alt

মুক্ত আলোচনা

জ্বিন-ভুত-দৈত্য-দানো

আসফাক বীন রহমান

: রোববার, ২৪ এপ্রিল ২০২২

বিপর্যস্ত মিঃ শরীফ (ছোটমামার ভাষায় ডক্টর শেরীফ) নানা বাড়ির ড্রইং রুমের মেঝেতে দুই হাতের মাঝখানে মাথাটি কোনরকম তুলে ধরে আছেন । চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি । ডানে-বামে তাকাচ্ছেন । মাথার উপর ঘটর ঘটর করে ফ্যানটা ঘুরছে । আমরা দুইভাই জুরী বোর্ডের সম্মানিত সদস্য । বিচারক ছোটমামা এবং পাবলিক প্রসিকিউটর খোকন । দর্শক শ্রোতা হিসেবে আরও ২৩ জন উৎসুক হয়ে বিচারকার্য পর্যবেক্ষণ করছে । খোকনের ভাষ্য, “কাক্কা, শরীফ ভাই উনাদের সাথে বেদ্দবী করছে ; ইতার লাইগ্যাই তেনারা এই শাস্তি দিছেন”। মিঃ শরীফ শুধু মাথা নাড়ছেন আর মিনমিন করে ছোট মামাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন, ‘উনাদের’ সাথে কোন বেয়াদবী হয়নি । শুধু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছেন “কাহা ,আতকা আমার আত- পা টাডি লাইগ্যা গেছে ,ঘাড়ও ঘুরাইতাম পারতেছিলাম না , কি থ্যাইক্যা কী হইলো !” মাননীয় বিচারক জুরিবোর্ডের দুই সম্মানিত সদস্যকে পূর্বাপর ঘটনা বর্ণনা করলেন । শরীফ মিয়া প্রায়ই তাদের জন্য নির্ধারিত টয়লেট বাদ দিয়ে সন্ধ্যার পর এদিক-ওদিক ছোট কাজ সেড়ে ফেলেন । ইদানিং প্রায়ই বেল গাছের পাশে এই ঘটনা ঘটাচ্ছেন । এসব কারণেই বেল গাছে বাস করা ‘ওনারা’ তাকে হাত- পা-ঘাড় জ্যাম করে শাস্তি দিয়েছেন । খোকন বা বিচারকার্য পর্যবেক্ষণকারী কোন একজন দুষ্টুমি করে শরীফ মিয়াকে বেল গাছের গোড়ায় পিছন থেকে চেপে ধরায় গোঁ গোঁ করে শব্দ করে হাত-পা ছেড়ে দেন শরীফ মিয়া । ছোট মামা খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মানুষ । শরীফ মিয়া সন্ধ্যার পর রাতকানায় আক্রান্ত হওয়ায় এবং জ্বীন পরী নিয়ে তীব্র আতঙ্কের কারণে উনার জন্য নির্ধারিত নির্জন টয়লেটে যেতে ভয় পান। খালি পায়ে সন্ধ্যার পরে ঘরে ঘুরঘুর করেন ।

শরীফ মিয়ার সাথে আমাদের প্রথম পরিচয়টা খুব ইন্টারেস্টিং ছিল । নানাবাড়িতে গতবার বেড়াতে এসে প্রথম ঘণ্টাতেই শরীফ মিয়ার সাথে ছোটমামা আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন । “প্লিজ মিট উইথ ডঃ শেরীফ; ডক্টর শেরীফ ইন্টারনেশনাল ব্যক্তি , প্রায়ই হিল্লী- দিল্লী ঘুরতে যায়

।” লাজুক মুখে ডক্টর শেরীফ ফিক করে হাসি দিয়ে বলেন , “কাহা যে কী কয়”! ডক্টর শেরীফ কসবা /আখাউড়ার কোন একটি গ্রামের মানুষ । খুবই সরল সোজা ভালো মানুষ । ভারত সীমান্তবর্তী গ্রামের বাসিন্দা হওয়ায় আত্মীয়-স্বজনদের প্রায় সবাই ইধার কা মাল উধার সাপ্লাইয়ের ব্যবসায় করেন । চিনি- জিরা- কাপড় ইত্যাদি ‘আমদানী-রপ্তানী’ বিজনেস পছন্দ নয় শরীফ মিয়ার । তাই একজনকে ধরে ছোটমামার স্মরণাপন্ন হলে তাকে নানা বাসায় মালী হিসেবে পদায়ন করা হয় । কিন্তু মাসকাবারী বেতন আর বাড়ির জন্য চালের বস্তা পাঠিয়েও শরীফ মিয়া স্বস্তিতে থাকতে পারেন না । প্রায়ই ওনার বেটারহাফ এসে কাঁচা টাকার ব্যবসায় ফেরত নিয়ে যাওয়ার জন্য হুমকি ধামকি দেন ।

আমাদের নানা বাসা ব্রাহ্মণবাড়ীয়া শহরের প্রায় মাঝখানে মৌলভীপাড়ায় । বিশাল বাউন্ডারির এই বাসার দেয়াল বরাবর অসংখ্য নারকেল ও সুপারী গাছ । ভেতরের দিকে প্রচুর পরিমাণে আম, কাঁঠাল ,পেয়ারার সাথে সাথে আছে আতা ,জাম্বুরা, লেবু আর বেল গাছ

। বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসেবে একটি প্রাচীন কামরাঙ্গা গাছ । এর গুঁড়ির দিকটা ফোঁপরা ,বিশাল গর্ত এটাকে একটা অন্যরকম অবয়ব দিয়েছে । প্রচুর কামরাঙ্গা ধরে । অজ্ঞাত কারনে এত কামরাঙ্গা ধরার পরও আশেপাশের ছেলে-ছোকরারা এখানে ঢিল ছুঁড়ে না । অনেকের ধারণা এখানে ‘ওনারা’ অর্থাৎ জ্বীন-পরীরা থাকেন । সন্ধ্যার পর থেকে ফজর পর্যন্ত এই গাছকে ঘিরে ‘ওনাদের’ রাজত্ব । আসলে এরকম ছিল কিনা জানিনা তবে সন্ধ্যার পর আমরা দুইভাই কামরাঙ্গা গাছ সংলগ্ন ড্রইং রুমে একা আসতামনা । এর ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্যতা স্থাপন করার জন্য ‘সিরাজ মামা’কে উপস্থাপন করা হয়েছে । আমাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে তোমাদের ‘সিরাজ মামা’ এক রাতে বারান্দার বড় বেঞ্চটিতে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে যান ।

কিন্তু ফজরের আজান হওয়ার সাথে সাথেই উনি নিজেকে কামরাঙ্গা গাছের মাথায় দেখতে পান । আযান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই পপাত ধরণীতল । এজন্যই উনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন।

গতরাত থেকেই অল্প ছায়া ও শব্দে কেঁপে উঠছি । ছোট ভাই ইমনের সাথে চ্যালেঞ্জ করে ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’ বইটি রাতে পড়ছিলাম । এক তৃতীয়াংশ পড়ার আগেই নানাবাড়ির নির্জন আবহ,নারকেল পাতার সড়সড় শব্দ , পিছনের খালটির উপর দিয়ে ভেসে যাওয়া নৌকার শব্দে ভয়ে চোখ বন্ধ করে কানের উপর বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।সারারাত লাইটটি জ্বলছিল ।এমনিতেই আমরা দুই ভাই নানা বাসার পশ্চিম দিকের কামরাঙ্গা গাছটিকে নিয়ে অস্বস্তিতে থাকতাম , এবার গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া পূর্বদিকের বেলগাছ । সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হবার আর কোনো উপায় রাখলো না খোকন। কামরাঙ্গা গাছের জ্বীন -পরী আর বেল গাছের ব্রহ্মিদত্যিকে নিয়ে নানীর কাছে সঙ্কট উত্তরণে কোন ওঝা বা হুজুরের পরামর্শ চাইলে নানী পান খেতে খেতে বেশ কিছুক্ষণ হাসলেন। বললেন, “ভাইয়া তোমরা ভয় পেয়ো না, তোমরা ঢাকার মেহমান । তোমাদেরকে ওরা কোনো ক্ষতি করবে না; আর খোকইন্যা শয়তানকে এখানে পাঠাও , দেখি ব্রহ্মিদত্যির কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় ?” পরদিন নানাকে বলে কামরাঙ্গা ও বেল গাছের পাশে বাল্বের ব্যবস্থা করে দেন ।

নানাবাড়ীর জ্বীন- ব্রহ্মিদত্যির সাথে সাথে দাদাবাড়ী জালশুকায় রয়েছে পেত্নী-জ্বীন আর মাইচ্ছা ভুতের (মেছোভুত) কান্ড- কারখানা । আমাদের জালশুকা গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে পাগলা নদীর পাড়ে যে শ্মশানটি রয়েছে সেটিকে ঘিরে বিভিন্ন কাহিনী রয়েছে ।গ্রামের কুমোরবাড়ীর একটু পশ্চিমে ঘিয়ারা চকে এই পঞ্চবটী শ্মশান । এখানে নদীটি একটা বিশাল বাঁক নিয়েছে । বিরাট বিরাট বটগাছ ,কদমগাছ এখানে একটা অন্ধকারাছন্ন পরিবেশ তৈরি করেছে । এমনিতেই শ্মশান , তার উপর বিশাল গাছ ও নদীতীরের নির্জনতা এখানের বট-কদম গাছে মাইচ্ছাভুত আর পেত্নীদের রাম-রাজত্বের গল্প তৈরি করেছে । আমরা সরাসরি পেত্নী -ভুতের পাল্লায় না পড়লেও ভরদুপুরে কখনো কখনো গোঁসাইপুর ঘাট থেকে বাড়ীর দিকে যাবার সময় আমাদের বাড়ীর বছরকালীন কৃষক নুরুমিয়া পশ্চিম দিকে তাকাতে নিষেধ করতেন ।নদীর ঐ বাঁকে অস্বাভাবিক বড় বড় বোয়াল -আইর মাছ পাওয়া যেতো । আর আমাদের বাড়ীর দালানের উত্তর দিকের খন্না (খন্দকার) বাড়ীর খালের পাশে বাঁশঝাড়ের মধ্যিখানে রয়েছে প্রাচীন এক পাকুড় গাছ । গাছটির গোড়ায় অনেক পুরনো আমলের ইটের তৈরি ঘর ছিল । পাকুড় গাছের গুঁড়ির ফাঁকা জায়গা থেকে ঘরটি উঠেছে নাকি ঘরের উপর পাকুড় গাছটি হয়েছে এটাই মাঝে মাঝে মনে হতো । এটি দরগাবাড়ি । দক্ষিণে প্রাথমিক স্কুল ,পুবদিকে একটি কচুরিপানা ভরা বড় পুকুর ,পশ্চিমে খাল ও উত্তরের বাঁশঝাড়ের কারণে সন্ধ্যার পর থেকেই এর আশেপাশের এলাকাতে কেউ যেতো না । মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় ওই ঘরে কেউ মোমবাতি জ্বালিয়ে যেতো । সন্ধ্যার পর আশেপাশে শিয়ালের হুক্কাহুয়া আর বড় কুবোপাখির (কুকপাখি) উক উক -কুপ কুপ অলুক্ষণে ডাকের সাথে সাথে মাঝে মাঝে থেমে যাওয়া ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ আতঙ্ক ছড়াতো। প্রতি মাঘের প্রথমদিকে বান্নি বসতো । এক সন্ধ্যায় মেশিনঘরের কুদ্দুস ভাই মুরগি খুঁজতে গিয়ে কিছু একটা দেখে খুব ভয় পান । পরদিন মারা যাওয়ায় ঐ দরগাবাড়ীর জ্বীনের গল্পটি আরো পোক্ত হয় ।

ঢাকায় আমাদের আজিমপুরের বাসাও কম নয় । নাম আজিমপুর কলোনী, কিন্তু পাবলিক একনামে চিনে আজিমপুর গোরস্থান হিসেবে । কলোনীতে প্রচুর গাছপালা ও বাগান থাকায় গভীর রাতে জানালা দিয়ে দূরে তাকাতে ভয় লাগত; এই কোন জ্বীন বা অতৃপ্ত আত্মা এসে না ধরে ! রাতে একবার দুইবার টয়লেটে যেতে হতো । প্রতিদিন আব্বা-আম্মাকে বিরক্ত করতে মন চাইতো না । এক ভাই অন্য ভাইকেও ডাকতে স্বস্তি পেতাম না । একজন সাহায্য চাইলেও টয়লেট থেকে অন্যজন বের হওয়ার আগেই সব লাইট বন্ধ করে ‘হাউ’ করে ভয় দেখানোর কারণে কোন একটা উপায় খুঁজতে লাগলাম । এই ফ্রীজ, ফ্রীজের পর ডাইনিং রুমের বাম দিকে মীটসেফ আর ডানদিকের ডাইনিং টেবিল- চেয়ার আমাদের চিরচেনা । মীটসেফ পেরুলে একটি রেক আর রেকের ডানদিকেই টয়লেটের সুইচ । এটা আমাদের হাজার বারের চেনা পথ । তাই চোখ খুললেই যাতে ভুত বা অতৃপ্ত আত্মাকে দেখতে না হয় সেজন্য চোখ বন্ধ করে আস্তে আস্তে টয়লেট পর্যন্ত হাতড়ে হাতড়ে চলে যাওয়া এবং ফেরত আসার কারণে আজিমপুরের ভুত বা অতৃপ্ত আত্মার মুখোমুখি কখনো পড়িনি ।

রাত তখন দেড়টা । হঠাৎ করে গগনবিদারী চিৎকার । চিৎকারটি আসছে হোস্টেলের উত্তর -পশ্চিম প্রান্তের জিমনেসিয়ামের ওপার হতে । জিমনেসিয়ামে কয়দিন ধরে পুলিশ ছিলো । কয়দিন আগে গন্ডগোলের কারণে সেখানে উনাদের পোস্টিং দেওয়া হয়েছে । এই ধরনের চিৎকারে বারান্দা থেকে আমরা উঁকিঝুঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম ‘কেইসটা কি?’ মেডিকেল কলেজের মুক্তা হোস্টেলের চারতলায় থাকতাম । মুক্তা- পিন্নু হোস্টেলের পশ্চিম দিকে ঢাকা- দিনাজপুর মহাসড়ক । আশেপাশে হাজীপাড়াসহ গ্রামীণ এলাকা । হোস্টেলের বিশাল মাঠের একপাশে জিমনেসিয়াম । জিমনেসিয়ামের পশ্চিমে রাস্তা, আর রাস্তার পশ্চিমে বিশাল কয়েকটি শিমুল গাছ । এই কাটাওয়ালা গাছের তুলার কারণে বছরের একটা সময় আমরা দরজা জানালা খুলতে পারতাম না । কিন্তু ,মূল বিষয় শিমুল গাছগুলোর নিচে হাসপাতালের লাশ কাটা ঘর (মর্গ) । মর্গের দক্ষিনে জেলখানার সীমানায় মেহগনি বাগানের ফাঁকে ফাঁকে হলুদের চাষ আর পশ্চিমে নিচু এলাকায় মাঝে মাঝে পাট চাষ হতো । দিনের বেলাতেই ছমছমে পরিবেশ । সন্ধ্যার পর কোন রিকশাওয়ালাকে সিও বাজার সংলগ্ন হেলিপোর্ট হোস্টেলে নেওয়া যেতো না । ‘উনারা ধরবেন’। হোস্টেল সংক্রান্ত কোনো ঘটনা না হওয়ায় গুটি গুটি পায়ে অনেকেই কাউসার হোটেল বরাবর গেটে জড়ো হলাম । পুলিশ সদস্যরাও কনফিউজড । সড়কের উপর একজন মানুষকে পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে উনার শুশ্রূষা করতে পুলিশ সদস্যরা এগিয়ে যান । এক ভদ্রলোক অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছেন, মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে । দ্রুত ইমার্জেন্সিতে নেয়া হয় । এক দেড় ঘণ্টা পর উনার পরিচয় জানালেন পুলিশ সদস্যরা । উনি একজন জেল পুলিশ । রাতে একটু দেরি করে ডিউটি শেষে সিওবাজারের বাসায় ফিরছিলেন । মর্গের কাছাকাছি আসতেই প্রায় দুই তলা লম্বা হলুদ শাড়ি পরা এক মহিলার নাচানাচি দেখে উনি অজ্ঞান । ‘দুই তলা সমান লম্বা হলুদ শাড়ি পরা মহিলা’র খোঁজ নিতে উপস্থিত ছাত্র বা পুলিশদের খুব একটা উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না । সবারই চিন্তা দ্রুত যার যার অবস্থানে ফিরে যাওয়া । কিছুক্ষণ পর পিন্নু হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেটখেকো এক পরীক্ষার্থী বড় ভাই রহস্যের গিঁট খুললেন। রাস্তার দুই দিকের দুইটা আম গাছের সাথে একটা ব্যানার লাগানো ছিল । বাসের / ট্রাকের কারণে একটা পাশ ছিড়ে যায় । দূর থেকে অন্য গাছের মাথা থেকে বাতাসে দুলতে থাকা ব্যানারটিই “দুই তলা সমান লম্বা হলুদ শাড়ি পড়া মহিলা” ।

বিশাল বিশাল বট-পাকুড়- শিমুলগাছ , আলো-ছায়ার খেলা , নির্জনতা অনেক সময়েই আমাদের মনের গভীর ভিতর থেকে টেনে বের করে নানা ধরনের কুসংস্কার ।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ]

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

বিশ্ব শিক্ষক দিবস : শিক্ষা পুনরুদ্ধারে শিক্ষকদের চ্যালেঞ্জ

tab

মুক্ত আলোচনা

জ্বিন-ভুত-দৈত্য-দানো

আসফাক বীন রহমান

রোববার, ২৪ এপ্রিল ২০২২

বিপর্যস্ত মিঃ শরীফ (ছোটমামার ভাষায় ডক্টর শেরীফ) নানা বাড়ির ড্রইং রুমের মেঝেতে দুই হাতের মাঝখানে মাথাটি কোনরকম তুলে ধরে আছেন । চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি । ডানে-বামে তাকাচ্ছেন । মাথার উপর ঘটর ঘটর করে ফ্যানটা ঘুরছে । আমরা দুইভাই জুরী বোর্ডের সম্মানিত সদস্য । বিচারক ছোটমামা এবং পাবলিক প্রসিকিউটর খোকন । দর্শক শ্রোতা হিসেবে আরও ২৩ জন উৎসুক হয়ে বিচারকার্য পর্যবেক্ষণ করছে । খোকনের ভাষ্য, “কাক্কা, শরীফ ভাই উনাদের সাথে বেদ্দবী করছে ; ইতার লাইগ্যাই তেনারা এই শাস্তি দিছেন”। মিঃ শরীফ শুধু মাথা নাড়ছেন আর মিনমিন করে ছোট মামাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন, ‘উনাদের’ সাথে কোন বেয়াদবী হয়নি । শুধু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছেন “কাহা ,আতকা আমার আত- পা টাডি লাইগ্যা গেছে ,ঘাড়ও ঘুরাইতাম পারতেছিলাম না , কি থ্যাইক্যা কী হইলো !” মাননীয় বিচারক জুরিবোর্ডের দুই সম্মানিত সদস্যকে পূর্বাপর ঘটনা বর্ণনা করলেন । শরীফ মিয়া প্রায়ই তাদের জন্য নির্ধারিত টয়লেট বাদ দিয়ে সন্ধ্যার পর এদিক-ওদিক ছোট কাজ সেড়ে ফেলেন । ইদানিং প্রায়ই বেল গাছের পাশে এই ঘটনা ঘটাচ্ছেন । এসব কারণেই বেল গাছে বাস করা ‘ওনারা’ তাকে হাত- পা-ঘাড় জ্যাম করে শাস্তি দিয়েছেন । খোকন বা বিচারকার্য পর্যবেক্ষণকারী কোন একজন দুষ্টুমি করে শরীফ মিয়াকে বেল গাছের গোড়ায় পিছন থেকে চেপে ধরায় গোঁ গোঁ করে শব্দ করে হাত-পা ছেড়ে দেন শরীফ মিয়া । ছোট মামা খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মানুষ । শরীফ মিয়া সন্ধ্যার পর রাতকানায় আক্রান্ত হওয়ায় এবং জ্বীন পরী নিয়ে তীব্র আতঙ্কের কারণে উনার জন্য নির্ধারিত নির্জন টয়লেটে যেতে ভয় পান। খালি পায়ে সন্ধ্যার পরে ঘরে ঘুরঘুর করেন ।

শরীফ মিয়ার সাথে আমাদের প্রথম পরিচয়টা খুব ইন্টারেস্টিং ছিল । নানাবাড়িতে গতবার বেড়াতে এসে প্রথম ঘণ্টাতেই শরীফ মিয়ার সাথে ছোটমামা আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন । “প্লিজ মিট উইথ ডঃ শেরীফ; ডক্টর শেরীফ ইন্টারনেশনাল ব্যক্তি , প্রায়ই হিল্লী- দিল্লী ঘুরতে যায়

।” লাজুক মুখে ডক্টর শেরীফ ফিক করে হাসি দিয়ে বলেন , “কাহা যে কী কয়”! ডক্টর শেরীফ কসবা /আখাউড়ার কোন একটি গ্রামের মানুষ । খুবই সরল সোজা ভালো মানুষ । ভারত সীমান্তবর্তী গ্রামের বাসিন্দা হওয়ায় আত্মীয়-স্বজনদের প্রায় সবাই ইধার কা মাল উধার সাপ্লাইয়ের ব্যবসায় করেন । চিনি- জিরা- কাপড় ইত্যাদি ‘আমদানী-রপ্তানী’ বিজনেস পছন্দ নয় শরীফ মিয়ার । তাই একজনকে ধরে ছোটমামার স্মরণাপন্ন হলে তাকে নানা বাসায় মালী হিসেবে পদায়ন করা হয় । কিন্তু মাসকাবারী বেতন আর বাড়ির জন্য চালের বস্তা পাঠিয়েও শরীফ মিয়া স্বস্তিতে থাকতে পারেন না । প্রায়ই ওনার বেটারহাফ এসে কাঁচা টাকার ব্যবসায় ফেরত নিয়ে যাওয়ার জন্য হুমকি ধামকি দেন ।

আমাদের নানা বাসা ব্রাহ্মণবাড়ীয়া শহরের প্রায় মাঝখানে মৌলভীপাড়ায় । বিশাল বাউন্ডারির এই বাসার দেয়াল বরাবর অসংখ্য নারকেল ও সুপারী গাছ । ভেতরের দিকে প্রচুর পরিমাণে আম, কাঁঠাল ,পেয়ারার সাথে সাথে আছে আতা ,জাম্বুরা, লেবু আর বেল গাছ

। বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসেবে একটি প্রাচীন কামরাঙ্গা গাছ । এর গুঁড়ির দিকটা ফোঁপরা ,বিশাল গর্ত এটাকে একটা অন্যরকম অবয়ব দিয়েছে । প্রচুর কামরাঙ্গা ধরে । অজ্ঞাত কারনে এত কামরাঙ্গা ধরার পরও আশেপাশের ছেলে-ছোকরারা এখানে ঢিল ছুঁড়ে না । অনেকের ধারণা এখানে ‘ওনারা’ অর্থাৎ জ্বীন-পরীরা থাকেন । সন্ধ্যার পর থেকে ফজর পর্যন্ত এই গাছকে ঘিরে ‘ওনাদের’ রাজত্ব । আসলে এরকম ছিল কিনা জানিনা তবে সন্ধ্যার পর আমরা দুইভাই কামরাঙ্গা গাছ সংলগ্ন ড্রইং রুমে একা আসতামনা । এর ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্যতা স্থাপন করার জন্য ‘সিরাজ মামা’কে উপস্থাপন করা হয়েছে । আমাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে তোমাদের ‘সিরাজ মামা’ এক রাতে বারান্দার বড় বেঞ্চটিতে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে যান ।

কিন্তু ফজরের আজান হওয়ার সাথে সাথেই উনি নিজেকে কামরাঙ্গা গাছের মাথায় দেখতে পান । আযান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই পপাত ধরণীতল । এজন্যই উনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন।

গতরাত থেকেই অল্প ছায়া ও শব্দে কেঁপে উঠছি । ছোট ভাই ইমনের সাথে চ্যালেঞ্জ করে ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’ বইটি রাতে পড়ছিলাম । এক তৃতীয়াংশ পড়ার আগেই নানাবাড়ির নির্জন আবহ,নারকেল পাতার সড়সড় শব্দ , পিছনের খালটির উপর দিয়ে ভেসে যাওয়া নৌকার শব্দে ভয়ে চোখ বন্ধ করে কানের উপর বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।সারারাত লাইটটি জ্বলছিল ।এমনিতেই আমরা দুই ভাই নানা বাসার পশ্চিম দিকের কামরাঙ্গা গাছটিকে নিয়ে অস্বস্তিতে থাকতাম , এবার গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া পূর্বদিকের বেলগাছ । সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হবার আর কোনো উপায় রাখলো না খোকন। কামরাঙ্গা গাছের জ্বীন -পরী আর বেল গাছের ব্রহ্মিদত্যিকে নিয়ে নানীর কাছে সঙ্কট উত্তরণে কোন ওঝা বা হুজুরের পরামর্শ চাইলে নানী পান খেতে খেতে বেশ কিছুক্ষণ হাসলেন। বললেন, “ভাইয়া তোমরা ভয় পেয়ো না, তোমরা ঢাকার মেহমান । তোমাদেরকে ওরা কোনো ক্ষতি করবে না; আর খোকইন্যা শয়তানকে এখানে পাঠাও , দেখি ব্রহ্মিদত্যির কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় ?” পরদিন নানাকে বলে কামরাঙ্গা ও বেল গাছের পাশে বাল্বের ব্যবস্থা করে দেন ।

নানাবাড়ীর জ্বীন- ব্রহ্মিদত্যির সাথে সাথে দাদাবাড়ী জালশুকায় রয়েছে পেত্নী-জ্বীন আর মাইচ্ছা ভুতের (মেছোভুত) কান্ড- কারখানা । আমাদের জালশুকা গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে পাগলা নদীর পাড়ে যে শ্মশানটি রয়েছে সেটিকে ঘিরে বিভিন্ন কাহিনী রয়েছে ।গ্রামের কুমোরবাড়ীর একটু পশ্চিমে ঘিয়ারা চকে এই পঞ্চবটী শ্মশান । এখানে নদীটি একটা বিশাল বাঁক নিয়েছে । বিরাট বিরাট বটগাছ ,কদমগাছ এখানে একটা অন্ধকারাছন্ন পরিবেশ তৈরি করেছে । এমনিতেই শ্মশান , তার উপর বিশাল গাছ ও নদীতীরের নির্জনতা এখানের বট-কদম গাছে মাইচ্ছাভুত আর পেত্নীদের রাম-রাজত্বের গল্প তৈরি করেছে । আমরা সরাসরি পেত্নী -ভুতের পাল্লায় না পড়লেও ভরদুপুরে কখনো কখনো গোঁসাইপুর ঘাট থেকে বাড়ীর দিকে যাবার সময় আমাদের বাড়ীর বছরকালীন কৃষক নুরুমিয়া পশ্চিম দিকে তাকাতে নিষেধ করতেন ।নদীর ঐ বাঁকে অস্বাভাবিক বড় বড় বোয়াল -আইর মাছ পাওয়া যেতো । আর আমাদের বাড়ীর দালানের উত্তর দিকের খন্না (খন্দকার) বাড়ীর খালের পাশে বাঁশঝাড়ের মধ্যিখানে রয়েছে প্রাচীন এক পাকুড় গাছ । গাছটির গোড়ায় অনেক পুরনো আমলের ইটের তৈরি ঘর ছিল । পাকুড় গাছের গুঁড়ির ফাঁকা জায়গা থেকে ঘরটি উঠেছে নাকি ঘরের উপর পাকুড় গাছটি হয়েছে এটাই মাঝে মাঝে মনে হতো । এটি দরগাবাড়ি । দক্ষিণে প্রাথমিক স্কুল ,পুবদিকে একটি কচুরিপানা ভরা বড় পুকুর ,পশ্চিমে খাল ও উত্তরের বাঁশঝাড়ের কারণে সন্ধ্যার পর থেকেই এর আশেপাশের এলাকাতে কেউ যেতো না । মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় ওই ঘরে কেউ মোমবাতি জ্বালিয়ে যেতো । সন্ধ্যার পর আশেপাশে শিয়ালের হুক্কাহুয়া আর বড় কুবোপাখির (কুকপাখি) উক উক -কুপ কুপ অলুক্ষণে ডাকের সাথে সাথে মাঝে মাঝে থেমে যাওয়া ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ আতঙ্ক ছড়াতো। প্রতি মাঘের প্রথমদিকে বান্নি বসতো । এক সন্ধ্যায় মেশিনঘরের কুদ্দুস ভাই মুরগি খুঁজতে গিয়ে কিছু একটা দেখে খুব ভয় পান । পরদিন মারা যাওয়ায় ঐ দরগাবাড়ীর জ্বীনের গল্পটি আরো পোক্ত হয় ।

ঢাকায় আমাদের আজিমপুরের বাসাও কম নয় । নাম আজিমপুর কলোনী, কিন্তু পাবলিক একনামে চিনে আজিমপুর গোরস্থান হিসেবে । কলোনীতে প্রচুর গাছপালা ও বাগান থাকায় গভীর রাতে জানালা দিয়ে দূরে তাকাতে ভয় লাগত; এই কোন জ্বীন বা অতৃপ্ত আত্মা এসে না ধরে ! রাতে একবার দুইবার টয়লেটে যেতে হতো । প্রতিদিন আব্বা-আম্মাকে বিরক্ত করতে মন চাইতো না । এক ভাই অন্য ভাইকেও ডাকতে স্বস্তি পেতাম না । একজন সাহায্য চাইলেও টয়লেট থেকে অন্যজন বের হওয়ার আগেই সব লাইট বন্ধ করে ‘হাউ’ করে ভয় দেখানোর কারণে কোন একটা উপায় খুঁজতে লাগলাম । এই ফ্রীজ, ফ্রীজের পর ডাইনিং রুমের বাম দিকে মীটসেফ আর ডানদিকের ডাইনিং টেবিল- চেয়ার আমাদের চিরচেনা । মীটসেফ পেরুলে একটি রেক আর রেকের ডানদিকেই টয়লেটের সুইচ । এটা আমাদের হাজার বারের চেনা পথ । তাই চোখ খুললেই যাতে ভুত বা অতৃপ্ত আত্মাকে দেখতে না হয় সেজন্য চোখ বন্ধ করে আস্তে আস্তে টয়লেট পর্যন্ত হাতড়ে হাতড়ে চলে যাওয়া এবং ফেরত আসার কারণে আজিমপুরের ভুত বা অতৃপ্ত আত্মার মুখোমুখি কখনো পড়িনি ।

রাত তখন দেড়টা । হঠাৎ করে গগনবিদারী চিৎকার । চিৎকারটি আসছে হোস্টেলের উত্তর -পশ্চিম প্রান্তের জিমনেসিয়ামের ওপার হতে । জিমনেসিয়ামে কয়দিন ধরে পুলিশ ছিলো । কয়দিন আগে গন্ডগোলের কারণে সেখানে উনাদের পোস্টিং দেওয়া হয়েছে । এই ধরনের চিৎকারে বারান্দা থেকে আমরা উঁকিঝুঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম ‘কেইসটা কি?’ মেডিকেল কলেজের মুক্তা হোস্টেলের চারতলায় থাকতাম । মুক্তা- পিন্নু হোস্টেলের পশ্চিম দিকে ঢাকা- দিনাজপুর মহাসড়ক । আশেপাশে হাজীপাড়াসহ গ্রামীণ এলাকা । হোস্টেলের বিশাল মাঠের একপাশে জিমনেসিয়াম । জিমনেসিয়ামের পশ্চিমে রাস্তা, আর রাস্তার পশ্চিমে বিশাল কয়েকটি শিমুল গাছ । এই কাটাওয়ালা গাছের তুলার কারণে বছরের একটা সময় আমরা দরজা জানালা খুলতে পারতাম না । কিন্তু ,মূল বিষয় শিমুল গাছগুলোর নিচে হাসপাতালের লাশ কাটা ঘর (মর্গ) । মর্গের দক্ষিনে জেলখানার সীমানায় মেহগনি বাগানের ফাঁকে ফাঁকে হলুদের চাষ আর পশ্চিমে নিচু এলাকায় মাঝে মাঝে পাট চাষ হতো । দিনের বেলাতেই ছমছমে পরিবেশ । সন্ধ্যার পর কোন রিকশাওয়ালাকে সিও বাজার সংলগ্ন হেলিপোর্ট হোস্টেলে নেওয়া যেতো না । ‘উনারা ধরবেন’। হোস্টেল সংক্রান্ত কোনো ঘটনা না হওয়ায় গুটি গুটি পায়ে অনেকেই কাউসার হোটেল বরাবর গেটে জড়ো হলাম । পুলিশ সদস্যরাও কনফিউজড । সড়কের উপর একজন মানুষকে পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে উনার শুশ্রূষা করতে পুলিশ সদস্যরা এগিয়ে যান । এক ভদ্রলোক অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছেন, মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে । দ্রুত ইমার্জেন্সিতে নেয়া হয় । এক দেড় ঘণ্টা পর উনার পরিচয় জানালেন পুলিশ সদস্যরা । উনি একজন জেল পুলিশ । রাতে একটু দেরি করে ডিউটি শেষে সিওবাজারের বাসায় ফিরছিলেন । মর্গের কাছাকাছি আসতেই প্রায় দুই তলা লম্বা হলুদ শাড়ি পরা এক মহিলার নাচানাচি দেখে উনি অজ্ঞান । ‘দুই তলা সমান লম্বা হলুদ শাড়ি পরা মহিলা’র খোঁজ নিতে উপস্থিত ছাত্র বা পুলিশদের খুব একটা উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না । সবারই চিন্তা দ্রুত যার যার অবস্থানে ফিরে যাওয়া । কিছুক্ষণ পর পিন্নু হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেটখেকো এক পরীক্ষার্থী বড় ভাই রহস্যের গিঁট খুললেন। রাস্তার দুই দিকের দুইটা আম গাছের সাথে একটা ব্যানার লাগানো ছিল । বাসের / ট্রাকের কারণে একটা পাশ ছিড়ে যায় । দূর থেকে অন্য গাছের মাথা থেকে বাতাসে দুলতে থাকা ব্যানারটিই “দুই তলা সমান লম্বা হলুদ শাড়ি পড়া মহিলা” ।

বিশাল বিশাল বট-পাকুড়- শিমুলগাছ , আলো-ছায়ার খেলা , নির্জনতা অনেক সময়েই আমাদের মনের গভীর ভিতর থেকে টেনে বের করে নানা ধরনের কুসংস্কার ।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ]

back to top