alt

মুক্ত আলোচনা

রেলগাড়ি ঝমাঝম

আসফাক বীন রহমান

: মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই ২০২২

“ পালাও ! পালাও ! কাশেম মামা আইলো !” নানা বাড়ির মেইন গেট থেকে ইমনের সাবধানবাণী দ্রুত এগিয়ে আসছে । কমান্ডো স্টাইলে পিছনের ওয়াল বেয়ে তড়িৎবেগে ছাদে নিরাপদ অবস্থানে এসে পরিস্থিতি যাচাই করতে বসি । পশ্চিম দিকে ড্রইং রুমের জানালা বরাবর প্রথমে ইমনের হাত পরে মাথা বের হতে দেখে নিশ্চিন্ত হই । তিনদিন হলো নানাবাড়ি এসেছি । বিরাট আনন্দ ! আজ সকালেই কামরাঙ্গা গাছে জাহাঙ্গীরকে উঠিয়ে প্রায় তিন কেজির মতো কামরাঙ্গা পেরেছি , কুচি কুচি করে কাটিয়ে বাছিরের মায়ের মাধ্যমে শুকনা মরিচ ভেজে কামরাঙ্গার ভর্তা বানিয়ে জনে জনে সাধতে বসেছি । কেউ খেতে চাচ্ছে না । আম্মা এক দফা হুমকি দিয়েছেন ,“তোরা যতটুক খেতে পারবি ,ততোটুকু ভর্তা কর”। এতগুলো কামরাঙ্গার কি গতি করব চিন্তা করতে করতে নানীর বিশাল হামানদিস্তাটার দিকে চোখ পড়লো। “ নানী ,এটা নিতে পারি ?” আমার কথায় নানী কুটকুট করে হেসে বললেন “ কি করবে ভাইয়া?” আমরা যা-ই করি তাতেই নানী বেশ মজা পান আর হাসেন । আমাদের অতিরিক্ত কামরাঙ্গা সংক্রান্ত সমস্যার কথা জানিয়ে বললাম,“ হামানদিস্তায় ছেঁচে কামরাঙ্গার জুস বানাবো, জুস কেউ না খেয়ে থাকতে পারবে না ”।এর মধ্যেই ইমনের বিপদ সংকেত!

কাশেম মামা নানার খুব প্রিয় ভাগ্নে , আম্মার ফুফাতো ভাই । সরকারি চাকরি করেন । খুবই অনেস্ট মানুষ । আল্লাহ উনাকে টাকা দেন নাই তবে ওনার বাসা ভর্তি জুয়েল । প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ে স্কলার । ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসলেই একটাই কথা , ‘ এবার কাশেম ভাইয়ের মেজো মেয়ে বৃত্তি পেয়েছে, বড় ছেলে ডাক্তারিতে ভর্তি হয়েছে ,এক মেয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে মেট্রিক পরীক্ষা পাস করেছে ।’ আমরা এসব শুনে আরো খুশি হই- যাক আমাদের মধ্যে কেউ খুব ভালো রেজাল্ট করেছে । কিন্তু , সমস্যা হলো কাশেম মামা আমাদেরকে দেখলেই খপ করে হাত ধরে বলেন , “ ভাইগ্না এইবার কোন ক্লাসে উঠছো? টেনস পড়ানো হইছে ? বলোতো ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মরিয়া গেলো কোন টেনস?” বিরাট বিপদ ! প্রেস্টিজ নিয়ে টানাটানি ! উনি নিজে ক্লাস ওয়ান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত সব ছেলে- মেয়ের পড়াশোনার তত্ত্বাবধান করেন । প্রত্যেকটা সাবজেক্ট সম্বন্ধে এ টু জেড আইডিয়া । এরমধ্যে মাঝে মাঝে ছোটমামা কাসেম মামাকে দেখলেই “ কাশেম ভাই, ওরা দু’জন ঢাকার স্কুলে খুব ভালো করছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর ঢাকার স্কুলের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কিনা একটু যদি যাচাই করতেন ?” আমরা বুঝতে পারি , আমাদের দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ ছোটমামা কাশেম মামাকে দিয়ে আমাদের সাইজ করতে চান !

গতকালও কাশেম মামার সাথে আমাদের দেখা হয়েছে । আমি বেঁচে গিয়েছি , ইমন ধরা খেয়েছে । কাসেম মামা যখন বাসার ভেতর আসেন, তখন আমি নানার ইজি-চেয়ারের পাশে বসে ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকা জোরে জোরে পড়ে নানাকে শুনাচ্ছিলাম । নানা মাঝে মাঝে “এটা না ,আগাও” “বলে সাড়া দিচ্ছেন ; আবার কখনো কখনো বলছেন ‘হুম’ । কিন্তু ‘ সালাউদ্দিন আবারো সেরা গোলদাতা , পাওলো রসি মোটর মেকানিক থেকে বিশ্বকাপ হিরো’- এইসব নিউজে নানার কেনো অনীহা সেটা বুঝতে পারছি না । আবার ‘ এবার প্রবৃদ্ধি ৩% এর নিচে বা ভারতে দাঙ্গা ’ ইত্যাদি নিউজে নানার এতো বেশী আগ্রহ কেনো সেটাও বুঝতে পারছি না । আমরা যে নিউজ পড়তে চাই - নানা সেটা শুনতে চান না আর নানা যেটা শুনতে চান - আমাদের সেটা পছন্দ না । তবে নানার পাশে বসে পত্রিকা পড়ায় অনেক জ্ঞান আহরণ হচ্ছে ! ‘ দক্ষিণ আফ্রিকায় ফেরী ডুবীতে তিনজনের সলিল সমাধি , উত্তর চীন সাগরে ভয়াবহ ঝড় ’ ইত্যাদি নিউজ পড়ে বড় খালাকে কনভে করায় বেশ সাড়া পাচ্ছি । বড় খালা আজ সকালেই খাসী মানত করেছেন সারোয়ার ভাইয়ের জন্য । সারোয়ার ভাই মেরিন ইঞ্জিনিয়ার । নানার সামনে কাশেম মামাকে দেখে টুক করে কদমবুচি করে আবার পত্রিকা নিয়ে নানার শেল্টারে চলে আসি । কাশেম মামা সমানে মুচকি মুচকি হাসছিলেন ।

নানা সেই ১৯৩০ সনে ‘বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস’ এর মাধ্যমে সরকারি চাকুরি শুরু করেন । বিভিন্ন জেলায় এসডিও , ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৬৫ সনে ডেপুটি সেক্রেটারি হিসেবে রিটায়ার করেন । উনার পদবী এবং সততার কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দক্ষিণাঞ্চলে ‘ডেপুটি বাড়ির পাশের গ্রামে আমার বাড়ি ’ বললেও মানুষ সমীহ করেন ,ইজ্জত করেন । নিভৃৃতচারী ‘আব্দুল হাই সাহেব ’ খুবই কম কথা বলেন। নির্দিষ্ট সময়ে পুরো বাড়ীতে হেঁটে ব্যায়াম , নির্দিষ্ট পরিমাপে খাওয়া , নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম , সকাল-সন্ধ্যা রেডিওতে বিবিসি -ভয়েস অব আমেেরিকা শোনা - পুরোপুরি রুটিন মাফিক জীবন । মাঝে মাঝে নানাকে উদ্বিগ্ন করার জন্য আম্মার” আব্বা, সুমন- ইমনের এইবারের গরমের ছুটিতে আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঁচ তারিখে আসছি “চিঠিই যথেষ্ঠ ! নানা বাসার ছাদের মই সরিয়ে দেওয়া এবং পিছনের খালে যাওয়ার সিড়ির দরজায় তালা লাগাতে নির্দেশ দেন । একটু পরপর আম্মাকে ডেকে বলেন ,” রুবি তোর ছেলে দুইটা কই ? ছাদে উঠে নাইতো ? “ আমাদেরকে আম -কাঁঠাল আর পেয়ারা গাছের আশেপাশে দেখলেই নিষেধ করেন , ” এই গাছে ওঠো না, হাত-পা ভাঙবে “। সব সময় দেখতাম , ওনার নিজের গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের অনেকগুলো গ্রামের দুঃস্থ দুই -তিনজন ছেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্কুল- কলেজে উনার খরচে থাকা, খাওয়া ও পড়াশোনা করছে । দরকার হলে তাদের চাকুরির জন্য সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পাঁচ ছেলে ও পাঁচ জামাতাকে বলতেন । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দক্ষিণাঞ্চলের দুঃস্থ কন্যাদায়গ্রস্হ পিতা-মাতা এবং শিক্ষা গ্রহণেচ্ছু ছেলেদের জন্য উনি ছিলেন বাতিঘর ।

কাশেম মামা নীচ থেকে,“ ভাইগ্না , তোমাদের পড়া ধরবো না ; নেমে আসো । কাল আমার বাসায় রাতে তোমাদের দাওয়া” বলে কোন সাড়া-শব্দ না পেয়ে “ আলামতই না ! দাওয়াতের কথা শুনলে মানুষ পালায় এইটাতো কোনোদিন শুনি নাই” , বলে চলে গেলেন ।

আম্মার মাধ্যমে তদবীর করে দাওয়াতে এটেইন করি , শর্ত একটাই ‘দাওয়াত হচ্ছে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপার , পড়াশোনার আলোচনা অন্য সময় হবে ’। বাসার গেটে কাশেম মামা সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “ বাবা পড়াশোনা থেকে পালিয়ে বেড়াবে না ”।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এবার এসেছি ‘উল্কা এক্সপ্রেস ’এ । নাম যেমন ‘উল্কা’ এর গতিও উল্কার মতো । ঢাকা -চট্টগ্রামের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত গতির ট্রেন । ট্রেন টঙ্গী পার হলেই যে টান দেয় , তাতে করে ভয় লাগে । সমানে ডানে- বামে দুলুনীর সাথে সাথে নেশা ধরানো প্রলম্বিত হুইসেল মনের মধ্যে

‘রেলগাড়ি ঝমাঝম

পা পিছলে আলুর দম’-

তালের সৃষ্টি করে । টিকেট পাওয়া যায়- কিন্তু সিট পাওয়াটাই দুরূহ । ট্রেন কমলাপুরে ঢোকার সাথে সাথে কুলিদের ‘লাল ফৌজ’ দ্রুতগতিতে সিটগুলোর দখল নিয়ে নেয় । টিকিট কাউন্টারে রেলওয়েকে টাকা দিয়ে টিকিট পাওয়া যায় আর সিট নিতে হলে কুলিদের টাকা দিতে হবে ! আব্বা আমাদের ট্রেনে উঠিয়ে দিতে এসেছেন , তাই সমস্যা হয়নি । ট্রেনে উঠেই আম্মার নজর বইয়ের হকারের ঝুলিতে নিমাই ভট্টাচার্য , আশাপূর্ণা দেবী - বিমল মিত্রের বইগুলোতে আর আমাদের নজর চানাচুরওয়ালার দিকে । যেহেতু ভ্যাকেশন - তাই অনেক কিছুই মাফ । লজেন্স, বাদাম ,চানাচুর ,আমড়া সব কিছুই আমরা বিনা ওজরে পেয়ে যাই । কমলাপুর ষ্টেশন থেকে ট্রেন বের হবার সাথে সাথে শাহজাহানপুর কলোনির আশেপাশের বিশাল মাঠ আর ঝিরঝিরে বাতাসে মনের ভিতর চনমনে অনুভূতি তৈরী করে । তেজগাঁও স্টেশন পার হবার সাথে সাথে সবুজ গাছপালা আর বড় বড় ফাঁকা মাঠ দেখলেই মনে হয়- ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাচ্ছি । কতো আনন্দ ! নতুন তৈরি হওয়া বিমানবন্দর স্টেশন , টঙ্গী, পূবাইল ,আড়িখোলা পার হয়ে শীতলক্ষা ব্রিজ পেরোলেই ঘোড়াশাল । আমাদের আর পায় কে ? ঘোড়াশাল মানেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসেই গেছি ! ভৈরব ষ্টেশন পেরুলেই আমরা দুই ভাই জানালা দিয়ে মাথা বের করে মেঘনা ব্রীজের দিকে তাকিয়ে থাকি । বিশাল বাঁক নিয়ে ট্রেন আস্তে আস্তে মেঘনার লাল লোহার ব্রীজে উঠে গমগম শব্দ তুলে চলতে থাকে । নীচে মেঘনার প্রবল স্রোত দেখলে ভয় লাগে - দ্রুত মাথা ভিতরে ঢুকিয়ে ফেলি । কতোদিন পর মেঘনার সাথে আবার দেখা । ভেট হিসেবে দুটি বাদাম বা একটি লজেন্স মেঘনা নদীর দিকে এগিয়ে দেই ।

যতোই ট্রেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে এগুতে থাকে আম্মার টেনশন বাড়তে থাকে । যেহেতু আগেভাগে সিট রিজার্ভের ব্যবস্থা নাই- তাই স্টেশনে ট্রাংক, ঝুড়ি ,ব্যাগ নিয়ে ধাক্কাধাক্কির মধ্যে নামাটা বেশ দুঃসাধ্য। কিন্তু আমাদের দুজনের মধ্যে কোন টেনশন নাই । আমরা জানি , আমাদের জন্য দুই গ্রুপ সাহায্যকারী থাকবেন- প্রতিবারের মতোই । হ্যাঁ - ঐতো এনাম ভাইয়ের নেতৃত্বে পিটি স্কুল গ্রুপ আর আরেকটু পিছনে ছোট মামার নেতৃত্বে নানাবাড়ি গ্রুপকে দেখা যাচ্ছে । প্রায় ১০-১২ জন মানুষ এসেছেন আমাদেরকে নিয়ে যেতে । ইমন জানালা দিয়ে মাথা বের করে “এনাম ভাই, ছোটমামা এই যে আমরা !” চিৎকার দেয় ।

আহ আমরা আমাদের মনজিলে মকসুদ অর্জন করেছি ! ছুটিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে গেছি ! কিন্তু সমস্যা, স্টেশন থেকে নানা বাসায় যাওয়ার পথে রেলওয়ে স্টাফদের বাসার পিছন দিকের টয়লেট গুলো । বড় বড় সিমেন্টের গামলায় টয়লেটের উপচে পড়া বর্জ্য আমাদেরকে বড়দের সামনে বিব্রত করে । অজ্ঞাত কারণে এই গামলা দেখলেই পেট ফেটে হাসি উঠে- কিন্তু ,গুরুজনদের সামনে হাসতে না পারলে হাঁসফাঁস উঠে । আমরা দুইজন সচেতনভাবে একজন অন্যজনের দিকে তাকাই না ; তাকালেই হাসির ফুলঝুড়ি ।

আমাদের রোজার ঈদের ছুটি, গ্রীষ্মের ছুটি, বার্ষিক পরীক্ষার ছুটি যেটাই হোক না কেন - সেটার শুরু ও শেষটা নানার বাসায় এবং মাঝখানের বিরাট একটা সময় আমাদের গ্রামের বাড়ি জালশুকায় দাদা -দাদীর সাথে কাটাই । ছোট্ট মফস্বল শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটু পর পর পুকুর আর শহরের পূর্ব -দক্ষিণ -পশ্চিম দিকটা ঘিরে রয়েছে তিতাস নদী দিয়ে ।

ঘটনাবহুল গ্রীষ্মের ছুটির শেষ পর্যায়ে আমরা ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি । আব্বা আসবেন আমাদের নিতে । গত দুইদিন থেকে গলার মধ্যে কি যেনো একটা দলা পাকিয়ে আছে । সবাইকে ছেড়ে আবার চলে যেতে হবে । একটু পর পর চোখ ভিজে আসে । নানী একদিন ছিটে রুটি তো আরেকদিন পাটিসাপটা পিঠা তৈরি করছেন । আজকে তৈরি করেছেন পোয়া পিঠা । এরমধ্যে দাদীর হাতের খোলা পিঠা , মেরা পিঠা , চটা পিঠা, নারকেল পিঠা,দুই বিরিয়ানী পিঠা, মাংসের সমুচা খেয়ে এসেছি । গতকাল বড় ফুফুর বাসায় সোয়াই খেয়ে এসেছি ।

গভীর রাতে নানীর ঘরের পুরানো বিশাল সিটিজেনের পেন্ডুলাম দেয়াল ঘড়িটা প্রতিটি সেকেন্ডের আওয়াজ আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে ছুটি শেষ হয়ে আসছে , চলে যেতে হবে । প্রতি ঘন্টায় ঢং ঢং করে শব্দটার সাথে রেলস্টেশন থেকে ভেসে আসা চিটাগাং মেইল - সিলেট মেইলের মন উদাস করা হুইসেলের শব্দ বুকটা চিরে বেরিয়ে যায়। গভীর রাতে ট্রেনের ঝকঝক শব্দে চোখ ফেটে কান্না আসে- কতো পুরানো কথা স্মৃতির ঝাঁপি থেকে টেনে বের করে । মনটাকে অসহায় করে ফেলে - মনে হয় পৃথিবীতে একাকীত্বটাই অমোঘ ।

আমাদের ট্রেন সন্ধ্যায় । দুই রিকশায় আমরা চারজন । সামনে পিছনে আরও তিন রিকশায় ছোটমামার গ্রুপসহ আমরা স্টেশনে পৌঁছে দেখি সেখানে এনাম ভাই ওনার গ্রুপ নিয়ে হাজির । এতো মানুষজন দেখে আব্বা কিছুটা শঙ্কিত । ট্রেনে কিভাবে উঠবো এটা নিয়ে আলাপ শুরু করতেই এনাম ভাই বলে ওঠেন “ মামা, আমাদের হাতে সবকিছু ছেড়ে দেন । চিন্তার কোন কারণই নাই ।” এরমধ্যে এক নাম্বার প্ল্যাটফর্ম ক্রস করে আম্মার মামাতো ভাই শামীম মামা আরো দুই তিনজন বন্ধুকে নিয়ে তৃতীয় গ্রুপ নিয়ে হাজির । আম্মা -আব্বাকে ঘিরে বেশ একটা উৎসবমুখর পরিবেশ । কর্ণফুলী ট্রেনটা পৌঁছার সাথে সাথে এই বগিতে শাজাহান কাকা তো সামনের বগিতে গিয়াসউদ্দিন ভাই , পিছনের বগিতে শামীম মামা প্রত্যেকেই লাফ দিয়ে উঠে “ দুলাভাই এইখানে , এইখানে ওঠেন ।” আরেক বগির জানালা দিয়ে আমাকে ভিতরে চালান করে দিয়ে গিয়াসউদ্দিন ভাই , “ কাহী এই বগিতে ওঠেন , হগগলতাই খালি”। সামনের বগিতে ঝুড়ি- ব্যাগসহ এনাম ভাই ইমনকে চালান করে দিয়েছেন । আব্বা প্লাটফর্ম থেকে সবকিছু অবজার্ভ করে বিপদের আভাস পেয়ে ট্রেন ছাড়ার আগেই তিনটি বগি থেকে আম্মা, ইমন আর আমাকে বকাঝকা করে নামান । চলন্ত ট্রেন থেকে তিন গ্রুপ সাহায্যকারী লাফ দিয়ে নেমে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে টেক্কা দেওয়ার জন্য বলতে লাগলো , “ আমি চাইরটা সিট বুক করছিলাম জানালার পাশে !” রেকর্ড তিন তিনটা ট্রেন ফেইল মেরে আমরা আবার নানার বাসায় ফেরত । আব্বা তিন গ্রুপ কমান্ডারকে বকাঝকা করেই যাচ্ছেন । আমরা দুই ভাই অনেক খুশি , আরো একটা দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকতে পারবো বলে !

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ,গাজীপুর]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

রেলগাড়ি ঝমাঝম

আসফাক বীন রহমান

মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই ২০২২

“ পালাও ! পালাও ! কাশেম মামা আইলো !” নানা বাড়ির মেইন গেট থেকে ইমনের সাবধানবাণী দ্রুত এগিয়ে আসছে । কমান্ডো স্টাইলে পিছনের ওয়াল বেয়ে তড়িৎবেগে ছাদে নিরাপদ অবস্থানে এসে পরিস্থিতি যাচাই করতে বসি । পশ্চিম দিকে ড্রইং রুমের জানালা বরাবর প্রথমে ইমনের হাত পরে মাথা বের হতে দেখে নিশ্চিন্ত হই । তিনদিন হলো নানাবাড়ি এসেছি । বিরাট আনন্দ ! আজ সকালেই কামরাঙ্গা গাছে জাহাঙ্গীরকে উঠিয়ে প্রায় তিন কেজির মতো কামরাঙ্গা পেরেছি , কুচি কুচি করে কাটিয়ে বাছিরের মায়ের মাধ্যমে শুকনা মরিচ ভেজে কামরাঙ্গার ভর্তা বানিয়ে জনে জনে সাধতে বসেছি । কেউ খেতে চাচ্ছে না । আম্মা এক দফা হুমকি দিয়েছেন ,“তোরা যতটুক খেতে পারবি ,ততোটুকু ভর্তা কর”। এতগুলো কামরাঙ্গার কি গতি করব চিন্তা করতে করতে নানীর বিশাল হামানদিস্তাটার দিকে চোখ পড়লো। “ নানী ,এটা নিতে পারি ?” আমার কথায় নানী কুটকুট করে হেসে বললেন “ কি করবে ভাইয়া?” আমরা যা-ই করি তাতেই নানী বেশ মজা পান আর হাসেন । আমাদের অতিরিক্ত কামরাঙ্গা সংক্রান্ত সমস্যার কথা জানিয়ে বললাম,“ হামানদিস্তায় ছেঁচে কামরাঙ্গার জুস বানাবো, জুস কেউ না খেয়ে থাকতে পারবে না ”।এর মধ্যেই ইমনের বিপদ সংকেত!

কাশেম মামা নানার খুব প্রিয় ভাগ্নে , আম্মার ফুফাতো ভাই । সরকারি চাকরি করেন । খুবই অনেস্ট মানুষ । আল্লাহ উনাকে টাকা দেন নাই তবে ওনার বাসা ভর্তি জুয়েল । প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ে স্কলার । ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসলেই একটাই কথা , ‘ এবার কাশেম ভাইয়ের মেজো মেয়ে বৃত্তি পেয়েছে, বড় ছেলে ডাক্তারিতে ভর্তি হয়েছে ,এক মেয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে মেট্রিক পরীক্ষা পাস করেছে ।’ আমরা এসব শুনে আরো খুশি হই- যাক আমাদের মধ্যে কেউ খুব ভালো রেজাল্ট করেছে । কিন্তু , সমস্যা হলো কাশেম মামা আমাদেরকে দেখলেই খপ করে হাত ধরে বলেন , “ ভাইগ্না এইবার কোন ক্লাসে উঠছো? টেনস পড়ানো হইছে ? বলোতো ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মরিয়া গেলো কোন টেনস?” বিরাট বিপদ ! প্রেস্টিজ নিয়ে টানাটানি ! উনি নিজে ক্লাস ওয়ান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত সব ছেলে- মেয়ের পড়াশোনার তত্ত্বাবধান করেন । প্রত্যেকটা সাবজেক্ট সম্বন্ধে এ টু জেড আইডিয়া । এরমধ্যে মাঝে মাঝে ছোটমামা কাসেম মামাকে দেখলেই “ কাশেম ভাই, ওরা দু’জন ঢাকার স্কুলে খুব ভালো করছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর ঢাকার স্কুলের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কিনা একটু যদি যাচাই করতেন ?” আমরা বুঝতে পারি , আমাদের দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ ছোটমামা কাশেম মামাকে দিয়ে আমাদের সাইজ করতে চান !

গতকালও কাশেম মামার সাথে আমাদের দেখা হয়েছে । আমি বেঁচে গিয়েছি , ইমন ধরা খেয়েছে । কাসেম মামা যখন বাসার ভেতর আসেন, তখন আমি নানার ইজি-চেয়ারের পাশে বসে ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকা জোরে জোরে পড়ে নানাকে শুনাচ্ছিলাম । নানা মাঝে মাঝে “এটা না ,আগাও” “বলে সাড়া দিচ্ছেন ; আবার কখনো কখনো বলছেন ‘হুম’ । কিন্তু ‘ সালাউদ্দিন আবারো সেরা গোলদাতা , পাওলো রসি মোটর মেকানিক থেকে বিশ্বকাপ হিরো’- এইসব নিউজে নানার কেনো অনীহা সেটা বুঝতে পারছি না । আবার ‘ এবার প্রবৃদ্ধি ৩% এর নিচে বা ভারতে দাঙ্গা ’ ইত্যাদি নিউজে নানার এতো বেশী আগ্রহ কেনো সেটাও বুঝতে পারছি না । আমরা যে নিউজ পড়তে চাই - নানা সেটা শুনতে চান না আর নানা যেটা শুনতে চান - আমাদের সেটা পছন্দ না । তবে নানার পাশে বসে পত্রিকা পড়ায় অনেক জ্ঞান আহরণ হচ্ছে ! ‘ দক্ষিণ আফ্রিকায় ফেরী ডুবীতে তিনজনের সলিল সমাধি , উত্তর চীন সাগরে ভয়াবহ ঝড় ’ ইত্যাদি নিউজ পড়ে বড় খালাকে কনভে করায় বেশ সাড়া পাচ্ছি । বড় খালা আজ সকালেই খাসী মানত করেছেন সারোয়ার ভাইয়ের জন্য । সারোয়ার ভাই মেরিন ইঞ্জিনিয়ার । নানার সামনে কাশেম মামাকে দেখে টুক করে কদমবুচি করে আবার পত্রিকা নিয়ে নানার শেল্টারে চলে আসি । কাশেম মামা সমানে মুচকি মুচকি হাসছিলেন ।

নানা সেই ১৯৩০ সনে ‘বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস’ এর মাধ্যমে সরকারি চাকুরি শুরু করেন । বিভিন্ন জেলায় এসডিও , ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৬৫ সনে ডেপুটি সেক্রেটারি হিসেবে রিটায়ার করেন । উনার পদবী এবং সততার কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দক্ষিণাঞ্চলে ‘ডেপুটি বাড়ির পাশের গ্রামে আমার বাড়ি ’ বললেও মানুষ সমীহ করেন ,ইজ্জত করেন । নিভৃৃতচারী ‘আব্দুল হাই সাহেব ’ খুবই কম কথা বলেন। নির্দিষ্ট সময়ে পুরো বাড়ীতে হেঁটে ব্যায়াম , নির্দিষ্ট পরিমাপে খাওয়া , নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম , সকাল-সন্ধ্যা রেডিওতে বিবিসি -ভয়েস অব আমেেরিকা শোনা - পুরোপুরি রুটিন মাফিক জীবন । মাঝে মাঝে নানাকে উদ্বিগ্ন করার জন্য আম্মার” আব্বা, সুমন- ইমনের এইবারের গরমের ছুটিতে আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঁচ তারিখে আসছি “চিঠিই যথেষ্ঠ ! নানা বাসার ছাদের মই সরিয়ে দেওয়া এবং পিছনের খালে যাওয়ার সিড়ির দরজায় তালা লাগাতে নির্দেশ দেন । একটু পরপর আম্মাকে ডেকে বলেন ,” রুবি তোর ছেলে দুইটা কই ? ছাদে উঠে নাইতো ? “ আমাদেরকে আম -কাঁঠাল আর পেয়ারা গাছের আশেপাশে দেখলেই নিষেধ করেন , ” এই গাছে ওঠো না, হাত-পা ভাঙবে “। সব সময় দেখতাম , ওনার নিজের গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের অনেকগুলো গ্রামের দুঃস্থ দুই -তিনজন ছেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্কুল- কলেজে উনার খরচে থাকা, খাওয়া ও পড়াশোনা করছে । দরকার হলে তাদের চাকুরির জন্য সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পাঁচ ছেলে ও পাঁচ জামাতাকে বলতেন । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দক্ষিণাঞ্চলের দুঃস্থ কন্যাদায়গ্রস্হ পিতা-মাতা এবং শিক্ষা গ্রহণেচ্ছু ছেলেদের জন্য উনি ছিলেন বাতিঘর ।

কাশেম মামা নীচ থেকে,“ ভাইগ্না , তোমাদের পড়া ধরবো না ; নেমে আসো । কাল আমার বাসায় রাতে তোমাদের দাওয়া” বলে কোন সাড়া-শব্দ না পেয়ে “ আলামতই না ! দাওয়াতের কথা শুনলে মানুষ পালায় এইটাতো কোনোদিন শুনি নাই” , বলে চলে গেলেন ।

আম্মার মাধ্যমে তদবীর করে দাওয়াতে এটেইন করি , শর্ত একটাই ‘দাওয়াত হচ্ছে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপার , পড়াশোনার আলোচনা অন্য সময় হবে ’। বাসার গেটে কাশেম মামা সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “ বাবা পড়াশোনা থেকে পালিয়ে বেড়াবে না ”।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এবার এসেছি ‘উল্কা এক্সপ্রেস ’এ । নাম যেমন ‘উল্কা’ এর গতিও উল্কার মতো । ঢাকা -চট্টগ্রামের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত গতির ট্রেন । ট্রেন টঙ্গী পার হলেই যে টান দেয় , তাতে করে ভয় লাগে । সমানে ডানে- বামে দুলুনীর সাথে সাথে নেশা ধরানো প্রলম্বিত হুইসেল মনের মধ্যে

‘রেলগাড়ি ঝমাঝম

পা পিছলে আলুর দম’-

তালের সৃষ্টি করে । টিকেট পাওয়া যায়- কিন্তু সিট পাওয়াটাই দুরূহ । ট্রেন কমলাপুরে ঢোকার সাথে সাথে কুলিদের ‘লাল ফৌজ’ দ্রুতগতিতে সিটগুলোর দখল নিয়ে নেয় । টিকিট কাউন্টারে রেলওয়েকে টাকা দিয়ে টিকিট পাওয়া যায় আর সিট নিতে হলে কুলিদের টাকা দিতে হবে ! আব্বা আমাদের ট্রেনে উঠিয়ে দিতে এসেছেন , তাই সমস্যা হয়নি । ট্রেনে উঠেই আম্মার নজর বইয়ের হকারের ঝুলিতে নিমাই ভট্টাচার্য , আশাপূর্ণা দেবী - বিমল মিত্রের বইগুলোতে আর আমাদের নজর চানাচুরওয়ালার দিকে । যেহেতু ভ্যাকেশন - তাই অনেক কিছুই মাফ । লজেন্স, বাদাম ,চানাচুর ,আমড়া সব কিছুই আমরা বিনা ওজরে পেয়ে যাই । কমলাপুর ষ্টেশন থেকে ট্রেন বের হবার সাথে সাথে শাহজাহানপুর কলোনির আশেপাশের বিশাল মাঠ আর ঝিরঝিরে বাতাসে মনের ভিতর চনমনে অনুভূতি তৈরী করে । তেজগাঁও স্টেশন পার হবার সাথে সাথে সবুজ গাছপালা আর বড় বড় ফাঁকা মাঠ দেখলেই মনে হয়- ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাচ্ছি । কতো আনন্দ ! নতুন তৈরি হওয়া বিমানবন্দর স্টেশন , টঙ্গী, পূবাইল ,আড়িখোলা পার হয়ে শীতলক্ষা ব্রিজ পেরোলেই ঘোড়াশাল । আমাদের আর পায় কে ? ঘোড়াশাল মানেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসেই গেছি ! ভৈরব ষ্টেশন পেরুলেই আমরা দুই ভাই জানালা দিয়ে মাথা বের করে মেঘনা ব্রীজের দিকে তাকিয়ে থাকি । বিশাল বাঁক নিয়ে ট্রেন আস্তে আস্তে মেঘনার লাল লোহার ব্রীজে উঠে গমগম শব্দ তুলে চলতে থাকে । নীচে মেঘনার প্রবল স্রোত দেখলে ভয় লাগে - দ্রুত মাথা ভিতরে ঢুকিয়ে ফেলি । কতোদিন পর মেঘনার সাথে আবার দেখা । ভেট হিসেবে দুটি বাদাম বা একটি লজেন্স মেঘনা নদীর দিকে এগিয়ে দেই ।

যতোই ট্রেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে এগুতে থাকে আম্মার টেনশন বাড়তে থাকে । যেহেতু আগেভাগে সিট রিজার্ভের ব্যবস্থা নাই- তাই স্টেশনে ট্রাংক, ঝুড়ি ,ব্যাগ নিয়ে ধাক্কাধাক্কির মধ্যে নামাটা বেশ দুঃসাধ্য। কিন্তু আমাদের দুজনের মধ্যে কোন টেনশন নাই । আমরা জানি , আমাদের জন্য দুই গ্রুপ সাহায্যকারী থাকবেন- প্রতিবারের মতোই । হ্যাঁ - ঐতো এনাম ভাইয়ের নেতৃত্বে পিটি স্কুল গ্রুপ আর আরেকটু পিছনে ছোট মামার নেতৃত্বে নানাবাড়ি গ্রুপকে দেখা যাচ্ছে । প্রায় ১০-১২ জন মানুষ এসেছেন আমাদেরকে নিয়ে যেতে । ইমন জানালা দিয়ে মাথা বের করে “এনাম ভাই, ছোটমামা এই যে আমরা !” চিৎকার দেয় ।

আহ আমরা আমাদের মনজিলে মকসুদ অর্জন করেছি ! ছুটিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে গেছি ! কিন্তু সমস্যা, স্টেশন থেকে নানা বাসায় যাওয়ার পথে রেলওয়ে স্টাফদের বাসার পিছন দিকের টয়লেট গুলো । বড় বড় সিমেন্টের গামলায় টয়লেটের উপচে পড়া বর্জ্য আমাদেরকে বড়দের সামনে বিব্রত করে । অজ্ঞাত কারণে এই গামলা দেখলেই পেট ফেটে হাসি উঠে- কিন্তু ,গুরুজনদের সামনে হাসতে না পারলে হাঁসফাঁস উঠে । আমরা দুইজন সচেতনভাবে একজন অন্যজনের দিকে তাকাই না ; তাকালেই হাসির ফুলঝুড়ি ।

আমাদের রোজার ঈদের ছুটি, গ্রীষ্মের ছুটি, বার্ষিক পরীক্ষার ছুটি যেটাই হোক না কেন - সেটার শুরু ও শেষটা নানার বাসায় এবং মাঝখানের বিরাট একটা সময় আমাদের গ্রামের বাড়ি জালশুকায় দাদা -দাদীর সাথে কাটাই । ছোট্ট মফস্বল শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটু পর পর পুকুর আর শহরের পূর্ব -দক্ষিণ -পশ্চিম দিকটা ঘিরে রয়েছে তিতাস নদী দিয়ে ।

ঘটনাবহুল গ্রীষ্মের ছুটির শেষ পর্যায়ে আমরা ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি । আব্বা আসবেন আমাদের নিতে । গত দুইদিন থেকে গলার মধ্যে কি যেনো একটা দলা পাকিয়ে আছে । সবাইকে ছেড়ে আবার চলে যেতে হবে । একটু পর পর চোখ ভিজে আসে । নানী একদিন ছিটে রুটি তো আরেকদিন পাটিসাপটা পিঠা তৈরি করছেন । আজকে তৈরি করেছেন পোয়া পিঠা । এরমধ্যে দাদীর হাতের খোলা পিঠা , মেরা পিঠা , চটা পিঠা, নারকেল পিঠা,দুই বিরিয়ানী পিঠা, মাংসের সমুচা খেয়ে এসেছি । গতকাল বড় ফুফুর বাসায় সোয়াই খেয়ে এসেছি ।

গভীর রাতে নানীর ঘরের পুরানো বিশাল সিটিজেনের পেন্ডুলাম দেয়াল ঘড়িটা প্রতিটি সেকেন্ডের আওয়াজ আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে ছুটি শেষ হয়ে আসছে , চলে যেতে হবে । প্রতি ঘন্টায় ঢং ঢং করে শব্দটার সাথে রেলস্টেশন থেকে ভেসে আসা চিটাগাং মেইল - সিলেট মেইলের মন উদাস করা হুইসেলের শব্দ বুকটা চিরে বেরিয়ে যায়। গভীর রাতে ট্রেনের ঝকঝক শব্দে চোখ ফেটে কান্না আসে- কতো পুরানো কথা স্মৃতির ঝাঁপি থেকে টেনে বের করে । মনটাকে অসহায় করে ফেলে - মনে হয় পৃথিবীতে একাকীত্বটাই অমোঘ ।

আমাদের ট্রেন সন্ধ্যায় । দুই রিকশায় আমরা চারজন । সামনে পিছনে আরও তিন রিকশায় ছোটমামার গ্রুপসহ আমরা স্টেশনে পৌঁছে দেখি সেখানে এনাম ভাই ওনার গ্রুপ নিয়ে হাজির । এতো মানুষজন দেখে আব্বা কিছুটা শঙ্কিত । ট্রেনে কিভাবে উঠবো এটা নিয়ে আলাপ শুরু করতেই এনাম ভাই বলে ওঠেন “ মামা, আমাদের হাতে সবকিছু ছেড়ে দেন । চিন্তার কোন কারণই নাই ।” এরমধ্যে এক নাম্বার প্ল্যাটফর্ম ক্রস করে আম্মার মামাতো ভাই শামীম মামা আরো দুই তিনজন বন্ধুকে নিয়ে তৃতীয় গ্রুপ নিয়ে হাজির । আম্মা -আব্বাকে ঘিরে বেশ একটা উৎসবমুখর পরিবেশ । কর্ণফুলী ট্রেনটা পৌঁছার সাথে সাথে এই বগিতে শাজাহান কাকা তো সামনের বগিতে গিয়াসউদ্দিন ভাই , পিছনের বগিতে শামীম মামা প্রত্যেকেই লাফ দিয়ে উঠে “ দুলাভাই এইখানে , এইখানে ওঠেন ।” আরেক বগির জানালা দিয়ে আমাকে ভিতরে চালান করে দিয়ে গিয়াসউদ্দিন ভাই , “ কাহী এই বগিতে ওঠেন , হগগলতাই খালি”। সামনের বগিতে ঝুড়ি- ব্যাগসহ এনাম ভাই ইমনকে চালান করে দিয়েছেন । আব্বা প্লাটফর্ম থেকে সবকিছু অবজার্ভ করে বিপদের আভাস পেয়ে ট্রেন ছাড়ার আগেই তিনটি বগি থেকে আম্মা, ইমন আর আমাকে বকাঝকা করে নামান । চলন্ত ট্রেন থেকে তিন গ্রুপ সাহায্যকারী লাফ দিয়ে নেমে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে টেক্কা দেওয়ার জন্য বলতে লাগলো , “ আমি চাইরটা সিট বুক করছিলাম জানালার পাশে !” রেকর্ড তিন তিনটা ট্রেন ফেইল মেরে আমরা আবার নানার বাসায় ফেরত । আব্বা তিন গ্রুপ কমান্ডারকে বকাঝকা করেই যাচ্ছেন । আমরা দুই ভাই অনেক খুশি , আরো একটা দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকতে পারবো বলে !

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ,গাজীপুর]

back to top