alt

উপ-সম্পাদকীয়

কোটাবিরোধী আন্দোলন ও শিক্ষকদের পেনশন সংকট

এইচএম নাজমুল আলম

: মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪

বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের ও শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়। এ অস্থিরতার মূল কারণগুলো জটিল, যার মধ্যে বিতর্কিত নীতি যেমন সার্বজনীন পেনশন স্কিম (প্রত্যয়) এবং সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন অন্যতম। এ বিষয়গুলো স্বতন্ত্র হলেও একত্রিত হয়ে এক ধরনের সংকট সৃষ্টি করছে, যা একাডেমিক কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে এবং বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করছে।

২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিল, যা তখন সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছিল। তাদের দাবি ছিল কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হোক। দীর্ঘদিনের আন্দোলনের পর, ২০১৮ সালে সরকারের পক্ষ থেকে পুরো কোটা পদ্ধতি বাতিলের একটি পরিপত্র জারি করা হয়। কিন্তু ২০২১ সালে হাইকোর্টের এক রায়ের পর ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল করা হয়। এই রায়ের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আবার রাস্তায় নেমেছে।

শিক্ষার্থীদের দাবি, কোটা পদ্ধতির সংস্কার না হলে মেধাবীরা সরকারি চাকরিতে যথাযথ সুযোগ পাবে না। শিক্ষার্থীরা কোটার মাধ্যমে সৃষ্ট বৈষম্যকে মেনে নিতে পারছে না। শিক্ষার্থীরা মনে করেন, মেধাবীরা গুরুত্ব না পেলে তারা দেশের বাইরে চলে যাবে, দেশে কাজ করার আগ্রহ হারাবে। তাই এত বছর পরে এসে কোটার এই চাহিদা কমিয়ে আনা দরকার।

শিক্ষার্থীরা চারটি প্রধান দাবি উপস্থাপন করেছেÑ

২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহাল, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কার করতে হবে।

মেধা কোটায় শূন্যপদ পূরণ, কোটায় প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা কোটায় শূন্যপদ পূরণ করতে হবে।

একবার কোটা ব্যবহার, একজন ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় সব ধরনের সরকারি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় একবার কোটা ব্যবহার করতে পারবে।

প্রতিটি জনশুমারির সাথে কোটার পুনর্মুল্যায়ন, অর্থনৈতিক সমীক্ষার মাধ্যমে বিদ্যমান কোটার পুনর্মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পাশাপাশি, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকরা সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিম’ বাতিলের দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন। শিক্ষকরা দাবি করছেন, নতুন পেনশন স্কিম তাদের জন্য ক্ষতিকর। বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় তারা যেসব সুবিধা পাচ্ছেন, নতুন স্কিমে সেই সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হবেন। তারা এ প্রকল্পকে বৈষম্যমূলক এবং তাদের পেশাগত মর্যাদার পরিপন্থী হিসেবে দেখছেন। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন (ঋইটঞঅ), যা ৩৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব করে, এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং পূর্ববর্তী পেনশন সুবিধাগুলো পুনঃপ্রবর্তনের দাবি জানাচ্ছে। গত ৩০ জুন শিক্ষকরা পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করেন এবং ১ জুলাই থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ঘোষণা করেন।

শিক্ষকদের অভিযোগ, নতুন স্কিমে তাদের বেতন থেকে দশ শতাংশ কেটে নেয়া হবে, যা বর্তমান পেনশন ব্যবস্থায় ছিল না। সরকার বলছে, নতুন পেনশন স্কিম শুধুমাত্র নতুন যোগদানকারীদের জন্য প্রযোজ্য হবে। তবে শিক্ষকদের মতে, এটি সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা হবে। বিক্ষোভ এবং কর্মবিরতি সত্ত্বেও, সরকার শিক্ষকদের উদ্বেগ যথাযথভাবে সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী জানিয়েছেন, এ বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারের বাইরে, যেহেতু এটি সরকারি নীতির বিষয়। শিক্ষকদের দাবি হলো প্রত্যয় প্রকল্পটি বাতিল করা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সুপার গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত করা এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য পৃথক পে-স্কেল প্রবর্তন করা।

প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এই দুই আন্দোলনের কারণে কঠিন এক সংকটে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের কোটা-বিরোধী আন্দোলন এবং শিক্ষকদের পেনশন সংকট—এই দুটি ইস্যুতে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিরাজ করছে অস্থিরতা। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের একযোগে আন্দোলন উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে স্থবির করে দিয়েছে। দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্ত ক্লাস, পরীক্ষা এবং একাডেমিক কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

এই স্থবিরতার প্রভাব সুদূরপ্রসারি। শিক্ষার্থীদের জন্য, ক্লাস এবং পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে তাদের একাডেমিক অগ্রগতি যেমন ধীরগতিতে চলবে, তেমনি গ্রাজুয়েশন শেষ করে চাকরি বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতার সম্মুখীন হতে হবে। শিক্ষকদের জন্য, চলমান বিক্ষোভ এবং কর্মবিরতি তাদের পেশাগত স্থিতিশীলতা এবং মনোবলে চির ধরাবে। জাতির উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার ওপর অনিশ্চয়তা এবং অস্থিরতা ভবিষ্যত শিক্ষার্থীদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতে এবং আগ্রহী মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করতে নিরুৎসাহিত করতে পারে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে কোটার পদ্ধতির সংস্কার করা প্রয়োজন। কোটার মাধ্যমে সৃষ্ট বৈষম্য দূর করতে হলে সরকারের উচিত একটি কমিশন গঠন করে কোটাপদ্ধতি সংস্কার করা এবং কোটায় প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা কোটায় শূন্যপদ পূরণ করা। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের পেনশন সংকট সমাধানে সরকারের উচিত শিক্ষকদের সাথে আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করা। নতুন পেনশন স্কিম চালু করতে হলে তা যেন শিক্ষকদের জন্য ক্ষতিকর না হয়, এ বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষকদের আন্দোলনের বিষয়ে দ্রুত সমাধান করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সরকারের দায়িত্ব।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমান সময়ে যে সংকটের মুখোমুখি, তা শুধু শিক্ষার্থীদের বা শিক্ষকদের সমস্যা নয়, বরং এটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধা। শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং শিক্ষকদের পেনশন সংকট, এই দুটি ইস্যুতে সরকারকে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের মেধার মূল্যায়ন এবং শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে, দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। তবে এই সংকট সমাধানে শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষকদের একতাবদ্ধ ও সচেতন থাকতে হবে, যাতে তাদের দাবিগুলো যথাযথভাবে পূরণ হয়। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে হলে, মেধার মূল্যায়ন এবং শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

[লেখক : প্রভাষক, ডিপার্টমেন্ট অব ইংলিশ অ্যান্ড মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজেস, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি)]

বয়নামা দলিল কখন স্বত্বের দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়?

বর্ষার আগেই নদীভাঙনের আতঙ্কে উপকূলবাসী

ছবি

ভূমিকম্প ঝুঁকিতে দেশ : মোকাবিলায় প্রস্তুতি প্রয়োজন

‘রিসেটের’ পরাকৌশল কী হওয়া প্রয়োজন

প্রসঙ্গ : জাতীয় বাজেট

ব্রুনোর শ্মশান মঞ্চ

দুর্নীতির অবিশ্বাস্য খতিয়ান

সাম্য, ন্যায়বিচার, সুশাসন, বহুত্ববাদ : সবকা সাথ্ সবকা বিকাশ!

পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ সংকটে ধর্মনিরপেক্ষতা

পেশাগত দায় ও নৈতিকতা

বিনোদনের রূপান্তর : সংস্কৃতির সংকোচন ও নতুন পথ

রম্যগদ্য : ‘চোর চাই, চোর...’

শুভ-অশুভ বলে কিছু কি আছে

পহেলা বৈশাখের সঙ্গে মিশে আছে কৃষি ও কৃষক

বাংলাদেশে ঘটনা অঘটন: প্রায় সবক্ষেত্রেই ইস্যু নির্বাচন

ছবি

নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদ

বৈসাবি : সম্মিলনের জাতীয় উৎসব

সংকট ও সংক্রান্তির শক্তি

ছবি

গাজার অশ্রু : ইসরায়েলের বর্বরতা ও বিশ্বের নীরবতা

দেশের কৃষি অর্থনীতির নীরব নায়িকারা

বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বের ফেরে বিএনপি ও এনসিপি

ফৌজদারি মামলায় অপরাধের আলামত উদ্ধারে আইন মানতে বাধা কোথায়?

জলবায়ুর নতুন ছকে বদলে যাচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ভারতে ওয়াকফ সংশোধনী আইন নিয়ে বিতর্ক

কীটনাশকের বিষচক্র : উন্নয়নের নামে শোষণ ও বিপর্যয়

বোরো ধান উৎপাদনে প্রধান অন্তরায় বিদ্যুৎ-বিভ্রাট

ঢাকার বাসিন্দাদের নিঃশ্বাসে এক বিপন্নতা

‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগ হলে ‘ওয়াশিং মেশিন পার্টি’ বেকার হয়ে পড়বে না তো!

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে সংক্ষুব্ধ ‘আমরা’ কারা?

বাসন্তী পূজা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস : বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার চিত্র

মার্কিন নীতির পরিবর্তনে ইউক্রেনের পরিণতি

গাজা : ক্রমবর্ধমান মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ পলিথিনে বিপন্ন প্রকৃতি

রাজনৈতিক রূপান্তরের এক সতর্কবার্তা

ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াই : আইনের শক্তি ও সমাজের দুর্বলতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কোটাবিরোধী আন্দোলন ও শিক্ষকদের পেনশন সংকট

এইচএম নাজমুল আলম

মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪

বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের ও শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়। এ অস্থিরতার মূল কারণগুলো জটিল, যার মধ্যে বিতর্কিত নীতি যেমন সার্বজনীন পেনশন স্কিম (প্রত্যয়) এবং সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন অন্যতম। এ বিষয়গুলো স্বতন্ত্র হলেও একত্রিত হয়ে এক ধরনের সংকট সৃষ্টি করছে, যা একাডেমিক কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে এবং বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করছে।

২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিল, যা তখন সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছিল। তাদের দাবি ছিল কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হোক। দীর্ঘদিনের আন্দোলনের পর, ২০১৮ সালে সরকারের পক্ষ থেকে পুরো কোটা পদ্ধতি বাতিলের একটি পরিপত্র জারি করা হয়। কিন্তু ২০২১ সালে হাইকোর্টের এক রায়ের পর ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল করা হয়। এই রায়ের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আবার রাস্তায় নেমেছে।

শিক্ষার্থীদের দাবি, কোটা পদ্ধতির সংস্কার না হলে মেধাবীরা সরকারি চাকরিতে যথাযথ সুযোগ পাবে না। শিক্ষার্থীরা কোটার মাধ্যমে সৃষ্ট বৈষম্যকে মেনে নিতে পারছে না। শিক্ষার্থীরা মনে করেন, মেধাবীরা গুরুত্ব না পেলে তারা দেশের বাইরে চলে যাবে, দেশে কাজ করার আগ্রহ হারাবে। তাই এত বছর পরে এসে কোটার এই চাহিদা কমিয়ে আনা দরকার।

শিক্ষার্থীরা চারটি প্রধান দাবি উপস্থাপন করেছেÑ

২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহাল, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কার করতে হবে।

মেধা কোটায় শূন্যপদ পূরণ, কোটায় প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা কোটায় শূন্যপদ পূরণ করতে হবে।

একবার কোটা ব্যবহার, একজন ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় সব ধরনের সরকারি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় একবার কোটা ব্যবহার করতে পারবে।

প্রতিটি জনশুমারির সাথে কোটার পুনর্মুল্যায়ন, অর্থনৈতিক সমীক্ষার মাধ্যমে বিদ্যমান কোটার পুনর্মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পাশাপাশি, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকরা সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিম’ বাতিলের দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন। শিক্ষকরা দাবি করছেন, নতুন পেনশন স্কিম তাদের জন্য ক্ষতিকর। বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় তারা যেসব সুবিধা পাচ্ছেন, নতুন স্কিমে সেই সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হবেন। তারা এ প্রকল্পকে বৈষম্যমূলক এবং তাদের পেশাগত মর্যাদার পরিপন্থী হিসেবে দেখছেন। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন (ঋইটঞঅ), যা ৩৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব করে, এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং পূর্ববর্তী পেনশন সুবিধাগুলো পুনঃপ্রবর্তনের দাবি জানাচ্ছে। গত ৩০ জুন শিক্ষকরা পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করেন এবং ১ জুলাই থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ঘোষণা করেন।

শিক্ষকদের অভিযোগ, নতুন স্কিমে তাদের বেতন থেকে দশ শতাংশ কেটে নেয়া হবে, যা বর্তমান পেনশন ব্যবস্থায় ছিল না। সরকার বলছে, নতুন পেনশন স্কিম শুধুমাত্র নতুন যোগদানকারীদের জন্য প্রযোজ্য হবে। তবে শিক্ষকদের মতে, এটি সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা হবে। বিক্ষোভ এবং কর্মবিরতি সত্ত্বেও, সরকার শিক্ষকদের উদ্বেগ যথাযথভাবে সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী জানিয়েছেন, এ বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারের বাইরে, যেহেতু এটি সরকারি নীতির বিষয়। শিক্ষকদের দাবি হলো প্রত্যয় প্রকল্পটি বাতিল করা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সুপার গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত করা এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য পৃথক পে-স্কেল প্রবর্তন করা।

প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এই দুই আন্দোলনের কারণে কঠিন এক সংকটে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের কোটা-বিরোধী আন্দোলন এবং শিক্ষকদের পেনশন সংকট—এই দুটি ইস্যুতে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিরাজ করছে অস্থিরতা। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের একযোগে আন্দোলন উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে স্থবির করে দিয়েছে। দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্ত ক্লাস, পরীক্ষা এবং একাডেমিক কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

এই স্থবিরতার প্রভাব সুদূরপ্রসারি। শিক্ষার্থীদের জন্য, ক্লাস এবং পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে তাদের একাডেমিক অগ্রগতি যেমন ধীরগতিতে চলবে, তেমনি গ্রাজুয়েশন শেষ করে চাকরি বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতার সম্মুখীন হতে হবে। শিক্ষকদের জন্য, চলমান বিক্ষোভ এবং কর্মবিরতি তাদের পেশাগত স্থিতিশীলতা এবং মনোবলে চির ধরাবে। জাতির উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার ওপর অনিশ্চয়তা এবং অস্থিরতা ভবিষ্যত শিক্ষার্থীদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতে এবং আগ্রহী মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করতে নিরুৎসাহিত করতে পারে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে কোটার পদ্ধতির সংস্কার করা প্রয়োজন। কোটার মাধ্যমে সৃষ্ট বৈষম্য দূর করতে হলে সরকারের উচিত একটি কমিশন গঠন করে কোটাপদ্ধতি সংস্কার করা এবং কোটায় প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা কোটায় শূন্যপদ পূরণ করা। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের পেনশন সংকট সমাধানে সরকারের উচিত শিক্ষকদের সাথে আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করা। নতুন পেনশন স্কিম চালু করতে হলে তা যেন শিক্ষকদের জন্য ক্ষতিকর না হয়, এ বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষকদের আন্দোলনের বিষয়ে দ্রুত সমাধান করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সরকারের দায়িত্ব।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমান সময়ে যে সংকটের মুখোমুখি, তা শুধু শিক্ষার্থীদের বা শিক্ষকদের সমস্যা নয়, বরং এটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধা। শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং শিক্ষকদের পেনশন সংকট, এই দুটি ইস্যুতে সরকারকে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের মেধার মূল্যায়ন এবং শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে, দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। তবে এই সংকট সমাধানে শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষকদের একতাবদ্ধ ও সচেতন থাকতে হবে, যাতে তাদের দাবিগুলো যথাযথভাবে পূরণ হয়। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে হলে, মেধার মূল্যায়ন এবং শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

[লেখক : প্রভাষক, ডিপার্টমেন্ট অব ইংলিশ অ্যান্ড মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজেস, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি)]

back to top