alt

মুক্ত আলোচনা

খাপড়া ওয়ার্ড শহীদ দিবস এবং দুই কৃষকের আত্নহত্যা

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

: শনিবার, ২৩ এপ্রিল ২০২২

২৪ এপ্রিল খাপড়া ওয়ার্ড শহীদ দিবস। ১৯৪৭ সালে কথিত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিÍতে উপমহাদেশ দুই ভাগে ভাগ হয়। বৃটিশ আমলে যে আন্দোলন গুলি চলে আসছিল , সেই আন্দোলনগুলির ধারা দেশ ভাগের পরও অব্যহত ছিল। যেমন ১৯৪৪ সাল থেকে হাট তোলা বিরোধী আন্দোলন , কৃষকদের তেভাগা আন্দোলনসহ নানা আন্দোলন। বিশেষ করে কৃষকদের তেভাগা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৫ থেকে আর এই কৃষক আন্দোলনের তীব্রতর হয়ে উঠে ১৯৫০ সালে। এদেশে বৃটিশ কতৃক জমিদার জোতদার সৃষ্টি হয়েছিল । খাজনা, হাটবাজারে টোল আদায় করতে গিয়ে জমিদাররা কৃষকদের উপর নানা ধরনের অত্যাচার করত। জোতদার ও জমিদাররা বর্গা চাষীদেরকে নায্য ফসলের ভাগ দিত না। বৃটিশ শাসনাধীন পুর্ব বাংলা একটি ছিল কৃষি প্রধান অঞ্চল ।

পুর্ব বাংলার ৯৫ ভাগ মানুষ সেই সময়ের কৃষি নির্ভরশীল। সরকারের ছত্রছায়ায় জমিদার, জোতদার মহাজনারা সাধারন কৃষক ও বর্গাচাষীদের উপর করত নানা প্রকারের জুলুম। জুলুমের হাত থেকে রক্ষা পেতে কৃষক নেতাদের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নতুন ভাবে সরকার গঠিত হলেও জুলমের ধারাটি বৃটিশদের ন্যায় অব্যহত থাকে। দেশ ভাগের পর নেতা কর্মী গ্রেফতারের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, পুর্ব বাংলার যে সমস্ত প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা কর্মী বৃটিশ তাড়ানো আন্দোলনে সক্রিয় ছিল, তাদেরকে পাকিস্তান সৃষ্টির পর শাসক সরকার পুনরায় গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়।১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে পুর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে রাজবন্দিদের রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত করে বিল পাস করা হয়। আর এই বিল পাসের মধ্য দিয়ে রাজবন্দিরে ষ্টেটাস বাতিল হয়ে যায়। তারাও সাধারন বন্দিতে পরিনত হন।

পাকিস্তান সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের সাধারন বন্দি বানানোর পর তাদের উপর চলে নানা ধরনের শারিরিক এবং মানসিক অত্যাচার।১৯৫০ সালের মার্চ মাসে রাজশাহী জেলের রাজবন্দি এবং সাধারন কয়েদিরা এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসেন। ঐদিনের আলোচনায় সকল বন্দিরা সর্ব সম্মত ভাবে একটি যুক্তদাবী নামা সরকারের কাছে পাঠায়। রাজশাহী জেরে সেই সময়ের ৫৫০ জন বন্দি যুক্তদাবী নামায় স্বাক্ষর করেন। কিন্তু সরকারী কতৃপক্ষ দাবী নামার বিষয়ে কোন আলোচনায় করেননি কারাবন্দীদের সাথে। উপরন্ত জেল কতৃপক্ষ বন্দি নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল খুব সকালে তৎকালীন রাজশাহীর কারাগারের জেলার মি. বিল আকস্মিক ভাবে পরিদর্শনে আসেন খাপড়া ওয়ার্ডে। বিল পরিদর্শনে এসে ওয়ার্ডের দরজা বন্ধ করে দেয় এবং অতর্কিত ভাবে কারা রক্ষীদের বন্দিদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়। তখন বন্দিরা থালা বাসন বিছানা পত্র দিয়ে বিলের কাপুরোষিত বর্বর আক্রমন প্রতিহত করা চেষ্টা করে। বাইরে অবস্থানরত বন্দিরা দৌড়ে খাপড়া ওয়ার্ডের দিকে আসতে শুরু করলে তাদেরকেও গুলি করা হয়। বিলের বর্বরোচিত আক্রমনে সাতজন কমিউনিষ্ট নেতা নিহত এবং প্রায় তেত্রিশ জন আহত হন। সাত জন নিহতরা হলেন খুলনার দেলোয়ার হোসেন, কুষ্টিয়ার হানিফ শেখ, ঢাকার সুধীন ধর, ময়মনসিংহের সুখেন ভট্টাচার্য, দিনাজপুরের কৃষক নেতা কম্পারাম সিং, রাজশাহীর কমিউনিষ্ট নেতা বিজন সেন, খুলনার আনোয়ার হোসেন। এই নিহত আহতদের জেল খানায় আটক করে রাখে পাকিস্তানী শাসকরা কৃষক আন্দোলনের অভিযোগে।

খাপড়া ওয়ার্ডে যারা বিদ্রোহ করেছিল তাদের অনেকেই বৃটিশ আমল থেকেই কারাগারে আটক ছিল। খাপড়া ওয়ার্ডের শাসকদের হাতে কৃষক নেতারা শহীদ হয়েছিলেন আজ থেকে ৭২ বছর আগে। ছয় যুগ পার হওয়ার পরও কি এদেশের কৃষকের মুক্তি মেলেছে ? কৃষক কি তার নায্য অধিকার পাচ্ছেন? দেশ স্বাধীন হয়েছে । জমিদারী প্রথা নাই একথা ঠিক তবে কৃষক শোষণ ও নীপীড়ন বেড়েছে বহুগুণ যা জমিদারী ব্যবস্থায়ও হত না। কৃষকের কাছ থেকে আট টাকা কেজি ধরে তরমুজ কিনে সেই তরমুজ ঢাকায় বিক্রি করা হয় ৬০ টাকা কেজি ধরে। কৃষকের উৎপাদিত কৃষি পণ্যের দাম হিসাব করলে এর কম চিত্রটি পাওয়া যায় প্রতিটি কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে। কৃষকের কাছ থেকে কেনা দামের পাচ থেকে ছয় গুণ বেশী মুল্যে ভোক্তার কাছে খাদ্যপণ্য বিক্রি হয় ।

এই পাচ থেকে ছয় গুণের মুনাফাটা কারা ভোগ করে ? এই বিপুল পরিমানের টাকা যায় কোথায় ? কৃষকদের সহায়তা করার জন্য সরকারী ভাবে গড়েে উঠেছে অনেক দপ্তর। এই দপ্তর গুলিরে কর্মীদের বেতন ভাতা এবং দপ্তর পরিচালনার ব্যায় ভার বহন করা হয় কৃষকের দেয়া রাজস্ব দিয়েই। প্রশ্ন হলো , এই দপ্তর গুলি কৃষকের জন্য কতটুকু কাজ করছে ? এর জবাবটা সরকারের দেয়া দরকার। বাংলাদেশের প্রধান শস্য ভা-ার হল বরেন্দ্র অঞ্চল। বরেন্দ্র ভুমির কৃষকের সার্বিক সহায়তা করার জন্য কৃষি মন্ত্রনালয়ের অধীন একটি সংস্থা গঠন করা হয় যার নাম “ বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কতৃপক্ষ”। এই অঞ্চলে বরেন্দ্র বহুমুখি কতৃপক্ষ গভীর নলকুপ স্থাপন করে। এই নলকুপ গুলির স্থাপন করা হয় কৃষকের জমিতে সেচের জন্য।

আজ থেকে দুই থেকে তিনশত বছর আগে বরেন্দ্র এলাকা কৃষি উপযোগী ছিল না। এই অঞ্চলকে কৃষি উপযোগী করার দ ইতিহাসটি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় , আজ যে বরেন্দ্র অঞ্চল শস্যপুর্ণা বসুধায় পরিণত হয়েছে , তা তা হয়েছে আদিবাসীদের পরিশ্রমে । এই আদিবাসী কৃষকরাই এখন এই অঞ্চলে ভুমিহীন, তারাই বর্গা চাষ করে জীবনযাপন করে। তেভাগা আন্দোলনের ফলে এখানকার বর্গাদাররা তিন ভাগের দুই ভাগ ফসল পায়। তবে ফসল উৎপাদনের জন্য যাবতীয় ব্যায় ভার বর্গাদারকেই বহন করতে হয়। পানির (সেচ) ব্যবস্থাটা বর্গাদারকেই করতে হচ্ছে। চৈত্র মাস বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রচ- খরার মৌসুম। এই সময়টায় ডিপের পানির উপর নির্ভর করা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকে না। রাজশাহী জেলার গোদাগড়ি উপজেলা বরেন্দ্রর একটি কৃষি প্রধান এলাকা।

গত ২১ মার্চ গোদাগাড়ী উপজলোর নিমঘটু গ্রামে সঠিক সময়ে ধানের জমিতে ডিপের পানি ( গভীর নল কুপের) না পেয়ে কৃষক অভিনাথ মারানডি ও রবি মারানডি আত্নহত্যা করেন। এই দুই কৃষককে আত্নহত্যার জন্য প্ররোচিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ এনে ২৫ মার্চ থানায় মামলা করে অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম। আত্নহত্যা প্ররোচনাকারী হিসাবে মুল আসামী করা হয় গভীর নলকুপের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনকে । সাখাওয়াত ঈশ্বরী পুর গ্রামের মৃত হারুনের ছেলে ও ওয়ার্ড কৃষক লীগের সভাপতি। বরেন্দ্র কতৃপক্ষের গভীর নলকুপের অপারেটরা বরাবরই আদিবাসীদের সাথে দুর্ব্যবহার করে আসছে। প্রায়ই দেখা যায় , বরেন্দ্র এলাকায় আদিবাসীদেরকে কটাক্ষ করে এমন এমন বাজে কথা বলে থাকে এরা , যা যে কোন মানুষের আত্ন সম্মানবোধে আঘাত লাগে। কতটা দুর্বব্যবহার পেয়েছিল অভিনাথ মারানডি ও রবি মারানডি তা হয়ত ভাষায় প্রকাশ করা যায়নি , সেই জন্যই হয়ত অপমান সহ্য করতে না পেরে এই দুই কৃষক আত্নহননের পথ বেছে নেন। গত ১৬ এপ্রিল মৃত দুই কৃষকের ময়না তদন্তের রিপোর্ট পেয়েছে পুলিশ। এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে , অর্গনো ফসফরাস যৌগ নামের কীটনাশক পানে তাদের মৃত্যু হয়েছে।

বরেন্দ্র উন্নয়ন কতৃপক্ষ বিষয়টি তদন্ত করে দেখছেন। গত ২ রা এপ্রিল সাখাওয়াতকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গোদাগাড়ি উপজেলার আদিবাসীরা নানা ধরনে নিগ্রহন ও উৎপীড়নের শিকার হন। তাদের নিয়ে এলাকার জনপ্রতিনিধিরাও ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে কথা বলতে দেখা যায়। তাই তদন্ত গুলি যথাযথ ভাবে যেন হয়। আর আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দায়ীকে দৃষ্টান্ত মুলক শাস্তি ব্যবস্থা যেন করেন, এটা এলাকার সাধারন মানুষের দাবী । খাপড়া ওয়াডেৃর দায়ী জেলারের কিছু হয়নি কারণ দেশ পরাধীন ছিল। এখন স্বাধীন দেশে অভিনাথ মারানডি ও রবি মারানডি আত্নহত্যার প্ররোচনাকারী ও দায়ীরা যেন বেকসুর খালাস না পায় সেই বিষয়টির দিকে কতৃপক্ষের সুদৃষ্টি দিতে হবে।

[লেখক: উন্নয়নকর্মী]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

খাপড়া ওয়ার্ড শহীদ দিবস এবং দুই কৃষকের আত্নহত্যা

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

শনিবার, ২৩ এপ্রিল ২০২২

২৪ এপ্রিল খাপড়া ওয়ার্ড শহীদ দিবস। ১৯৪৭ সালে কথিত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিÍতে উপমহাদেশ দুই ভাগে ভাগ হয়। বৃটিশ আমলে যে আন্দোলন গুলি চলে আসছিল , সেই আন্দোলনগুলির ধারা দেশ ভাগের পরও অব্যহত ছিল। যেমন ১৯৪৪ সাল থেকে হাট তোলা বিরোধী আন্দোলন , কৃষকদের তেভাগা আন্দোলনসহ নানা আন্দোলন। বিশেষ করে কৃষকদের তেভাগা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৫ থেকে আর এই কৃষক আন্দোলনের তীব্রতর হয়ে উঠে ১৯৫০ সালে। এদেশে বৃটিশ কতৃক জমিদার জোতদার সৃষ্টি হয়েছিল । খাজনা, হাটবাজারে টোল আদায় করতে গিয়ে জমিদাররা কৃষকদের উপর নানা ধরনের অত্যাচার করত। জোতদার ও জমিদাররা বর্গা চাষীদেরকে নায্য ফসলের ভাগ দিত না। বৃটিশ শাসনাধীন পুর্ব বাংলা একটি ছিল কৃষি প্রধান অঞ্চল ।

পুর্ব বাংলার ৯৫ ভাগ মানুষ সেই সময়ের কৃষি নির্ভরশীল। সরকারের ছত্রছায়ায় জমিদার, জোতদার মহাজনারা সাধারন কৃষক ও বর্গাচাষীদের উপর করত নানা প্রকারের জুলুম। জুলুমের হাত থেকে রক্ষা পেতে কৃষক নেতাদের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নতুন ভাবে সরকার গঠিত হলেও জুলমের ধারাটি বৃটিশদের ন্যায় অব্যহত থাকে। দেশ ভাগের পর নেতা কর্মী গ্রেফতারের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, পুর্ব বাংলার যে সমস্ত প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা কর্মী বৃটিশ তাড়ানো আন্দোলনে সক্রিয় ছিল, তাদেরকে পাকিস্তান সৃষ্টির পর শাসক সরকার পুনরায় গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়।১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে পুর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে রাজবন্দিদের রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত করে বিল পাস করা হয়। আর এই বিল পাসের মধ্য দিয়ে রাজবন্দিরে ষ্টেটাস বাতিল হয়ে যায়। তারাও সাধারন বন্দিতে পরিনত হন।

পাকিস্তান সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের সাধারন বন্দি বানানোর পর তাদের উপর চলে নানা ধরনের শারিরিক এবং মানসিক অত্যাচার।১৯৫০ সালের মার্চ মাসে রাজশাহী জেলের রাজবন্দি এবং সাধারন কয়েদিরা এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসেন। ঐদিনের আলোচনায় সকল বন্দিরা সর্ব সম্মত ভাবে একটি যুক্তদাবী নামা সরকারের কাছে পাঠায়। রাজশাহী জেরে সেই সময়ের ৫৫০ জন বন্দি যুক্তদাবী নামায় স্বাক্ষর করেন। কিন্তু সরকারী কতৃপক্ষ দাবী নামার বিষয়ে কোন আলোচনায় করেননি কারাবন্দীদের সাথে। উপরন্ত জেল কতৃপক্ষ বন্দি নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল খুব সকালে তৎকালীন রাজশাহীর কারাগারের জেলার মি. বিল আকস্মিক ভাবে পরিদর্শনে আসেন খাপড়া ওয়ার্ডে। বিল পরিদর্শনে এসে ওয়ার্ডের দরজা বন্ধ করে দেয় এবং অতর্কিত ভাবে কারা রক্ষীদের বন্দিদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়। তখন বন্দিরা থালা বাসন বিছানা পত্র দিয়ে বিলের কাপুরোষিত বর্বর আক্রমন প্রতিহত করা চেষ্টা করে। বাইরে অবস্থানরত বন্দিরা দৌড়ে খাপড়া ওয়ার্ডের দিকে আসতে শুরু করলে তাদেরকেও গুলি করা হয়। বিলের বর্বরোচিত আক্রমনে সাতজন কমিউনিষ্ট নেতা নিহত এবং প্রায় তেত্রিশ জন আহত হন। সাত জন নিহতরা হলেন খুলনার দেলোয়ার হোসেন, কুষ্টিয়ার হানিফ শেখ, ঢাকার সুধীন ধর, ময়মনসিংহের সুখেন ভট্টাচার্য, দিনাজপুরের কৃষক নেতা কম্পারাম সিং, রাজশাহীর কমিউনিষ্ট নেতা বিজন সেন, খুলনার আনোয়ার হোসেন। এই নিহত আহতদের জেল খানায় আটক করে রাখে পাকিস্তানী শাসকরা কৃষক আন্দোলনের অভিযোগে।

খাপড়া ওয়ার্ডে যারা বিদ্রোহ করেছিল তাদের অনেকেই বৃটিশ আমল থেকেই কারাগারে আটক ছিল। খাপড়া ওয়ার্ডের শাসকদের হাতে কৃষক নেতারা শহীদ হয়েছিলেন আজ থেকে ৭২ বছর আগে। ছয় যুগ পার হওয়ার পরও কি এদেশের কৃষকের মুক্তি মেলেছে ? কৃষক কি তার নায্য অধিকার পাচ্ছেন? দেশ স্বাধীন হয়েছে । জমিদারী প্রথা নাই একথা ঠিক তবে কৃষক শোষণ ও নীপীড়ন বেড়েছে বহুগুণ যা জমিদারী ব্যবস্থায়ও হত না। কৃষকের কাছ থেকে আট টাকা কেজি ধরে তরমুজ কিনে সেই তরমুজ ঢাকায় বিক্রি করা হয় ৬০ টাকা কেজি ধরে। কৃষকের উৎপাদিত কৃষি পণ্যের দাম হিসাব করলে এর কম চিত্রটি পাওয়া যায় প্রতিটি কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে। কৃষকের কাছ থেকে কেনা দামের পাচ থেকে ছয় গুণ বেশী মুল্যে ভোক্তার কাছে খাদ্যপণ্য বিক্রি হয় ।

এই পাচ থেকে ছয় গুণের মুনাফাটা কারা ভোগ করে ? এই বিপুল পরিমানের টাকা যায় কোথায় ? কৃষকদের সহায়তা করার জন্য সরকারী ভাবে গড়েে উঠেছে অনেক দপ্তর। এই দপ্তর গুলিরে কর্মীদের বেতন ভাতা এবং দপ্তর পরিচালনার ব্যায় ভার বহন করা হয় কৃষকের দেয়া রাজস্ব দিয়েই। প্রশ্ন হলো , এই দপ্তর গুলি কৃষকের জন্য কতটুকু কাজ করছে ? এর জবাবটা সরকারের দেয়া দরকার। বাংলাদেশের প্রধান শস্য ভা-ার হল বরেন্দ্র অঞ্চল। বরেন্দ্র ভুমির কৃষকের সার্বিক সহায়তা করার জন্য কৃষি মন্ত্রনালয়ের অধীন একটি সংস্থা গঠন করা হয় যার নাম “ বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কতৃপক্ষ”। এই অঞ্চলে বরেন্দ্র বহুমুখি কতৃপক্ষ গভীর নলকুপ স্থাপন করে। এই নলকুপ গুলির স্থাপন করা হয় কৃষকের জমিতে সেচের জন্য।

আজ থেকে দুই থেকে তিনশত বছর আগে বরেন্দ্র এলাকা কৃষি উপযোগী ছিল না। এই অঞ্চলকে কৃষি উপযোগী করার দ ইতিহাসটি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় , আজ যে বরেন্দ্র অঞ্চল শস্যপুর্ণা বসুধায় পরিণত হয়েছে , তা তা হয়েছে আদিবাসীদের পরিশ্রমে । এই আদিবাসী কৃষকরাই এখন এই অঞ্চলে ভুমিহীন, তারাই বর্গা চাষ করে জীবনযাপন করে। তেভাগা আন্দোলনের ফলে এখানকার বর্গাদাররা তিন ভাগের দুই ভাগ ফসল পায়। তবে ফসল উৎপাদনের জন্য যাবতীয় ব্যায় ভার বর্গাদারকেই বহন করতে হয়। পানির (সেচ) ব্যবস্থাটা বর্গাদারকেই করতে হচ্ছে। চৈত্র মাস বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রচ- খরার মৌসুম। এই সময়টায় ডিপের পানির উপর নির্ভর করা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকে না। রাজশাহী জেলার গোদাগড়ি উপজেলা বরেন্দ্রর একটি কৃষি প্রধান এলাকা।

গত ২১ মার্চ গোদাগাড়ী উপজলোর নিমঘটু গ্রামে সঠিক সময়ে ধানের জমিতে ডিপের পানি ( গভীর নল কুপের) না পেয়ে কৃষক অভিনাথ মারানডি ও রবি মারানডি আত্নহত্যা করেন। এই দুই কৃষককে আত্নহত্যার জন্য প্ররোচিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ এনে ২৫ মার্চ থানায় মামলা করে অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম। আত্নহত্যা প্ররোচনাকারী হিসাবে মুল আসামী করা হয় গভীর নলকুপের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনকে । সাখাওয়াত ঈশ্বরী পুর গ্রামের মৃত হারুনের ছেলে ও ওয়ার্ড কৃষক লীগের সভাপতি। বরেন্দ্র কতৃপক্ষের গভীর নলকুপের অপারেটরা বরাবরই আদিবাসীদের সাথে দুর্ব্যবহার করে আসছে। প্রায়ই দেখা যায় , বরেন্দ্র এলাকায় আদিবাসীদেরকে কটাক্ষ করে এমন এমন বাজে কথা বলে থাকে এরা , যা যে কোন মানুষের আত্ন সম্মানবোধে আঘাত লাগে। কতটা দুর্বব্যবহার পেয়েছিল অভিনাথ মারানডি ও রবি মারানডি তা হয়ত ভাষায় প্রকাশ করা যায়নি , সেই জন্যই হয়ত অপমান সহ্য করতে না পেরে এই দুই কৃষক আত্নহননের পথ বেছে নেন। গত ১৬ এপ্রিল মৃত দুই কৃষকের ময়না তদন্তের রিপোর্ট পেয়েছে পুলিশ। এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে , অর্গনো ফসফরাস যৌগ নামের কীটনাশক পানে তাদের মৃত্যু হয়েছে।

বরেন্দ্র উন্নয়ন কতৃপক্ষ বিষয়টি তদন্ত করে দেখছেন। গত ২ রা এপ্রিল সাখাওয়াতকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গোদাগাড়ি উপজেলার আদিবাসীরা নানা ধরনে নিগ্রহন ও উৎপীড়নের শিকার হন। তাদের নিয়ে এলাকার জনপ্রতিনিধিরাও ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে কথা বলতে দেখা যায়। তাই তদন্ত গুলি যথাযথ ভাবে যেন হয়। আর আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দায়ীকে দৃষ্টান্ত মুলক শাস্তি ব্যবস্থা যেন করেন, এটা এলাকার সাধারন মানুষের দাবী । খাপড়া ওয়াডেৃর দায়ী জেলারের কিছু হয়নি কারণ দেশ পরাধীন ছিল। এখন স্বাধীন দেশে অভিনাথ মারানডি ও রবি মারানডি আত্নহত্যার প্ররোচনাকারী ও দায়ীরা যেন বেকসুর খালাস না পায় সেই বিষয়টির দিকে কতৃপক্ষের সুদৃষ্টি দিতে হবে।

[লেখক: উন্নয়নকর্মী]

back to top