alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের সম্ভাবনা

অমৃত চিছাম

: সোমবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৩

বিশ্বব্যাপী শিল্পায়ন ও নগরায়ণ সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহর এলাকায় মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনবৈচিত্র্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রায় প্রতিটি সদস্য কোনো না কোনোভাবে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। উক্ত পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুমেয় এই যে, দেশে দৈনিক কি পরিমাণ প্লাস্টিকসামগ্রীর ব্যবহার হচ্ছে। প্লাস্টিকসামগ্রী ব্যবহার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে, কিন্তু এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা হচ্ছে না। প্রতিদিন খাবার, দৈনন্দিন বাজার, শপিং, সুপারশপ, অনলাইন কেনাকাটা প্রতিটি পণ্যের মোড়কে অবিশ্বাস্যহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার, এর ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ। প্লাস্টিক ব্যবহার নিয়ে তেমন কোনো আপত্তি ছিল না, তবে ব্যবহারের পর উৎপন্ন বর্জ্যসমূহ যেভাবে যত্রতত্র ফেলে দেয়া হচ্ছে, তাতেই আসলে আপত্তি। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব থাকায় তারা ব্যবহারের প্লাস্টিকসামগ্রী যেখানে-সেখানে ফেলে দিচ্ছে। যেহেতু প্লাস্টিকসামগ্রী সম্পূর্ণভাবে মাটিতে মিশে যায় না, যা বর্তমানে পরিবেশের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্যরে ফলে মাটি দূষিত হয় এবং এতে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের কারণে জীবজগত ও উদ্ভিদকুল তথা পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়। এছাড়া প্লাস্টিক দূষণের কারণে মাটির উর্বরতা বহুগুণ হ্রাস পায়, কৃষি উৎপাদনশীলতা বাধাগ্রস্ত হয় এবং বাস্ততন্ত্রের সুস্থতা বিঘিœত হয়। এর একাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়, তাই ক্রমশ তা বর্জ্য হিসেবে জমা হচ্ছে পরিবেশে। এর দরুন সৃষ্টি হচ্ছে দূষণ ও জলাবদ্ধতা। পলিমারসামগ্রী পোড়ানো হলে আরও বিপদ, হাইড্রোকার্বন হয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে তা বাড়িয়ে দিচ্ছে দূষণের মাত্রা। প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানোর ফলে মারাত্মক বায়ুদূষণ ঘটে, যা নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়। প্লাস্টিক পোড়ানোর কারণে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, বাড়ছে বায়ুদূষণ। এক গবেষণায় দেখা যায়, প্লাস্টিক বর্জ্য আগুনে পোড়ানোর ফলে ২০১৯ সালে বায়ুম-লে প্রায় ৮.৫ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড যোগ হয়েছে, যার পরিমাণ দিন দিন শুধু বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্র যেন প্লাস্টিক বর্জ্যরে এক বিশাল মজুত কারখানা। জাতিসংঘের পরিবেশ প্রোগ্রাম (ইউএনইপি) এর এক পরিসংখ্যান হতে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ৮ মিলিয়নেরও বেশি মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতি বছর সমুদ্রে প্রবেশ করে। এই প্লাস্টিক দূষণ সামুদ্রিক প্রাণীদের জন্য বিশাল হুমকি, অবুঝ প্রাণীগুলো প্রায়ই ভুল করে প্লাস্টিককে খাবার মনে করে বা বিভিন্নভাবে প্লাস্টিকের সঙ্গে তাদের শরীর জড়িয়ে যায়। প্লাস্টিক দূষণ মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সাধারণত প্লাস্টিক পদার্থে প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক রঞ্জক মেশানো হয়। এসব রঞ্জক পদার্থ কারসিনোজেন হিসেবে কাজ করে ও এন্ডোক্রিনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ২০২২ সালের মার্চে প্রকাশিত এক গবেষণা ফলাফলে প্রথমবারের মতো মানুষের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ শনাক্ত হয়। এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে প্রকাশিত হওয়া তথ্য অনুযায়ী, গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষের রক্তে এই ক্ষুদ্র কণা পায় বিজ্ঞানীরা। প্লাস্টিক পণ্যের এত এত নেতিবাচক প্রভাব সমূহের মধ্যে একটি ইতিবাচক দিক হলো প্লাস্টিকসামগ্রী রিসাইক্লিং করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ। প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইক্লিং শুধু পরিবেশকেই রক্ষা করছে না বরং বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে। অনেক পরিবেশ বিজ্ঞানীর মতে, রিসাইক্লিং হতে পারে প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের একটি সহজ সমাধান। দেশে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য যেন সম্ভাবনার এক নতুন দুয়ার। কারণ বর্তমানে দেশে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক রিসাইক্লিং হতে নিজেদের চাহিদার প্রায় সিংহভাগ পূরণ করা হয়ে থাকে। এছাড়া রিসাইক্লিংকৃত প্লাস্টিক পরবর্তীতে চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনামসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিকের গুঁড়ো রপ্তানি করা হচ্ছে। যার বাজারমূল্য বিশ্ববাজারে উল্লেখ করার মতো। এতে একদিকে যেমন দেশের জীবজগৎ, প্রাণীজগৎ তথা পরিবেশ দূষণ বহুলাংশে হ্রাস পাবে, সেইসঙ্গে জাতীয় অর্থনীতিতেও কিছুটা পরিবর্তন সাধিত হবে। দেশে পরিত্যক্ত প্লাস্টিকসামগ্রী রিসাইক্লিং করার উদ্দেশ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, কুমিল্লা, রাজশাহী ও বগুড়াসহ বিভিন্ন শহরে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার কারখানা রয়েছে। দেশে পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীরচর, ইসলামবাগ ও লালবাগসহ ৩০০ কারখানায় রিসাইক্লিং পক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক পণ্য প্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে যুক্ত না হলেও বর্জ্য প্লাস্টিক রিসাইক্লিং খাতে হতে জাতীয় অর্থনীতিতে উক্ত শিল্পের অবদান প্রায় ২ হাজার ৮ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংক হতে প্রাপ্ত তথ্যমতে, শুধু দুই সিটি করপোরেশনে ছয় ধরনের প্লাস্টিকের ৬৪৬ টন বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে প্রতিদিন। এর মধ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য, পাতলা নমনীয়, খাদ্যের প্যাকেট জাতীয় (এলডিপিই) প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে ৩২৩ টন। বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে এখন ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মাত্র ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ ২ লাখ ২৮ হাজার টনের মতো রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার করা হয়। এসব উৎপন্ন প্লাস্টিক রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ায় যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করার মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি করে দেশ বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। রপ্তানি খাতে ১২তম অবস্থানে উঠে এসেছে পণ্যটি। দেশের চাহিদা মিটিয়ে ২০৩০ সালে ৮৫ হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক পণ্যসামগ্রী রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না জাতীয় অর্থনীতিতে কেমন পরিবর্তন আনতে সক্ষম। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ তথা জাতীয় অর্থনীতির জন্য প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কী পরিমাণ কার্যকর হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। ২০০২ সালে বাংলাদেশে পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এ সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ও লেমিনেটেড প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। দেশে ৫ হাজার ৫০০ কারখানায় বর্তমানে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দক্ষ, আধাদক্ষ মিলিয়ে প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার ফলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার হবে। দেশে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং শিল্পের প্রসারের ফলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, বেকারত্ব, লিঙ্গবৈষম্য বহুলাংশে দূর হবে সর্বোপরি জাতীয় অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হবে। ভবিষ্যতে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং শিল্পের মাধ্যমে পরিবর্তন হতে পারে হাজারো মানুষের ভাগ্যের চাকা। পরিবেশ সুরক্ষার কথা চিন্তা করে উত্তর উত্তর প্লাস্টিক রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ার ওপর সুদৃষ্টি প্রদান করতে হবে। তাছাড়া সভা-সেমিনার, পত্র-পত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়ায়, রেডিও, টেলিভিশনে বিভিন্ন ধরনের জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম আরও উত্তর উত্তর বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে সব প্লাস্টিকসামগ্রী ব্যবহারের পর রিসাইক্লিংয়ের প্রতি আরও যতœশীল হয়। সর্বোপরি ২০৩০ সালে এসডিজি বাস্তবায়ন ও রূপকল্প ২০৪১ বা বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১ ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত এবং উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং শিল্প গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করবে, সেইসঙ্গে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে ।

[লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়]

মূল্যস্ফীতি কমাতে কেন কোনো ফর্মুলাই কাজ করছে না?

ছবি

তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বের সৌন্দর্যের সন্ধানে

মধ্যপ্রাচ্য সংকট

গাজায় মানবিক সংকট

প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন গ্রেডে সংস্কার দরকার

ফিকে হচ্ছে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়ন, এআই এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন পথ

অতীতটা হয়ে যাক দূর

রম্যগদ্য: নিমক-হারাম

হ্যালোইনে আমি একা

প্রসঙ্গ : প্রতিযোগিতামূলক দর

ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ, ফ্যাসিবাদী প্রবণতা কি বন্ধ হয়েছে

ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের সমস্যা

মানুষ গড়ার কারিগর

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও মানসিক স্বাস্থ্য সংকট

‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’

বাদ, প্রতিবাদ ও সম্বাদ

জলবায়ুর পরিবর্তন নির্ণয়ে প্রযুক্তি

অটিজম প্রতিরোধ ও প্রতিকারে করণীয়

বাজারে কৃষিপণ্যের দাম কেন বেশি?

জাতিসংঘ ভবন

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ

ধর্মভিত্তিক জোট কোন পথে

ছবি

বিদায় অগ্নিকন্যা

রিমান্ড সংস্কৃতি : আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটি মানবাধিকার পরিপ্রেক্ষিত

ছবি

ডেঙ্গুজ্বর : সচেতনতার বিকল্প নেই

ছবি

উন্নয়ন ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য রাখা কেন জরুরি

ছবি

মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-ল

নদীর প্রাণ শুশুক, নিরাপদে বেঁচে থাকুক

ভবন নির্মাণ ও বিল্ডিং কোড

রম্যগদ্য : গণতন্ত্রের গলিতে গলিতে হিটলার

রাষ্ট্র সংস্কার ও আদিবাসী

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে সংবিধান ও অতীত-ইতিহাস

শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করার উপায়

দিবস যায় দিবস আসে, নিরাপদ হয় না সড়ক

‘ক্ষুদ্রতার মন্দিরেতে বসায়ে আপনারে আপন পায়ে না দিই যেন অর্ঘ্য ভারে ভারে’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের সম্ভাবনা

অমৃত চিছাম

সোমবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৩

বিশ্বব্যাপী শিল্পায়ন ও নগরায়ণ সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহর এলাকায় মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনবৈচিত্র্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রায় প্রতিটি সদস্য কোনো না কোনোভাবে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। উক্ত পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুমেয় এই যে, দেশে দৈনিক কি পরিমাণ প্লাস্টিকসামগ্রীর ব্যবহার হচ্ছে। প্লাস্টিকসামগ্রী ব্যবহার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে, কিন্তু এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা হচ্ছে না। প্রতিদিন খাবার, দৈনন্দিন বাজার, শপিং, সুপারশপ, অনলাইন কেনাকাটা প্রতিটি পণ্যের মোড়কে অবিশ্বাস্যহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার, এর ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ। প্লাস্টিক ব্যবহার নিয়ে তেমন কোনো আপত্তি ছিল না, তবে ব্যবহারের পর উৎপন্ন বর্জ্যসমূহ যেভাবে যত্রতত্র ফেলে দেয়া হচ্ছে, তাতেই আসলে আপত্তি। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব থাকায় তারা ব্যবহারের প্লাস্টিকসামগ্রী যেখানে-সেখানে ফেলে দিচ্ছে। যেহেতু প্লাস্টিকসামগ্রী সম্পূর্ণভাবে মাটিতে মিশে যায় না, যা বর্তমানে পরিবেশের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্যরে ফলে মাটি দূষিত হয় এবং এতে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের কারণে জীবজগত ও উদ্ভিদকুল তথা পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়। এছাড়া প্লাস্টিক দূষণের কারণে মাটির উর্বরতা বহুগুণ হ্রাস পায়, কৃষি উৎপাদনশীলতা বাধাগ্রস্ত হয় এবং বাস্ততন্ত্রের সুস্থতা বিঘিœত হয়। এর একাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়, তাই ক্রমশ তা বর্জ্য হিসেবে জমা হচ্ছে পরিবেশে। এর দরুন সৃষ্টি হচ্ছে দূষণ ও জলাবদ্ধতা। পলিমারসামগ্রী পোড়ানো হলে আরও বিপদ, হাইড্রোকার্বন হয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে তা বাড়িয়ে দিচ্ছে দূষণের মাত্রা। প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানোর ফলে মারাত্মক বায়ুদূষণ ঘটে, যা নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়। প্লাস্টিক পোড়ানোর কারণে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, বাড়ছে বায়ুদূষণ। এক গবেষণায় দেখা যায়, প্লাস্টিক বর্জ্য আগুনে পোড়ানোর ফলে ২০১৯ সালে বায়ুম-লে প্রায় ৮.৫ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড যোগ হয়েছে, যার পরিমাণ দিন দিন শুধু বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্র যেন প্লাস্টিক বর্জ্যরে এক বিশাল মজুত কারখানা। জাতিসংঘের পরিবেশ প্রোগ্রাম (ইউএনইপি) এর এক পরিসংখ্যান হতে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ৮ মিলিয়নেরও বেশি মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতি বছর সমুদ্রে প্রবেশ করে। এই প্লাস্টিক দূষণ সামুদ্রিক প্রাণীদের জন্য বিশাল হুমকি, অবুঝ প্রাণীগুলো প্রায়ই ভুল করে প্লাস্টিককে খাবার মনে করে বা বিভিন্নভাবে প্লাস্টিকের সঙ্গে তাদের শরীর জড়িয়ে যায়। প্লাস্টিক দূষণ মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সাধারণত প্লাস্টিক পদার্থে প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক রঞ্জক মেশানো হয়। এসব রঞ্জক পদার্থ কারসিনোজেন হিসেবে কাজ করে ও এন্ডোক্রিনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ২০২২ সালের মার্চে প্রকাশিত এক গবেষণা ফলাফলে প্রথমবারের মতো মানুষের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ শনাক্ত হয়। এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে প্রকাশিত হওয়া তথ্য অনুযায়ী, গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষের রক্তে এই ক্ষুদ্র কণা পায় বিজ্ঞানীরা। প্লাস্টিক পণ্যের এত এত নেতিবাচক প্রভাব সমূহের মধ্যে একটি ইতিবাচক দিক হলো প্লাস্টিকসামগ্রী রিসাইক্লিং করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ। প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইক্লিং শুধু পরিবেশকেই রক্ষা করছে না বরং বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে। অনেক পরিবেশ বিজ্ঞানীর মতে, রিসাইক্লিং হতে পারে প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের একটি সহজ সমাধান। দেশে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য যেন সম্ভাবনার এক নতুন দুয়ার। কারণ বর্তমানে দেশে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক রিসাইক্লিং হতে নিজেদের চাহিদার প্রায় সিংহভাগ পূরণ করা হয়ে থাকে। এছাড়া রিসাইক্লিংকৃত প্লাস্টিক পরবর্তীতে চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনামসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিকের গুঁড়ো রপ্তানি করা হচ্ছে। যার বাজারমূল্য বিশ্ববাজারে উল্লেখ করার মতো। এতে একদিকে যেমন দেশের জীবজগৎ, প্রাণীজগৎ তথা পরিবেশ দূষণ বহুলাংশে হ্রাস পাবে, সেইসঙ্গে জাতীয় অর্থনীতিতেও কিছুটা পরিবর্তন সাধিত হবে। দেশে পরিত্যক্ত প্লাস্টিকসামগ্রী রিসাইক্লিং করার উদ্দেশ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, কুমিল্লা, রাজশাহী ও বগুড়াসহ বিভিন্ন শহরে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার কারখানা রয়েছে। দেশে পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীরচর, ইসলামবাগ ও লালবাগসহ ৩০০ কারখানায় রিসাইক্লিং পক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক পণ্য প্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে যুক্ত না হলেও বর্জ্য প্লাস্টিক রিসাইক্লিং খাতে হতে জাতীয় অর্থনীতিতে উক্ত শিল্পের অবদান প্রায় ২ হাজার ৮ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংক হতে প্রাপ্ত তথ্যমতে, শুধু দুই সিটি করপোরেশনে ছয় ধরনের প্লাস্টিকের ৬৪৬ টন বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে প্রতিদিন। এর মধ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য, পাতলা নমনীয়, খাদ্যের প্যাকেট জাতীয় (এলডিপিই) প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে ৩২৩ টন। বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে এখন ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মাত্র ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ ২ লাখ ২৮ হাজার টনের মতো রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার করা হয়। এসব উৎপন্ন প্লাস্টিক রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ায় যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করার মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি করে দেশ বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। রপ্তানি খাতে ১২তম অবস্থানে উঠে এসেছে পণ্যটি। দেশের চাহিদা মিটিয়ে ২০৩০ সালে ৮৫ হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক পণ্যসামগ্রী রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না জাতীয় অর্থনীতিতে কেমন পরিবর্তন আনতে সক্ষম। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ তথা জাতীয় অর্থনীতির জন্য প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কী পরিমাণ কার্যকর হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। ২০০২ সালে বাংলাদেশে পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এ সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ও লেমিনেটেড প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। দেশে ৫ হাজার ৫০০ কারখানায় বর্তমানে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দক্ষ, আধাদক্ষ মিলিয়ে প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার ফলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার হবে। দেশে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং শিল্পের প্রসারের ফলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, বেকারত্ব, লিঙ্গবৈষম্য বহুলাংশে দূর হবে সর্বোপরি জাতীয় অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হবে। ভবিষ্যতে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং শিল্পের মাধ্যমে পরিবর্তন হতে পারে হাজারো মানুষের ভাগ্যের চাকা। পরিবেশ সুরক্ষার কথা চিন্তা করে উত্তর উত্তর প্লাস্টিক রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ার ওপর সুদৃষ্টি প্রদান করতে হবে। তাছাড়া সভা-সেমিনার, পত্র-পত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়ায়, রেডিও, টেলিভিশনে বিভিন্ন ধরনের জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম আরও উত্তর উত্তর বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে সব প্লাস্টিকসামগ্রী ব্যবহারের পর রিসাইক্লিংয়ের প্রতি আরও যতœশীল হয়। সর্বোপরি ২০৩০ সালে এসডিজি বাস্তবায়ন ও রূপকল্প ২০৪১ বা বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১ ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত এবং উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং শিল্প গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করবে, সেইসঙ্গে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে ।

[লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top