মাহমুদুল হাছান
লেখাচুরি বা চৌর্যবৃত্তি বুঝাতে ইংরেজিতে প্লাগিয়ারিজম (Plagiarism) শব্দটি বেশি পরিচিত। চৌর্যবৃত্তি বা প্লাগিয়ারিজম হলো, অন্য কারোর লেখা বা রচনা থেকে এমনকি নিজের পূর্ববর্তী প্রকাশনা থেকে উৎপাদিতধারণা, শব্দ বা বাক্যাংশ নিয়ে কোন পত্র (Paper) লেখা এবং সেখানে মূল লেখক এবং প্রকাশনার উদ্ধৃতি সঠিকভাবে না দেয়া। কোনো মুদ্রিত উৎসেরঅনুলিপি (Copy) করে তা নিজের ভাষায় মূল লেখা লিখে এবং তা নিজের চয়নিকা হিসাবে ব্যাখ্যা করে প্রকাশ করাই হলো লেখাচুরি বা চৌর্যবৃত্তি। মেরিয়াম ওয়েবস্টার অভিধান মতে চৌর্যবৃত্তি বা প্লাগিয়ারিজম হলো, “To steal and pass off (the ideas or words of another) as one’s own; use (another’s production) without crediting the source is called Plagiarism"। এটি এক ধরণের অসদাচরণ ও বৌদ্ধিক ব্যাধি। দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমানে অনেক গবেষক ও লেখক তাদের নিয়মিত লেখাতে বা মৌলিক গবেষণা কর্ম যেমন এম ফিল, পি এইচ ডি বা বই প্রকাশনা ইত্যাদিতে ব্যাপক চৌর্যবৃত্তি করে থাকেন। ইতোমধ্যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকদের লেখাচুরির খবর মিডিয়াতে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এটি জঘন্য ও ঘৃণ্য অপরাধ।
লেখালেখিতে চৌর্যবৃত্তি বা নকল প্রবণতা নতুন কোন বিষয় নয়। এ চৌর্যবৃত্তি নিয়ে থমাস স্টারন্স এলিয়ট বা টি এস এলিয়ট বলেছিলেন, ‘নতুন কবিরা করেন অনুকরণ আর বুড়ো কবিরা করেন চুরি।’ এরকম চৌর্যবৃত্তির খতিয়ান তুলে ধরে মুনীর চৌধুরী ‘আসুন চুরি করি’ শিরোনামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। লেখা চুরির ওই খতিয়ানে অন্যদের মধ্যে যাদের কথা বলেছিলেন তারা হলেন বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, শিবরাম চক্রবর্তী, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ এবং কাজি আফসার উদ্দিন। অনুরুপভাবে, সত্যজিৎরায়ের‘দ্য এলিয়েন’ অনির্মিত সিনেমার পাণ্ডুলিপি নকল করে স্টিভেন স্পিলবার্গ টি ডট এন ডট (T.N.) ছবি বানিয়ে দুনিয়া জুড়ে আলোড়ন তুলেছেন। এরকম অভিযোগ রয়েছে হুমায়ুন আজাদের ‘ভাষা শিক্ষা ও ভাষাবিজ্ঞান পরিচিতি’, ‘নারী’ এবং ‘আমার অবিশ্বাস’ বই তিনটি নিয়েও। এসব নিয়ে সৈয়দ শামসুল হক এবং আহমদ ছফা মুখ খুলেছিলেন।
এরকম চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ দিল্লিতে নির্বাসিত আমাদের এক লেখিকার বিরুদ্ধেও। যিনি চুরি করা লেখা নিয়ে আনন্দ পুরস্কার পর্যন্ত পেয়েছিলেন। আমাদের সমসাময়িক জীবিত বেশ কয়েকজন লেখকের কথা জানি, যারা হুবুহু চৌর্যবৃত্তির সাথে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। নানা সময়ে তাদেরকে প্রশ্ন করা হলেও সেটি তারা এড়িয়ে গেছেন। অসংখ্য লেখক ও গবেষকের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তি বা লেখাচুরীর অভিযোগ রয়েছে এবং অনেকেই এর জন্য দাপ্তরিক ও প্রশাসনিক শাস্তিও পেয়েছেন।
চুরি চুরিই! সেটি পণ্য হোক বা লেখা হোক। মসজিদে গেলে যেমন জুতা চুরি যায়। অমুক্তিযোদ্ধা আমলা যেমন মুক্তিযোদ্ধার নকল সনদ নিয়ে সুযোগ সুবিধা নেন, ব্যবসায়ী যেমন পণ্যে ভেজাল মেশান। তবে ওসবের নজরদারির জন্যে, প্রতিকারের জন্যে বা ওসব থেকে পরিত্রাণের জন্য নিয়ম-কানুন ও ব্যবস্থাও থাকে। কিন্তু লেখালেখিতে এই প্রবণতা ঠেকানোর জন্যে আমাদের দেশে কি কোন নিয়ম নীতি আছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেমন গবেষণাকর্ম চুরি করে নিজেদের নামে ছাপিয়ে ডিগ্রি নেন। আমাদের দেশে কপিরাইট বিধিতে কিছু বিধির উল্লেখ থাকলেও তা মানে কয়জন!
একথা সত্য যে, যারা লেখক তাদের সকলেই জানেন, প্লাগিয়ারিজম বা চৌর্যবৃত্তি থেকে এড়িয়ে থাকার কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। এই সহজ নিয়মগুলিকে অনেক লেখক ভুলে যান বা উপেক্ষা করেন। ফলে, তথ্য-প্রযুক্তির এ যুগে চুরির ঘটনাগুলি খুব সাধারণ হয়ে উঠেছে। একটি উদার সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি হল, যে লেখক চুরির জন্য দোষী তারা চুরির ধরণ কী সে সম্পর্কেও অজ্ঞ। আবার, আমরা সকলেই চুরি সংক্রান্ত সাধারণ মানদণ্ডে সম্মত হই, কিন্তু সে নিয়মগুলি মেনে চলতে চাই না। বর্তমানে প্লাগিয়ারিজম নামক এ ব্যাধি অনেক বেড়ে গেছে। ফলে, সৃজনশীল কর্মকান্ড বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। তাই, লেখাচুরি বা চৌর্যবৃত্তি (Plagiarism) এড়াতে আমাদেরকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। লেখক সম্প্রদায় নিজেদের অপরাধবোধ জাগ্রত করতে পারলেই এ ব্যাধি থেকে দ্রুত নিরাময় সম্ভব। সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই সকল নবীন-প্রবীন লেখকদের উদ্দেশ্যে নিম্নে সাতটি নিয়ম-নির্দেশিকা উল্লেখ করা হলো, যা জানা থাকলে প্লাগিয়ারিজম থেকে এড়িয়ে থাকা সহজ হবেঃ
১। কপি বা অনুলিপি করবেন নাঃ অন্য কোনো কাগজ বা বই থেকে (এমনকি এটি আপনার নিজের পূর্বে প্রকাশিত বই বা প্রবন্ধ হলেও) কোন শব্দ বা বাক্য নকল করে লেখা কোন ভালো লেখা নয়। নিজের লেখার মধ্যে দালিলিক সত্য প্রতিষ্ঠায় খুব সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে, তবে তা যেন উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে থাকে এবং উদ্ধৃতির সাথে সাথে উৎসেরউদ্ধৃতিওদেয়াথাকে। এটা বলা বাহুল্য যে, উদ্ধৃতি চিহ্ন ছাড়া কপি বা অনুলিপি করা অর্থাৎ উপযুক্ত উদ্ধৃতির অভাব হল নির্লজ্জ চুরি এবং সেটি খুবই দুঃখজনক।
২। আপনার নিজের ভাষায় লিখুনঃনিজের লেখাকে সম্মৃদ্ধশালী করতে অন্য কারোর লেখার শব্দ বা শৈলী ব্যবহার না করে আপনার সমস্ত ধারণাগুলি নিজের ভাষায় লিখুন। এর মানে হল যে আপনার সাধারণত যতটা সম্ভব প্যারাফ্রেজিং বা শব্দান্তর এড়িয়ে চলা উচিত। অনুচ্ছেদ করা বা আপনার নিজের শব্দে অন্য কারো পাঠ পুনঃলিখন, শুধুমাত্র তখনই গ্রহণযোগ্য হয় যখন এটি পাঠ্যের মধ্যে সামান্যতমভাবে ঘটে থাকে এবং মূল উৎসটিঅনুচ্ছেদের বাক্যাংশের শেষে উদ্ধৃত করা হয়। এখানে চুরির বিষয়ে কোনো উদ্বেগ এড়ানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হল প্যারাফ্রেজ না করা। আপনার ধারনা জানাতে আপনার নিজস্ব সৃষ্ট আসল ভাষা ব্যবহার করুন। ধার করা টেক্সট উদ্ধৃত না করে মূল বলে নিজের নামে চালিয়ে দেয়া এবং ধার করা টেক্সটির সামান্য শব্দ বা ভাবার্থ পরিবর্তন বা সামান্য মিশ্রিত করে প্রকাশ করাও চৌর্যবৃত্তির অন্তর্ভুক্ত।
৩। তথ্যগত সন্দেহ হলে তা উল্লেখ করুনঃ আপনি যদি আপনার লেখার মাঝে নিজের কথার চেয়ে বেশি উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে এটি অন্যের লেখা থেকে বেশি ধার করে এনেছেন এবং সেটি চৌর্যবৃত্তি। এক্ষেত্রে আপনার প্রবন্ধটি বা প্রকাশনাটি পুনরায় লেখার বিষয়ে বিবেচনা করা উচিত। সাধারণ শব্দ এবং বাক্যাংশগুলিকে উদ্ধৃত করা বা উদ্ধৃতি চিহ্নে রাখার দরকার নেই, তবে সাধারণ বোধগম্য ধারণাগুলির যে কোনও আলোচনা অবশ্যই যথাযথভাবে উদ্ধৃত করা আবশ্যক। কোন তথ্যের ব্যাপারে আপনার অজ্ঞতা থাকলে বা আপনার চৌর্যবৃত্তির প্রবল সন্দেহ হলে তা নিজের লেখা বলে চালিয়ে না দিয়ে যার লেখা থেকে আপনি ধার করেছেন, তার রেফারেন্স উল্লেখ করে আপনার লেখাকে শক্তিশালি করতে পারেন।
৪। পূর্বের লেখার পুনর্ব্যবহার করবেন নাঃযেকোন প্রকাশিত প্রবন্ধ, কবিতা বা লেখা থেকে সংগৃহীত শব্দ বা বাক্যাংশ, এমনকি আপনার নিজের পূর্বে প্রকাশিত গবেষনা পত্র থেকে ছবি, চিত্র, টেবিল বা পাঠ্য পুনর্ব্যবহার করবেন না। কিন্তু যদি আপনার প্রয়োজন হয তাহলে চিত্র বা টেবিলের ক্যাপশনে মূল পত্রটি উদ্ধৃত করুন এবং নিশ্চিত করুন যে আপনি পাঠ্যে উল্লেখ করেছেন যে এটি আপনার পূর্বের প্রকাশনা থেকে এসেছে। মোটকথা, এক লেখা থেকে অন্য লেখায় পাঠ্য পুনর্ব্যবহার করবেন না। প্রতিটি লেখার জন্য নতুন পাঠ্য লিখুন। এই কাজগুলো করতে ব্যর্থ হলে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও আপনি লেখাচুরীর দায়ে দুষ্ট হয়ে যাবেন এবং সেটি ইচ্ছাকৃত চুরির মতোই আচরণ করা হয়।
৫। কপি করতে অনুমতি নিনঃ আপনি যদি একটি চিত্র ব্যবহার করতে চান, যেমন কোন টেবিল বা কোনো ধরনের ডেটা বা চিত্র, যা আগে প্রকাশ করা হয়নি, এবং আপনার পত্রের সহ-লেখক নন এমন কারো দ্বারা তৈরি বা সংগ্রহ করা হয়েছে, আপনাকে অবশ্যই তাদের অনুমতি নিতে হবে এবং তাদের কাছে এটি আরোপ করতে হবে। আপনি যদি তাদের ফিগার বা চিত্র, টেবিল ও তথ্যস্মারণী নিজের মত করে তৈরি করেন তবে সেক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য এবং তাদের অনুমতি নিতে হবে।
৬। আপনার নিজস্ব ধারণা উপস্থাপন করুনঃ
উৎসের ধারনা বা শব্দগুলিকে তোতা পাখির মত হুবহু কপি করার পরিবর্তে, আপনি এটি সম্পর্কে কী বলতে চান তা অন্বেষণ করুন। নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন কোন অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি বা পয়েন্ট আপনি আপনার লেখায় অবদান রাখতে পারেন যা সম্পূর্ণ আপনার নিজস্ব। মনে রাখবেন, আপনি যদি আপনার নিজস্ব পয়েন্ট ফ্রেম করার জন্য একটি উৎসের ধারণা বা শব্দের প্রতি ইঙ্গিত করে থাকেন, তাহলেও চুরি করা এড়াতে আপনাকে উপরের নির্দেশিকাগুলি প্রয়োগ করতে হবে। অন্যদিকে, আপনি যদি একাধিক অ্যাসাইনমেন্টের জন্য একই বিষয়ে লিখেন, তাহলে আপনার আগের কিছু শব্দকে পুনর্ব্যবহার করতে প্রলুব্ধ হতে পারেন, এটিকে বলা হয় ‘আত্ম-সাহসিকতা’ (Self-Plagiarism) যদি প্রকাশক বা আপনার প্রশিক্ষক আপনাকে আপনার পুরানো কাজ পুনঃব্যবহারের অনুমতি না দেন তাহলে এটিও চৌর্যবৃত্তির মত ঝুকিপূর্ণ অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।
৭। প্লাগিয়ারিজম চেকার ব্যবহার করুনঃএকটি বিষয়ের উপর আপনার গবেষণা পরিচালনা করার সময়, কিছু বাক্যাংশ বা বাক্য আপনার সাথে এত ভালভাবে মিলে যেতে পারে যে আপনি অজান্তেই সেগুলিকে আপনার লেখায় উদ্ধৃতি ছাড়াই অন্তর্ভুক্ত করেন। সন্দেহ হলে, একটি অনলাইন প্লাগিয়ারিজম চেকার বা চুরি পরীক্ষক টুল ব্যবহার করে চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে পারেন। বর্তমানে অনেক সফটওয়্যার আবিস্কৃত হয়েছে যা ব্যবহার করে আপনার সন্দেহযুক্ত চৌর্যবৃত্তি স্ক্যান করে মূল লেখা বা রচনা তৈরি করতে পারেন। এছাড়াও গুগল প্লাগিয়ারিজম চেকার দিয়েও আপনার লেখার কিছু অংশ চুরি করা হয়েছে কিনা তা জানাতে পারেন।
সুতরাং লেখাচুরী বা চৌর্যবৃত্তি (Plagiarism) যেহেতু একটি অসদাচরণ রুপের বহিঃপ্রকাশ এবং একধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক অপরাধ, এ থেকে আমাদের শিক্ষিত গবেষক শ্রেণি-গোষ্ঠির মানুষদেরকে আন্তরিকভাবে সচেতন হতে হবে। উপরোক্ত নিয়ম ও নির্দেশিকাগুলি মেনে চলতে পারলেই কোন লেখকই আর চৌর্যবৃত্তির দায়ে কলংকিত হবেন না এবং শিক্ষা সমাজ থেকে এ ঘৃণ্য অপরাধ চীরতরে দূর হয়ে যাবে।
[লেখক: প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]
মাহমুদুল হাছান
রোববার, ২১ আগস্ট ২০২২
লেখাচুরি বা চৌর্যবৃত্তি বুঝাতে ইংরেজিতে প্লাগিয়ারিজম (Plagiarism) শব্দটি বেশি পরিচিত। চৌর্যবৃত্তি বা প্লাগিয়ারিজম হলো, অন্য কারোর লেখা বা রচনা থেকে এমনকি নিজের পূর্ববর্তী প্রকাশনা থেকে উৎপাদিতধারণা, শব্দ বা বাক্যাংশ নিয়ে কোন পত্র (Paper) লেখা এবং সেখানে মূল লেখক এবং প্রকাশনার উদ্ধৃতি সঠিকভাবে না দেয়া। কোনো মুদ্রিত উৎসেরঅনুলিপি (Copy) করে তা নিজের ভাষায় মূল লেখা লিখে এবং তা নিজের চয়নিকা হিসাবে ব্যাখ্যা করে প্রকাশ করাই হলো লেখাচুরি বা চৌর্যবৃত্তি। মেরিয়াম ওয়েবস্টার অভিধান মতে চৌর্যবৃত্তি বা প্লাগিয়ারিজম হলো, “To steal and pass off (the ideas or words of another) as one’s own; use (another’s production) without crediting the source is called Plagiarism"। এটি এক ধরণের অসদাচরণ ও বৌদ্ধিক ব্যাধি। দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমানে অনেক গবেষক ও লেখক তাদের নিয়মিত লেখাতে বা মৌলিক গবেষণা কর্ম যেমন এম ফিল, পি এইচ ডি বা বই প্রকাশনা ইত্যাদিতে ব্যাপক চৌর্যবৃত্তি করে থাকেন। ইতোমধ্যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকদের লেখাচুরির খবর মিডিয়াতে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এটি জঘন্য ও ঘৃণ্য অপরাধ।
লেখালেখিতে চৌর্যবৃত্তি বা নকল প্রবণতা নতুন কোন বিষয় নয়। এ চৌর্যবৃত্তি নিয়ে থমাস স্টারন্স এলিয়ট বা টি এস এলিয়ট বলেছিলেন, ‘নতুন কবিরা করেন অনুকরণ আর বুড়ো কবিরা করেন চুরি।’ এরকম চৌর্যবৃত্তির খতিয়ান তুলে ধরে মুনীর চৌধুরী ‘আসুন চুরি করি’ শিরোনামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। লেখা চুরির ওই খতিয়ানে অন্যদের মধ্যে যাদের কথা বলেছিলেন তারা হলেন বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, শিবরাম চক্রবর্তী, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ এবং কাজি আফসার উদ্দিন। অনুরুপভাবে, সত্যজিৎরায়ের‘দ্য এলিয়েন’ অনির্মিত সিনেমার পাণ্ডুলিপি নকল করে স্টিভেন স্পিলবার্গ টি ডট এন ডট (T.N.) ছবি বানিয়ে দুনিয়া জুড়ে আলোড়ন তুলেছেন। এরকম অভিযোগ রয়েছে হুমায়ুন আজাদের ‘ভাষা শিক্ষা ও ভাষাবিজ্ঞান পরিচিতি’, ‘নারী’ এবং ‘আমার অবিশ্বাস’ বই তিনটি নিয়েও। এসব নিয়ে সৈয়দ শামসুল হক এবং আহমদ ছফা মুখ খুলেছিলেন।
এরকম চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ দিল্লিতে নির্বাসিত আমাদের এক লেখিকার বিরুদ্ধেও। যিনি চুরি করা লেখা নিয়ে আনন্দ পুরস্কার পর্যন্ত পেয়েছিলেন। আমাদের সমসাময়িক জীবিত বেশ কয়েকজন লেখকের কথা জানি, যারা হুবুহু চৌর্যবৃত্তির সাথে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। নানা সময়ে তাদেরকে প্রশ্ন করা হলেও সেটি তারা এড়িয়ে গেছেন। অসংখ্য লেখক ও গবেষকের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তি বা লেখাচুরীর অভিযোগ রয়েছে এবং অনেকেই এর জন্য দাপ্তরিক ও প্রশাসনিক শাস্তিও পেয়েছেন।
চুরি চুরিই! সেটি পণ্য হোক বা লেখা হোক। মসজিদে গেলে যেমন জুতা চুরি যায়। অমুক্তিযোদ্ধা আমলা যেমন মুক্তিযোদ্ধার নকল সনদ নিয়ে সুযোগ সুবিধা নেন, ব্যবসায়ী যেমন পণ্যে ভেজাল মেশান। তবে ওসবের নজরদারির জন্যে, প্রতিকারের জন্যে বা ওসব থেকে পরিত্রাণের জন্য নিয়ম-কানুন ও ব্যবস্থাও থাকে। কিন্তু লেখালেখিতে এই প্রবণতা ঠেকানোর জন্যে আমাদের দেশে কি কোন নিয়ম নীতি আছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেমন গবেষণাকর্ম চুরি করে নিজেদের নামে ছাপিয়ে ডিগ্রি নেন। আমাদের দেশে কপিরাইট বিধিতে কিছু বিধির উল্লেখ থাকলেও তা মানে কয়জন!
একথা সত্য যে, যারা লেখক তাদের সকলেই জানেন, প্লাগিয়ারিজম বা চৌর্যবৃত্তি থেকে এড়িয়ে থাকার কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। এই সহজ নিয়মগুলিকে অনেক লেখক ভুলে যান বা উপেক্ষা করেন। ফলে, তথ্য-প্রযুক্তির এ যুগে চুরির ঘটনাগুলি খুব সাধারণ হয়ে উঠেছে। একটি উদার সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি হল, যে লেখক চুরির জন্য দোষী তারা চুরির ধরণ কী সে সম্পর্কেও অজ্ঞ। আবার, আমরা সকলেই চুরি সংক্রান্ত সাধারণ মানদণ্ডে সম্মত হই, কিন্তু সে নিয়মগুলি মেনে চলতে চাই না। বর্তমানে প্লাগিয়ারিজম নামক এ ব্যাধি অনেক বেড়ে গেছে। ফলে, সৃজনশীল কর্মকান্ড বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। তাই, লেখাচুরি বা চৌর্যবৃত্তি (Plagiarism) এড়াতে আমাদেরকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। লেখক সম্প্রদায় নিজেদের অপরাধবোধ জাগ্রত করতে পারলেই এ ব্যাধি থেকে দ্রুত নিরাময় সম্ভব। সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই সকল নবীন-প্রবীন লেখকদের উদ্দেশ্যে নিম্নে সাতটি নিয়ম-নির্দেশিকা উল্লেখ করা হলো, যা জানা থাকলে প্লাগিয়ারিজম থেকে এড়িয়ে থাকা সহজ হবেঃ
১। কপি বা অনুলিপি করবেন নাঃ অন্য কোনো কাগজ বা বই থেকে (এমনকি এটি আপনার নিজের পূর্বে প্রকাশিত বই বা প্রবন্ধ হলেও) কোন শব্দ বা বাক্য নকল করে লেখা কোন ভালো লেখা নয়। নিজের লেখার মধ্যে দালিলিক সত্য প্রতিষ্ঠায় খুব সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে, তবে তা যেন উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে থাকে এবং উদ্ধৃতির সাথে সাথে উৎসেরউদ্ধৃতিওদেয়াথাকে। এটা বলা বাহুল্য যে, উদ্ধৃতি চিহ্ন ছাড়া কপি বা অনুলিপি করা অর্থাৎ উপযুক্ত উদ্ধৃতির অভাব হল নির্লজ্জ চুরি এবং সেটি খুবই দুঃখজনক।
২। আপনার নিজের ভাষায় লিখুনঃনিজের লেখাকে সম্মৃদ্ধশালী করতে অন্য কারোর লেখার শব্দ বা শৈলী ব্যবহার না করে আপনার সমস্ত ধারণাগুলি নিজের ভাষায় লিখুন। এর মানে হল যে আপনার সাধারণত যতটা সম্ভব প্যারাফ্রেজিং বা শব্দান্তর এড়িয়ে চলা উচিত। অনুচ্ছেদ করা বা আপনার নিজের শব্দে অন্য কারো পাঠ পুনঃলিখন, শুধুমাত্র তখনই গ্রহণযোগ্য হয় যখন এটি পাঠ্যের মধ্যে সামান্যতমভাবে ঘটে থাকে এবং মূল উৎসটিঅনুচ্ছেদের বাক্যাংশের শেষে উদ্ধৃত করা হয়। এখানে চুরির বিষয়ে কোনো উদ্বেগ এড়ানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হল প্যারাফ্রেজ না করা। আপনার ধারনা জানাতে আপনার নিজস্ব সৃষ্ট আসল ভাষা ব্যবহার করুন। ধার করা টেক্সট উদ্ধৃত না করে মূল বলে নিজের নামে চালিয়ে দেয়া এবং ধার করা টেক্সটির সামান্য শব্দ বা ভাবার্থ পরিবর্তন বা সামান্য মিশ্রিত করে প্রকাশ করাও চৌর্যবৃত্তির অন্তর্ভুক্ত।
৩। তথ্যগত সন্দেহ হলে তা উল্লেখ করুনঃ আপনি যদি আপনার লেখার মাঝে নিজের কথার চেয়ে বেশি উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে এটি অন্যের লেখা থেকে বেশি ধার করে এনেছেন এবং সেটি চৌর্যবৃত্তি। এক্ষেত্রে আপনার প্রবন্ধটি বা প্রকাশনাটি পুনরায় লেখার বিষয়ে বিবেচনা করা উচিত। সাধারণ শব্দ এবং বাক্যাংশগুলিকে উদ্ধৃত করা বা উদ্ধৃতি চিহ্নে রাখার দরকার নেই, তবে সাধারণ বোধগম্য ধারণাগুলির যে কোনও আলোচনা অবশ্যই যথাযথভাবে উদ্ধৃত করা আবশ্যক। কোন তথ্যের ব্যাপারে আপনার অজ্ঞতা থাকলে বা আপনার চৌর্যবৃত্তির প্রবল সন্দেহ হলে তা নিজের লেখা বলে চালিয়ে না দিয়ে যার লেখা থেকে আপনি ধার করেছেন, তার রেফারেন্স উল্লেখ করে আপনার লেখাকে শক্তিশালি করতে পারেন।
৪। পূর্বের লেখার পুনর্ব্যবহার করবেন নাঃযেকোন প্রকাশিত প্রবন্ধ, কবিতা বা লেখা থেকে সংগৃহীত শব্দ বা বাক্যাংশ, এমনকি আপনার নিজের পূর্বে প্রকাশিত গবেষনা পত্র থেকে ছবি, চিত্র, টেবিল বা পাঠ্য পুনর্ব্যবহার করবেন না। কিন্তু যদি আপনার প্রয়োজন হয তাহলে চিত্র বা টেবিলের ক্যাপশনে মূল পত্রটি উদ্ধৃত করুন এবং নিশ্চিত করুন যে আপনি পাঠ্যে উল্লেখ করেছেন যে এটি আপনার পূর্বের প্রকাশনা থেকে এসেছে। মোটকথা, এক লেখা থেকে অন্য লেখায় পাঠ্য পুনর্ব্যবহার করবেন না। প্রতিটি লেখার জন্য নতুন পাঠ্য লিখুন। এই কাজগুলো করতে ব্যর্থ হলে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও আপনি লেখাচুরীর দায়ে দুষ্ট হয়ে যাবেন এবং সেটি ইচ্ছাকৃত চুরির মতোই আচরণ করা হয়।
৫। কপি করতে অনুমতি নিনঃ আপনি যদি একটি চিত্র ব্যবহার করতে চান, যেমন কোন টেবিল বা কোনো ধরনের ডেটা বা চিত্র, যা আগে প্রকাশ করা হয়নি, এবং আপনার পত্রের সহ-লেখক নন এমন কারো দ্বারা তৈরি বা সংগ্রহ করা হয়েছে, আপনাকে অবশ্যই তাদের অনুমতি নিতে হবে এবং তাদের কাছে এটি আরোপ করতে হবে। আপনি যদি তাদের ফিগার বা চিত্র, টেবিল ও তথ্যস্মারণী নিজের মত করে তৈরি করেন তবে সেক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য এবং তাদের অনুমতি নিতে হবে।
৬। আপনার নিজস্ব ধারণা উপস্থাপন করুনঃ
উৎসের ধারনা বা শব্দগুলিকে তোতা পাখির মত হুবহু কপি করার পরিবর্তে, আপনি এটি সম্পর্কে কী বলতে চান তা অন্বেষণ করুন। নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন কোন অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি বা পয়েন্ট আপনি আপনার লেখায় অবদান রাখতে পারেন যা সম্পূর্ণ আপনার নিজস্ব। মনে রাখবেন, আপনি যদি আপনার নিজস্ব পয়েন্ট ফ্রেম করার জন্য একটি উৎসের ধারণা বা শব্দের প্রতি ইঙ্গিত করে থাকেন, তাহলেও চুরি করা এড়াতে আপনাকে উপরের নির্দেশিকাগুলি প্রয়োগ করতে হবে। অন্যদিকে, আপনি যদি একাধিক অ্যাসাইনমেন্টের জন্য একই বিষয়ে লিখেন, তাহলে আপনার আগের কিছু শব্দকে পুনর্ব্যবহার করতে প্রলুব্ধ হতে পারেন, এটিকে বলা হয় ‘আত্ম-সাহসিকতা’ (Self-Plagiarism) যদি প্রকাশক বা আপনার প্রশিক্ষক আপনাকে আপনার পুরানো কাজ পুনঃব্যবহারের অনুমতি না দেন তাহলে এটিও চৌর্যবৃত্তির মত ঝুকিপূর্ণ অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।
৭। প্লাগিয়ারিজম চেকার ব্যবহার করুনঃএকটি বিষয়ের উপর আপনার গবেষণা পরিচালনা করার সময়, কিছু বাক্যাংশ বা বাক্য আপনার সাথে এত ভালভাবে মিলে যেতে পারে যে আপনি অজান্তেই সেগুলিকে আপনার লেখায় উদ্ধৃতি ছাড়াই অন্তর্ভুক্ত করেন। সন্দেহ হলে, একটি অনলাইন প্লাগিয়ারিজম চেকার বা চুরি পরীক্ষক টুল ব্যবহার করে চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে পারেন। বর্তমানে অনেক সফটওয়্যার আবিস্কৃত হয়েছে যা ব্যবহার করে আপনার সন্দেহযুক্ত চৌর্যবৃত্তি স্ক্যান করে মূল লেখা বা রচনা তৈরি করতে পারেন। এছাড়াও গুগল প্লাগিয়ারিজম চেকার দিয়েও আপনার লেখার কিছু অংশ চুরি করা হয়েছে কিনা তা জানাতে পারেন।
সুতরাং লেখাচুরী বা চৌর্যবৃত্তি (Plagiarism) যেহেতু একটি অসদাচরণ রুপের বহিঃপ্রকাশ এবং একধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক অপরাধ, এ থেকে আমাদের শিক্ষিত গবেষক শ্রেণি-গোষ্ঠির মানুষদেরকে আন্তরিকভাবে সচেতন হতে হবে। উপরোক্ত নিয়ম ও নির্দেশিকাগুলি মেনে চলতে পারলেই কোন লেখকই আর চৌর্যবৃত্তির দায়ে কলংকিত হবেন না এবং শিক্ষা সমাজ থেকে এ ঘৃণ্য অপরাধ চীরতরে দূর হয়ে যাবে।
[লেখক: প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]