নাজমুল হুদা খান
একদিকে সারা দেশে চলছে ডেঙ্গুর সংক্রমণ; পাশাপাশি সারা দেশে ভারি বৃষ্টির কারণে দেশের নদনদীগুলোর পানি বাড়তে শুরু করেছে। বেশ কিছু নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। এর মধ্যে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি দ্রুত বাড়ছে। বন্যাপূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের মতে, বৃষ্টি চলবে আগস্টজুড়ে, বাড়বে নদীর পানি। ইতোমধ্যে বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের ১০ লাখ মানুষ। বন্যার কারণে চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের এইচএসসি ও সমমানের চারটি পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে বন্যার সম্পর্ক যেন ওতপ্রোত। তাই হয়তো দেশের পানি বিশেষজ্ঞদের মতামত, ‘বন্যা না হলে তো বাংলাদেশ হতো না’। বিভিন্ন কারণে এ দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহমান ছোট বড় ২৩০টি নদীর নাব্য হ্রাস, হিমালয়ের বরফগলা, উজানের দেশগুলো থেকে নেমে আসা বৃষ্টি আর মানব সৃষ্ট বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণেই এ বন্যা বিপর্যয়।
ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই এ ভূখন্ডে থেকে পর্যায়ক্রমে বন্যার তথ্য পাওয়া যায়। এ দেশে বন্যার দাপটের শুরু মূলত ১৯৫৪ সাল থেকে। ১৯৫৪-৯৮ সাল পর্যন্ত তিন যুগে প্রায় ৩২ বার বড় আকারের বন্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঠিক আগে ১৯৭০ সালে রয়েছে প্রলয়ংকারী বন্যার দুঃসহ স্মৃতি। এ বছরের বন্যায় প্রাণহানি ঘটে ৫ লাখ মানুষের। খাদ্য শস্য নষ্ট হয় প্রায় ১৩ লাখ টন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২, ১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৮ ও ২০১৭ সালে দেশজুড়ে বন্যার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এসব বন্যায় দেশের ২০-৬০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হতে দেখা যায়। বন্যায় ঘরবাড়ি, গবাদি পশু, কৃষিপণ্য, মৎস খামার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সবাই সামাজিক সরবরাহ, সেতু-কালভার্টসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় হাজার হাজার কোটি টাকা ।
বন্যার কারণে দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা, পয়ো ও পানি নিষ্কাশন এবং সুপেয় পানির অভাব, খাদ্য সংকট, পরিবেশ দূষণ, সাপ ও নানা ধরনের বিষাক্ত প্রাণী ও মশা-মাছির উপদ্রবসহ নানা কারণে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। পানি ও খাদ্যবাহিত রোগ যথা- ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস ও পেটের পিড়া প্রভৃতি ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। পরিবেশ দূষণের কারণে জ্বর, কাশি, নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, নানা ধরনের চর্মরোগ, কঞ্জাংটিভাইটিসসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। বন্যার সময় প্রায়শঃই পানিতে ডুবে বা বিদ্যুৎতাড়িত হয়ে কিংবা সর্প দংশনে মৃত্যুবরণ করতে দেখা যায় অনেককে।
বন্যার কারণে সৃষ্ট রোগের সিংহভাগই হয়ে থাকে পানি ও খাবার থেকে। এ সময় কষ্ট হলেও বন্যার পানি পান পরিহার করতে হবে। সম্ভব হলে আধা ঘণ্টা ফুটিয়ে পান করতে হবে, ফুটানো সম্ভব না হলে ১০ লিটার পানিতে ২টি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট (হ্যালোজেন ট্যাবলেট) আধা ঘণ্টা মিশিয়ে রাখলেই ওই পানি পানের উপযোগী হবে।
পচা ও বাসি খাবার গ্রহণ পরিহার করতে হবে, খাবার সবসময় ঢেকে রাখতে হবে। তাহলেই কলেরা বা ডায়রিয়া জীবানু বহনকারী মাছি বা মশা এসব রোগ ছড়াতে পারবে না। বাসস্থানের আশপাশে মলমূত্র ত্যাগে বিরত থাকতে হবে; এ সময় অবশ্যই সাবান, ছাই বা মাটি দিয়ে হাত পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।
বন্যাকালে অধিকাংশ সময় পানির সংস্পর্শে থাকার ফলে শরীরে খোসপাঁচড়া , ফাংগাসের সংক্রমণ বা স্ক্যাবিস জাতীয় চর্মরোগ দেখা দিতে পারে, তাই যতটা সম্ভব শরীর শুকনো রাখতে হবে। শিশুদের অনেকে সাঁতার না জানার কারণে ও বৃদ্ধরা এ সময় পানিতে ডুবে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তাই এদের দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে।
এ সময় সাপ ও ইঁদুরের উপদ্রব বেড়ে যায়। বাসস্থানের চারদিকে কার্বলিক এসিড রেখে দিলে সাপের উপদ্রব হ্রাস পায়। সাপ বা ইঁদুর কামড়ালে দ্রুত স্থানীয় মেডিকেল টিম বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডায়রিয়া বা কলেরা আক্রান্ত রোগীকে পর্যাপ্ত খাবার স্যালাইন বা ভাতের মাড় খাওয়ালে শরীরে পানিশূন্যতা কমবে। পাশাপাশি তাদের স্থানীয় মেডিকেল টিম বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা এড়াতে পারতপক্ষে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রাখাই শ্রেয়। সংযোগ চলাকালে বিশেষ সতর্কতা জরুরি।
বন্যাপরবর্তীতে বাড়িঘর, পয়ঃনিষ্কাশনসহ বাড়ির আঙ্গিনা ও আশপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে। মৃত ও পচা জীবজন্তু মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। বন্যায় ডুবে যাওয়া টিউবওয়েলের মূল অংশ খুলে পাইপের পানিতে ০.০৫% ব্লিচিং দ্রবন ঢেলে, আধা ঘণ্টা পর মূল অংশ পুনঃস্থাপন করে ১৫-২০ মিনিট ধরে চেপে পানি বের করে ফেললেই টিউবওয়েলের পানি পানের উপযোগী হয়ে যাবে।
প্রাকৃতিক ও ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম একটি বন্যাপ্রবণ দেশ। আন্তর্জাতিক ও জাতীয়ভাবে সমন্বিত উদ্যোগ; নদী ও পানি সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতা বন্যাকে নির্মূল করা না গেলেও তীব্রতা অনেকটাই হ্রাস সম্ভব। ডেঙ্গুর পাশাপাশি বন্যা ও বন্যাপরবর্তী দুর্যোগ প্রতিরোধ, ক্ষয়ক্ষতি প্রশমন ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা যাতে ভেঙে না পড়ে সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
[লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ]
নাজমুল হুদা খান
বুধবার, ১৬ আগস্ট ২০২৩
একদিকে সারা দেশে চলছে ডেঙ্গুর সংক্রমণ; পাশাপাশি সারা দেশে ভারি বৃষ্টির কারণে দেশের নদনদীগুলোর পানি বাড়তে শুরু করেছে। বেশ কিছু নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। এর মধ্যে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি দ্রুত বাড়ছে। বন্যাপূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের মতে, বৃষ্টি চলবে আগস্টজুড়ে, বাড়বে নদীর পানি। ইতোমধ্যে বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের ১০ লাখ মানুষ। বন্যার কারণে চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের এইচএসসি ও সমমানের চারটি পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে বন্যার সম্পর্ক যেন ওতপ্রোত। তাই হয়তো দেশের পানি বিশেষজ্ঞদের মতামত, ‘বন্যা না হলে তো বাংলাদেশ হতো না’। বিভিন্ন কারণে এ দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহমান ছোট বড় ২৩০টি নদীর নাব্য হ্রাস, হিমালয়ের বরফগলা, উজানের দেশগুলো থেকে নেমে আসা বৃষ্টি আর মানব সৃষ্ট বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণেই এ বন্যা বিপর্যয়।
ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই এ ভূখন্ডে থেকে পর্যায়ক্রমে বন্যার তথ্য পাওয়া যায়। এ দেশে বন্যার দাপটের শুরু মূলত ১৯৫৪ সাল থেকে। ১৯৫৪-৯৮ সাল পর্যন্ত তিন যুগে প্রায় ৩২ বার বড় আকারের বন্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঠিক আগে ১৯৭০ সালে রয়েছে প্রলয়ংকারী বন্যার দুঃসহ স্মৃতি। এ বছরের বন্যায় প্রাণহানি ঘটে ৫ লাখ মানুষের। খাদ্য শস্য নষ্ট হয় প্রায় ১৩ লাখ টন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২, ১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৮ ও ২০১৭ সালে দেশজুড়ে বন্যার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এসব বন্যায় দেশের ২০-৬০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হতে দেখা যায়। বন্যায় ঘরবাড়ি, গবাদি পশু, কৃষিপণ্য, মৎস খামার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সবাই সামাজিক সরবরাহ, সেতু-কালভার্টসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় হাজার হাজার কোটি টাকা ।
বন্যার কারণে দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা, পয়ো ও পানি নিষ্কাশন এবং সুপেয় পানির অভাব, খাদ্য সংকট, পরিবেশ দূষণ, সাপ ও নানা ধরনের বিষাক্ত প্রাণী ও মশা-মাছির উপদ্রবসহ নানা কারণে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। পানি ও খাদ্যবাহিত রোগ যথা- ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস ও পেটের পিড়া প্রভৃতি ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। পরিবেশ দূষণের কারণে জ্বর, কাশি, নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, নানা ধরনের চর্মরোগ, কঞ্জাংটিভাইটিসসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। বন্যার সময় প্রায়শঃই পানিতে ডুবে বা বিদ্যুৎতাড়িত হয়ে কিংবা সর্প দংশনে মৃত্যুবরণ করতে দেখা যায় অনেককে।
বন্যার কারণে সৃষ্ট রোগের সিংহভাগই হয়ে থাকে পানি ও খাবার থেকে। এ সময় কষ্ট হলেও বন্যার পানি পান পরিহার করতে হবে। সম্ভব হলে আধা ঘণ্টা ফুটিয়ে পান করতে হবে, ফুটানো সম্ভব না হলে ১০ লিটার পানিতে ২টি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট (হ্যালোজেন ট্যাবলেট) আধা ঘণ্টা মিশিয়ে রাখলেই ওই পানি পানের উপযোগী হবে।
পচা ও বাসি খাবার গ্রহণ পরিহার করতে হবে, খাবার সবসময় ঢেকে রাখতে হবে। তাহলেই কলেরা বা ডায়রিয়া জীবানু বহনকারী মাছি বা মশা এসব রোগ ছড়াতে পারবে না। বাসস্থানের আশপাশে মলমূত্র ত্যাগে বিরত থাকতে হবে; এ সময় অবশ্যই সাবান, ছাই বা মাটি দিয়ে হাত পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।
বন্যাকালে অধিকাংশ সময় পানির সংস্পর্শে থাকার ফলে শরীরে খোসপাঁচড়া , ফাংগাসের সংক্রমণ বা স্ক্যাবিস জাতীয় চর্মরোগ দেখা দিতে পারে, তাই যতটা সম্ভব শরীর শুকনো রাখতে হবে। শিশুদের অনেকে সাঁতার না জানার কারণে ও বৃদ্ধরা এ সময় পানিতে ডুবে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তাই এদের দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে।
এ সময় সাপ ও ইঁদুরের উপদ্রব বেড়ে যায়। বাসস্থানের চারদিকে কার্বলিক এসিড রেখে দিলে সাপের উপদ্রব হ্রাস পায়। সাপ বা ইঁদুর কামড়ালে দ্রুত স্থানীয় মেডিকেল টিম বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডায়রিয়া বা কলেরা আক্রান্ত রোগীকে পর্যাপ্ত খাবার স্যালাইন বা ভাতের মাড় খাওয়ালে শরীরে পানিশূন্যতা কমবে। পাশাপাশি তাদের স্থানীয় মেডিকেল টিম বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা এড়াতে পারতপক্ষে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রাখাই শ্রেয়। সংযোগ চলাকালে বিশেষ সতর্কতা জরুরি।
বন্যাপরবর্তীতে বাড়িঘর, পয়ঃনিষ্কাশনসহ বাড়ির আঙ্গিনা ও আশপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে। মৃত ও পচা জীবজন্তু মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। বন্যায় ডুবে যাওয়া টিউবওয়েলের মূল অংশ খুলে পাইপের পানিতে ০.০৫% ব্লিচিং দ্রবন ঢেলে, আধা ঘণ্টা পর মূল অংশ পুনঃস্থাপন করে ১৫-২০ মিনিট ধরে চেপে পানি বের করে ফেললেই টিউবওয়েলের পানি পানের উপযোগী হয়ে যাবে।
প্রাকৃতিক ও ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম একটি বন্যাপ্রবণ দেশ। আন্তর্জাতিক ও জাতীয়ভাবে সমন্বিত উদ্যোগ; নদী ও পানি সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতা বন্যাকে নির্মূল করা না গেলেও তীব্রতা অনেকটাই হ্রাস সম্ভব। ডেঙ্গুর পাশাপাশি বন্যা ও বন্যাপরবর্তী দুর্যোগ প্রতিরোধ, ক্ষয়ক্ষতি প্রশমন ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা যাতে ভেঙে না পড়ে সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
[লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ]