alt

মুক্ত আলোচনা

তেজোদ্দীপ্ত এক মহীয়সী

মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান

: সোমবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২

২৯ ডিসেম্বর ২০১১। সেদিন ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত হয়েছিল স্লোগানে স্লোগানে- যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই, দিতে হবে। যে রেসকোর্স ময়দানে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই রেসকোর্সেই (সোহরাওয়ারদি উদ্যান) আবার জনতার মুষ্টিবদ্ধ হাতে শপথ উচ্চারিত হল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরব না- শপথ পাঠ করালেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহযোদ্ধা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, ১৪ দলের সমন্বয়ক এবং জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।

আমাদের মুক্তি সংগ্রামে গণ মানুষের দল আওয়ামী লীগের যেকোনো সঙ্কটে অকুতোভয় এই নেত্রী এগিয়ে এসেছেন বার বার। সাংগঠনিক অভিভাবকত্তে, মুক্তিযুদ্ধে নারী সমাজকে সম্পৃক্তকরণে স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে আর ১৯৭৫ পরবর্তী গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার আন্দোলনে সামনে থেকে লড়ে গেছেন যে মহীয়সী তিনি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ।

১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্তে ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ অতঃপর ১৯৬৯ সালে মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। বিপুল ভোটে ১৯৭০ সালে পাকিস্তান ন্যাশনাল এসেম্বলির সদস্য(এস এন এ)নির্বাচিত হন। অর্থাৎ তাঁর এই সাংগঠনিক দক্ষতা আর বীরোচিত নেতৃত্তে এদেশের নারী সমাজের মধ্যে যে জাগরণ সৃষ্টি হয় তা মুক্তিযুদ্ধে নারী সমাজের অংশগ্রহনে ব্যাপক ভুমিকা রাখে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দূরদর্শী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বেই প্রাথমিক চিকিৎসা এবং রাইফেল চালনায় দেশের নারী সমাজকে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেন সাজেদা চৌধুরী। এরই অংশ হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের গোবরা ক্যাম্পে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সার্বিক পরিচালনার দায়িত্ব তুলে নেন নিজ হাতে। বলা বাহুল্য এটাই ছিল প্রবাসী সরকারের একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প।

তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ এর সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বাকশাল গঠনের পর ন্যাশনাল ওমেন ফ্রন্ট এর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এর পরই নেমে আসে ১৫ই আগস্টের সেই ঘৃণ্যতম কাল রাত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য যখন নেতাকর্মীর উপর সামরিক জান্তা নির্যাতন চালাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে সব রকম ভয়ভীতি আর নিপীড়নের শঙ্কাকে তাচ্ছিল্য করে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী হাল ধরেন আওয়ামীলীগের।

হতোদ্দাম কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ছুটে বেড়ালেন সারা দেশে- কখনো প্রকাশশে কখনো গোপনে। কর্মীদের মনোবল ফেরালেন এবং ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহন করলেন। ১৯৮১ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আবার সামরিক বাহিনী শুরু করে রাজনৈতিক নিপীড়ন। এগিয়ে এলেন সাজেদা চৌধুরী। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলকে মজবুত আর সংহত করলেন। ১৯৮৭ সালে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত একই পদে অধিষ্ঠিত থেকে আবার দলকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্তে রূপান্তর করলেন। উল্লেখ্য এসময় নানা বিপত্তি সত্ত্বেও সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন মহীরুহের মত অবিচল।

১৯৭৫ পরবর্তী বিএনপি ও জাতীয় পার্টির শাসনামলে এই অকুতোভয় যোদ্ধা এবং একনিষ্ঠ সংগঠক একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছেন এবং জেল খেটেছেন।

দুই দশকের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে নেতাকর্মীদেরকে উদ্দীপ্ত করতে সর্বোপরি জননেত্রি শেখ হাসিনার পাশে থেকে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগকে যেভাবে সুসংহত করতে যেভাবে নিরলস কাজ করেছেন তারই ফলশ্রুতিতে আন্দোলন রূপ নেয় এক গন আন্দোলনে। অবশেষে,১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জননেত্রি শেখ হাসিনার নেতৃত্তে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করে যে সরকারে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী হন পরিবেশ ও বন মন্ত্রী।

২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বিএনপির দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জননেত্রি শেখ হাসিনার পাশে থেকে আন্দোলন সংগ্রামে তিনি দলকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। তত্তাবধায়ক সরকারের সময়ে ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে শেখ হাসিনাকে কারাগার থেকে মুক্ত করাসহ দলকে বিভেদের ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছেন। একদিকে বঙ্গবন্ধু কন্যাকে মুক্ত করা অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার এ সংগ্রামের কাছে নিজের জীবনের নিরাপত্তা ও সীমাহীন দুর্দশাকে উপেক্ষা করেছেন বর্ষীয়ান এই নেত্রী।

সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বাংলাদেশের প্রথিতযশা নারী রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম। শিক্ষাজীবনে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৯–১৯৭৫ সময়কালে তিনি বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কলকাতা গোবরা নার্সিং ক্যাম্পের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বরেণ্য রাজনীতিবিদ সাজেদা চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রদত্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ফরিদপুর-২ নির্বাচনী এলাকা (নগরকান্দা, সালথা ও সদরপুর) থেকে তিনি সাত বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন।

২০০৮ এর নির্বাচনে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে আওয়ামীলীগের সরকার গঠনের পর সংসদ উপনেতার মত এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন সাজেদা চৌধুরী। সংসদ নেতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পাশে থেকে সংসদ উপনেতা হিসেবে একনিষ্ঠ দায়িত্ব পালনের এ দৃশ্য যেন এক অমোঘ নিয়তি- ঠিক বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া মন্ত্র যেন বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছেসোহরাওরদি উদ্যানের সেই বজ্রমুষ্টির শপথে যেভাবে লাখ জনতা উদ্দীপ্ত হয়েছিল- সেই উদ্দীপনা আর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে বেগবান করার মাধ্যমে শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয়; জঙ্গিবাদ, দুর্নীতিবাজ আর দেশদ্রোহী শত্রুদের পরাস্ত করে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে উঠবে- আগামী প্রজন্ম সেই অপেক্ষায়।

১৯৩৫ সালে জন্ম গ্রহণ করা বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সাজেদা চৌধুরী দীর্ঘদিন ডিমেন্সিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। ৮৭ বছর বয়সে গত ১১ সেপ্টেম্বর রাতে তিনি ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। তার মৃত্যুতে আওয়ামী পরিবার, মুক্তিযুদ্ধকালীন সহযোদ্ধ্‌ গুণগ্রাহী ও ভক্ত-সমর্থকদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধাদের এভাবে চলে যাওয়া আসাম্প্রদায়িক আর প্রগতিশীল রাজনীতির জন্য এক অপূরনীয় ক্ষতি।

[লেখক : সাবেক পরিবেশ ও বনমন্ত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর জনসংযোগ কর্মকর্তা]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

তেজোদ্দীপ্ত এক মহীয়সী

মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান

সোমবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২

২৯ ডিসেম্বর ২০১১। সেদিন ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত হয়েছিল স্লোগানে স্লোগানে- যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই, দিতে হবে। যে রেসকোর্স ময়দানে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই রেসকোর্সেই (সোহরাওয়ারদি উদ্যান) আবার জনতার মুষ্টিবদ্ধ হাতে শপথ উচ্চারিত হল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরব না- শপথ পাঠ করালেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহযোদ্ধা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, ১৪ দলের সমন্বয়ক এবং জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।

আমাদের মুক্তি সংগ্রামে গণ মানুষের দল আওয়ামী লীগের যেকোনো সঙ্কটে অকুতোভয় এই নেত্রী এগিয়ে এসেছেন বার বার। সাংগঠনিক অভিভাবকত্তে, মুক্তিযুদ্ধে নারী সমাজকে সম্পৃক্তকরণে স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে আর ১৯৭৫ পরবর্তী গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার আন্দোলনে সামনে থেকে লড়ে গেছেন যে মহীয়সী তিনি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ।

১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্তে ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ অতঃপর ১৯৬৯ সালে মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। বিপুল ভোটে ১৯৭০ সালে পাকিস্তান ন্যাশনাল এসেম্বলির সদস্য(এস এন এ)নির্বাচিত হন। অর্থাৎ তাঁর এই সাংগঠনিক দক্ষতা আর বীরোচিত নেতৃত্তে এদেশের নারী সমাজের মধ্যে যে জাগরণ সৃষ্টি হয় তা মুক্তিযুদ্ধে নারী সমাজের অংশগ্রহনে ব্যাপক ভুমিকা রাখে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দূরদর্শী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বেই প্রাথমিক চিকিৎসা এবং রাইফেল চালনায় দেশের নারী সমাজকে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেন সাজেদা চৌধুরী। এরই অংশ হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের গোবরা ক্যাম্পে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সার্বিক পরিচালনার দায়িত্ব তুলে নেন নিজ হাতে। বলা বাহুল্য এটাই ছিল প্রবাসী সরকারের একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প।

তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ এর সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বাকশাল গঠনের পর ন্যাশনাল ওমেন ফ্রন্ট এর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এর পরই নেমে আসে ১৫ই আগস্টের সেই ঘৃণ্যতম কাল রাত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য যখন নেতাকর্মীর উপর সামরিক জান্তা নির্যাতন চালাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে সব রকম ভয়ভীতি আর নিপীড়নের শঙ্কাকে তাচ্ছিল্য করে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী হাল ধরেন আওয়ামীলীগের।

হতোদ্দাম কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ছুটে বেড়ালেন সারা দেশে- কখনো প্রকাশশে কখনো গোপনে। কর্মীদের মনোবল ফেরালেন এবং ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহন করলেন। ১৯৮১ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আবার সামরিক বাহিনী শুরু করে রাজনৈতিক নিপীড়ন। এগিয়ে এলেন সাজেদা চৌধুরী। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলকে মজবুত আর সংহত করলেন। ১৯৮৭ সালে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত একই পদে অধিষ্ঠিত থেকে আবার দলকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্তে রূপান্তর করলেন। উল্লেখ্য এসময় নানা বিপত্তি সত্ত্বেও সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন মহীরুহের মত অবিচল।

১৯৭৫ পরবর্তী বিএনপি ও জাতীয় পার্টির শাসনামলে এই অকুতোভয় যোদ্ধা এবং একনিষ্ঠ সংগঠক একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছেন এবং জেল খেটেছেন।

দুই দশকের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে নেতাকর্মীদেরকে উদ্দীপ্ত করতে সর্বোপরি জননেত্রি শেখ হাসিনার পাশে থেকে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগকে যেভাবে সুসংহত করতে যেভাবে নিরলস কাজ করেছেন তারই ফলশ্রুতিতে আন্দোলন রূপ নেয় এক গন আন্দোলনে। অবশেষে,১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জননেত্রি শেখ হাসিনার নেতৃত্তে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করে যে সরকারে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী হন পরিবেশ ও বন মন্ত্রী।

২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বিএনপির দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জননেত্রি শেখ হাসিনার পাশে থেকে আন্দোলন সংগ্রামে তিনি দলকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। তত্তাবধায়ক সরকারের সময়ে ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে শেখ হাসিনাকে কারাগার থেকে মুক্ত করাসহ দলকে বিভেদের ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছেন। একদিকে বঙ্গবন্ধু কন্যাকে মুক্ত করা অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার এ সংগ্রামের কাছে নিজের জীবনের নিরাপত্তা ও সীমাহীন দুর্দশাকে উপেক্ষা করেছেন বর্ষীয়ান এই নেত্রী।

সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বাংলাদেশের প্রথিতযশা নারী রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম। শিক্ষাজীবনে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৯–১৯৭৫ সময়কালে তিনি বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কলকাতা গোবরা নার্সিং ক্যাম্পের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বরেণ্য রাজনীতিবিদ সাজেদা চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রদত্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ফরিদপুর-২ নির্বাচনী এলাকা (নগরকান্দা, সালথা ও সদরপুর) থেকে তিনি সাত বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন।

২০০৮ এর নির্বাচনে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে আওয়ামীলীগের সরকার গঠনের পর সংসদ উপনেতার মত এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন সাজেদা চৌধুরী। সংসদ নেতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পাশে থেকে সংসদ উপনেতা হিসেবে একনিষ্ঠ দায়িত্ব পালনের এ দৃশ্য যেন এক অমোঘ নিয়তি- ঠিক বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া মন্ত্র যেন বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছেসোহরাওরদি উদ্যানের সেই বজ্রমুষ্টির শপথে যেভাবে লাখ জনতা উদ্দীপ্ত হয়েছিল- সেই উদ্দীপনা আর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে বেগবান করার মাধ্যমে শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয়; জঙ্গিবাদ, দুর্নীতিবাজ আর দেশদ্রোহী শত্রুদের পরাস্ত করে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে উঠবে- আগামী প্রজন্ম সেই অপেক্ষায়।

১৯৩৫ সালে জন্ম গ্রহণ করা বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সাজেদা চৌধুরী দীর্ঘদিন ডিমেন্সিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। ৮৭ বছর বয়সে গত ১১ সেপ্টেম্বর রাতে তিনি ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। তার মৃত্যুতে আওয়ামী পরিবার, মুক্তিযুদ্ধকালীন সহযোদ্ধ্‌ গুণগ্রাহী ও ভক্ত-সমর্থকদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধাদের এভাবে চলে যাওয়া আসাম্প্রদায়িক আর প্রগতিশীল রাজনীতির জন্য এক অপূরনীয় ক্ষতি।

[লেখক : সাবেক পরিবেশ ও বনমন্ত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর জনসংযোগ কর্মকর্তা]

back to top