মনজুরুল হক
রবীন্দ্রনাথ। এক অপার বিস্ময়! আজকের এই দিনে দিনে কলকাতায় জন্ম নিয়েছিলেন বাঙালির ‘আইডেন্টিটি’। বাংলা সন মতে ২৫শে বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথ না জন্মালে কী হতো সে প্রশ্ন অবান্তর। তবে তিনি বেঁচে থাকতে এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে প্রথমে অবিভক্ত বাংলায়, পরে দুই বাংলায় কত শত মানুষ যে বিদ্ব্যান বনে গেছে সে হিসেব মেলে না। জমিদার, উচ্চবিত্ত, সাম্যবাদী নন, প্রজাহিতৈষী নন, দারিদ্র না বোঝা, সাম্প্রদায়ীক, উন্নাসিক.....অতঃপর ‘হিন্দু কবি’! কতই না অভিধা তাঁর! অথচ সেই তাঁকে নিয়েই শত-সহস্র কবি-লেখক করে-কম্মে খাচ্ছেন! তাঁকে ফাতা ফাতা করে ফেলা হয়েছে। এখনও হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে বাঙালি তাঁকেই ‘ভাঙিয়ে খাচ্ছে’। উপায় নেই। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি অলঙ্কৃত করেননি। না, নেই। রাজনীতির ভেদবুদ্ধি এবং শ্রেণি সংগ্রামের বাইরে রবীন্দ্রনাথকে মাইনাস করলে বাঙালির কী থাকে? কিসসু না।
.
আমার রাজনৈতিক মতবাদের দিক থেকে তিনি আমার নমঃস্য নন। আবার আমি এটাও মনে করি; তাঁর ছোটগল্প আর সংগীত বাদ দিলে বাঙালির ভাঁড়ার ঘর প্রায় শূণ্য।
সত্যি বলতে কি তাঁর গানকে আমার কেবলই সুরবদ্ধ ছন্দময় ঐক্যতান মনে হয় না। মনে হয় মহাকালের স্বপ্নময় বাস্তবতা! আমি আজও ভেবে পাই না এই মানুষটা কীকরে এমন সুর ও বাণী সৃষ্টি করতে পারে! এ আমার পরম বিস্ময়!
জন্মদিনে তাঁরই একটি গান নিয়ে নৈবেদ্য—
.
গানটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ জন্মদিনে রচনা করেছিলেন। কীভাবে যেন জানতেন; এর পরে আর কোনো পঁচিশে বৈশাখ আসছে না তাঁর জীবনে! জানতেন অসম্ভব, তার পরও কী এক অসীম শক্তিবলে কামনা করেছেন-আরও একটি বার এই প্রাঙ্গনে জন্ম নেবার। অবচেতনে বলে গেছেন- ‘হে নূতন দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ !’ যে জন প্রাচীন হয়ে গেছে সে যে আর কখনও নূতন হয়ে দেখা দেবে না জেনেও তাঁর নিজেকেই আহবান-আর একটি বার দেখা দিক!
.
না। তেমনটি হবার নয়। তারপরও তাঁর মনে হয়েছে যদি তেমন হয়! যদি হয়েই যায়? তাই নিজের সেই প্রকাশ যেন কুহেলিকা উদ্ঘাটনের জন্যই হয়। রবীন্দ্রনাথ এখানে মৃত্যুকেই যেন কুহেলিকা রূপে চিত্রিত করলেন!
.
তিনি যখন ধরেই নিলেন তাঁর অন্তরাত্মার পুর্নজন্ম হতে চলেছে…সেই রূপকল্পটিও তিনি এঁকে দিলেন-
‘রিক্ততার বক্ষ ভেদি
আপনারে করো উন্মোচন
ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,
ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে
অসীমের চিরবিস্ময়’!
.
এই যে তিনি চলে যাচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন রূপে চলেই যাচ্ছেন, তার পরও ফিরে ফিরে এসে রিক্ততার বক্ষ ভেদ করে নিজেকেই উন্মোচন করতে চাইছেন। সেই চাওয়ার পলে পলে জীবনের জয়গান। আর সেই জয়গান গাইতে গাইতেই নিজেকে অসীমের চিরবিস্ময় কল্পনা করে নিচ্ছেন। যে অসীমে আমাদের শঙ্কা, ভয়, রবীন্দ্রনাথ তাকেই চিরবিস্ময় আখ্যা দিলেন। মৃত্যুকে কী নির্লিপ্ততায় আপনার করে নেয়া!
একেবারে শেষের ঘোর কেটে যাওয়ার আগে তিনি ধরতে পারলেন কল্পলোকে তাঁর পুর্নজন্ম হচ্ছে…তিনি আবার ধরনীতে ফিরে আসছেন….সেই আসাটা কেমন হবে তাও তার ধী-শক্তি প্রকাশ করতে পেরেছিল!
‘উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্তমাঝে
চিরনূতনেরে দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ
হে নূতন-‘
.
অবশেষে তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর আর ফিরে আসা হবে না। যা কিছু ভেবেছিলেন তা তাঁর একান্তই কল্পলোকের ভাবনা। তাতেও শঙ্খ বাজিয়ে তাঁর আগমন। কল্পলোকের ঘোর কেটে গেলে তিনি আবিষ্কার করেন- যে নূতন প্রাণ আসবে সে না হোক তিনি, হোক আর কেউ, অন্য কেউ, তার আগমনেও যেন শঙ্খ বাজে সেও যেন চিরনূতন হয়ে বারে বারে এই বাংলায় জন্ম নেয়…...
রবীন্দ্রনাথের ১৬০তম জন্মতীথিতে এই আমার নৈবেদ্য।
.............................................................................................
হে নূতন,
দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ ।।
তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন
সূর্যের মতন ।
তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন
রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন ।।
ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,
ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে অসীমের চিরবিস্ময় ।।
উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্তমাঝে।।
চিরনূতনেরে দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ ।। হে নূতন-
হে নূতন,
দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ
তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন।।
সূর্যের মতন ।
হয়ত কাগজের লেখা এমন হয় না। হয়ত লেখার নিয়মের বত্যয় ঘটল। তার পরও রবীন্দ্রনাথকে স্মরণে এরচে’ শ্রেয়তর লেখার উপায় নেই। তিনি তো বাঙালি অন্তরাত্মায় এভাবেই মিশে আছেন।
[লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]
মনজুরুল হক
রোববার, ০৮ মে ২০২২
রবীন্দ্রনাথ। এক অপার বিস্ময়! আজকের এই দিনে দিনে কলকাতায় জন্ম নিয়েছিলেন বাঙালির ‘আইডেন্টিটি’। বাংলা সন মতে ২৫শে বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথ না জন্মালে কী হতো সে প্রশ্ন অবান্তর। তবে তিনি বেঁচে থাকতে এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে প্রথমে অবিভক্ত বাংলায়, পরে দুই বাংলায় কত শত মানুষ যে বিদ্ব্যান বনে গেছে সে হিসেব মেলে না। জমিদার, উচ্চবিত্ত, সাম্যবাদী নন, প্রজাহিতৈষী নন, দারিদ্র না বোঝা, সাম্প্রদায়ীক, উন্নাসিক.....অতঃপর ‘হিন্দু কবি’! কতই না অভিধা তাঁর! অথচ সেই তাঁকে নিয়েই শত-সহস্র কবি-লেখক করে-কম্মে খাচ্ছেন! তাঁকে ফাতা ফাতা করে ফেলা হয়েছে। এখনও হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে বাঙালি তাঁকেই ‘ভাঙিয়ে খাচ্ছে’। উপায় নেই। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি অলঙ্কৃত করেননি। না, নেই। রাজনীতির ভেদবুদ্ধি এবং শ্রেণি সংগ্রামের বাইরে রবীন্দ্রনাথকে মাইনাস করলে বাঙালির কী থাকে? কিসসু না।
.
আমার রাজনৈতিক মতবাদের দিক থেকে তিনি আমার নমঃস্য নন। আবার আমি এটাও মনে করি; তাঁর ছোটগল্প আর সংগীত বাদ দিলে বাঙালির ভাঁড়ার ঘর প্রায় শূণ্য।
সত্যি বলতে কি তাঁর গানকে আমার কেবলই সুরবদ্ধ ছন্দময় ঐক্যতান মনে হয় না। মনে হয় মহাকালের স্বপ্নময় বাস্তবতা! আমি আজও ভেবে পাই না এই মানুষটা কীকরে এমন সুর ও বাণী সৃষ্টি করতে পারে! এ আমার পরম বিস্ময়!
জন্মদিনে তাঁরই একটি গান নিয়ে নৈবেদ্য—
.
গানটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ জন্মদিনে রচনা করেছিলেন। কীভাবে যেন জানতেন; এর পরে আর কোনো পঁচিশে বৈশাখ আসছে না তাঁর জীবনে! জানতেন অসম্ভব, তার পরও কী এক অসীম শক্তিবলে কামনা করেছেন-আরও একটি বার এই প্রাঙ্গনে জন্ম নেবার। অবচেতনে বলে গেছেন- ‘হে নূতন দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ !’ যে জন প্রাচীন হয়ে গেছে সে যে আর কখনও নূতন হয়ে দেখা দেবে না জেনেও তাঁর নিজেকেই আহবান-আর একটি বার দেখা দিক!
.
না। তেমনটি হবার নয়। তারপরও তাঁর মনে হয়েছে যদি তেমন হয়! যদি হয়েই যায়? তাই নিজের সেই প্রকাশ যেন কুহেলিকা উদ্ঘাটনের জন্যই হয়। রবীন্দ্রনাথ এখানে মৃত্যুকেই যেন কুহেলিকা রূপে চিত্রিত করলেন!
.
তিনি যখন ধরেই নিলেন তাঁর অন্তরাত্মার পুর্নজন্ম হতে চলেছে…সেই রূপকল্পটিও তিনি এঁকে দিলেন-
‘রিক্ততার বক্ষ ভেদি
আপনারে করো উন্মোচন
ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,
ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে
অসীমের চিরবিস্ময়’!
.
এই যে তিনি চলে যাচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন রূপে চলেই যাচ্ছেন, তার পরও ফিরে ফিরে এসে রিক্ততার বক্ষ ভেদ করে নিজেকেই উন্মোচন করতে চাইছেন। সেই চাওয়ার পলে পলে জীবনের জয়গান। আর সেই জয়গান গাইতে গাইতেই নিজেকে অসীমের চিরবিস্ময় কল্পনা করে নিচ্ছেন। যে অসীমে আমাদের শঙ্কা, ভয়, রবীন্দ্রনাথ তাকেই চিরবিস্ময় আখ্যা দিলেন। মৃত্যুকে কী নির্লিপ্ততায় আপনার করে নেয়া!
একেবারে শেষের ঘোর কেটে যাওয়ার আগে তিনি ধরতে পারলেন কল্পলোকে তাঁর পুর্নজন্ম হচ্ছে…তিনি আবার ধরনীতে ফিরে আসছেন….সেই আসাটা কেমন হবে তাও তার ধী-শক্তি প্রকাশ করতে পেরেছিল!
‘উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্তমাঝে
চিরনূতনেরে দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ
হে নূতন-‘
.
অবশেষে তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর আর ফিরে আসা হবে না। যা কিছু ভেবেছিলেন তা তাঁর একান্তই কল্পলোকের ভাবনা। তাতেও শঙ্খ বাজিয়ে তাঁর আগমন। কল্পলোকের ঘোর কেটে গেলে তিনি আবিষ্কার করেন- যে নূতন প্রাণ আসবে সে না হোক তিনি, হোক আর কেউ, অন্য কেউ, তার আগমনেও যেন শঙ্খ বাজে সেও যেন চিরনূতন হয়ে বারে বারে এই বাংলায় জন্ম নেয়…...
রবীন্দ্রনাথের ১৬০তম জন্মতীথিতে এই আমার নৈবেদ্য।
.............................................................................................
হে নূতন,
দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ ।।
তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন
সূর্যের মতন ।
তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন
রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন ।।
ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,
ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে অসীমের চিরবিস্ময় ।।
উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্তমাঝে।।
চিরনূতনেরে দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ ।। হে নূতন-
হে নূতন,
দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ
তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন।।
সূর্যের মতন ।
হয়ত কাগজের লেখা এমন হয় না। হয়ত লেখার নিয়মের বত্যয় ঘটল। তার পরও রবীন্দ্রনাথকে স্মরণে এরচে’ শ্রেয়তর লেখার উপায় নেই। তিনি তো বাঙালি অন্তরাত্মায় এভাবেই মিশে আছেন।
[লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]