alt

মুক্ত আলোচনা

নিটোর: দেশের প্রথম বিশেষায়িত ইনষ্টিটিউট

মো. ওয়াহিদুর রহমান

: সোমবার, ১৫ আগস্ট ২০২২

স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭২ সাল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। দেশের অগনিত গর্বিত সন্তান যারা জীবন বাজি রেখে জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে এদেশ স্বাধীন করেছিলেন সেই অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ যারা আহত হয়েছিলেন তাদের চিকিৎসা সেবা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন সময়ে একটি বিশেষায়িত হাসপাতালের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। সেই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহায়তায় বিশিষ্ট মিশনারী মানবকল্যানে নিয়োজিত আমেরিকান অর্থোপেডিক সার্জন ডাঃ আর. জে গার্ষ্টকে এদেশে নিয়ে আসেন। তাঁরই সার্বিক তত্ত্বাবধানে “মুক্তিবাহিনী হাসপাতাল” নামে বর্তমান সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় চালু হয় বাংলাদেশের প্রথম অর্থোপেডিক হাসপাতাল।

প্রসঙ্গত উল্লেখ যে তখন বাংলাদেশ কোন অর্থোপেডিক সার্জন ছিলেন না। একজন পাকিস্তানি অর্থোপেডিক সার্জন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে দেশ ত্যাগ করে পাকিস্তানে ট্রাভেল ডকুমেন্টেস-এ চলে যায়। বঙ্গবন্ধু আর. জে. গার্ষ্টকে নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করেন। দেশে তখনও কোন পাসপোর্ট ভিসা চালু হয়নি। বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে লিখে ৫জন জেনারেল সার্জন, ১৩জন নার্স ও ২৭জন কৃত্রিম পা তৈরীর মেকানিক প্রশিক্ষণের জন্য পূর্ব জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে তারা প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর দেশে ফেরত এলে বাংলাদেশে অর্থোপেডিক চিকিৎসার যাত্রা শুরু হয়। অসংখ্য যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চিকিৎসা সেবার স্থান সংকুলান না হওয়ায় ডাঃ আর. জে. গার্ষ্টের সঙ্গে আলোচনা করে বঙ্গবন্ধু শেরে বাংলানগরে (বর্তমানে নিটোর ও শিশু হাসপাতালের) জায়গা বরাদ্দ দেন। হাসপাতালের আর্কাইভে বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে স্বাক্ষরিত দলিল এখনও রক্ষিত আছে। শুরু হয় এই হাসপাতালের স্থাপনা কার্যক্রম। নামকরণ করা হয় R. I. H. D. (Rehabilitation Institute & Hospital for the Disable)। এই প্রজেক্টের প্রথম প্রকল্প পরিচালক নিযুক্ত হন আর. জে. গার্ষ্ট, যার মাসিক বেতন ছিল ১টাকা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসহ দেশের সকল নাগরিকের জন্য এই বিশেষায়িত হাসপাতাল যাত্রা শুরু করে। অপ্রতুল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সংকট কাটাতে আর. জে. গার্ষ্ট ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্তিতে চালু করেন পোষ্ট গ্রাজুয়েট MS, Diploma Course সঙ্গে চালু হয় পুনর্বাসনের প্রয়োজন অত্যন্ত পরিপূরক ফিজিওথেরাপী, অকুপেশনাল থেরাপি বিভাগ। শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ তৈরীর মাতুলালয় তৎকালীন R. I. H. D. যা বর্তমানে নিটোর নামে পরিচিত।

২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বিগ্রেডিয়ার (অবঃ) ডাঃ মালিক স্যারের উদ্যোগে তৎকালীন হাসপাতালের চিকিৎসকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নামকরণ R. I. H. D. থেকে NITOR এ পরিবর্তন করা হয়। বলা অত্যাবশ্যক যে R. I. H. D. জনগণের কাছে পঙ্গু হাসপাতাল হিসাবে উচ্চারিত হতে থাকে বিধায় নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়।

জনসংখ্যার ঊর্ধ্বগতি, আধুনিকায়নের যুগে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শিশু হাসপাতালের জন্য ছেড়ে দেওয়া কিছু অংশের পর কোনভাবেই রোগীদের চিকিৎসা সেবার সংকুলান হচ্ছিল না। প্রয়োজন অনুভূত হয় হাসপাতাল সম্প্রসারণের। এদিকে দেশে বিশেষজ্ঞ অর্থোপেডিক সার্জনের সংখ্যা বাড়তে থাকে যা বর্তমানে প্রায় ২০০০জন।

এদেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে ধবংস করার চক্রান্ত শুরু হয় ১৯৯৬ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। তারপর ২০০১ সালের জামাত-বিএনপি-এর তান্ডব দেশকে এক দূর্বিসহ অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। বিভিন্ন সময় এই “তান্ডব মানবতা বিরোধী রাজনৈতিক দলের হামলায় দেশের অগনিত মানুষ চিকিৎসার জন্য আসতে থাকেন এই হাসপাতালে। দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকাকালীন তাদের বারবার খোঁজ খবর নিতে ছুটে আসতেন এই হাসপাতালে। যোগ্য পিতার যোগ্য কন্যা তখন থেকেই স্মৃতি বিজড়িত এই হাসপাতালের উন্নয়নের চিন্তা মাথায় রেখে চলতেন।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ট্রাজেডির সময় হাজার হাজার আহত শ্রমিকদের দেখতে এলে এক মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারনা হয়। অশ্রুসিক্ত প্রধানমন্ত্রী মানবতার কল্যাণে নিজেকে আত্মনিয়োগ করা এই মানুষটির কাছে নিটোরের চিকিৎসকবৃন্দ ও অর্থোপেডিক সোসাইটির নেতৃবৃন্দ শয্যার অপ্রতুলতার কথা অবহিত করার সঙ্গে সঙ্গে ঐখানে দাঁড়িয়েই তিনি তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে পরের একনেক সভায় এই প্রকল্প পাশ করার ব্যাপারে নির্দেশ দেন। যার ধারাবাহিকতায় সুদৃশ্যমান ১০০০শয্যা বিশিষ্ট আজকের নিটোর। পিতার ভিত্তি প্রস্তরকে বিশাল এক অবকাঠামোতে রূপান্তরের এই মহ্নানেত্রী স্বশরীরে এই ক্যাম্পাসে এই ভবনের উদ্বোধন করেন। যা বিশে^র অন্যতম বৃহৎ বিশেষায়িত অর্থোপেডিক হাসপাতাল। যার উদ্বোধন হয় ২৯-১০-২০১৯ইং সালে।

অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বর্তমান পরিচালকের নেতৃত্বে সারাদেশের মানুষের বিশেষায়িত আধুনিক সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন এখানকার চিকিৎসকগণ। অর্থোপেডিক চিকিৎসায় সকল সাবস্পেশালিটি সেবা এখন বিশ^মানের। দেশের মানুষের বিদেশে চিকিৎসা নেবার প্রবণতা অনেক কমে গেছে। এই হাসপাতাল বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি দেশের সমস্ত দুর্যোগে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে গেছেন। এখানকার অন্যান্য শাখাও আধুনিকতম।

এই হাসপাতালটিতে সারাদেশ থেকে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা ও আঘাতে গুরুতর আহত এবং বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রেফারকৃত রোগীরা চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন। এখানে জরুরী বিভাগে প্রতিদিন প্রায় ২৫০-৩০০ রোগী চিকিৎসা সেবা গ্রহন করেন। বর্হিঃবিভাগে প্রায় প্রতিদিন ১০০০-১৫০০ পুরাতন ও নতুন রোগী চিকিৎসা সেবা গ্রহন করেন।

এখানে উল্লেখ্য যে, করোনাকালীন সময়ে নিটোরে আগত রোগীদের কোভিড-১৯ পরীক্ষা কার্যক্রম গত জুন ২০২০ইং হতে RT-PCR টেস্টের মাধ্যমে শুরু করা হয়। বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটি নিজস্ব অর্থায়নে নমুনা সংগ্রহ করার জন্য টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেওয়া হয় এবং দুইটি HFNC ক্রয় করা হয়। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি যখন ভয়াবহ রূপ ধারন করে, আমাদের দেশে ২০২০সালে মে-ডিসেম্বর-এ সারাদেশ ব্যাপী বিভিন্ন হাসপাতালে বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে, তখনও অত্র হাসপাতালে সর্বনিন্ম অর্থোপেডিক Polytrauma রোগীর সংখ্যা ২৭২ জন ছিল। সে সময়ও অত্র প্রতিষ্ঠানে ৩টি জরুরী অপারেশন থিয়েটার ও ৬টি রুটিন অপারেশন থিয়েটার চলমান রাখা হয়। বর্তমানে ২৪টি অপারেশন থিয়েটার (ওটিতে) প্রতিদিন প্রায় ১২৫-১৫০টি রুটিন অপারেশন হচ্ছে ও জরুরী বিভাগে প্রতিদিন ৭৫-১০০টির মত অপারেশন হচ্ছে। পরবর্তীতে চিকিৎসক ও নার্সগণ আক্রান্ত হওয়ায় জরুরী বিভাগে আগত রোগীদের নিটোরেই Rapid Antigen Test প্রথম এর মাধ্যমে কোভিড-১৯ পরীক্ষা শুরু করা হয়। জুন ২০২১ থেকে শুরু হয়ে এ পর্যন্ত ২০৪২৮ সেম্পল কালেকশন হয যার মধ্যে ১৩২৯ জন পজেটিভ রোগী পাওয়া যায়।

নিটোরে কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম বিগত ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১ইং হতে শুরু হয়। এ পর্যন্ত নিটোর এর কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম ড্যাসবোর্ডে ৫৭০৮৯ জন রেজিষ্ট্রার টিকা গ্রহীতা আছেন। যার মধ্যে ১ম ডোজ প্রদান ৫৭০৭২জন ২য় ডোজ ৫৪০৫৫জন এবং বুষ্টার ডোজ বা ৩য় ডোজ প্রদান করা হয় ২৫০০জন। পুরাতন বর্হিঃবিভাগে ১০টি বুথের মাধ্যমে টিকাদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

করোনা মহামারি ভয়াবহ রূপ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ার কারনে মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয়ের জুম মিটিং এর নির্দেশনা মোতাবেক নিটোর ১৫০ শয্যাবিশিষ্ট কোভিড-১৯ ডেডিকেটেট হাসপাতাল-এর কার্যক্রম নতুন হাসপাতাল ভবনের ৮, ৯, ১০ তলাতে শুরু করা হয়। পরবর্তীতে করোনা মহামারি প্রকোপ কমে যাওয়ায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং- ৮৯০ তারিখ ১০-১০-২০২১ইং হতে ১৫০ শয্যা হতে কমিয়ে ৫০ শয্যার কোভিড-১৯ ডেডিকেটেট হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়। উল্লেখ্য গত ২৪-০১-২০২২ইং সকাল ১১:০০ ঘটিকায় মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয়ের জুম মিটিং এর পুনঃনির্দেশনা মোতাবেক অত্র প্রতিষ্ঠানে ২০০ শয্যাবিশিষ্ট কোভিড-১৯ ডেডিকেটেট হাসপাতাল এর কার্যক্রম গ্রহন করে সকল প্রকার কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে।

বর্তমানে অত্র হাসপাতালে রুটিন সকল প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা যেমন- CBC, PBF, Routine Urine & Stool Examination, Blood Sugar, Lipid Profile, Electrolyte, Creatinine, Uric Acid, LFT, HBsAg, HCV, HbA1c, Culture & Sencitivity, Histropathology, FNAC etc. তাছাড়াও কোভিড-১৯ পরীক্ষা যেমন- - Rapid Antigent Test and Sample collection for RT-PCR নিয়মিত হয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, গত ১জানুয়ারী, ২০২২ইং হতে জরুরী বিভাগের রোগীদের জরুরী চিকিৎসা সেবা আরো তরান্বিত করান লক্ষ্যে বৈকালিক ল্যাবরেটরী মেডিসিন সেবা (২.৩০ ঘটিকা হতে ৮.০০ ঘটিকা পর্যন্ত) চালু করা হয়েছে। নিটোর এর মেরি গার্ষ্ট লাইব্রেরীটিকে ইন্টারনেট সংযোগসহ আধুনিকায়ন করা হয়েছে। নিটোর-এর সৌন্দর্য বর্ধনসহ পরিবেশ বান্ধব সবুজ হাসপাতালের জন্য মুজিব শতবর্ষে ১০০০ এর বেশি বৃক্ষরোপন কর্মসূচী পালিত হয় এখনো এটা চালু আছে। বঙ্গবন্ধু কর্ণার করার জন্য ইতিমধ্যে সকল প্রস্তুতি গ্রহন করা হয়েছে।

[লেখক: সাবেক মহাসচিব, বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটি]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

নিটোর: দেশের প্রথম বিশেষায়িত ইনষ্টিটিউট

মো. ওয়াহিদুর রহমান

সোমবার, ১৫ আগস্ট ২০২২

স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭২ সাল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। দেশের অগনিত গর্বিত সন্তান যারা জীবন বাজি রেখে জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে এদেশ স্বাধীন করেছিলেন সেই অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ যারা আহত হয়েছিলেন তাদের চিকিৎসা সেবা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন সময়ে একটি বিশেষায়িত হাসপাতালের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। সেই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহায়তায় বিশিষ্ট মিশনারী মানবকল্যানে নিয়োজিত আমেরিকান অর্থোপেডিক সার্জন ডাঃ আর. জে গার্ষ্টকে এদেশে নিয়ে আসেন। তাঁরই সার্বিক তত্ত্বাবধানে “মুক্তিবাহিনী হাসপাতাল” নামে বর্তমান সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় চালু হয় বাংলাদেশের প্রথম অর্থোপেডিক হাসপাতাল।

প্রসঙ্গত উল্লেখ যে তখন বাংলাদেশ কোন অর্থোপেডিক সার্জন ছিলেন না। একজন পাকিস্তানি অর্থোপেডিক সার্জন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে দেশ ত্যাগ করে পাকিস্তানে ট্রাভেল ডকুমেন্টেস-এ চলে যায়। বঙ্গবন্ধু আর. জে. গার্ষ্টকে নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করেন। দেশে তখনও কোন পাসপোর্ট ভিসা চালু হয়নি। বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে লিখে ৫জন জেনারেল সার্জন, ১৩জন নার্স ও ২৭জন কৃত্রিম পা তৈরীর মেকানিক প্রশিক্ষণের জন্য পূর্ব জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে তারা প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর দেশে ফেরত এলে বাংলাদেশে অর্থোপেডিক চিকিৎসার যাত্রা শুরু হয়। অসংখ্য যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চিকিৎসা সেবার স্থান সংকুলান না হওয়ায় ডাঃ আর. জে. গার্ষ্টের সঙ্গে আলোচনা করে বঙ্গবন্ধু শেরে বাংলানগরে (বর্তমানে নিটোর ও শিশু হাসপাতালের) জায়গা বরাদ্দ দেন। হাসপাতালের আর্কাইভে বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে স্বাক্ষরিত দলিল এখনও রক্ষিত আছে। শুরু হয় এই হাসপাতালের স্থাপনা কার্যক্রম। নামকরণ করা হয় R. I. H. D. (Rehabilitation Institute & Hospital for the Disable)। এই প্রজেক্টের প্রথম প্রকল্প পরিচালক নিযুক্ত হন আর. জে. গার্ষ্ট, যার মাসিক বেতন ছিল ১টাকা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসহ দেশের সকল নাগরিকের জন্য এই বিশেষায়িত হাসপাতাল যাত্রা শুরু করে। অপ্রতুল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সংকট কাটাতে আর. জে. গার্ষ্ট ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্তিতে চালু করেন পোষ্ট গ্রাজুয়েট MS, Diploma Course সঙ্গে চালু হয় পুনর্বাসনের প্রয়োজন অত্যন্ত পরিপূরক ফিজিওথেরাপী, অকুপেশনাল থেরাপি বিভাগ। শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ তৈরীর মাতুলালয় তৎকালীন R. I. H. D. যা বর্তমানে নিটোর নামে পরিচিত।

২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বিগ্রেডিয়ার (অবঃ) ডাঃ মালিক স্যারের উদ্যোগে তৎকালীন হাসপাতালের চিকিৎসকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নামকরণ R. I. H. D. থেকে NITOR এ পরিবর্তন করা হয়। বলা অত্যাবশ্যক যে R. I. H. D. জনগণের কাছে পঙ্গু হাসপাতাল হিসাবে উচ্চারিত হতে থাকে বিধায় নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়।

জনসংখ্যার ঊর্ধ্বগতি, আধুনিকায়নের যুগে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শিশু হাসপাতালের জন্য ছেড়ে দেওয়া কিছু অংশের পর কোনভাবেই রোগীদের চিকিৎসা সেবার সংকুলান হচ্ছিল না। প্রয়োজন অনুভূত হয় হাসপাতাল সম্প্রসারণের। এদিকে দেশে বিশেষজ্ঞ অর্থোপেডিক সার্জনের সংখ্যা বাড়তে থাকে যা বর্তমানে প্রায় ২০০০জন।

এদেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে ধবংস করার চক্রান্ত শুরু হয় ১৯৯৬ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। তারপর ২০০১ সালের জামাত-বিএনপি-এর তান্ডব দেশকে এক দূর্বিসহ অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। বিভিন্ন সময় এই “তান্ডব মানবতা বিরোধী রাজনৈতিক দলের হামলায় দেশের অগনিত মানুষ চিকিৎসার জন্য আসতে থাকেন এই হাসপাতালে। দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকাকালীন তাদের বারবার খোঁজ খবর নিতে ছুটে আসতেন এই হাসপাতালে। যোগ্য পিতার যোগ্য কন্যা তখন থেকেই স্মৃতি বিজড়িত এই হাসপাতালের উন্নয়নের চিন্তা মাথায় রেখে চলতেন।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ট্রাজেডির সময় হাজার হাজার আহত শ্রমিকদের দেখতে এলে এক মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারনা হয়। অশ্রুসিক্ত প্রধানমন্ত্রী মানবতার কল্যাণে নিজেকে আত্মনিয়োগ করা এই মানুষটির কাছে নিটোরের চিকিৎসকবৃন্দ ও অর্থোপেডিক সোসাইটির নেতৃবৃন্দ শয্যার অপ্রতুলতার কথা অবহিত করার সঙ্গে সঙ্গে ঐখানে দাঁড়িয়েই তিনি তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে পরের একনেক সভায় এই প্রকল্প পাশ করার ব্যাপারে নির্দেশ দেন। যার ধারাবাহিকতায় সুদৃশ্যমান ১০০০শয্যা বিশিষ্ট আজকের নিটোর। পিতার ভিত্তি প্রস্তরকে বিশাল এক অবকাঠামোতে রূপান্তরের এই মহ্নানেত্রী স্বশরীরে এই ক্যাম্পাসে এই ভবনের উদ্বোধন করেন। যা বিশে^র অন্যতম বৃহৎ বিশেষায়িত অর্থোপেডিক হাসপাতাল। যার উদ্বোধন হয় ২৯-১০-২০১৯ইং সালে।

অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বর্তমান পরিচালকের নেতৃত্বে সারাদেশের মানুষের বিশেষায়িত আধুনিক সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন এখানকার চিকিৎসকগণ। অর্থোপেডিক চিকিৎসায় সকল সাবস্পেশালিটি সেবা এখন বিশ^মানের। দেশের মানুষের বিদেশে চিকিৎসা নেবার প্রবণতা অনেক কমে গেছে। এই হাসপাতাল বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি দেশের সমস্ত দুর্যোগে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে গেছেন। এখানকার অন্যান্য শাখাও আধুনিকতম।

এই হাসপাতালটিতে সারাদেশ থেকে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা ও আঘাতে গুরুতর আহত এবং বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রেফারকৃত রোগীরা চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন। এখানে জরুরী বিভাগে প্রতিদিন প্রায় ২৫০-৩০০ রোগী চিকিৎসা সেবা গ্রহন করেন। বর্হিঃবিভাগে প্রায় প্রতিদিন ১০০০-১৫০০ পুরাতন ও নতুন রোগী চিকিৎসা সেবা গ্রহন করেন।

এখানে উল্লেখ্য যে, করোনাকালীন সময়ে নিটোরে আগত রোগীদের কোভিড-১৯ পরীক্ষা কার্যক্রম গত জুন ২০২০ইং হতে RT-PCR টেস্টের মাধ্যমে শুরু করা হয়। বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটি নিজস্ব অর্থায়নে নমুনা সংগ্রহ করার জন্য টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেওয়া হয় এবং দুইটি HFNC ক্রয় করা হয়। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি যখন ভয়াবহ রূপ ধারন করে, আমাদের দেশে ২০২০সালে মে-ডিসেম্বর-এ সারাদেশ ব্যাপী বিভিন্ন হাসপাতালে বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে, তখনও অত্র হাসপাতালে সর্বনিন্ম অর্থোপেডিক Polytrauma রোগীর সংখ্যা ২৭২ জন ছিল। সে সময়ও অত্র প্রতিষ্ঠানে ৩টি জরুরী অপারেশন থিয়েটার ও ৬টি রুটিন অপারেশন থিয়েটার চলমান রাখা হয়। বর্তমানে ২৪টি অপারেশন থিয়েটার (ওটিতে) প্রতিদিন প্রায় ১২৫-১৫০টি রুটিন অপারেশন হচ্ছে ও জরুরী বিভাগে প্রতিদিন ৭৫-১০০টির মত অপারেশন হচ্ছে। পরবর্তীতে চিকিৎসক ও নার্সগণ আক্রান্ত হওয়ায় জরুরী বিভাগে আগত রোগীদের নিটোরেই Rapid Antigen Test প্রথম এর মাধ্যমে কোভিড-১৯ পরীক্ষা শুরু করা হয়। জুন ২০২১ থেকে শুরু হয়ে এ পর্যন্ত ২০৪২৮ সেম্পল কালেকশন হয যার মধ্যে ১৩২৯ জন পজেটিভ রোগী পাওয়া যায়।

নিটোরে কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম বিগত ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১ইং হতে শুরু হয়। এ পর্যন্ত নিটোর এর কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম ড্যাসবোর্ডে ৫৭০৮৯ জন রেজিষ্ট্রার টিকা গ্রহীতা আছেন। যার মধ্যে ১ম ডোজ প্রদান ৫৭০৭২জন ২য় ডোজ ৫৪০৫৫জন এবং বুষ্টার ডোজ বা ৩য় ডোজ প্রদান করা হয় ২৫০০জন। পুরাতন বর্হিঃবিভাগে ১০টি বুথের মাধ্যমে টিকাদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

করোনা মহামারি ভয়াবহ রূপ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ার কারনে মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয়ের জুম মিটিং এর নির্দেশনা মোতাবেক নিটোর ১৫০ শয্যাবিশিষ্ট কোভিড-১৯ ডেডিকেটেট হাসপাতাল-এর কার্যক্রম নতুন হাসপাতাল ভবনের ৮, ৯, ১০ তলাতে শুরু করা হয়। পরবর্তীতে করোনা মহামারি প্রকোপ কমে যাওয়ায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং- ৮৯০ তারিখ ১০-১০-২০২১ইং হতে ১৫০ শয্যা হতে কমিয়ে ৫০ শয্যার কোভিড-১৯ ডেডিকেটেট হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়। উল্লেখ্য গত ২৪-০১-২০২২ইং সকাল ১১:০০ ঘটিকায় মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয়ের জুম মিটিং এর পুনঃনির্দেশনা মোতাবেক অত্র প্রতিষ্ঠানে ২০০ শয্যাবিশিষ্ট কোভিড-১৯ ডেডিকেটেট হাসপাতাল এর কার্যক্রম গ্রহন করে সকল প্রকার কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে।

বর্তমানে অত্র হাসপাতালে রুটিন সকল প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা যেমন- CBC, PBF, Routine Urine & Stool Examination, Blood Sugar, Lipid Profile, Electrolyte, Creatinine, Uric Acid, LFT, HBsAg, HCV, HbA1c, Culture & Sencitivity, Histropathology, FNAC etc. তাছাড়াও কোভিড-১৯ পরীক্ষা যেমন- - Rapid Antigent Test and Sample collection for RT-PCR নিয়মিত হয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, গত ১জানুয়ারী, ২০২২ইং হতে জরুরী বিভাগের রোগীদের জরুরী চিকিৎসা সেবা আরো তরান্বিত করান লক্ষ্যে বৈকালিক ল্যাবরেটরী মেডিসিন সেবা (২.৩০ ঘটিকা হতে ৮.০০ ঘটিকা পর্যন্ত) চালু করা হয়েছে। নিটোর এর মেরি গার্ষ্ট লাইব্রেরীটিকে ইন্টারনেট সংযোগসহ আধুনিকায়ন করা হয়েছে। নিটোর-এর সৌন্দর্য বর্ধনসহ পরিবেশ বান্ধব সবুজ হাসপাতালের জন্য মুজিব শতবর্ষে ১০০০ এর বেশি বৃক্ষরোপন কর্মসূচী পালিত হয় এখনো এটা চালু আছে। বঙ্গবন্ধু কর্ণার করার জন্য ইতিমধ্যে সকল প্রস্তুতি গ্রহন করা হয়েছে।

[লেখক: সাবেক মহাসচিব, বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটি]

back to top