alt

উপ-সম্পাদকীয়

রাসেলস ভাইপার : আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা

নাজমুল হুদা খান

: সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪

দেশে সম্প্রতি রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপের উপস্থিতি এবং এর কামড়ে প্রাণহানির কারণে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মূলত, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে এটির বসবাস হলেও বর্তমানে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তীরবর্তী বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বের প্রায় ৩৫টি জেলায় এ সাপের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। রাসেলস ভাইপার ভালো সাঁতারু সাপ। তাই এটি নদীর স্রোত ও বন্যার পানিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অনেকের বিশ্বাস, এ সাপ সবচেয়ে বিষধর ও ভয়ংকর। প্রকৃতপক্ষে এটি বিশ্বের প্রথম ত্রিশ বিষধর সাপের মধ্যেও পড়ে না। সঠিক সময় চিকিৎসা দিলে ৯০ ভাগ বিষধর সাপে কাটা রোগী ভালো হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৪ লাখ মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়, প্রাণ হারায় ৭ হাজারের বেশি। গত বছর সাপের কামড়ের ওপর এক জাতীয় সমীক্ষায় এ তথ্য প্রকাশিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সারা বিশ্বে বছরে প্রায় ৫.৪ মিলিয়ন মানুষ বিভিন্ন ধরনের সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়। এর প্রায় অর্ধেক মানুষ বিষক্রিয়ায় ভোগে থাকে। মৃত্যু ঘটে প্রায় দেড় লাখ। তার মধ্যে অর্ধেকের মৃত্যু ঘটে ভারতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এসব ঘটনাকে গ্রীষ্মপ্রধান এলাকার সবচেয়ে উপেক্ষিত ব্যাধি বলে আখ্যা দিয়েছে। কারণ, মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও প্রাণহানি ঘটলেও অনেক দেশে এর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা অবহেলিত। তাই সংস্থাটি সাপের দংশনের ঘটনাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করার ঘোষণা আমাদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা আছে যে, সাপ মাত্রই বিষাক্ত, যা মোটেও ঠিক নয়।

বিশ্বে প্রায় তিন হাজার প্রজাতির সাপ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ বিষধর। বিষহীন সাপের কামড়ে বিশেষ কোনও ক্ষতি হয় না। রাসেলস ভাইপারের কামড়ে আক্রান্ত রোগী সহজে মারা যায় এ কথাও সত্য নয়। আমাদের দেশে বিষধর সাপের কামড়ে সঠিক চিকিৎসা ব্যতিত ১৫ দিন পর্যন্ত বেঁচে ছিল এমন রেকর্ড ও আছে। বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির সভাপতি ডা. এম এ ফয়েজ সাপের দংশন ও এর চিকিৎসা নামক বইয়ে তার গবেষণালব্ধ তথ্যে উল্লেখ করেন যে, সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেয়েও কেউটে সাপের দংশনে রোগী গড়ে ১৮ ঘণ্টা, গোখরা সাপের দংশনে রোগী গড়ে ৮ ঘণ্টা এবং রাসেলস ভাইপারের সাপের দংশনে ৩ দিন পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।

রাসেলস ভাইপার সাপের বিষ রক্তের রক্তকণিকা ধ্বংস করে। তাই এ বিষকে হেমোটক্সিক বলা হয়। এ সাপ কামড়ালে অনেক সময় মনে হয়, কাঁটা ফুটেছে। কিন্তু আক্রান্ত স্থানে জ্বালা বা ফুলে আসার অনুভূতি হলে সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হতে হবে। কামড়ানোর পর বিষ রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। কামড়ের স্থানের যন্ত্রণা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। বমি এবং ঝিমুনি ভাব দেখা দেয়। রোগীর শরীরের নানা স্থান যথাÑ নাক বা দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ে। প্রস্রাবের সঙ্গেও রক্ত পড়ে। এ সাপের কামড়ে রোগীকে দ্রুত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়াটা জরুরি। চিকিৎসায় দেরি হলে রোগীর কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বিষধর সাপে কামড়ের উপসর্গ হচ্ছে :

রোগীর শরীরে দুটি পিন ফোটানোর মতো রক্তাক্ত দাগ দেখা দেয়।

আক্রান্ত জায়গা ফুলে উঠে লালচে হতে থাকে।

সাপে কাটা ব্যক্তির দুচোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে।

কামড়ের স্থানে প্রচ- জ্বালা যন্ত্রণা করে।

রোগী ঝাপসা দেখতে পারে।

রোগীর ঢোক গিলতে অসুবিধা হয় এবং গলা বন্ধ হয়ে আসে।

শরীর ফুলতে থাকে।

শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়।

বমি ভাব হয় কিংবা বমি হতে পারে।

সাপে কাটা রোগীর ব্যবস্থাপনায় করণীয় :

রোগীকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে যে, সাপে কেটেছে মানেই যে সেটি বিষাক্ত তা ঠিক নয়। এমনকি বিষধর সাপও সব সময় পরিমাণ মতো বিষ ঢালতে পারে না।

রোগীর শরীরে কোনও শক্ত জিনিস যথা : হাতঘড়ি, চুড়ি বা বালা থাকলে তা খুলে ফেলুন।

ক্ষতস্থান যত সম্ভব স্থির রাখতে হবে।

সাপে কামড়ালে বেশির ভাগ রোগীই ভয়ে হার্টফেল করতে পারে। তাই তার মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে যেতে হবে।

রুল অব ১০০ অর্থাৎ সাপে কামড়ানোর ১০০ মিনিটের মধ্যে ১০০ মিলিলিটার অ্যান্টিভেনম (এএসভি) শরীরে প্রবেশ করালে রোগী বেঁচে যাবে।

যা বর্জন আবশ্যক :

ওঝা কিংবা কবিরাজের কাছে একেবারেই যাবেন না। এতে ব্যক্তির প্রাণহানির আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়।

ক্ষতস্থান ব্লেড দিয়ে ছেঁড়া বা চুষে রক্ত বের করার চেষ্টা করবেন না।

আক্রান্ত স্থানের আগে ও পরে বা ক্ষতস্থানে দুই বা ততধিক পট্টি শক্ত করে বাঁধবেন না।

কামড়ের জায়গায় কোনও কেমিক্যাল যথাÑ কার্বলিক এসিড লাগাবেন না।

কামড়ের স্থানে গরম বা ঠা-া পানি দিয়ে ধোয়া যাবে না।

আক্রান্ত স্থানে বিষ শোষণের জন্য বিভিন্ন লতাগুল্মের পেস্ট কিংবা গোবর বা কাদামাটি লাগানো অনুচিত। এতে উপকারের চেয়ে আক্রান্ত স্থানে জীবাণুঘটিত সংক্রমণ তৈরি করতে পারে।

রোগীকে হাঁটাচলা বা নড়াচড়া করতে দেয়া যাবে না। রোগী নিজে দৌড়ে বা সাইকেল চালিয়ে আসবেন না।

কারণ, হাঁটাচলা করলে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে বিষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।

আক্রান্ত ব্যক্তিকে তেল, ঘি, গোল মরিচ কিংবা বিভিন্ন লতাগুল্ম জাতীয় পদার্থ খাওয়ানোর মাধ্যমে বমি করানো যাবে না।

আক্রান্ত স্থানে বিষ শোষণকল্পে পাথর, বীজ বা লালা প্রয়োগ করা যাবে না।

সাপ ধরে হাসপাতালে আনার দরকার নেই।

সাপের কামড়ের প্রতিরোধ ব্যবস্থা :

বাড়ির চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখুন। চুনের সঙ্গে ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে ছড়িয়ে দিন। এর ঝাঁজাল গন্ধে সাপ আসে না। কার্বলিক অ্যাসিড শরীরে লাগলে ক্ষতি হয় তাই ব্যবহার না করাই ভালো।

রাতে অবশ্যই বিছানা ঝেড়ে মশারি টানিয়ে ঘুমাবেন। দরজা-জানলার নিচে ফাঁকা জায়গা বন্ধ করার ব্যবস্থা করবেন।

অন্ধকারে হাঁটাচলা করবেন না। হাতে লাঠি নিয়ে রাস্তা ঠুকে চলুন। হাততালি দিয়ে লাভ নেই, কারণ সাপের কান নেই। অন্ধকারে অবশ্যই টর্চ ব্যবহার করতে হবে।

লম্বা ঘাস, ঝোঁপঝাড়, কৃষি এলাকায় হাঁটার সময় সতর্ক থাকুন। গর্তের মধ্যে হাত-পা ঢোকাবেন না।

পতিত গাছ, জ্বালানির লাকড়ি ও খড় সরানোর সময় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করুন।

জুতো পরার আগে সেটা ঝেড়ে নিন। মাটির বাড়িতে ইঁদুরের গর্ত থাকলে তা বন্ধ করে ফেলুন।

বাড়িতে ইঁদুরের উপদ্রব ঠেকাতে হবে। অনেক সময় ঘরের মধ্যে চাল, ধানের মতো দ্রব্যাদি রাখা হয়।

এসব জায়গা ইঁদুরের আবাসস্থল। এ অবস্থায় সাপ থাকার সম্ভাবনা বাড়ে।

বাড়ির সামনে আবর্জনা জমা করা যাবে না। অনেক সময় বাড়ির বাইরে কাঠ, খড় ইত্যাদি জড়ো করে রাখা হয়। এসব স্থানে সাপ থাকার সম্ভাবনা বেশি।

বর্ষায় পুকুর বা জলাশয়ের আশপাশ পরিষ্কার রাখা দরকার এবং ওই জায়গাগুলোতে গেলে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।

আমাদের দেশে মে-সেপ্টেম্বর মাসে ৮০ শতাংশ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে থাকে, এ সময় অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

[লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ]

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য পেনশন ও গ্র্যাচুইটি সময়ের দাবি

ফসলের দাম ও কৃষক

রূপাইয়া, ডন, অনন্ত কিংবা রেংদের মনের ক্ষত কে সারাবে?

পরিবেশ বিপর্যয় : শিক্ষার্থীদের করণীয়

বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা

কিশোর অপরাধ ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন

চাই জীবনমুখী যুগোপযোগী উচ্চশিক্ষা

খেজুর গুড়ের বাণিজ্যিক গুরুত্ব

হামাস-ইসরাইলের অস্ত্র বিরতি

ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি

আদিবাসীদের প্রাণের স্পন্দন

ছবি

ট্রাম্পের বিস্ফোরক মন্তব্য ও যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সম্পর্ক

কৃতিত্ব অস্বীকারের অপসংস্কৃতি

পশ্চিমবঙ্গ : স্যালাইনে ফাঙ্গাস, অসহায় মানুষ

ছবি

আত্মপরিচয় ও জাতিসত্তার অঙ্গীকার : বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য

এইচএমপিভি ভাইরাস : প্রয়োজন জনসচেতনতা

সিভিল সার্ভিস ক্যাডারে কেন সংস্কার জরুরি

কেন দ্যাখাও মিথ্যে স্বপ্ন

অনিয়ন্ত্রিত অটোরিকশা ও সড়ক দুর্ঘটনা

অপরিকল্পিত ভ্যাট ও কর বৃদ্ধি

ছবি

‘বেগমপাড়া’ হইতে খোলা চিঠি

সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টানবে কে

মকর সংক্রান্তি : বাঙালির উৎসব ও ঐতিহ্যের ধারক

শৃঙ্খলে আবদ্ধ সামাজিক মানুষ

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : অপসংস্কৃতি ও নৈতিক প্রশ্ন

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে কূটতর্ক

শৃঙ্খলে আবদ্ধ সামাজিক মানুষ

রজিনাদের বেঁচে থাকার লড়াই

মানব পাচার প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা

সংবিধান সংশোধন : আমাদের বলার আছে

চিন্তা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা

গ্রাম উন্নয়নে যুব সমাজের ভূমিকা

‘দেশজ নাট্যশৈলী’র কেন্দ্রীয় নাট্যআঙ্গিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ও কিছু প্রশ্ন

রাখাইন পরিস্থিতি : বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির বড় পরীক্ষা

রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রাসেলস ভাইপার : আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা

নাজমুল হুদা খান

সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪

দেশে সম্প্রতি রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপের উপস্থিতি এবং এর কামড়ে প্রাণহানির কারণে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মূলত, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে এটির বসবাস হলেও বর্তমানে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তীরবর্তী বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বের প্রায় ৩৫টি জেলায় এ সাপের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। রাসেলস ভাইপার ভালো সাঁতারু সাপ। তাই এটি নদীর স্রোত ও বন্যার পানিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অনেকের বিশ্বাস, এ সাপ সবচেয়ে বিষধর ও ভয়ংকর। প্রকৃতপক্ষে এটি বিশ্বের প্রথম ত্রিশ বিষধর সাপের মধ্যেও পড়ে না। সঠিক সময় চিকিৎসা দিলে ৯০ ভাগ বিষধর সাপে কাটা রোগী ভালো হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৪ লাখ মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়, প্রাণ হারায় ৭ হাজারের বেশি। গত বছর সাপের কামড়ের ওপর এক জাতীয় সমীক্ষায় এ তথ্য প্রকাশিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সারা বিশ্বে বছরে প্রায় ৫.৪ মিলিয়ন মানুষ বিভিন্ন ধরনের সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়। এর প্রায় অর্ধেক মানুষ বিষক্রিয়ায় ভোগে থাকে। মৃত্যু ঘটে প্রায় দেড় লাখ। তার মধ্যে অর্ধেকের মৃত্যু ঘটে ভারতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এসব ঘটনাকে গ্রীষ্মপ্রধান এলাকার সবচেয়ে উপেক্ষিত ব্যাধি বলে আখ্যা দিয়েছে। কারণ, মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও প্রাণহানি ঘটলেও অনেক দেশে এর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা অবহেলিত। তাই সংস্থাটি সাপের দংশনের ঘটনাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করার ঘোষণা আমাদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা আছে যে, সাপ মাত্রই বিষাক্ত, যা মোটেও ঠিক নয়।

বিশ্বে প্রায় তিন হাজার প্রজাতির সাপ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ বিষধর। বিষহীন সাপের কামড়ে বিশেষ কোনও ক্ষতি হয় না। রাসেলস ভাইপারের কামড়ে আক্রান্ত রোগী সহজে মারা যায় এ কথাও সত্য নয়। আমাদের দেশে বিষধর সাপের কামড়ে সঠিক চিকিৎসা ব্যতিত ১৫ দিন পর্যন্ত বেঁচে ছিল এমন রেকর্ড ও আছে। বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির সভাপতি ডা. এম এ ফয়েজ সাপের দংশন ও এর চিকিৎসা নামক বইয়ে তার গবেষণালব্ধ তথ্যে উল্লেখ করেন যে, সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেয়েও কেউটে সাপের দংশনে রোগী গড়ে ১৮ ঘণ্টা, গোখরা সাপের দংশনে রোগী গড়ে ৮ ঘণ্টা এবং রাসেলস ভাইপারের সাপের দংশনে ৩ দিন পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।

রাসেলস ভাইপার সাপের বিষ রক্তের রক্তকণিকা ধ্বংস করে। তাই এ বিষকে হেমোটক্সিক বলা হয়। এ সাপ কামড়ালে অনেক সময় মনে হয়, কাঁটা ফুটেছে। কিন্তু আক্রান্ত স্থানে জ্বালা বা ফুলে আসার অনুভূতি হলে সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হতে হবে। কামড়ানোর পর বিষ রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। কামড়ের স্থানের যন্ত্রণা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। বমি এবং ঝিমুনি ভাব দেখা দেয়। রোগীর শরীরের নানা স্থান যথাÑ নাক বা দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ে। প্রস্রাবের সঙ্গেও রক্ত পড়ে। এ সাপের কামড়ে রোগীকে দ্রুত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়াটা জরুরি। চিকিৎসায় দেরি হলে রোগীর কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বিষধর সাপে কামড়ের উপসর্গ হচ্ছে :

রোগীর শরীরে দুটি পিন ফোটানোর মতো রক্তাক্ত দাগ দেখা দেয়।

আক্রান্ত জায়গা ফুলে উঠে লালচে হতে থাকে।

সাপে কাটা ব্যক্তির দুচোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে।

কামড়ের স্থানে প্রচ- জ্বালা যন্ত্রণা করে।

রোগী ঝাপসা দেখতে পারে।

রোগীর ঢোক গিলতে অসুবিধা হয় এবং গলা বন্ধ হয়ে আসে।

শরীর ফুলতে থাকে।

শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়।

বমি ভাব হয় কিংবা বমি হতে পারে।

সাপে কাটা রোগীর ব্যবস্থাপনায় করণীয় :

রোগীকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে যে, সাপে কেটেছে মানেই যে সেটি বিষাক্ত তা ঠিক নয়। এমনকি বিষধর সাপও সব সময় পরিমাণ মতো বিষ ঢালতে পারে না।

রোগীর শরীরে কোনও শক্ত জিনিস যথা : হাতঘড়ি, চুড়ি বা বালা থাকলে তা খুলে ফেলুন।

ক্ষতস্থান যত সম্ভব স্থির রাখতে হবে।

সাপে কামড়ালে বেশির ভাগ রোগীই ভয়ে হার্টফেল করতে পারে। তাই তার মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে যেতে হবে।

রুল অব ১০০ অর্থাৎ সাপে কামড়ানোর ১০০ মিনিটের মধ্যে ১০০ মিলিলিটার অ্যান্টিভেনম (এএসভি) শরীরে প্রবেশ করালে রোগী বেঁচে যাবে।

যা বর্জন আবশ্যক :

ওঝা কিংবা কবিরাজের কাছে একেবারেই যাবেন না। এতে ব্যক্তির প্রাণহানির আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়।

ক্ষতস্থান ব্লেড দিয়ে ছেঁড়া বা চুষে রক্ত বের করার চেষ্টা করবেন না।

আক্রান্ত স্থানের আগে ও পরে বা ক্ষতস্থানে দুই বা ততধিক পট্টি শক্ত করে বাঁধবেন না।

কামড়ের জায়গায় কোনও কেমিক্যাল যথাÑ কার্বলিক এসিড লাগাবেন না।

কামড়ের স্থানে গরম বা ঠা-া পানি দিয়ে ধোয়া যাবে না।

আক্রান্ত স্থানে বিষ শোষণের জন্য বিভিন্ন লতাগুল্মের পেস্ট কিংবা গোবর বা কাদামাটি লাগানো অনুচিত। এতে উপকারের চেয়ে আক্রান্ত স্থানে জীবাণুঘটিত সংক্রমণ তৈরি করতে পারে।

রোগীকে হাঁটাচলা বা নড়াচড়া করতে দেয়া যাবে না। রোগী নিজে দৌড়ে বা সাইকেল চালিয়ে আসবেন না।

কারণ, হাঁটাচলা করলে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে বিষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।

আক্রান্ত ব্যক্তিকে তেল, ঘি, গোল মরিচ কিংবা বিভিন্ন লতাগুল্ম জাতীয় পদার্থ খাওয়ানোর মাধ্যমে বমি করানো যাবে না।

আক্রান্ত স্থানে বিষ শোষণকল্পে পাথর, বীজ বা লালা প্রয়োগ করা যাবে না।

সাপ ধরে হাসপাতালে আনার দরকার নেই।

সাপের কামড়ের প্রতিরোধ ব্যবস্থা :

বাড়ির চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখুন। চুনের সঙ্গে ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে ছড়িয়ে দিন। এর ঝাঁজাল গন্ধে সাপ আসে না। কার্বলিক অ্যাসিড শরীরে লাগলে ক্ষতি হয় তাই ব্যবহার না করাই ভালো।

রাতে অবশ্যই বিছানা ঝেড়ে মশারি টানিয়ে ঘুমাবেন। দরজা-জানলার নিচে ফাঁকা জায়গা বন্ধ করার ব্যবস্থা করবেন।

অন্ধকারে হাঁটাচলা করবেন না। হাতে লাঠি নিয়ে রাস্তা ঠুকে চলুন। হাততালি দিয়ে লাভ নেই, কারণ সাপের কান নেই। অন্ধকারে অবশ্যই টর্চ ব্যবহার করতে হবে।

লম্বা ঘাস, ঝোঁপঝাড়, কৃষি এলাকায় হাঁটার সময় সতর্ক থাকুন। গর্তের মধ্যে হাত-পা ঢোকাবেন না।

পতিত গাছ, জ্বালানির লাকড়ি ও খড় সরানোর সময় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করুন।

জুতো পরার আগে সেটা ঝেড়ে নিন। মাটির বাড়িতে ইঁদুরের গর্ত থাকলে তা বন্ধ করে ফেলুন।

বাড়িতে ইঁদুরের উপদ্রব ঠেকাতে হবে। অনেক সময় ঘরের মধ্যে চাল, ধানের মতো দ্রব্যাদি রাখা হয়।

এসব জায়গা ইঁদুরের আবাসস্থল। এ অবস্থায় সাপ থাকার সম্ভাবনা বাড়ে।

বাড়ির সামনে আবর্জনা জমা করা যাবে না। অনেক সময় বাড়ির বাইরে কাঠ, খড় ইত্যাদি জড়ো করে রাখা হয়। এসব স্থানে সাপ থাকার সম্ভাবনা বেশি।

বর্ষায় পুকুর বা জলাশয়ের আশপাশ পরিষ্কার রাখা দরকার এবং ওই জায়গাগুলোতে গেলে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।

আমাদের দেশে মে-সেপ্টেম্বর মাসে ৮০ শতাংশ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে থাকে, এ সময় অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

[লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ]

back to top