মাহমুদুল হাছান
আমরা জানি, শিক্ষাব্যবস্থাপনায় শিক্ষাকৌশলের তিনটি পরিভাষা রয়েছে, যা পেডাগোজি (Pedagogy), এন্ড্রাগোজি (Andragogy) ও হিউটাগোজি (Heutagogy) নামে পরিচিত। এদের মধ্যে হিউটাগোজি একটি কার্যকরি শিক্ষাকৌশল, যা অন্যান্য দু’টি থেকে শিখনফল বিবেচনায় ভিন্ন ও তুলনামূলকভাবে বেশি কার্যকর।
হিউটাগোজি (Heutagogy) পরিভাষাটি শিক্ষার্থীদের স্ব-নির্ধারিত শিক্ষাপদ্ধতি হিসাবে পরিচিত। এটি একটি শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক নির্দেশনামূলক কৌশল। এটি শিক্ষার্থীদেরকে তাদের স্বায়ত্তশাসন, ক্ষমতা এবং সক্ষমতা বিকাশের উপর জোর দেয়। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আজীবন শিক্ষাকৌশল।
শাব্দিক বিশ্লেষণে ইংরেজী Heutagogy শব্দের উচ্চারণ সাধারণত হিউ-টা-গোজি করা হয়ে থাকে। এটি একটি গ্রীক শব্দ Heureskein (হিউরিস্কিন) থেকে উদ্ভূত। গ্রাহাম আর পার্সলোর মতে, “Heureskein হল একটি গ্রীক ক্রিয়া যা শিক্ষার্থীদেরকে তাদের নিজেদের প্রচেষ্টায় প্রস্তুত করার জন্য শিক্ষার একটি পদ্ধতি হিসাবে কার্যকরি হয়। কেউ কেউ বলেছেন হিউটাগোজি শব্দটি গ্রীক মূল শব্দ হেস (Hase) এবং কেনিয়ন (Kenyon) থেকে নিঃসৃত, যা ২০০০ সালে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে স্ব-শিক্ষাকে বর্ণনা করার জন্য আবিস্কৃত হয়েছিলো। মোটকথা, হিউটাগোজি (Heutagogy) হল নিজে নিজে শেখার জন্য এমন অধ্যয়ন, যা শিক্ষাদান এবং শিক্ষাগ্রহনের বিষয়ে কিছু ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করার একটি প্রয়াস হিসেবে মূল্যায়িত হয়। এটি এমন একটি উত্তেজনাপূর্ণ ধারণা যা শিক্ষার্থীদেরকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
শিক্ষায় অন্যদুটি পরিভাষার মধ্যে পেডাগোজি (Pedagogy) হলো শিক্ষক নেতৃত্বাধীন শিক্ষা, যা সাধারণত অনধিক ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার জন্য প্রযোজ্য এবং প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি অনুশীলিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে, এন্ড্রাগজি (Andragogy) হলো প্রাপ্তবয়স্কদের স্ব-নির্দেশিত শিক্ষা, যা সাধারনত ১৮ বছর উর্দ্ধের বয়সী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার জন্য প্রযোজ্য এবং উচ্চশিক্ষার জন্য যারা আরো শিখতে চান বা গবেষণা করতে চান তাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিটা ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
কিন্তু, হিউটাগজি হলো অন্যদুটি থেকে ব্যতিক্রম যাকে শিক্ষার্থীদের স্ব-উদ্যোগী শিক্ষা বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এটি জীবনব্যাপী শিক্ষাপদ্ধতি, যা যে কোন বয়সের শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই কার্যকর। হিউটাগোজি উপরের অন্য দু’টি থেকে বেশি গ্রহন যোগ্য। কারন, বর্তমানে শিক্ষার্থীদেরকে শেখার পদ্ধতি শেখানো হয় এবং তাদেরকে নিজে নিজে শেখার জন্য আগ্রহী করে তোলা হয়।
মোটকথা, পেডাগোজিতে শিক্ষকরাই সিদ্ধান্ত নেন শিক্ষার্থীরা কী শিখবে, কিভাবে শিখবে এবং কেমন পরিবেশে তারা শিখবে। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের উপর নির্ভর করে এবং তাদের নির্দেশনার বাইরে শিক্ষার্থীরা শেখার সুযোগ পায় না। অপরদিকে, এন্ড্রাগোজিক পরিবেশে শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে পরামর্শদাতা বা গাইড হিসেবে বিবেচনা করে। তবে তারা স্বাধীনভাবে শিক্ষককের কাজগুলির সমাধান খুঁজে বের করার দিকেও লক্ষ্য রাখে। কিন্তু হিউটাগোজিকাল পদ্ধতি শিক্ষার্থীদেরকে নিজেদের উত্তর দিতে বা উত্তর পত্র তৈরি করতে এবং প্রশ্নোত্তর খুঁজে পেতে উৎসাহিত করে। শিক্ষক-অর্পিত কাজগুলি শিক্ষককের সাহায্য নিয়ে সহজভাবে সম্পন্ন করার পরিবর্তে, শিক্ষার্থীরা যে বিষয়গুলি অধ্যয়ন করে সেই বিষয়ে অনিশ্চয়তা এবং জটিলতার ক্ষেত্র খুঁজে বের করে এবং সেগুলির সমাধান তৈরি করতে চেষ্টা করে। হিউটাগোজিতে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শেখার পরিবেশ তৈরি করেন এবং শেখার উপকরণ খুঁজে পেতে সাহায্য করেন। শিক্ষকের পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা তাদের জ্ঞান চর্চার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করে।
শ্রেণিকক্ষে হিউটাগজিকাল পদ্ধতি প্রয়োগ করার জন্য ৪টি গুরুত্বপূর্ণ টিপস রয়েছে যেগুলি অনুশীলন করলে শিক্ষার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদিত হয় এবং শিক্ষার্থীদের শিখণফল কার্যকরী হয়। নিম্নে এব্যাপারে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলোঃ
১। শিক্ষক-নির্ধারিত শিখণফল তৈরি করাঃ শিক্ষক-নির্ধারিত একটি শিখনফল ডিজাইন করা হিউটাগজিকাল পদ্ধতি বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ। এই পদ্ধতিতে, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক উভয়ে শেখার প্রয়োজনীয়তা এবং উদ্দিষ্ট ফলাফল খুঁজে পেতে একসাথে কাজ করে। যেমন একজন শিক্ষক এটি নিশ্চিত করতে তিনি একটি প্রশ্নচার্ট তৈরি করে পাঠপরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করতে পারেন। প্রশ্নগুলি হতে পারে এমনঃ (ক) শিক্ষার্থী কী শিখতে বা অর্জন করতে চায়? (খ) শেখার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের কী ফলাফল আশা করা উচিত? (গ) শিক্ষকের নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রমের কোন উদ্দেশ্যটি প্রয়োজন?
শিখনফল ভিত্তিক শিক্ষা, শিক্ষার্থীরা কি শিখতে চায় তা নির্ধারণ করতে সাহায্য করে। তারা তাদের স্বতন্ত্র শিক্ষার পথ তৈরি করতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতিটি শিক্ষার্থী শেখার মানসিকতা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারে যে, তারা কী শিখবে, শেখার কোন পদ্ধতি ও কার্যকলাপগুলি ব্যবহার করবে এবং শিক্ষক কীভাবে তাদের শেখার মূল্যায়ন করবেন।
২। পাঠ্যক্রমে শিথিলতা প্রদর্শন করাঃ একটি হিউটাগজিকাল পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা তখনই সম্ভব যখন পাঠ্যক্রমটি ফ্লেক্সিবল বা নমনীয় হয়, যার ফলে শিক্ষার্থীরা যা শিখেছে তার কারণে তাদের কৌতুহল, প্রেরণা এবং চিন্তাভাবনার মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। শিক্ষার্থীদের নিজেদের জন্য একটি পাঠ্যক্রম তৈরি করতে সক্ষম হতে হবে, যাতে আদর্শিকভাবে তারা তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনের সাথে শৃঙ্খলাবদ্ধ একটি অভিযোজিত পথ তৈরি করতে পারে।
শিক্ষার্থী নির্ধারিত শেখার উদ্দেশ্যগুলির উপর ভিত্তি করে শিক্ষকদেরকে তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করার প্রয়োজন হতে পারে। তবে হিউটাগোজিতে ছাত্র-ছাত্রীরা কি শিখবে এবং কিভাবে শিখবে তা নির্ধারণ করার স্বাধীনতা তাদের রয়েছে। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগতকরণ ও ক্ষমতায়িত বোধ করতে সাহায্য করে এবং বৃহত্তর ব্যস্ততাকে উৎসাহিত করে।
৩। আলোচনার ভিত্তিতে সহজ মূল্যায়ন পন্থা বের করাঃ মূল্যায়ন বা এসেসমেন্ট হিউটাগজিসহ সমস্ত নির্দেশমূলক পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শিক্ষার্থীরা কাঠামোবদ্ধ ও গদবাধা পরীক্ষার পরিবর্তে এই শিখণ শৈলীতে তাদের মূল্যায়ন ডিজাইন করে। এ মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের জন্য কম হুমকির পরিবেশ তৈরি করে এবং এটি সুশিক্ষাকে উৎসাহিত করতে পারে।
এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা অবশ্যই বিষয়বস্তু বোঝার এবং অর্জিত দক্ষতা পরিমাপের মূল্যায়ন ডিজাইন করতে পারে। শিখণ ফলাবর্তে শিক্ষার্থীদের দেখাতে হবে যে এ পদ্ধতিতে তারা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
৪। সহযোগীতাপূর্ণ শিক্ষাকার্যক্রম সেট করাঃ সতন্ত্র বৈশিষ্ঠ্যে অনন্য হিউটাগজিকাল ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীরা শিখনকর্মে সামান্য সমস্যা অনুভব করতে পারে। কারণ, আগে তারা শিক্ষক নির্ভর পড়া-লেখা করতো এবং তাদেরকে নিজে শেখার দায়িত্ব নিতে হয়নি, সেহেতু এ পদ্ধতিতে তাদের মধ্যে কিছুটা ইতস্তত ভাব বোধ হতে পারে। তবে একবার শিক্ষার্থীরা স্ব-নির্ধারিত এ হিউটাগোজিকাল শিক্ষার স্বাদ পেয়ে গেলে, তারা আর অন্য পদ্ধতিতে শিখতে চাইবে না এবং পারতপক্ষে পুনরায় আর কাঠামোবদ্ধ পাঠ্যক্রমের সীমাবদ্ধতায় ফিরে যেতেও ইচ্ছে করবে না।
তাই হিউটাগোজিকাল পদ্ধতিতে শিক্ষাধারা রুপান্তরিত করার সহজ একটি উপায় হল শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদেরকে সহযোগিতা করা এবং স্ব-উদ্যোগে শিখতে উৎসাহিত করা। শিক্ষকদের পরিকল্পিত ডিজাইনের মাধ্যমে, হিউটাগোজিকাল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা একে অন্যের সাথে শিখনকার্য ভাগ করে নিতে পারে এবং পাঠকর্মের অগ্রগতি আনতে সকলে মিলে একসাথে কাজ করতে পারে।
মোটকথা, হিউটাগোজি ব্যবহার করে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের একসাথে কাজ করতে উৎসাহিত করে, যেন ব্যক্তিগত এবং ডিজিটালভাবে তারা উভয়েই একটি সাধারণ লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। এ পদ্ধতিতে, তারা পঠন-পাঠনে অনুভূত সমস্যাগুলি সমাধান করতে পারে এবং তথ্য ও অভিজ্ঞতা শেয়ারও করতে পারে। এছাড়াও, তাদের ধারণাগুলি অনুশীলন করে এবং পরীক্ষা করে এ পদ্ধতিতে তারা তাদের জ্ঞানকে আরো শক্তিশালী করতে পারে। এই সহযোগী অধিবেশনগুলি শিক্ষার্থীদের একে অপরের কাছ থেকে শেখার এবং তারা কীভাবে তাদের নতুন দক্ষতাগুলি অনুশীলনে প্রয়োগ করতে পারে সে সম্পর্কে চিন্তা করার একটি সুযোগ সৃষ্টি করে। সুতরাং একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শিক্ষার্থীদেরকে ক্যারিয়ার ভিত্তিক জ্ঞানচর্চায় উদবুদ্ধ করতে স্ব-উদ্ভাবিত (Heutagogy) শিক্ষা একটি অন্যতম শিক্ষা কৌশল, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সারা জীবন নিজে নিজে শিখতে পারে এবং তাদেরকে স্বেচ্ছায় স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ গ্রহন করতে পারে। আমি মনে করি, বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে শিখন ও শিক্ষণকর্মে এ হিউটাগোজিকাল পদ্ধতিগুলি প্রয়োগ করলে আমাদের দেশের শিক্ষার মান আরো উন্নত ও ফলপ্রসূ হবে।
[লেখক: প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা ও প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ স্মার্ট এডুকেশন নেটওয়ার্ক (বিডিসেন)]
মাহমুদুল হাছান
মঙ্গলবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২
আমরা জানি, শিক্ষাব্যবস্থাপনায় শিক্ষাকৌশলের তিনটি পরিভাষা রয়েছে, যা পেডাগোজি (Pedagogy), এন্ড্রাগোজি (Andragogy) ও হিউটাগোজি (Heutagogy) নামে পরিচিত। এদের মধ্যে হিউটাগোজি একটি কার্যকরি শিক্ষাকৌশল, যা অন্যান্য দু’টি থেকে শিখনফল বিবেচনায় ভিন্ন ও তুলনামূলকভাবে বেশি কার্যকর।
হিউটাগোজি (Heutagogy) পরিভাষাটি শিক্ষার্থীদের স্ব-নির্ধারিত শিক্ষাপদ্ধতি হিসাবে পরিচিত। এটি একটি শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক নির্দেশনামূলক কৌশল। এটি শিক্ষার্থীদেরকে তাদের স্বায়ত্তশাসন, ক্ষমতা এবং সক্ষমতা বিকাশের উপর জোর দেয়। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আজীবন শিক্ষাকৌশল।
শাব্দিক বিশ্লেষণে ইংরেজী Heutagogy শব্দের উচ্চারণ সাধারণত হিউ-টা-গোজি করা হয়ে থাকে। এটি একটি গ্রীক শব্দ Heureskein (হিউরিস্কিন) থেকে উদ্ভূত। গ্রাহাম আর পার্সলোর মতে, “Heureskein হল একটি গ্রীক ক্রিয়া যা শিক্ষার্থীদেরকে তাদের নিজেদের প্রচেষ্টায় প্রস্তুত করার জন্য শিক্ষার একটি পদ্ধতি হিসাবে কার্যকরি হয়। কেউ কেউ বলেছেন হিউটাগোজি শব্দটি গ্রীক মূল শব্দ হেস (Hase) এবং কেনিয়ন (Kenyon) থেকে নিঃসৃত, যা ২০০০ সালে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে স্ব-শিক্ষাকে বর্ণনা করার জন্য আবিস্কৃত হয়েছিলো। মোটকথা, হিউটাগোজি (Heutagogy) হল নিজে নিজে শেখার জন্য এমন অধ্যয়ন, যা শিক্ষাদান এবং শিক্ষাগ্রহনের বিষয়ে কিছু ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করার একটি প্রয়াস হিসেবে মূল্যায়িত হয়। এটি এমন একটি উত্তেজনাপূর্ণ ধারণা যা শিক্ষার্থীদেরকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
শিক্ষায় অন্যদুটি পরিভাষার মধ্যে পেডাগোজি (Pedagogy) হলো শিক্ষক নেতৃত্বাধীন শিক্ষা, যা সাধারণত অনধিক ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার জন্য প্রযোজ্য এবং প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি অনুশীলিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে, এন্ড্রাগজি (Andragogy) হলো প্রাপ্তবয়স্কদের স্ব-নির্দেশিত শিক্ষা, যা সাধারনত ১৮ বছর উর্দ্ধের বয়সী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার জন্য প্রযোজ্য এবং উচ্চশিক্ষার জন্য যারা আরো শিখতে চান বা গবেষণা করতে চান তাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিটা ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
কিন্তু, হিউটাগজি হলো অন্যদুটি থেকে ব্যতিক্রম যাকে শিক্ষার্থীদের স্ব-উদ্যোগী শিক্ষা বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এটি জীবনব্যাপী শিক্ষাপদ্ধতি, যা যে কোন বয়সের শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই কার্যকর। হিউটাগোজি উপরের অন্য দু’টি থেকে বেশি গ্রহন যোগ্য। কারন, বর্তমানে শিক্ষার্থীদেরকে শেখার পদ্ধতি শেখানো হয় এবং তাদেরকে নিজে নিজে শেখার জন্য আগ্রহী করে তোলা হয়।
মোটকথা, পেডাগোজিতে শিক্ষকরাই সিদ্ধান্ত নেন শিক্ষার্থীরা কী শিখবে, কিভাবে শিখবে এবং কেমন পরিবেশে তারা শিখবে। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের উপর নির্ভর করে এবং তাদের নির্দেশনার বাইরে শিক্ষার্থীরা শেখার সুযোগ পায় না। অপরদিকে, এন্ড্রাগোজিক পরিবেশে শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে পরামর্শদাতা বা গাইড হিসেবে বিবেচনা করে। তবে তারা স্বাধীনভাবে শিক্ষককের কাজগুলির সমাধান খুঁজে বের করার দিকেও লক্ষ্য রাখে। কিন্তু হিউটাগোজিকাল পদ্ধতি শিক্ষার্থীদেরকে নিজেদের উত্তর দিতে বা উত্তর পত্র তৈরি করতে এবং প্রশ্নোত্তর খুঁজে পেতে উৎসাহিত করে। শিক্ষক-অর্পিত কাজগুলি শিক্ষককের সাহায্য নিয়ে সহজভাবে সম্পন্ন করার পরিবর্তে, শিক্ষার্থীরা যে বিষয়গুলি অধ্যয়ন করে সেই বিষয়ে অনিশ্চয়তা এবং জটিলতার ক্ষেত্র খুঁজে বের করে এবং সেগুলির সমাধান তৈরি করতে চেষ্টা করে। হিউটাগোজিতে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শেখার পরিবেশ তৈরি করেন এবং শেখার উপকরণ খুঁজে পেতে সাহায্য করেন। শিক্ষকের পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা তাদের জ্ঞান চর্চার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করে।
শ্রেণিকক্ষে হিউটাগজিকাল পদ্ধতি প্রয়োগ করার জন্য ৪টি গুরুত্বপূর্ণ টিপস রয়েছে যেগুলি অনুশীলন করলে শিক্ষার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদিত হয় এবং শিক্ষার্থীদের শিখণফল কার্যকরী হয়। নিম্নে এব্যাপারে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলোঃ
১। শিক্ষক-নির্ধারিত শিখণফল তৈরি করাঃ শিক্ষক-নির্ধারিত একটি শিখনফল ডিজাইন করা হিউটাগজিকাল পদ্ধতি বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ। এই পদ্ধতিতে, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক উভয়ে শেখার প্রয়োজনীয়তা এবং উদ্দিষ্ট ফলাফল খুঁজে পেতে একসাথে কাজ করে। যেমন একজন শিক্ষক এটি নিশ্চিত করতে তিনি একটি প্রশ্নচার্ট তৈরি করে পাঠপরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করতে পারেন। প্রশ্নগুলি হতে পারে এমনঃ (ক) শিক্ষার্থী কী শিখতে বা অর্জন করতে চায়? (খ) শেখার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের কী ফলাফল আশা করা উচিত? (গ) শিক্ষকের নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রমের কোন উদ্দেশ্যটি প্রয়োজন?
শিখনফল ভিত্তিক শিক্ষা, শিক্ষার্থীরা কি শিখতে চায় তা নির্ধারণ করতে সাহায্য করে। তারা তাদের স্বতন্ত্র শিক্ষার পথ তৈরি করতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতিটি শিক্ষার্থী শেখার মানসিকতা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারে যে, তারা কী শিখবে, শেখার কোন পদ্ধতি ও কার্যকলাপগুলি ব্যবহার করবে এবং শিক্ষক কীভাবে তাদের শেখার মূল্যায়ন করবেন।
২। পাঠ্যক্রমে শিথিলতা প্রদর্শন করাঃ একটি হিউটাগজিকাল পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা তখনই সম্ভব যখন পাঠ্যক্রমটি ফ্লেক্সিবল বা নমনীয় হয়, যার ফলে শিক্ষার্থীরা যা শিখেছে তার কারণে তাদের কৌতুহল, প্রেরণা এবং চিন্তাভাবনার মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। শিক্ষার্থীদের নিজেদের জন্য একটি পাঠ্যক্রম তৈরি করতে সক্ষম হতে হবে, যাতে আদর্শিকভাবে তারা তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনের সাথে শৃঙ্খলাবদ্ধ একটি অভিযোজিত পথ তৈরি করতে পারে।
শিক্ষার্থী নির্ধারিত শেখার উদ্দেশ্যগুলির উপর ভিত্তি করে শিক্ষকদেরকে তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করার প্রয়োজন হতে পারে। তবে হিউটাগোজিতে ছাত্র-ছাত্রীরা কি শিখবে এবং কিভাবে শিখবে তা নির্ধারণ করার স্বাধীনতা তাদের রয়েছে। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগতকরণ ও ক্ষমতায়িত বোধ করতে সাহায্য করে এবং বৃহত্তর ব্যস্ততাকে উৎসাহিত করে।
৩। আলোচনার ভিত্তিতে সহজ মূল্যায়ন পন্থা বের করাঃ মূল্যায়ন বা এসেসমেন্ট হিউটাগজিসহ সমস্ত নির্দেশমূলক পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শিক্ষার্থীরা কাঠামোবদ্ধ ও গদবাধা পরীক্ষার পরিবর্তে এই শিখণ শৈলীতে তাদের মূল্যায়ন ডিজাইন করে। এ মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের জন্য কম হুমকির পরিবেশ তৈরি করে এবং এটি সুশিক্ষাকে উৎসাহিত করতে পারে।
এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা অবশ্যই বিষয়বস্তু বোঝার এবং অর্জিত দক্ষতা পরিমাপের মূল্যায়ন ডিজাইন করতে পারে। শিখণ ফলাবর্তে শিক্ষার্থীদের দেখাতে হবে যে এ পদ্ধতিতে তারা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
৪। সহযোগীতাপূর্ণ শিক্ষাকার্যক্রম সেট করাঃ সতন্ত্র বৈশিষ্ঠ্যে অনন্য হিউটাগজিকাল ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীরা শিখনকর্মে সামান্য সমস্যা অনুভব করতে পারে। কারণ, আগে তারা শিক্ষক নির্ভর পড়া-লেখা করতো এবং তাদেরকে নিজে শেখার দায়িত্ব নিতে হয়নি, সেহেতু এ পদ্ধতিতে তাদের মধ্যে কিছুটা ইতস্তত ভাব বোধ হতে পারে। তবে একবার শিক্ষার্থীরা স্ব-নির্ধারিত এ হিউটাগোজিকাল শিক্ষার স্বাদ পেয়ে গেলে, তারা আর অন্য পদ্ধতিতে শিখতে চাইবে না এবং পারতপক্ষে পুনরায় আর কাঠামোবদ্ধ পাঠ্যক্রমের সীমাবদ্ধতায় ফিরে যেতেও ইচ্ছে করবে না।
তাই হিউটাগোজিকাল পদ্ধতিতে শিক্ষাধারা রুপান্তরিত করার সহজ একটি উপায় হল শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদেরকে সহযোগিতা করা এবং স্ব-উদ্যোগে শিখতে উৎসাহিত করা। শিক্ষকদের পরিকল্পিত ডিজাইনের মাধ্যমে, হিউটাগোজিকাল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা একে অন্যের সাথে শিখনকার্য ভাগ করে নিতে পারে এবং পাঠকর্মের অগ্রগতি আনতে সকলে মিলে একসাথে কাজ করতে পারে।
মোটকথা, হিউটাগোজি ব্যবহার করে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের একসাথে কাজ করতে উৎসাহিত করে, যেন ব্যক্তিগত এবং ডিজিটালভাবে তারা উভয়েই একটি সাধারণ লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। এ পদ্ধতিতে, তারা পঠন-পাঠনে অনুভূত সমস্যাগুলি সমাধান করতে পারে এবং তথ্য ও অভিজ্ঞতা শেয়ারও করতে পারে। এছাড়াও, তাদের ধারণাগুলি অনুশীলন করে এবং পরীক্ষা করে এ পদ্ধতিতে তারা তাদের জ্ঞানকে আরো শক্তিশালী করতে পারে। এই সহযোগী অধিবেশনগুলি শিক্ষার্থীদের একে অপরের কাছ থেকে শেখার এবং তারা কীভাবে তাদের নতুন দক্ষতাগুলি অনুশীলনে প্রয়োগ করতে পারে সে সম্পর্কে চিন্তা করার একটি সুযোগ সৃষ্টি করে। সুতরাং একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শিক্ষার্থীদেরকে ক্যারিয়ার ভিত্তিক জ্ঞানচর্চায় উদবুদ্ধ করতে স্ব-উদ্ভাবিত (Heutagogy) শিক্ষা একটি অন্যতম শিক্ষা কৌশল, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সারা জীবন নিজে নিজে শিখতে পারে এবং তাদেরকে স্বেচ্ছায় স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ গ্রহন করতে পারে। আমি মনে করি, বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে শিখন ও শিক্ষণকর্মে এ হিউটাগোজিকাল পদ্ধতিগুলি প্রয়োগ করলে আমাদের দেশের শিক্ষার মান আরো উন্নত ও ফলপ্রসূ হবে।
[লেখক: প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা ও প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ স্মার্ট এডুকেশন নেটওয়ার্ক (বিডিসেন)]