alt

মুক্ত আলোচনা

মে দিবস ও বাংলাদেশের শ্রম মজুরী

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

: শনিবার, ৩০ এপ্রিল ২০২২

সকল উৎপাদনের জন্য মুল উপাদান হলো শ্রম । তাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ হচ্ছে শ্রম সম্পদ। শ্রম বিনিয়োগের ফলে পৃথিবীর সকল পরিবর্তন এবং উন্নয়ন হয়েছে। উৎপাদনের সকল উপকরণের মুল্য চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। কোন কিছু করতে হলে শ্রম ছাড়া তা উৎপাদন কোন ভঅবেই সম্ভব না। যত শত প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা হোক না কেন তা তৈরী এবং প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন হয় শ্রমের। কিন্তু দেখা যায় সারা দুনিয়ায় শ্রমের মুল্য বা মজুরীটা নির্ধারণে রয়েছে নানা অনিয়ম । আদি সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার পরির্বতনের সাথে সাথে শ্রমের মজুরীর বৈষম্য সৃষ্টি হতে থাকে। সামন্তরা মানুষকে ভোগ্য পণ্যের ন্যায় ব্যবহার করতো।

বর্তমানে শ্রমের মজুরী নির্ধারনের যে পার্থক্য দেখা যায় তা সামন্তবাদীদেরই একটি ধারবাহিকতা। ফলে সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের বেতনের রয়েছে পার্থক্য ফলে মানুষে মানুষে আয়ের বৈষম্যটা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ব্যাক্তি ব্যাক্তির মাঝে যে সামাজিক পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে তা মুলত মজুরী বা বেতন বৈষম্যের কারণে। বর্তমানে দেখা যায় , কিছু মানুষ মাত্র আট ঘন্টা কাজ করে যে মজুরী প্রায় সেই মজুরীটা আবার কেউ কেউ সারা বছর কাজ করেও পায় না। কিছু পদ বা কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে মানুষকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য। তাই নিয়ন্ত্রকদের কাছে মানুষ হয়েছে উঠেছে পণ্যের ন্যায়। পণ্যকে যেভাবে ভোগ করা হয় সৃষ্ট নিয়ন্ত্রক গোষ্ঠি মানুষের শ্রমটাকেও সেই ভাবে ভোগ করে। পণ্যে বিক্রির ক্ষেত্রে মুনাফাটা যেভাবে মধ্যস্বত্ব ভোগীরা এমনি করে মানুষের শ্রমের বানিজ্য করে কিছু কিছু মুনাফা করে যাচ্ছে । দিনে কাজের কর্ম ঘন্টা ও মজুরীর ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে যায়।

শ্রম ক্ষেত্রের সকল বৈষম্য লাঘবের উদ্যেশ্যে ১৬০০ সাল থেকে শ্রমিকরা নানা আন্দোলন শুরু করেন। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে হে মার্কেটের সামনে কারখানার শ্রমিকরা নিজেদের দৈনিক আট ঘন্টা কাজ করার এবং নায্য মজুরীর দাবীতে ধর্মঘট করেন। শ্রমিকদের এই ধর্মঘট মালিক, এবং শাসকগোষ্ঠির জন্য হয়ে উঠে বিপদ , তাই ধর্মঘট ভাঙ্গার জন্য শাসক গোষ্ঠি ধর্মঘটি শ্রমিকদের উপর গুলি চালায়। ঔ দিন পুলিশের গুলিতে ১০-১২ জন শ্রমিক শহীদ হন। তারা নিহত শ্রমিকের রক্ত মাখা শার্টকে ঝাণ্ডা বানিয়ে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে। তাই বর্তমানে লাল ঝাণ্ডা হলো নায্যতা আন্দোলনের প্রতীক। তারাপর বিশ্বে নানা দেশের শ্রমিকরা আর্ন্তজাতিক ভাবে মিলিত হয়ে দুণিয়া ব্যাপী শ্রম শোষণ ও নায্য মজুরী প্রতিষ্ঠার নানা শ্রম সংগঠন গড়ে তুলো। এবং শিকাগোর হে মার্কেটে নিহত শহীদেরকে স্মরণ করে রাখতেই আজকে মে দিবস বিশ্ব ব্যাপী পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।

হে মার্কেটের আন্দোলনের শ্রমিকের রক্ত ঝরানো দিনের দাবী গুলো কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে তা দেখার বিষয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আলোচনা করলে দেখা যায় , পাকিস্তানী ও বৃটিশ শাসকরা মে দিবস পালন করতে দিতো না। বাংলাদেশে সরকারী ভাবে ১৯৭২ সালে মে দিবস পালন শুরু হয়। ১ মে সরকারী ভাবে ছুটির দিন ঘোষনা করেন ১৯৭২ সালের সরকার। ১৯৭২ সালের মে দিবসে তৎকালীন সরকার প্রধান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্যেশ্যে ভাষণ দেন। সেই দিন থেকে মে দিবস সারাম্ভরে পালিত হয় বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মহান মুক্তির সংগ্রামের মুল্য উদ্যেশ্যটা ছিল সমতা ও সমবন্টনের । বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় তার বিভিন্ন ভাষণে বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রের মালিক হলো এদেশের কৃষক ও শ্রমিক। এই কৃষক শ্রমিকের শ্রম এবং তাদের দেয়া রাজস্বেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। ১৯৭৫ সালে ২৪ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ( বাকশাল ) গঠিত হয়। বাকশালের মুল্য উদ্যেশ্য ছিল কৃষক শ্রমিকের রাষ্ট্রীয় মালিকানা নিশ্চিত করা। বঙ্গবন্ধু সারাদেশে কৃষকদের ৬৮ হাজার সমবায় সমিতি গঠন করেন।

কৃষি ভুমির যথাযথ ব্যবহার করে উৎপাদনমুখি করতে নানা পদক্ষেপ গ্রহন করেন। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের কৃষি জমিতে কৃষকের মালিকানাটা নিশ্চিত হওয়ার পথটা সুদৃঢ় করে। বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের সকল কলকারাখানা রাষ্ট্রীয়করন করেন । দেশের সকল কলকারখানার মালিক হয়ে যান জনগন। বঙ্গবন্ধুর এই পদক্ষেপের ফলে সকল সম্পদে সকল মানুষের অধিকারটা নিশ্চিত হওয়ার পথে ধাবিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে একদল বিপদগামী সেনা। হত্যাকারীরা মুলত সা¤্রাজ্যবাদীদের দোসর। তাই দেখা যায় বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সকল কলকারখানা ব্যাক্তি মালিকানায় চলে যায়। রাতারাতি কিছু মানুষ ধনকুবের হতে শুরু করে। আর দেশে মজুরীর পার্থক্যটা বাড়তে থাকে।

বাংলাদেশে বেতনের পার্থক্যটা বর্তমানে চরম বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে কেউ সারাদিন খেটে পায় ৫০ টাকা আবার কেউ কেউ ঠা-া ঘরে বসে আড্ডা দিয়ে দৈনিক আয় করেন লাখ টাকা। কেউ কেউ দৈনিক দু ঘন্টা শ্রম বিনিয়োগ করেন দৈনিক যে আয়টা করে তা দেশের বৃহৎ শ্রমজীবী মানুষ দৈনিক দশঘন্টা পরিশ্রম করে একমাসেও সেই পরিমানে আয়টুকু করতে পারেন না।মাথাপিছু আয় বেড়েছে সেই নিরিখে দেখা যায় , কিছু মানুষের হয়েছে পোয়া বারো। অপর দিকে কিছু মানুষের বেড়েছে খাটুনি। দেশের সরকারী অনেক দপ্তরে দেখা যায় , তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেনীর চাকুরীজীবির অসংখ্য শুন্যপদ রয়েছে। একজন অফিস সহকারী একাই তিন জনের কাজ করতে হয় । অপরদিকে দেখা যায় প্রশাসন ক্যাডারের দেখা যায় ভিন্ন চিত্র।

সম্প্রতি একটি সংবাদ থেকে জানা যায় যে, বিভিন্ন কর্তা ব্যাক্তিদের অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয় হয়েছে এর ফলে সারা দেশে অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা দাড়িয়েছে ৫০০ জনে । অথচ অতিরিক্তি সচিবের স্থায়ী পদে লোকের প্রয়োজন মাত্র ১৩০ জন। এই অতিরিক্ত কর্তা ব্যাক্তিদের মাসিক বেতন ভাতা অনেকটা বসিয়ে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। একজন অতিরিক্ত সচিবের মাসিক বেতন ভাতা গাড়িসহ নানা অনুসাঙ্গিকতা পুরণ করতে প্রয়োজন হয় প্রায় পাচ লাখ টাকার মত। এই সাধারন হিসাবটা ধরলে দেখা যায় শুধুমাত্র এই পদের অতিরিক্ত ব্যাক্তিদের পেছনে মাসে প্রায় ১৫-২০ কোটি টাকা ব্যায় হয়। এটা শুধু অতিরিক্ত সচিবের হিসাব । প্রশাসন ক্যাডারে সহকারী সচিব থেকে সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার এমন অসংখ্য কর্তা ব্যাক্তিদের পদোনইত দেয়া হয়েছে যার স্থায়ী পদ নেই। তাই দেখা যায় বিপুল সংখ্যক কর্তা ব্যাক্তিদের বসিয়ে বেতন দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে একজন গার্মেন্টস শ্রমিক দৈনিক ১২ ঘন্টা পরিশ্রম মাসে বেতন পায় ১৫ হাজার টাকারও কম।

প্রান্তিক পর্যায়ের একজন কৃষকের সারা বছরের আয় হিসাব করলে দেখা যায় তার মাসিক আয় কোন ভাবেই ১০-১৫ হাজার টাকার বেশী হয় না। অপরদিকে সরকারের একজন সিনিয়র সচিব মাসে বেতন ভাতা গাড়ী বাড়িসহ পান চার থেকে পাচ লাখ টাকা। দেশের আয় বৈষম্য প্রকট রুপ ধারন করেছে। বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা অনেক বেশী এই বেকারদের শ্রমকে স্বল্প মুল্যে কিনে নিচ্ছে দেশী বিদেশী শিল্প মালিকরা। দেশের শ্রমজীবি মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করছে দেশী বিদেশী এনজিও । এরা মুখে যা বলছে কার্যত তা করছে না। একেকটি বিদেশী ও দেশী এনজিওর কর্তা ব্যাক্তিরা মাঠ পর্যায়ের একজন কর্মীর চেয়ে ৩০-৪০ গুণ বেশী বেতন পান। অথচ এই এনজিও গুলোই আবার শ্রমের নায্যতার জন্য কর্মশালাসহ নানা কর্মসুচির আয়োজন করে। দেশের প্রান্তিক কৃষক , ছোট ছোট শিল্প উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য রাষ্ট্রিয় সুযোগ অনেক কম বা নেই বললেই চলে। অথচ প্রায় সময় এদেরকেই ঘাড়ে চাপানো হয় শ্রম শোষনের দায়ভার ।

রাষ্ট্রীয় ভাবে দেশের শ্রম ঘন্টা এবং মজুরী বৈষম্য নিরসনে পদক্ষেপ নেয়াটা জরুরী।

[লেখক:উন্নয়নকর্মী]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

মে দিবস ও বাংলাদেশের শ্রম মজুরী

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

শনিবার, ৩০ এপ্রিল ২০২২

সকল উৎপাদনের জন্য মুল উপাদান হলো শ্রম । তাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ হচ্ছে শ্রম সম্পদ। শ্রম বিনিয়োগের ফলে পৃথিবীর সকল পরিবর্তন এবং উন্নয়ন হয়েছে। উৎপাদনের সকল উপকরণের মুল্য চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। কোন কিছু করতে হলে শ্রম ছাড়া তা উৎপাদন কোন ভঅবেই সম্ভব না। যত শত প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা হোক না কেন তা তৈরী এবং প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন হয় শ্রমের। কিন্তু দেখা যায় সারা দুনিয়ায় শ্রমের মুল্য বা মজুরীটা নির্ধারণে রয়েছে নানা অনিয়ম । আদি সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার পরির্বতনের সাথে সাথে শ্রমের মজুরীর বৈষম্য সৃষ্টি হতে থাকে। সামন্তরা মানুষকে ভোগ্য পণ্যের ন্যায় ব্যবহার করতো।

বর্তমানে শ্রমের মজুরী নির্ধারনের যে পার্থক্য দেখা যায় তা সামন্তবাদীদেরই একটি ধারবাহিকতা। ফলে সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের বেতনের রয়েছে পার্থক্য ফলে মানুষে মানুষে আয়ের বৈষম্যটা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ব্যাক্তি ব্যাক্তির মাঝে যে সামাজিক পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে তা মুলত মজুরী বা বেতন বৈষম্যের কারণে। বর্তমানে দেখা যায় , কিছু মানুষ মাত্র আট ঘন্টা কাজ করে যে মজুরী প্রায় সেই মজুরীটা আবার কেউ কেউ সারা বছর কাজ করেও পায় না। কিছু পদ বা কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে মানুষকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য। তাই নিয়ন্ত্রকদের কাছে মানুষ হয়েছে উঠেছে পণ্যের ন্যায়। পণ্যকে যেভাবে ভোগ করা হয় সৃষ্ট নিয়ন্ত্রক গোষ্ঠি মানুষের শ্রমটাকেও সেই ভাবে ভোগ করে। পণ্যে বিক্রির ক্ষেত্রে মুনাফাটা যেভাবে মধ্যস্বত্ব ভোগীরা এমনি করে মানুষের শ্রমের বানিজ্য করে কিছু কিছু মুনাফা করে যাচ্ছে । দিনে কাজের কর্ম ঘন্টা ও মজুরীর ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে যায়।

শ্রম ক্ষেত্রের সকল বৈষম্য লাঘবের উদ্যেশ্যে ১৬০০ সাল থেকে শ্রমিকরা নানা আন্দোলন শুরু করেন। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে হে মার্কেটের সামনে কারখানার শ্রমিকরা নিজেদের দৈনিক আট ঘন্টা কাজ করার এবং নায্য মজুরীর দাবীতে ধর্মঘট করেন। শ্রমিকদের এই ধর্মঘট মালিক, এবং শাসকগোষ্ঠির জন্য হয়ে উঠে বিপদ , তাই ধর্মঘট ভাঙ্গার জন্য শাসক গোষ্ঠি ধর্মঘটি শ্রমিকদের উপর গুলি চালায়। ঔ দিন পুলিশের গুলিতে ১০-১২ জন শ্রমিক শহীদ হন। তারা নিহত শ্রমিকের রক্ত মাখা শার্টকে ঝাণ্ডা বানিয়ে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে। তাই বর্তমানে লাল ঝাণ্ডা হলো নায্যতা আন্দোলনের প্রতীক। তারাপর বিশ্বে নানা দেশের শ্রমিকরা আর্ন্তজাতিক ভাবে মিলিত হয়ে দুণিয়া ব্যাপী শ্রম শোষণ ও নায্য মজুরী প্রতিষ্ঠার নানা শ্রম সংগঠন গড়ে তুলো। এবং শিকাগোর হে মার্কেটে নিহত শহীদেরকে স্মরণ করে রাখতেই আজকে মে দিবস বিশ্ব ব্যাপী পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।

হে মার্কেটের আন্দোলনের শ্রমিকের রক্ত ঝরানো দিনের দাবী গুলো কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে তা দেখার বিষয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আলোচনা করলে দেখা যায় , পাকিস্তানী ও বৃটিশ শাসকরা মে দিবস পালন করতে দিতো না। বাংলাদেশে সরকারী ভাবে ১৯৭২ সালে মে দিবস পালন শুরু হয়। ১ মে সরকারী ভাবে ছুটির দিন ঘোষনা করেন ১৯৭২ সালের সরকার। ১৯৭২ সালের মে দিবসে তৎকালীন সরকার প্রধান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্যেশ্যে ভাষণ দেন। সেই দিন থেকে মে দিবস সারাম্ভরে পালিত হয় বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মহান মুক্তির সংগ্রামের মুল্য উদ্যেশ্যটা ছিল সমতা ও সমবন্টনের । বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় তার বিভিন্ন ভাষণে বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রের মালিক হলো এদেশের কৃষক ও শ্রমিক। এই কৃষক শ্রমিকের শ্রম এবং তাদের দেয়া রাজস্বেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। ১৯৭৫ সালে ২৪ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ( বাকশাল ) গঠিত হয়। বাকশালের মুল্য উদ্যেশ্য ছিল কৃষক শ্রমিকের রাষ্ট্রীয় মালিকানা নিশ্চিত করা। বঙ্গবন্ধু সারাদেশে কৃষকদের ৬৮ হাজার সমবায় সমিতি গঠন করেন।

কৃষি ভুমির যথাযথ ব্যবহার করে উৎপাদনমুখি করতে নানা পদক্ষেপ গ্রহন করেন। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের কৃষি জমিতে কৃষকের মালিকানাটা নিশ্চিত হওয়ার পথটা সুদৃঢ় করে। বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের সকল কলকারাখানা রাষ্ট্রীয়করন করেন । দেশের সকল কলকারখানার মালিক হয়ে যান জনগন। বঙ্গবন্ধুর এই পদক্ষেপের ফলে সকল সম্পদে সকল মানুষের অধিকারটা নিশ্চিত হওয়ার পথে ধাবিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে একদল বিপদগামী সেনা। হত্যাকারীরা মুলত সা¤্রাজ্যবাদীদের দোসর। তাই দেখা যায় বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সকল কলকারখানা ব্যাক্তি মালিকানায় চলে যায়। রাতারাতি কিছু মানুষ ধনকুবের হতে শুরু করে। আর দেশে মজুরীর পার্থক্যটা বাড়তে থাকে।

বাংলাদেশে বেতনের পার্থক্যটা বর্তমানে চরম বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে কেউ সারাদিন খেটে পায় ৫০ টাকা আবার কেউ কেউ ঠা-া ঘরে বসে আড্ডা দিয়ে দৈনিক আয় করেন লাখ টাকা। কেউ কেউ দৈনিক দু ঘন্টা শ্রম বিনিয়োগ করেন দৈনিক যে আয়টা করে তা দেশের বৃহৎ শ্রমজীবী মানুষ দৈনিক দশঘন্টা পরিশ্রম করে একমাসেও সেই পরিমানে আয়টুকু করতে পারেন না।মাথাপিছু আয় বেড়েছে সেই নিরিখে দেখা যায় , কিছু মানুষের হয়েছে পোয়া বারো। অপর দিকে কিছু মানুষের বেড়েছে খাটুনি। দেশের সরকারী অনেক দপ্তরে দেখা যায় , তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেনীর চাকুরীজীবির অসংখ্য শুন্যপদ রয়েছে। একজন অফিস সহকারী একাই তিন জনের কাজ করতে হয় । অপরদিকে দেখা যায় প্রশাসন ক্যাডারের দেখা যায় ভিন্ন চিত্র।

সম্প্রতি একটি সংবাদ থেকে জানা যায় যে, বিভিন্ন কর্তা ব্যাক্তিদের অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয় হয়েছে এর ফলে সারা দেশে অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা দাড়িয়েছে ৫০০ জনে । অথচ অতিরিক্তি সচিবের স্থায়ী পদে লোকের প্রয়োজন মাত্র ১৩০ জন। এই অতিরিক্ত কর্তা ব্যাক্তিদের মাসিক বেতন ভাতা অনেকটা বসিয়ে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। একজন অতিরিক্ত সচিবের মাসিক বেতন ভাতা গাড়িসহ নানা অনুসাঙ্গিকতা পুরণ করতে প্রয়োজন হয় প্রায় পাচ লাখ টাকার মত। এই সাধারন হিসাবটা ধরলে দেখা যায় শুধুমাত্র এই পদের অতিরিক্ত ব্যাক্তিদের পেছনে মাসে প্রায় ১৫-২০ কোটি টাকা ব্যায় হয়। এটা শুধু অতিরিক্ত সচিবের হিসাব । প্রশাসন ক্যাডারে সহকারী সচিব থেকে সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার এমন অসংখ্য কর্তা ব্যাক্তিদের পদোনইত দেয়া হয়েছে যার স্থায়ী পদ নেই। তাই দেখা যায় বিপুল সংখ্যক কর্তা ব্যাক্তিদের বসিয়ে বেতন দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে একজন গার্মেন্টস শ্রমিক দৈনিক ১২ ঘন্টা পরিশ্রম মাসে বেতন পায় ১৫ হাজার টাকারও কম।

প্রান্তিক পর্যায়ের একজন কৃষকের সারা বছরের আয় হিসাব করলে দেখা যায় তার মাসিক আয় কোন ভাবেই ১০-১৫ হাজার টাকার বেশী হয় না। অপরদিকে সরকারের একজন সিনিয়র সচিব মাসে বেতন ভাতা গাড়ী বাড়িসহ পান চার থেকে পাচ লাখ টাকা। দেশের আয় বৈষম্য প্রকট রুপ ধারন করেছে। বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা অনেক বেশী এই বেকারদের শ্রমকে স্বল্প মুল্যে কিনে নিচ্ছে দেশী বিদেশী শিল্প মালিকরা। দেশের শ্রমজীবি মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করছে দেশী বিদেশী এনজিও । এরা মুখে যা বলছে কার্যত তা করছে না। একেকটি বিদেশী ও দেশী এনজিওর কর্তা ব্যাক্তিরা মাঠ পর্যায়ের একজন কর্মীর চেয়ে ৩০-৪০ গুণ বেশী বেতন পান। অথচ এই এনজিও গুলোই আবার শ্রমের নায্যতার জন্য কর্মশালাসহ নানা কর্মসুচির আয়োজন করে। দেশের প্রান্তিক কৃষক , ছোট ছোট শিল্প উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য রাষ্ট্রিয় সুযোগ অনেক কম বা নেই বললেই চলে। অথচ প্রায় সময় এদেরকেই ঘাড়ে চাপানো হয় শ্রম শোষনের দায়ভার ।

রাষ্ট্রীয় ভাবে দেশের শ্রম ঘন্টা এবং মজুরী বৈষম্য নিরসনে পদক্ষেপ নেয়াটা জরুরী।

[লেখক:উন্নয়নকর্মী]

back to top