alt

মুক্ত আলোচনা

শিকারের শিকারী বধ

আসফাক বীন রহমান

: বুধবার, ২২ জুন ২০২২

“ বালা টিক্যা পইট করো , চোখে লাগবো কইলাম”- ঋতু বলতে না বলতে গুলতি ছেড়ে দিতেই মাটির গুলিটি হাতে লেগে প্রচন্ড ব্যাথা দিলো । আমরা সড়কের পাশে খাঁ বাড়ীর ঢালে একটি কদম গাছের নীচে দুইজনে ঊর্ধ্বমুখী দাঁড়িয়ে আছি । সকাল থেকেই পকেটভর্তি মাটির গুলি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছি । আজকে একটা হেস্তনেস্ত করবোই । প্রতিদিন পাখি শিকারে বের হই , ফলাফল অষ্টরম্ভা ।

পরশু দিনের আগের দিন জালশুকা এসেছি । গোঁসাইপুর ঘাট থেকে প্রায় এক ঘণ্টা হেঁটে বাড়ী আসতে হয়েছে । ক্ষেতের আইল ,সড়কের ভাঙ্গা অংশ আর বাড়ি- ঘরের ভিতর দিয়ে আসতে গিয়ে আম্মার পা ব্যাথায় ফুলে গেছে । বর্ষাকালে জালশুকার জার্নিটা আম্মার জন্য আরামদায়ক । পুরোটা পথ নৌকায় আসতে পারেন । সড়ক থেকে মোল্লা বাড়ীর সামনের ব্রীজটায় উঠতেই বাংলাঘরের কোনায় দাদাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম ।

ইমন চিৎকার করে “ দাদা আমরা আইসা গেছি ” বলে পুকুরের পাশ ঘেঁষে শুকাতে দেয়া খড়ের উপর দিয়ে দৌঁড়ে দাদাকে জড়িয়ে ধরলো । আম্মাকে ফেলে আমিও দৌঁড় দিবো কিনা ভাবছি । আম্মা বললেন ,“ঐ যে তোমার দাদা কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন ,কাছে যাও”। আম্মার চোখের কোনের পানি চশমাটি আড়াল করতে পারেনি । মুখে হাসি ,চোখে পানি ; অনেক সময় বড়দের ব্যাপার স্যাপার বুঝতে পারিনা । পুরো গোঁসাইপুরের মাটির রাস্তায় বারবার থেমে , মাঝে মাঝে ওমাগো এবার পাটা মনে হয় মঁচকে গেছে বলে ইমনকে ডাকাডাকি করেছেন ।

বারবার বিরক্ত আম্মা অনুপস্থিত আব্বাকেও হুমকি দিচ্ছিলেন, “এরপর থেকে বর্ষা ছাড়া আমি জালশুকায় আসবো না ”। এখন আবার খুশিতে চোখ-মুখ চিকচিক করছে । দাদাকে সালাম করতেই বুকে জড়িয়ে ধরেন । দাদী পর্দানশীন মানুষ , বাড়ীর বাইরে আসেন না ; তারপরও ঘরের কোনায় লেবুর শরবত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন । ইমনের চোখ-মুখ দাদী আঁচল দিয়ে মুছে দিয়ে মাথায় হাত বুলাচ্ছেন । আমাদের দেখার সাথে সাথে বিশাল এক ঝাঁক এন্ডা-পেন্ডা জড়ো হয়েছে ।ওরা খুব মনোযোগের সাথে আমাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছে । টিউবওয়েলের পাশে গেলে তাদের এক গ্রুপ কে কার আগে টিউবওয়েলে চাপ দিবে ,ঠেলাঠেলি লাগিয়েছে । ইমনের হাতের লাক্স সাবান দেখে “সাবানডার বুই হুব সুন্দর ”- সমস্বরে বলে উঠলো ।

আম্মা ঘরে এসেই ব্যাগ-বোঁচকা খোলা শুরু করেছেন । দাদী বেশ কয়বার এই বাহিনীকে যার যার বাড়ী যাবার নির্দেশনা দিলেও কোনো কাজে আসেনি । বেতের ঝুড়িতে বেশ কয় রকম তরকারী ও শুকনা খাবার নানী দিয়ে দিয়েছেন । আম্মা হাতের ইশারা করে এক স্মলম্যানকে ডাকলেন । একহাতে নাকের সিকনি মুছতে মুছতে আরেক হাতে প্যান্ট সামলে বাচ্চাটি আসতেই আম্মা বললেন তোমার নাম কী? আম্মা স্কুল টিচার , তাই ছোট বাচ্চাদের খুব পছন্দ করেন ।

ঝুড়ি থেকে কাগজের এক বিশাল ঠোঙ্গা বের করলেন । ইমন আর আমি হতবাক ! একজন আরেকজনের সাথে চোখাচোখি করে বোঝাতে চাইলাম ‘ও এই ব্যাপার’! ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসার পথে ট্রেনে এতগুলো লজেন্স কেনো কিনলেন সেটা মালুম হলো। আমরা তখন অনেক অনুনয় বিনয় করে মাত্র দুটি করে পেয়েছিলাম । এই কয়দিন নানা বাড়ি থাকার সময়ে বেশ কয়েকবার আম্মার ট্রাংকে পর্যন্ত হানা দিয়েছি ! বাচ্চাগুলোকে লাইনে দাঁড় করিয়ে এক এক করে লজেন্স দিয়ে বিদায় করলেন । দাদি এক ফাঁকে দেখে গিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে গেলেন ‘ বউ যে কি করো’।

বিকালে ঋতুর দেখা পেলাম । গলায় একটা ব্রহ্মাস্ত্র ঝুলানো । সারাদিন জাল আর ছিপ দিয়ে বিভিন্ন পুকুর-বিল-নদীতে মাছ ধরাটা তার নেশা । মাঝে মাঝে ভোর কিংবা সন্ধ্যায় পঞ্চাবটীর শ্মশানের বাঁকে ভুতের আস্তানার(!) পাশে মাছ ধরতে যায় । তখন ওর মা এসে কান্নাকাটি করেন। পাখি আর পাখির ছানা-পোনাদের হাল-হকিকত এই ডানপিটে ছেলেটির থেকে কেউ বেশী জানেনা । সম্পর্কে আমার ভাতিজা ও সমবয়সী । দাদী ওকে দেখেই , ‘তুই পাখি মারিস কেনো ’ বলে একটা বকা দিলেন ।

আমি গলায় ঝুলানো ব্রহ্মাস্ত্রটি দেখে এর নাম জিজ্ঞেস করলাম । বললো ‘গুলতি’। সাথে সাথে গলা থেকে খুলে আমাকে এর কার্যকারিতা বুঝিয়ে দিতে শুরু করলো,‘ এই যে কাঠের ইংরেজি ওয়াই -এর মতো অংশটা হাত দিয়া ধরো ।’ দুটি রাবারের সামনের অংশের চামড়া টুকরায় একটি ছোট মার্বেল রাখার সাথে সাথে ইমন ওটা নিয়ে পকেটে ভরে ফেলল । ঢাকার মার্বেল থেকে কিছুটা আলাদা দেখতে । ওইটা কাঁচের তৈরী আর এটা মাটির মতো মনে হচ্ছে । ঋতুকে বললাম এগুলো কোন জায়গা থেকে কিনেছো ? আকাশ থেকে পড়লো এমন ভাব নিয়ে বললো,“ এইগুলি আবার কৈ বেচবো , আমি বানাইছি ”। পকেট থেকে বাদামী-লালচে মাটির মতো মার্বেলটি বের করে আমরা দেখতে লাগলাম । পাকায় ফেললে ভাঙছে না ।

আমিঃ আমাকে দেখাবে কিভাবে বানায় ?

ঋতুঃ কাইল লইয়ো ।

আপাতত বাড়ীর পিছনের বাঁশঝাড়ের সঙ্গের শোলার টালের পাশে আমাদের শিখিয়ে দেয় কিভাবে গুলতি মারতে হয়।

পরদিন ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে ঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে নানা নকশা করে আলো ঘুম ভেঙে দিলো । পাখিদের কল কাকলির এত চিৎকার ! বাঁশঝাড়ে মনে হয় পাখিদের ঈদ উৎসব চলছে । বিরাট পালঙ্কে আম্মার এক পাশে আমি অন্যপাশে ইমন ।বিশাল নকশাকাটা দরজা খোলার জন্য মোড়ার উপর দাঁড়াতেই দাদি পাশের রুম থেকে এসে দরজা খুলে দিলেন । কি সুন্দর ভোরের নরম আলো । ঢাকায় এরকম ভোরে কখনো নিজে নিজে ঘুম ভাঙেনি । দাদীকে দেখলাম উঠানের ওই পাড়ে হাঁস- মুরগির খোয়ারের দরজা খুলে ওযু করতে যাচ্ছেন । খোয়ারটিতে দুইজন প্রমাণ সাইজের বাচ্চা ঢুকতে পারে । এটা লাল-নীল কাঠের নকশা ও টিনের তৈরি একটা ছোট্ট চার চালা টিনের ঘর ,চাচা বানিয়েছেন । বেশি সামনে যেতে ভয় লাগে, রাজহাঁসের জন্য । বিশাল কয়টা রাজহাঁস আছে , সামনে গেলে গলা মাটির সমান্তরালে নামিয়ে তেড়ে আসে ।

বাঁশঝাড়ের দিকে তাকাতেই মনে হলো অসংখ্য ছেড়া সাদা কাপড় কে যেন বাঁশেঝাড়ের মাথায় বেঁধে দিয়েছে । মাঝে মাঝে হঠাৎ করে এক একটা সাদা কাপড়ের টুকরা নিজ থেকে চার-পাঁচ গুন বড় হয়ে বক হয়ে পাখা মেলে আকাশে উড়ে যাচ্ছে । সামনে হলুদ ঠোঁট আর সাদা শরীরের পিছনে লম্বা দুটি পা বাংলাদেশ বিমানের লোগো উড়ণ্ত বলাকার আকৃতির কথা মনে করিয়ে দেয় । সাঁই সাঁই করে মাথার উপর দিয়ে নদীর দিকে চলে যাচ্ছে । হঠাৎ করে সিনেমার পেত্নীর মত ই-হি- ই -হি-ই-হি কর্কশ আওয়াজে বুকে কাঁপন ধরে গেছে । এই সাতসকালে পেত্নী আসলো কোত্থেকে ? দাদী ইশারা করে বাঁশঝাড়ের পাশে টিউবওয়েলের পার থেকে ডাকলেন । দৌড়ে দাদীর কাছে যেতেই আঙ্গুল দিয়ে খালের পাশে বড় আমগাছটার দিকে দেখালেন, তখনই কানে আসলো ঠক ঠক ঠক ঠক আওয়াজ । কি সুন্দর একটা হলুদ ছিটছিটে পাখি ! মাথায় লাল ঝুঁটি । বললেন কাঠকুড়ালি । এটা আবার কি নাম ? এবার বললেন কাঠঠোকরা । কিন্তু, পেত্নীর মত আওয়াজটা কিসের জিজ্ঞেস করতেই দাদী বললেন পাখি উড়ে যাবার সময় এই ভাবে ডাকে ।

নাস্তার পর পর ঋতুর সাথে পথ দিলাম । ভাঙ্গা সড়ক ধরে পশ্চিম দিকে যেতে লাগলাম ।

--এটাতো গোঁসাইপুর যাবার পথ ।

--হ্যাঁ । সামনে কুমার বাড়ি ।

--কুমার মানে, যারা মাটির জিনিস বানায় ?

জালশুকার পশ্চিম প্রান্তে কুমোর বাড়ি । এই সাতসকালে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে । কালো মাটির স্তুপ একটা বাড়ির পাশে দেখতে পেলাম । উপরে একটা বেড়ার ছাউনি , ভেজা কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে রেখেছে । এক বয়স্ক ভদ্রলোক একটা গরুর গাড়ির চাকা মাটিতে ফেলে ঘোরাচ্ছেন। আমি হাঁটুর উপর বসে এটা দেখতে লাগলাম ।

ধুতি পরা ভদ্রলোকঃ জিতু মিয়া ,এই পুলাডা কেডা ?

ঋতুঃ ডাইরেক্টর সাহেবের নাতি ।

ঋতুকে দেখলাম ওরা জিতু মিয়া বলে ডাকছে ।

ঋতুঃ কদ্দুর মাটি লাগবো, গুলি বানাইতাম ।

উনি কোদাল দিয়ে মাটি কেটে নিলেন । আমাকে বুঝিয়ে দিলেন দোআঁশ বা বেলে মাটি দিয়ে মাটির বাসন- কোসন বানানো যাবেনা,এঁটেল মাটি লাগবে । এই মাটি ওনারা প্রতিবছর পানি নেমে গেলে কোন না কোন জমির মালিকের কাছ থেকে কিনেন । সেটাকে ঠান্ডা জায়গায় সংরক্ষণ করেন ,মাঝে মাঝে পানি দেন, কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে রাখেন । কিছু বানানোর আগে সেটা ভালো করে ছেনে নুরী -পাথড় -শামুক আলাদা করেন । আমরা তিনজন দুই হাতের মাঝখানে মাটি নিয়ে প্রায় দুই-তিনশো মার্বেল সাইজ গুলি বানিয়ে রোদে শুকাতে দিলাম । দুপুরে উনুনের জ্বলন্ত ছাইয়ে এইগুলো দেওয়ার পর বিকালের মধ্যে লালচে-বাদামি গুলি পেয়ে গেলাম । বিকালে পকেটে ভরে গুলি নিয়ে গুলতি প্র্যাকটিস করতে বেরোলাম । গাব গাছের পাশে খড়ের গাদার পেছনে বড় আমগাছটার নীচে ইজি চেয়ারে বসে দাদা আমাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছেন । উনি এ সময় পেপার পড়েন । খেলাধুলা, এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতে উনার অনেক উৎসাহ । আমাকে দেখে উৎসাহিত করে বললেন,“ ভালো করে প্র্যাকটিস কর , দুই-তিন বছর পর তোকে নিয়ে বিলে বন্দুক দিয়ে পাখি শিকারে যাবো ”।

পরদিন যেটাই দেখি সেটাই এইম করি । উৎসাহ টগবগ করে ফুটছে- জিম করবেট ,কেনেথ এন্ডারসন না হলে পঁচাব্দী গাজীতো হতে পারবো ! গ্রামের দুষ্টু প্রকৃতির কিছু তরুণ আমাকে ফরদীবাড়ী কবরস্থানের পাশে শেয়াল শিকারের জন্য উৎসাহ দেয়ার সাথে সাথে একটু ইগো চাঙ্গা করতে “বাঘও থাকত পারে, ডরাইবানাতো ?” একটু সামনে এগোতেই পিছনে তাদের খিকখিক হাসির সাথে ‘ টুলাও পাইতনা,ডরাইছে ’।শুনে ঋতুর দিকে তাকাতেই বললো “বন বিড়াল”। হঠাৎ মাথার উপর দিয়ে ফরফর শব্দ তুলে একটি পাখি উড়ে যেতেই ঋতু তৎপর হয়ে উঠল । কিছুটা দূরে বড় একটি জাম গাছ থেকে কুরকুর কুরকুর করে একটা মন উদাস করা আওয়াজে দেখলাম কবুতরের মতো পাখিটাকে । লম্বা লেজের ছিটছিটে বাদামী রঙের পাখিটির নজর সামনের দিকে ,আমাদের দিকে তার খেয়ালই নেই; পাত্তাই দিচ্ছে না । এটাই নাকি ঘুঘু পাখি । ঘুঘু পাখি মিস করার পর হলুদ রঙের একটা ঢেউ লক্ষ করে ঋতু দৌড়াতে লাগল ,“ কুটুম পাখি ,কুটুম পাখি ” । কালো গলার হলুদ রঙের পাখিটি ঘুঘু থেকে অনেক সতর্ক । এত মিষ্টি আওয়াজ । যে বাড়ির আশেপাশে ডাকে সেখানে নাকি কুটুম আসে । অনেক দৌড়াদৌড়ি করে বুঝলাম হলুদ পাখির পিছে দৌড়ে লাভ নেই । ‘ চলো তো দেখি সামনের বেগুন খেতে, একটা টুনির বাসায় দুইটা ছাও আছে ,’ ঋতু । বেগুন খেতের পাশে টুই টুই করে সাউন্ড বক্সের আওয়াজ । লম্বা ঠোঁটের হালকা সবুজ রঙের এতোটুকু পিচ্চি টুনটুনির গলাতে এতো আওয়াজ ! খুব চঞ্চল । একটা বড় পাতাকে পানের খিলির মতো কিভাবে ভাঁজ করল, আর কিভাবে এই পাতাটাকে দর্জির মতো নিখুঁতভাবে সেলাই করলো - আল্লাহই জানেন । ভিতরে তুলার মত কিছু একটা আর ছোট ছোট খড় দেখলাম , কিন্তু কোন ছানাপোনা দেখলাম না । বাড়ি ফিরতেই আম্মার ঝাড়ি খেলাম ।

আবুনীর মা বুবু মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,‘ ভাই আমার কত্ত বড় হইয়া গেছে ’। হঠাৎ করে কোয়াক-কোয়াক করে একটানা একটা ডাক শুনে বললেন, “ ডাউক পাখির ডিম ফুটছে। এহন সারা রাইত ডাকবো ,ডাকতে ডাকতে গলা দিয়া রক্ত বাইরইবো । সেই রক্ত বাচ্চার চোখের উপর দিলে বাচ্চার চোখ ফুটবো ”! শুনে গা হিম হয়ে আসে । পিছনের খালের দিকে অনেকক্ষণ নজর দিতেই খুব সতর্ক একটা মুরগির মত পাখি দেখলাম । লেজ উঁচু করে লম্বা লম্বা হলুদ পা দিয়ে পিঠের কালচে-বেগুনি অংশ আর পেটের সাদা অংশ নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। এটা একটা ডাহুক পাখি । আবুনীর মা বুবু বললেন পালিত বক আর ডাহুক পাখি দিয়ে শিকারিরা বন্য বক ও ডাহুক ধরে ।

পুরো গরমের ছুটিতে অসংখ্য বক, পায়রা ,ঘুঘু, ডাহুক, টুনটুনিকে গুলতি দিয়ে গুলি ছুঁড়ে শান্তিতে থাকতে দিলাম না । ধানক্ষেতে ধ্যানমগ্ন একঠ্যাংগা লম্বা বড় সাদা বকগুলোর আশেপাশেও যেতে পারলাম না । দেখে মনে হয় তারা ঘুমিয়ে আছে , কিন্তু কাছাকাছি যাওয়ার সাথে সাথেই হাওয়া । গ্রামের বদ টাইপের ছেলে ছোকরারা হাসাহাসি করে ।

ঢাকায় আসার পথে এক ব্যাগ মাটির গুলি নিয়ে নানা বাসায় আসলাম । মনের দুঃখে এখন পাখির দিকে তাক না করে দূরের কোনো লাঠি কিংবা কৌটার দিকে তাক করি। হঠাৎ লেবু গাছের পাশ থেকে একটা মিষ্টি শীষের আওয়াজ পেলাম । আমি এখন কিছু কিছু পাখির ডাক শুনলেই চিনতে পারি ,এটা নিশ্চয়ই একটা দোয়েল পাখি । কালো পিঠ আর নীলচে তামাটে গলা আর সাদা পেট নিয়ে এই স্মার্ট পাখিটি খুব চঞ্চল । না , গুলি করার কোন স্কোপই পেলাম না । এই সময় বেল গাছ থেকে টুই টুই করে টুনটুনির আওয়াজে মন মেজাজ খারাপ করে তাক করার সাথে সাথে গুলি ছুঁড়ে দেই । হঠাৎ পাখা ঝাপটে ঘুরতে ঘুরতে বেল গাছ থেকে পাখিটি নীচে মাটিতে পড়ে গেলো । আমার হাত-পা -বুক থরথর করে কাঁপতে লাগলো । একটা ছোট্ট টুনটুনি পাখিকে আমি মেরে ফেললাম ! এটাতো খাওয়াও যায় না । ভয়, লজ্জা , অনুশোচনায় পাখির মাথায় পানি দিতে থাকলাম । এই পানির সাথে মিশে গেলো আমার চোখের পানিও । গুলতি ছুঁড়ে ফেলে দিলাম দূরে ।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

শিকারের শিকারী বধ

আসফাক বীন রহমান

বুধবার, ২২ জুন ২০২২

“ বালা টিক্যা পইট করো , চোখে লাগবো কইলাম”- ঋতু বলতে না বলতে গুলতি ছেড়ে দিতেই মাটির গুলিটি হাতে লেগে প্রচন্ড ব্যাথা দিলো । আমরা সড়কের পাশে খাঁ বাড়ীর ঢালে একটি কদম গাছের নীচে দুইজনে ঊর্ধ্বমুখী দাঁড়িয়ে আছি । সকাল থেকেই পকেটভর্তি মাটির গুলি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছি । আজকে একটা হেস্তনেস্ত করবোই । প্রতিদিন পাখি শিকারে বের হই , ফলাফল অষ্টরম্ভা ।

পরশু দিনের আগের দিন জালশুকা এসেছি । গোঁসাইপুর ঘাট থেকে প্রায় এক ঘণ্টা হেঁটে বাড়ী আসতে হয়েছে । ক্ষেতের আইল ,সড়কের ভাঙ্গা অংশ আর বাড়ি- ঘরের ভিতর দিয়ে আসতে গিয়ে আম্মার পা ব্যাথায় ফুলে গেছে । বর্ষাকালে জালশুকার জার্নিটা আম্মার জন্য আরামদায়ক । পুরোটা পথ নৌকায় আসতে পারেন । সড়ক থেকে মোল্লা বাড়ীর সামনের ব্রীজটায় উঠতেই বাংলাঘরের কোনায় দাদাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম ।

ইমন চিৎকার করে “ দাদা আমরা আইসা গেছি ” বলে পুকুরের পাশ ঘেঁষে শুকাতে দেয়া খড়ের উপর দিয়ে দৌঁড়ে দাদাকে জড়িয়ে ধরলো । আম্মাকে ফেলে আমিও দৌঁড় দিবো কিনা ভাবছি । আম্মা বললেন ,“ঐ যে তোমার দাদা কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন ,কাছে যাও”। আম্মার চোখের কোনের পানি চশমাটি আড়াল করতে পারেনি । মুখে হাসি ,চোখে পানি ; অনেক সময় বড়দের ব্যাপার স্যাপার বুঝতে পারিনা । পুরো গোঁসাইপুরের মাটির রাস্তায় বারবার থেমে , মাঝে মাঝে ওমাগো এবার পাটা মনে হয় মঁচকে গেছে বলে ইমনকে ডাকাডাকি করেছেন ।

বারবার বিরক্ত আম্মা অনুপস্থিত আব্বাকেও হুমকি দিচ্ছিলেন, “এরপর থেকে বর্ষা ছাড়া আমি জালশুকায় আসবো না ”। এখন আবার খুশিতে চোখ-মুখ চিকচিক করছে । দাদাকে সালাম করতেই বুকে জড়িয়ে ধরেন । দাদী পর্দানশীন মানুষ , বাড়ীর বাইরে আসেন না ; তারপরও ঘরের কোনায় লেবুর শরবত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন । ইমনের চোখ-মুখ দাদী আঁচল দিয়ে মুছে দিয়ে মাথায় হাত বুলাচ্ছেন । আমাদের দেখার সাথে সাথে বিশাল এক ঝাঁক এন্ডা-পেন্ডা জড়ো হয়েছে ।ওরা খুব মনোযোগের সাথে আমাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছে । টিউবওয়েলের পাশে গেলে তাদের এক গ্রুপ কে কার আগে টিউবওয়েলে চাপ দিবে ,ঠেলাঠেলি লাগিয়েছে । ইমনের হাতের লাক্স সাবান দেখে “সাবানডার বুই হুব সুন্দর ”- সমস্বরে বলে উঠলো ।

আম্মা ঘরে এসেই ব্যাগ-বোঁচকা খোলা শুরু করেছেন । দাদী বেশ কয়বার এই বাহিনীকে যার যার বাড়ী যাবার নির্দেশনা দিলেও কোনো কাজে আসেনি । বেতের ঝুড়িতে বেশ কয় রকম তরকারী ও শুকনা খাবার নানী দিয়ে দিয়েছেন । আম্মা হাতের ইশারা করে এক স্মলম্যানকে ডাকলেন । একহাতে নাকের সিকনি মুছতে মুছতে আরেক হাতে প্যান্ট সামলে বাচ্চাটি আসতেই আম্মা বললেন তোমার নাম কী? আম্মা স্কুল টিচার , তাই ছোট বাচ্চাদের খুব পছন্দ করেন ।

ঝুড়ি থেকে কাগজের এক বিশাল ঠোঙ্গা বের করলেন । ইমন আর আমি হতবাক ! একজন আরেকজনের সাথে চোখাচোখি করে বোঝাতে চাইলাম ‘ও এই ব্যাপার’! ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসার পথে ট্রেনে এতগুলো লজেন্স কেনো কিনলেন সেটা মালুম হলো। আমরা তখন অনেক অনুনয় বিনয় করে মাত্র দুটি করে পেয়েছিলাম । এই কয়দিন নানা বাড়ি থাকার সময়ে বেশ কয়েকবার আম্মার ট্রাংকে পর্যন্ত হানা দিয়েছি ! বাচ্চাগুলোকে লাইনে দাঁড় করিয়ে এক এক করে লজেন্স দিয়ে বিদায় করলেন । দাদি এক ফাঁকে দেখে গিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে গেলেন ‘ বউ যে কি করো’।

বিকালে ঋতুর দেখা পেলাম । গলায় একটা ব্রহ্মাস্ত্র ঝুলানো । সারাদিন জাল আর ছিপ দিয়ে বিভিন্ন পুকুর-বিল-নদীতে মাছ ধরাটা তার নেশা । মাঝে মাঝে ভোর কিংবা সন্ধ্যায় পঞ্চাবটীর শ্মশানের বাঁকে ভুতের আস্তানার(!) পাশে মাছ ধরতে যায় । তখন ওর মা এসে কান্নাকাটি করেন। পাখি আর পাখির ছানা-পোনাদের হাল-হকিকত এই ডানপিটে ছেলেটির থেকে কেউ বেশী জানেনা । সম্পর্কে আমার ভাতিজা ও সমবয়সী । দাদী ওকে দেখেই , ‘তুই পাখি মারিস কেনো ’ বলে একটা বকা দিলেন ।

আমি গলায় ঝুলানো ব্রহ্মাস্ত্রটি দেখে এর নাম জিজ্ঞেস করলাম । বললো ‘গুলতি’। সাথে সাথে গলা থেকে খুলে আমাকে এর কার্যকারিতা বুঝিয়ে দিতে শুরু করলো,‘ এই যে কাঠের ইংরেজি ওয়াই -এর মতো অংশটা হাত দিয়া ধরো ।’ দুটি রাবারের সামনের অংশের চামড়া টুকরায় একটি ছোট মার্বেল রাখার সাথে সাথে ইমন ওটা নিয়ে পকেটে ভরে ফেলল । ঢাকার মার্বেল থেকে কিছুটা আলাদা দেখতে । ওইটা কাঁচের তৈরী আর এটা মাটির মতো মনে হচ্ছে । ঋতুকে বললাম এগুলো কোন জায়গা থেকে কিনেছো ? আকাশ থেকে পড়লো এমন ভাব নিয়ে বললো,“ এইগুলি আবার কৈ বেচবো , আমি বানাইছি ”। পকেট থেকে বাদামী-লালচে মাটির মতো মার্বেলটি বের করে আমরা দেখতে লাগলাম । পাকায় ফেললে ভাঙছে না ।

আমিঃ আমাকে দেখাবে কিভাবে বানায় ?

ঋতুঃ কাইল লইয়ো ।

আপাতত বাড়ীর পিছনের বাঁশঝাড়ের সঙ্গের শোলার টালের পাশে আমাদের শিখিয়ে দেয় কিভাবে গুলতি মারতে হয়।

পরদিন ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে ঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে নানা নকশা করে আলো ঘুম ভেঙে দিলো । পাখিদের কল কাকলির এত চিৎকার ! বাঁশঝাড়ে মনে হয় পাখিদের ঈদ উৎসব চলছে । বিরাট পালঙ্কে আম্মার এক পাশে আমি অন্যপাশে ইমন ।বিশাল নকশাকাটা দরজা খোলার জন্য মোড়ার উপর দাঁড়াতেই দাদি পাশের রুম থেকে এসে দরজা খুলে দিলেন । কি সুন্দর ভোরের নরম আলো । ঢাকায় এরকম ভোরে কখনো নিজে নিজে ঘুম ভাঙেনি । দাদীকে দেখলাম উঠানের ওই পাড়ে হাঁস- মুরগির খোয়ারের দরজা খুলে ওযু করতে যাচ্ছেন । খোয়ারটিতে দুইজন প্রমাণ সাইজের বাচ্চা ঢুকতে পারে । এটা লাল-নীল কাঠের নকশা ও টিনের তৈরি একটা ছোট্ট চার চালা টিনের ঘর ,চাচা বানিয়েছেন । বেশি সামনে যেতে ভয় লাগে, রাজহাঁসের জন্য । বিশাল কয়টা রাজহাঁস আছে , সামনে গেলে গলা মাটির সমান্তরালে নামিয়ে তেড়ে আসে ।

বাঁশঝাড়ের দিকে তাকাতেই মনে হলো অসংখ্য ছেড়া সাদা কাপড় কে যেন বাঁশেঝাড়ের মাথায় বেঁধে দিয়েছে । মাঝে মাঝে হঠাৎ করে এক একটা সাদা কাপড়ের টুকরা নিজ থেকে চার-পাঁচ গুন বড় হয়ে বক হয়ে পাখা মেলে আকাশে উড়ে যাচ্ছে । সামনে হলুদ ঠোঁট আর সাদা শরীরের পিছনে লম্বা দুটি পা বাংলাদেশ বিমানের লোগো উড়ণ্ত বলাকার আকৃতির কথা মনে করিয়ে দেয় । সাঁই সাঁই করে মাথার উপর দিয়ে নদীর দিকে চলে যাচ্ছে । হঠাৎ করে সিনেমার পেত্নীর মত ই-হি- ই -হি-ই-হি কর্কশ আওয়াজে বুকে কাঁপন ধরে গেছে । এই সাতসকালে পেত্নী আসলো কোত্থেকে ? দাদী ইশারা করে বাঁশঝাড়ের পাশে টিউবওয়েলের পার থেকে ডাকলেন । দৌড়ে দাদীর কাছে যেতেই আঙ্গুল দিয়ে খালের পাশে বড় আমগাছটার দিকে দেখালেন, তখনই কানে আসলো ঠক ঠক ঠক ঠক আওয়াজ । কি সুন্দর একটা হলুদ ছিটছিটে পাখি ! মাথায় লাল ঝুঁটি । বললেন কাঠকুড়ালি । এটা আবার কি নাম ? এবার বললেন কাঠঠোকরা । কিন্তু, পেত্নীর মত আওয়াজটা কিসের জিজ্ঞেস করতেই দাদী বললেন পাখি উড়ে যাবার সময় এই ভাবে ডাকে ।

নাস্তার পর পর ঋতুর সাথে পথ দিলাম । ভাঙ্গা সড়ক ধরে পশ্চিম দিকে যেতে লাগলাম ।

--এটাতো গোঁসাইপুর যাবার পথ ।

--হ্যাঁ । সামনে কুমার বাড়ি ।

--কুমার মানে, যারা মাটির জিনিস বানায় ?

জালশুকার পশ্চিম প্রান্তে কুমোর বাড়ি । এই সাতসকালে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে । কালো মাটির স্তুপ একটা বাড়ির পাশে দেখতে পেলাম । উপরে একটা বেড়ার ছাউনি , ভেজা কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে রেখেছে । এক বয়স্ক ভদ্রলোক একটা গরুর গাড়ির চাকা মাটিতে ফেলে ঘোরাচ্ছেন। আমি হাঁটুর উপর বসে এটা দেখতে লাগলাম ।

ধুতি পরা ভদ্রলোকঃ জিতু মিয়া ,এই পুলাডা কেডা ?

ঋতুঃ ডাইরেক্টর সাহেবের নাতি ।

ঋতুকে দেখলাম ওরা জিতু মিয়া বলে ডাকছে ।

ঋতুঃ কদ্দুর মাটি লাগবো, গুলি বানাইতাম ।

উনি কোদাল দিয়ে মাটি কেটে নিলেন । আমাকে বুঝিয়ে দিলেন দোআঁশ বা বেলে মাটি দিয়ে মাটির বাসন- কোসন বানানো যাবেনা,এঁটেল মাটি লাগবে । এই মাটি ওনারা প্রতিবছর পানি নেমে গেলে কোন না কোন জমির মালিকের কাছ থেকে কিনেন । সেটাকে ঠান্ডা জায়গায় সংরক্ষণ করেন ,মাঝে মাঝে পানি দেন, কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে রাখেন । কিছু বানানোর আগে সেটা ভালো করে ছেনে নুরী -পাথড় -শামুক আলাদা করেন । আমরা তিনজন দুই হাতের মাঝখানে মাটি নিয়ে প্রায় দুই-তিনশো মার্বেল সাইজ গুলি বানিয়ে রোদে শুকাতে দিলাম । দুপুরে উনুনের জ্বলন্ত ছাইয়ে এইগুলো দেওয়ার পর বিকালের মধ্যে লালচে-বাদামি গুলি পেয়ে গেলাম । বিকালে পকেটে ভরে গুলি নিয়ে গুলতি প্র্যাকটিস করতে বেরোলাম । গাব গাছের পাশে খড়ের গাদার পেছনে বড় আমগাছটার নীচে ইজি চেয়ারে বসে দাদা আমাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছেন । উনি এ সময় পেপার পড়েন । খেলাধুলা, এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতে উনার অনেক উৎসাহ । আমাকে দেখে উৎসাহিত করে বললেন,“ ভালো করে প্র্যাকটিস কর , দুই-তিন বছর পর তোকে নিয়ে বিলে বন্দুক দিয়ে পাখি শিকারে যাবো ”।

পরদিন যেটাই দেখি সেটাই এইম করি । উৎসাহ টগবগ করে ফুটছে- জিম করবেট ,কেনেথ এন্ডারসন না হলে পঁচাব্দী গাজীতো হতে পারবো ! গ্রামের দুষ্টু প্রকৃতির কিছু তরুণ আমাকে ফরদীবাড়ী কবরস্থানের পাশে শেয়াল শিকারের জন্য উৎসাহ দেয়ার সাথে সাথে একটু ইগো চাঙ্গা করতে “বাঘও থাকত পারে, ডরাইবানাতো ?” একটু সামনে এগোতেই পিছনে তাদের খিকখিক হাসির সাথে ‘ টুলাও পাইতনা,ডরাইছে ’।শুনে ঋতুর দিকে তাকাতেই বললো “বন বিড়াল”। হঠাৎ মাথার উপর দিয়ে ফরফর শব্দ তুলে একটি পাখি উড়ে যেতেই ঋতু তৎপর হয়ে উঠল । কিছুটা দূরে বড় একটি জাম গাছ থেকে কুরকুর কুরকুর করে একটা মন উদাস করা আওয়াজে দেখলাম কবুতরের মতো পাখিটাকে । লম্বা লেজের ছিটছিটে বাদামী রঙের পাখিটির নজর সামনের দিকে ,আমাদের দিকে তার খেয়ালই নেই; পাত্তাই দিচ্ছে না । এটাই নাকি ঘুঘু পাখি । ঘুঘু পাখি মিস করার পর হলুদ রঙের একটা ঢেউ লক্ষ করে ঋতু দৌড়াতে লাগল ,“ কুটুম পাখি ,কুটুম পাখি ” । কালো গলার হলুদ রঙের পাখিটি ঘুঘু থেকে অনেক সতর্ক । এত মিষ্টি আওয়াজ । যে বাড়ির আশেপাশে ডাকে সেখানে নাকি কুটুম আসে । অনেক দৌড়াদৌড়ি করে বুঝলাম হলুদ পাখির পিছে দৌড়ে লাভ নেই । ‘ চলো তো দেখি সামনের বেগুন খেতে, একটা টুনির বাসায় দুইটা ছাও আছে ,’ ঋতু । বেগুন খেতের পাশে টুই টুই করে সাউন্ড বক্সের আওয়াজ । লম্বা ঠোঁটের হালকা সবুজ রঙের এতোটুকু পিচ্চি টুনটুনির গলাতে এতো আওয়াজ ! খুব চঞ্চল । একটা বড় পাতাকে পানের খিলির মতো কিভাবে ভাঁজ করল, আর কিভাবে এই পাতাটাকে দর্জির মতো নিখুঁতভাবে সেলাই করলো - আল্লাহই জানেন । ভিতরে তুলার মত কিছু একটা আর ছোট ছোট খড় দেখলাম , কিন্তু কোন ছানাপোনা দেখলাম না । বাড়ি ফিরতেই আম্মার ঝাড়ি খেলাম ।

আবুনীর মা বুবু মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,‘ ভাই আমার কত্ত বড় হইয়া গেছে ’। হঠাৎ করে কোয়াক-কোয়াক করে একটানা একটা ডাক শুনে বললেন, “ ডাউক পাখির ডিম ফুটছে। এহন সারা রাইত ডাকবো ,ডাকতে ডাকতে গলা দিয়া রক্ত বাইরইবো । সেই রক্ত বাচ্চার চোখের উপর দিলে বাচ্চার চোখ ফুটবো ”! শুনে গা হিম হয়ে আসে । পিছনের খালের দিকে অনেকক্ষণ নজর দিতেই খুব সতর্ক একটা মুরগির মত পাখি দেখলাম । লেজ উঁচু করে লম্বা লম্বা হলুদ পা দিয়ে পিঠের কালচে-বেগুনি অংশ আর পেটের সাদা অংশ নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। এটা একটা ডাহুক পাখি । আবুনীর মা বুবু বললেন পালিত বক আর ডাহুক পাখি দিয়ে শিকারিরা বন্য বক ও ডাহুক ধরে ।

পুরো গরমের ছুটিতে অসংখ্য বক, পায়রা ,ঘুঘু, ডাহুক, টুনটুনিকে গুলতি দিয়ে গুলি ছুঁড়ে শান্তিতে থাকতে দিলাম না । ধানক্ষেতে ধ্যানমগ্ন একঠ্যাংগা লম্বা বড় সাদা বকগুলোর আশেপাশেও যেতে পারলাম না । দেখে মনে হয় তারা ঘুমিয়ে আছে , কিন্তু কাছাকাছি যাওয়ার সাথে সাথেই হাওয়া । গ্রামের বদ টাইপের ছেলে ছোকরারা হাসাহাসি করে ।

ঢাকায় আসার পথে এক ব্যাগ মাটির গুলি নিয়ে নানা বাসায় আসলাম । মনের দুঃখে এখন পাখির দিকে তাক না করে দূরের কোনো লাঠি কিংবা কৌটার দিকে তাক করি। হঠাৎ লেবু গাছের পাশ থেকে একটা মিষ্টি শীষের আওয়াজ পেলাম । আমি এখন কিছু কিছু পাখির ডাক শুনলেই চিনতে পারি ,এটা নিশ্চয়ই একটা দোয়েল পাখি । কালো পিঠ আর নীলচে তামাটে গলা আর সাদা পেট নিয়ে এই স্মার্ট পাখিটি খুব চঞ্চল । না , গুলি করার কোন স্কোপই পেলাম না । এই সময় বেল গাছ থেকে টুই টুই করে টুনটুনির আওয়াজে মন মেজাজ খারাপ করে তাক করার সাথে সাথে গুলি ছুঁড়ে দেই । হঠাৎ পাখা ঝাপটে ঘুরতে ঘুরতে বেল গাছ থেকে পাখিটি নীচে মাটিতে পড়ে গেলো । আমার হাত-পা -বুক থরথর করে কাঁপতে লাগলো । একটা ছোট্ট টুনটুনি পাখিকে আমি মেরে ফেললাম ! এটাতো খাওয়াও যায় না । ভয়, লজ্জা , অনুশোচনায় পাখির মাথায় পানি দিতে থাকলাম । এই পানির সাথে মিশে গেলো আমার চোখের পানিও । গুলতি ছুঁড়ে ফেলে দিলাম দূরে ।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ]

back to top