই ভারতীয়দের আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তিনি দেশের মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো আপস করেননি। দুটো উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ভারত ১৬ ডিসেম্বরের পর প্রশাসন চালানোর জন্য তাঁদের কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ঢাকায় পাঠাতে চেয়েছিল। যুক্তি ছিল, বাংলাদেশ সরকারে যাঁরা আছেন তাঁরা কনিষ্ঠ কর্মকর্তা। তাজউদ্দীন তাদের এ প্রস্তাবে নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘আমাদের কর্মকর্তারা ভালোভাবেই সরকার চালিয়েছেন। বাইরের লোক নেওয়ার প্রয়োজন নেই। মুজিবনগর সরকারের অন্য সদস্যরা কলকাতায় সপরিবার বাস করলেও তাজউদ্দীন ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি ৮ থিয়েটার রোডে নিজের অফিসের পাশে একটি ছোট্ট কক্ষে থাকতেন। নিজের কাপড় নিজে ধুতেন। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারক ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এক অর্থে একজন সাধারণ মানুষের জীবন যাপন করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে কীভাবে এই ‘প্রবাসী সরকার’ গঠিত হবে তা নিয়ে তাজউদ্দীন সাহেব খুবই চিন্তায় পড়েন। মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে এর প্রতিক্রিয়া কী হবে তা তাজউদ্দীন আহমদ অনুমান করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে প্রথম প্রথম কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলেন। সেদিন যদি সমস্ত অভিযোগ, অপমান সহ্য করে অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ মুজিবনগর সরকারের দপ্তর আগলে না রাখতেন, তাহলে বাংলাদেশ আজও স্বাধীন হতো কিনা সন্দেহ। ঢাকার তদানীন্তন ভারতীয় হাই কমিশনার সুবিমল দত্তকে তাজউদ্দীন আহমদ একবার একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কীভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি সুবিমল বাবুকে বলেছিলেন, ‘আমি অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে ধরনের নিঃসঙ্গতায় সেই ৯ মাস কাটিয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধুও সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে খুবই একাকিত্ব বোধে ভুগছেন। এক সময় যারা তার খুব কাছের লোক ছিল, আজ তারা তাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। অনেকে গেছে তাদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খার জন্য। কয়েকজন গেছে মতের অমিলের জন্য, যদিও তারা মন-প্রাণ দিয়ে তাকে ভালোবাসেন এবং তার জন্য তারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতেও রাজি। ‘মুজিবনগর সরকার’ গঠনের শুরু থেকেই খন্দকার মোশতাক ও শেখ ফজলুল হক মণি তাজউদ্দীন আহমদকে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা করেন। তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এসব সমস্যা মোকাবিলা করেন। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি যে পরিশ্রম করেন তা অবর্ণনীয়। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে মুজিবনগর সরকার যেমন বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের সহায়তা পেয়েছে, তেমনি ভেতরে-বাইরে বিরোধিতারও মুখোমুখি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মুসলিম দেশগুলো সরাসরি পাকিন্তানের পক্ষ নেয়। একাত্তরে চীন-মার্কিন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় দূতিয়ালির কাজ করে পাকিস্তান। ইউরোপের গণতান্ত্রিক দেশগুলোও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বিধাদ্বন্ধে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনো রাষ্ট্র ভেঙ্গে নতুন রাষ্ট্র গঠনের নজির ছিল না। নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে।

সেই জটিল ভূ-রাজনীতিতে অন্যতম বৃহৎ শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন জরুরি ছিল। একই সময় মুক্তিযুদ্ধকে বহুদলীয় চরিত্র দিতে আওয়ামী লীগ, ন্যাপের দুই অংশ, কমিউনিস্ট পার্টি ও জাতীয় কংগ্রেসকে নিয়ে গঠন করা হয় উপদেষ্টা পরিষদ। যদিও এর কোনো ভূমিকা ছিল না। ভারত-সোভিয়েত সহযোগিতা চুক্তি সই হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তাও বাড়তে থাকে। মুজিবনগর সরকার রণাঙ্গনের পাশাপাশি কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য পায়। কয়েক মাসের মধ্যে অধিকাংশ বাঙালি কূটনীতিক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে থাকেন। লন্ডনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্ব প্রবাসী বাঙালিদের আন্দোলন আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁকে করা হয় মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানমালা মুক্তিযোদ্ধা ও অবরুদ্ধ জনপদের মানুষকে দারুণভাবে আন্দোলিত করে।

মুক্তিযুদ্ধের কঠিন দুঃসময়ে ভারত আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। মিত্রবাহিনী গঠন করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় সৈনিকরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণোৎসর্গ করেছে। দেশ স্বাধীনের পর জাতির জনকের অনুরোধে ৭২-এর ১২ মার্চ তাদের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। ২০১৭-এর ১৭ এপ্রিল ৫১তম মুজিবনগর দিবসে আমাদের প্রত্যাশা, যে লক্ষ্য ও স্বপ্ন নিয়ে জাতির জনক বাংলাদেশকে স্বাধীন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করে গেছেন, সেই পথ ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলে দেশের মানুষের সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত হবে। জনপ্রতিনিধিদের ইচ্ছার শতভাগ প্রতিফলন ঘটিয়ে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রেখে, রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করে সেদিন রাষ্ট্র ও সরকার গঠিত হয়েছিল। আর এসব কিছুর বৈধ ভিত্তি ছিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’। পরে ৩০ লক্ষাধিক মানুষের রক্তস্নাত আত্মদান ও দুই লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সার্বিক সাফল্য নিশ্চিত হয়েছিল এই দিনটিতেই। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তথা ‘৭১-এর এপ্রিলের ১০ ও ১৭ তারিখে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল সাংবিধানিকভাবে রাজনৈতিক বৈধতা নিশ্চিত করে মুক্তিযুদ্ধ তথা জনযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে সুমহান বিজয় ছিনিয়ে আনা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই দিনের গুরুত্ব অপরিসীম।

১৯৭১ সালে ১০ ই এপ্রিল মাসে গঠিত সরকার এবং ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক শপথ এর মাধ্যমে মুজিবনগর সরকারের আনুষ্ঠানিক যত্রা শুরু হয়। প্রবাসী এই সরকারের প্রধান মন্ত্রি ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ এবং তার ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। মুজিবনগর সরকার ছিল মূলত প্রতীকি সরকার এবং তার সকল কাজকর্ম কলকাতা কেন্দ্রীক পরিচালিত হয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা অপরিসীম। মুজিবনগর সরকার ভারতের সহযোগিতায় দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী সফল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে বাংলাদেশকে পাক-হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করেছিল। এটি ছিল মুজিবনগর সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অতএব ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাস আমাদের জাতীয় জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ মাস বলে বিবেচিত হবে।

[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

মুজিবনগর সরকার ও তাজউদ্দীন আহমদ এর ভূমিকা

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

শনিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২২

১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় বাঙালি জাতির মনে রাষ্ট্রশাসনের অভিপ্রায় জাগ্রত করে। কিন্তু ক্ষমতালোভী পাকিস্তানি শাসকবর্গ বাঙালিদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে একের পর এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ৭ তারিখে বাঙলি জাতির অবিসংবাদিত নেতা তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তার এই ভাষণে তিনি সুকৌশলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং দশ লাখ লোকের ওই গণসমাবেশে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু সেদিন সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে পাকিস্তানি সরকার সমাবেশে গুলিবর্ষণ করে অসংখ্য মানুষ হত্যা করত। এমনই পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানিদের। বঙ্গবন্ধু নিজেও সে-সম্পর্কে অবগত ছিলেন। বস্তুুতপক্ষে, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পরেই বাংলাদেশ পুরোপুরি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে শুরু করে। বাংলার মানুষ বুঝে ফেলে পাকিস্তানি সামরিক সরকার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তাই তারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীনতা-সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু চুপ করে বসে থাকেননি। তিনি ভবিষ্যতের ভয়াবহ যুদ্ধের কথা নানা মাধ্যম থেকে আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত চার সহযোগী, পরবর্তীতে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে নিয়ে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড গঠন করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হামলা চালানোর পর একই বছরের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। এদিন ঘোষিত ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়। ঘোষণাপত্রে সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে প্রজাতন্ত্রের উপ রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও তাজউদ্দীন আহমদ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীর উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন, যা আকাশবাণী থেকে একাধিকবার প্রচারিত হয়। তাজউদ্দীনের ভাষণের মধ্যদিয়েই দেশ-বিদেশের মানুষ জানতে পারে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে একটি আইনানুগ সরকার গঠিত হয়েছে। পথ পরিক্রমায় ১৭ এপ্রিল সকালে মুজিবনগর আ¤্রকাননে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরের দিন দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা এবং সংবাদ মাধ্যমে যে খবরটি ছাপা হয় তা হলো- ১৭ এপ্রিল শপথগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক সূচনা বা আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধানদের গার্ড অব অনার দিয়েছেন স্থানীয় আনসার ক্যাম্পের ১২ জন সদস্য। ১৭ এপ্রিল বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও তাঁর মন্ত্রিসভা আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেন। স্থানটি ছিল তৎকালীন মেহেরপুর মহাকুমার আম্রকুঞ্জঘেরা বৈদ্যনাথতলা। সাংবাদিকেরা বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী কোথায়, জিজ্ঞেস করলে তাজউদ্দীন বলেন, মুজিবনগর। সেই থেকে ২২ ডিসেম্বর ঢাকায় স্থানান্তর না হওয়া পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল বাংলাদেশের ঘোষিত রাজধানী। আর সরকারও পরিচিতি লাভ করে মুজিবনগরের নামে। তার সবটাই ছিল প্রতীকী অর্থে। আসলে সরকার পরিচালিত হতো কলকাতা হতে। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম কর্তব্য হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা, প্রশিক্ষণ দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বর্হিবিশ্বের সমর্থন আদায় এবং ভারতের সহায়তা নিশ্চিত করা।

প্রথমেই নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক দলিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাওয়া হয়। অপূর্ব এক ভাবগম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল তখন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেছি এবং তার পরামর্শক্রমে আরও তিনজনকে মন্ত্রীরূপে নিয়োগ করেছি।’ তারপর ঘোষণা করেন প্রধান সেনাপতি পদে কর্নেল ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে কর্নেল আবদুর রবের নাম। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর তাজউদ্দীন আহমদ অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় বক্তৃতায় বলেন, ‘পাকিস্তানি আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন।’ আমাদের শীর্ষ দুই নেতার এই দিকনির্দেশনা মূলক ভাষণ ছিল ঐতিহাসিক এবং অনন্য।

বিভিন্ন দলিল ও গবেষণায় দেখা যায়, দ্রুত মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম প্রসারিত করা এবং বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সমর্থন আদায়ে তাজউদ্দীন আহমদ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি মোশতাক ছাড়া মন্ত্রিসভার বাকি সদস্যদের সহযোগিতা পেয়েছেন। বিশেষভাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সব কাজেই তাঁকে সমর্থন জুগিয়েছেন। তাজউদ্দীন আহমদ নিশ্চয়ই ভারতীয়দের আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তিনি দেশের মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো আপস করেননি। দুটো উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ভারত ১৬ ডিসেম্বরের পর প্রশাসন চালানোর জন্য তাঁদের কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ঢাকায় পাঠাতে চেয়েছিল। যুক্তি ছিল, বাংলাদেশ সরকারে যাঁরা আছেন তাঁরা কনিষ্ঠ কর্মকর্তা। তাজউদ্দীন তাদের এ প্রস্তাবে নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘আমাদের কর্মকর্তারা ভালোভাবেই সরকার চালিয়েছেন। বাইরের লোক নেওয়ার প্রয়োজন নেই। মুজিবনগর সরকারের অন্য সদস্যরা কলকাতায় সপরিবার বাস করলেও তাজউদ্দীন ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি ৮ থিয়েটার রোডে নিজের অফিসের পাশে একটি ছোট্ট কক্ষে থাকতেন। নিজের কাপড় নিজে ধুতেন। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারক ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এক অর্থে একজন সাধারণ মানুষের জীবন যাপন করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে কীভাবে এই ‘প্রবাসী সরকার’ গঠিত হবে তা নিয়ে তাজউদ্দীন সাহেব খুবই চিন্তায় পড়েন। মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে এর প্রতিক্রিয়া কী হবে তা তাজউদ্দীন আহমদ অনুমান করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে প্রথম প্রথম কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলেন। সেদিন যদি সমস্ত অভিযোগ, অপমান সহ্য করে অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ মুজিবনগর সরকারের দপ্তর আগলে না রাখতেন, তাহলে বাংলাদেশ আজও স্বাধীন হতো কিনা সন্দেহ। ঢাকার তদানীন্তন ভারতীয় হাই কমিশনার সুবিমল দত্তকে তাজউদ্দীন আহমদ একবার একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কীভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি সুবিমল বাবুকে বলেছিলেন, ‘আমি অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে ধরনের নিঃসঙ্গতায় সেই ৯ মাস কাটিয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধুও সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে খুবই একাকিত্ব বোধে ভুগছেন। এক সময় যারা তার খুব কাছের লোক ছিল, আজ তারা তাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। অনেকে গেছে তাদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খার জন্য। কয়েকজন গেছে মতের অমিলের জন্য, যদিও তারা মন-প্রাণ দিয়ে তাকে ভালোবাসেন এবং তার জন্য তারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতেও রাজি। ‘মুজিবনগর সরকার’ গঠনের শুরু থেকেই খন্দকার মোশতাক ও শেখ ফজলুল হক মণি তাজউদ্দীন আহমদকে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা করেন। তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এসব সমস্যা মোকাবিলা করেন। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি যে পরিশ্রম করেন তা অবর্ণনীয়। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে মুজিবনগর সরকার যেমন বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের সহায়তা পেয়েছে, তেমনি ভেতরে-বাইরে বিরোধিতারও মুখোমুখি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মুসলিম দেশগুলো সরাসরি পাকিন্তানের পক্ষ নেয়। একাত্তরে চীন-মার্কিন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় দূতিয়ালির কাজ করে পাকিস্তান। ইউরোপের গণতান্ত্রিক দেশগুলোও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বিধাদ্বন্ধে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনো রাষ্ট্র ভেঙ্গে নতুন রাষ্ট্র গঠনের নজির ছিল না। নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে।

সেই জটিল ভূ-রাজনীতিতে অন্যতম বৃহৎ শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন জরুরি ছিল। একই সময় মুক্তিযুদ্ধকে বহুদলীয় চরিত্র দিতে আওয়ামী লীগ, ন্যাপের দুই অংশ, কমিউনিস্ট পার্টি ও জাতীয় কংগ্রেসকে নিয়ে গঠন করা হয় উপদেষ্টা পরিষদ। যদিও এর কোনো ভূমিকা ছিল না। ভারত-সোভিয়েত সহযোগিতা চুক্তি সই হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তাও বাড়তে থাকে। মুজিবনগর সরকার রণাঙ্গনের পাশাপাশি কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য পায়। কয়েক মাসের মধ্যে অধিকাংশ বাঙালি কূটনীতিক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে থাকেন। লন্ডনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্ব প্রবাসী বাঙালিদের আন্দোলন আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁকে করা হয় মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানমালা মুক্তিযোদ্ধা ও অবরুদ্ধ জনপদের মানুষকে দারুণভাবে আন্দোলিত করে।

মুক্তিযুদ্ধের কঠিন দুঃসময়ে ভারত আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। মিত্রবাহিনী গঠন করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় সৈনিকরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণোৎসর্গ করেছে। দেশ স্বাধীনের পর জাতির জনকের অনুরোধে ৭২-এর ১২ মার্চ তাদের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। ২০১৭-এর ১৭ এপ্রিল ৫১তম মুজিবনগর দিবসে আমাদের প্রত্যাশা, যে লক্ষ্য ও স্বপ্ন নিয়ে জাতির জনক বাংলাদেশকে স্বাধীন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করে গেছেন, সেই পথ ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলে দেশের মানুষের সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত হবে। জনপ্রতিনিধিদের ইচ্ছার শতভাগ প্রতিফলন ঘটিয়ে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রেখে, রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করে সেদিন রাষ্ট্র ও সরকার গঠিত হয়েছিল। আর এসব কিছুর বৈধ ভিত্তি ছিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’। পরে ৩০ লক্ষাধিক মানুষের রক্তস্নাত আত্মদান ও দুই লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সার্বিক সাফল্য নিশ্চিত হয়েছিল এই দিনটিতেই। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তথা ‘৭১-এর এপ্রিলের ১০ ও ১৭ তারিখে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল সাংবিধানিকভাবে রাজনৈতিক বৈধতা নিশ্চিত করে মুক্তিযুদ্ধ তথা জনযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে সুমহান বিজয় ছিনিয়ে আনা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই দিনের গুরুত্ব অপরিসীম।

১৯৭১ সালে ১০ ই এপ্রিল মাসে গঠিত সরকার এবং ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক শপথ এর মাধ্যমে মুজিবনগর সরকারের আনুষ্ঠানিক যত্রা শুরু হয়। প্রবাসী এই সরকারের প্রধান মন্ত্রি ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ এবং তার ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। মুজিবনগর সরকার ছিল মূলত প্রতীকি সরকার এবং তার সকল কাজকর্ম কলকাতা কেন্দ্রীক পরিচালিত হয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা অপরিসীম। মুজিবনগর সরকার ভারতের সহযোগিতায় দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী সফল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে বাংলাদেশকে পাক-হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করেছিল। এটি ছিল মুজিবনগর সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অতএব ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাস আমাদের জাতীয় জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ মাস বলে বিবেচিত হবে।

[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী]

back to top