রেজাউল করিম খোকন
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছিল ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৫০০ টন। তবে বিবিএস বলছে, একই অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছিল ২৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯৯৪ টন। ফলে পেঁয়াজের উৎপাদন নিয়ে ডিএইর তুলনায় বিবিএসের তথ্যে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে ৯ লাখ ৯ হাজার ৫০৬ টন। পেঁয়াজ উৎপাদনের তথ্য নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বিস্তর ফারাক দেখা যাচ্ছে।
অন্যান্য কৃষিপণ্যের উৎপাদনের হিসাব নিয়ে সংস্থা দুটির মধ্যে সমন্বয় থাকলেও পেঁয়াজের ক্ষেত্রে রয়েছে ভিন্নতা। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটির চাহিদা নিরূপণ এবং সরবরাহ নিশ্চিত করতে সমস্যায় পড়ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আর তথ্যের এমন ফারাকের সুযোগ নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরাও। ফলে বিপাকে পড়ছে ভোক্তারা।
গত কয়েক বছর ধরে পেঁয়াজের আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তাদের জন্য বড় বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছে। গত এক মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। কেজিতে বেড়েছে ১০-১৫ টাকা। বছরে পণ্যটির চাহিদা ২৬ লাখ টন। তবে উৎপাদনের সঠিক হিসাব নিয়ে দেখা দিয়েছে ভিন্নতা। সরকারের দুটি সংস্থার মধ্যে উৎপাদনের তফাৎ দেখা যাচ্ছে নয় লাখ টনের বেশি, যা মোট চাহিদার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। তথ্যের এমন বিস্তর ফারাক পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা তৈরির পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে।
রাষ্ট্রের অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট তথ্য থাকা উচিত। দুই ধরনের তথ্যের কারণে চাহিদা-জোগানের পার্থক্য দেখা দেয়, যা নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে ও বাজার ব্যবস্থাপনায় সমস্যা তৈরি করে। তথ্যের এমন গরমিল থাকলে দামে প্রায়ই উত্থান-পতন দেখা দেয়। ব্যবসায়ীদের মধ্যেও ভুল বার্তা যায়। ফলে সময়মতো আমদানি না করায় বাজারে হঠাৎ সংকট দেখা দেয়। এতে ভোগান্তিতে পড়ে ক্রেতা সাধারণ, বাড়ে মূল্যস্ফীতিও। তথ্য দেয়ার সময় নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কিছুটা বাড়িয়ে দেখানোর একটা প্রবণতা থাকে। তাই দুই সংস্থার তথ্যে গরমিল থাকে। বিবিএস অনেক দেরিতে তথ্য দেয়। ফলে সময়মতো আমদানি করা যায় না। আর ভারত পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ করলে বাজারে হৈ চৈ পড়ে যায়। উৎপাদনের পরই বিবিএস তথ্য দিলে সেটা কাজে লাগত; কিন্তু মৌসুম চলে গেলে তথ্য দিলে তা বইয়ের মধ্যেই শোভা পায়। বাজার ব্যবস্থাপনায় সেই তথ্য কোনো কাজে আসে না। আমাদের পেঁয়াজের প্রকৃত চাহিদা ২৯-৩০ লাখ টন।
কিন্তু উৎপাদনের পর কিছু পেঁয়াজ নষ্ট হওয়ায় নিট উৎপাদন দাঁড়ায় ২২ লাখ টনের মতো। ফলে চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর আমাদের ছয়-সাত লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। দেশের মধ্যে একেক সংস্থা উৎপাদনের একেক তথ্য দেয়, যা অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেখা যায়। সংস্থাগুলোর তথ্যে আবার অনেক বেশি তফাৎ থাকে, যা উচিত নয়। সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বিতভাবে হিসাব করা উচিত। রাষ্ট্রের যেকোনো ডাটা একই হওয়া উচিত। একেক প্রতিষ্ঠান একেক ডাটা দেবে এটা হতে পারে না। এতে বাজার ব্যবস্থাপনায় সমস্যা তৈরি হয়। চাহিদা নিরূপণে সমস্যা হওয়ায় সার্বিক নীতি গ্রহণেও সমস্যা হতে পারে। ডিএইর তথ্য ঠিক থাকলে এত উচচ দাম হতো না। তথ্যের হেরফের থাকলেই মূল্য ওঠানামা করে। নিজেদের কর্মকা- ভালো দেখানোর জন্য অনেক সময় সংস্থাগুলো ফলাফল বেশি দেখায়।
দুই ধরনের তথ্যে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। ব্যবসায়ীদের মধ্যেও ভুল বার্তা যায়। উৎপাদন বেশি বলা হলে ব্যবসায়ীরা আমদানির জন্য প্রস্তুত থাকে না। পরে দাম বেড়ে গেলে আমদানির সিদ্ধান্ত হলেও পণ্য আসতে দেরি হয়। এতে দাম আরো বেড়ে গিয়ে ভোগান্তি তৈরি হয়, যা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে; যা একটি রাজনৈতিক সরকারের জন্যও বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে। তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয়ভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বিবিএস। তাদের এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ রয়েছে। আইনগতভাবেও তাদের তথ্য গ্রহণযোগ্য।
দেশের পণ্য রপ্তানির হিসাবে গরমিল বের হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকৃত রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, গত দুই অর্থবছরের মোট ২০ মাসে রপ্তানির হিসাব থেকে ২ হাজার ৩৩৪ কোটি মার্কিন ডলার উধাও। রপ্তানির হিসাবের এই ওলট-পালট হওয়ার কারণ কী, প্রভাব কী? দুই অর্থবছরের ২০ মাসের রপ্তানি হিসাব থেকে ২৩ বিলিয়ন ডলার উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ওপর দায় চাপিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বড় এ ঘাটতির ফলে দেশের বিভিন্ন আর্থিক পরিসংখ্যান ওলট-পালট হয়ে পড়েছে। রপ্তানি কমে যাওয়ায় চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত থেকে ঘাটতিতে পড়েছে। আর রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ আসার লক্ষ্য কমে যাওয়ায় আর্থিক হিসাব ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্তে ফিরে গেছে। এনবিআরের সরবরাহকৃত রপ্তানির ডেটাসেটে একাধিকবার রপ্তানির হিসাব থাকার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে তাদের পর্যবেক্ষণের পর জানিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানি আয়ের তথ্য-উপাত্ত তফসিলি ব্যাংকগুলোর শাখা থেকে সংগ্রহ করে থাকে। ফলে সেই তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে প্রকৃত রপ্তানির তেমন পার্থক্য থাকে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংগ্রহ এবং ইপিবি কর্তৃক প্রকাশিত রপ্তানিসংক্রান্ত তথ্যে পার্থক্য থাকার কারণগুলোকে চিহ্নিত করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি বলেছে, একই রপ্তানি তথ্য এবং পণ্যের এইচএস কোড একাধিকবার ইনপুট দেয়া হয়েছে। পণ্যের কাটিং, মেকিং এবং ট্রিমিংয়ের ক্ষেত্রে শুধু তৈরির মাশুল পাওয়ার কথা, কিন্তু ইপিবি কাপড়সহ সব যন্ত্রাংশের হিসাব করেছে। ইপিবি অনেক সময় নমুনা পণ্যের দামও ইনপুট দিয়েছে, অথচ নমুনা পণ্যের কোনো দাম হিসাবে আসার কথা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল থেকে দেশের অভ্যন্তরে বিক্রয়কে রপ্তানি হিসবে এবং এসব পণ্য আবার বিদেশে রপ্তানির সময় হিসাব করা হয়েছে। সাধারণত পণ্য রপ্তানির সময় রপ্তানির প্রাথমিক ঋতপত্র মূল্য থেকে কিছুটা কম হয়ে থাকে, যা ইপিবি সমন্বয় করে না। এছাড়া স্টকলট, ডিসকাউন্ট এবং কমিশনের কারণে ক্ষয়ক্ষতি ইপিবি কর্তৃক সমন্বয় করা হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সব ব্যাংক, ইপিবি, এনবিআরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আমদানি ব্যয়, রপ্তানি আয়, অদৃশ্য ব্যয়, অদৃশ্য আয়, রেমিট্যান্সের তথ্য মাসিক ভিত্তিতে সংগ্রহ করে লেনদেন ভারসাম্যের বিবরণী প্রস্তুত করে থাকে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ কম, ফলে রপ্তানিও কমে গেছে। আগে প্রতি মাসে ৪-৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হলেও ওই সময় তা কমে ৩ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। অথচ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বলছিল, রপ্তানি বেড়েছে। ওই বছরের নভেম্বরে ৫০৯ কোটি ডলারের রপ্তানির তথ্য দেয় ইপিবি, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ রপ্তানি। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর ইউডির হিসাবের সঙ্গেও এই হিসাব মেলেনি। তারপরও কয়েক মাস ধারাবাহিকভাবে ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলারের বেশি রপ্তানির তথ্য দিয়ে যাচ্ছিল ইপিবি। সে কারণে ইপিবির রপ্তানির তথ্য নিয়ে দেড় থেকে দুই বছর ধরেই দ্বিমত প্রকাশ করে আসছে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ।
দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে আমরা অনেক দিন ধরেই চ্যালেঞ্জের মধ্য রয়েছি। রপ্তানির গোলমেলে হিসাবের কারণে সামনে আরও খারাপ সময় আসছে। রপ্তানির ভুল তথ্যের জন্য আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমেছে। কারণ ইপিবির বাড়িয়ে দেখানো রপ্তানির তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সরকার নীতি গ্রহণ করেছে। ইপিবির হিসাবে বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৭৪৭ কোটি ডলারের পণ্য। অন্যদিকে এনবিআর হিসাব কষে বলেছে, ওই সময়ে দেশ থেকে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
এনবিআরের এই হিসাবকে চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি তিন সংস্থা মিলে গত দুই বছরের রপ্তানি হিসাব চূড়ান্ত করেছে। এতেও এনবিআরের হিসাবকে চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানির যে তথ্য প্রকাশ করেছে, এটাই প্রকৃত। প্রতি মাসে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি রপ্তানি দেখিয়ে আসছিল ইপিবি। বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস জুলাই-এপ্রিলে ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৮০ কোটি ডলার কমে যাওয়ায় রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ আসার পার্থক্যও কমে এসেছে। এই সময়ে এক্ষেত্রে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৬৮ কোটি ডলার। আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থে ২৪৩ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। ফলে গত জুলাই-এপ্রিল সময়ে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি থেকে ২২৩ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে।
কাদের ভুলের কারণে রপ্তানির হিসাব ওলট-পালট হয়ে গেল, সেটি খুঁজে বের করা দরকার। এ প্রক্রিয়ায় রপ্তানি খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদেরও যুক্ত করা প্রয়োজন। এছাড়া প্রকৃত রপ্তানি হিসাব যেটি করা হয়েছে, সেটি সঠিক কি না, তা-ও নিশ্চিত হতে হবে। তবে প্রকৃত রপ্তানির তথ্য প্রাথমিকভাবে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে। যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে অন্যান্য যেসব সূচক এ রপ্তানি তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে, সেগুলোর পরিবর্তনও দ্রুত করা উচিত। সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই সময়ে রপ্তানি ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৮০ কোটি মার্কিন ডলার কমেছে। এর ফলে দেশের আর্থিক হিসাব ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্ত হয়ে গেছে। তবে এতে নতুন করে ঘাটতিতে পড়েছে চলতি হিসাব। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
আর্থিক হিসাব ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্ত হয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। এটা শুধু গণনার হিসাবে পরিবর্তন। এতে চলতি হিসাব আবার ঘাটতিতে চলে গেছে। অর্থনীতি এখনো চাপের মধ্যে আছে। প্রকৃত রপ্তানি কত হচ্ছে, সেই তথ্য ব্যবহার করে আর্থিক হিসাব গণনা শুরু হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আর রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোও (ইপিবি) একই রকম রপ্তানি তথ্য ব্যবহার করবে। ফলে রপ্তানি তথ্য নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছিল, তা কেটে যাবে। এত দিন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বা ইপিবি রপ্তানি ধরে হিসাব করা হতো; কিন্তু হিসাব অনুযায়ী দেশে রপ্তানি আয় আসছিল না। এ নিয়ে দেশি ও বিদেশি নানা সংস্থা থেকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, এত পণ্য রপ্তানি হয়নি। ফলে আয় বেশি আসার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এখন থেকে প্রকৃত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। সঠিক হিসাব না দেয়ায় এত দিন নীতিনির্ধারকদের কাছে ভুল বার্তা গেছে। এতে করে পুরো খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এত দিন রপ্তানির ভুল তথ্য দেখিয়ে হিসাব করা হয়েছে। এটা আগেই ঠিক করে ফেলা উচিত ছিল।
রপ্তানির তথ্যে গরমিলের পেছনে সরকারের তিন সংস্থার সমন্বয়হীনতা ছিল, তবে দেরিতে হলেও বিষয়টির সমাধান হয়েছে। সম্প্রতি রপ্তানির তথ্য সংশোধন করা হয়েছে।
যাই হোক, এ বিষয়ে একটা সমাধান হয়েছে। আশা করছি, ভবিষ্যতে এমন বিভ্রান্তি আর হবে না। সরকারি সংস্থাগুলো সমন্বয় করে কাজ করবে। অনেক দিন ধরেই ইপিবির তথ্যের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের রপ্তানির তথ্য মিলছিল না। আমাদের যেখানে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়, সেখানে ইপিবি দেখায় ইতিবাচক। এটি ইপিবি কিভাবে করে, তা আমাদের জানা নেই। ইপিবির তথ্য সংগ্রহের ভুল ঠিক করা প্রয়োজন। এমন ভুলের কারণে দেশের ভাবমূর্তি নেতিবাচক হতে পারে। রপ্তানির ক্ষেত্রে এত দিন ধরে ভুল তথ্য দেখিয়ে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে নগদ প্রণোদনা কমানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। এর মাধ্যমে আমাদের টেক্সটাইল শিল্প খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। নানাবিধ সংকটের কারণে ইতোমধ্যে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আরও অনেক কারখানা যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। রপ্তানির হিসাবে বড় ধরনের গরমিলের তথ্য প্রকাশের পরে হুঁশ ফিরেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি)। সংস্থাটি এখন বাণিজ্যসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংকলন ও উপস্থাপনের পদ্ধতি আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ইপিবি এখন থেকে রপ্তানি সংশিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে তথ্য প্রকাশ করবে। এ জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি (এসওপি) অনুসরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সমন্বিতভাবে কাজ না করে, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো খাতের ভুল হিসাব তুলে ধরে, তার নেতিবাচক প্রভাব প্রবৃদ্ধি তথা অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে যে পড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়সহ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো পরিমাপের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো রপ্তানি আয়ের তথ্য।
সংশোধনের মাধ্যমে রপ্তানি আয় কমে আসায় দেশের জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়সহ এসব সূচকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে। রপ্তানি আয়ের হিসাব পরিবর্তনের ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রায় সব ধরনের সূচকেই পরিবর্তন আসবে। রপ্তানির তুলনায় আমদানির হিসাবে পরিবর্তন না হওয়ায় বাণিজ্য-ঘাটতি বাড়বে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও কমে আসবে।
এত দিন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বা ইপিবির রপ্তানি ধরে হিসাব করা হতো। কিন্তু হিসাব অনুযায়ী দেশে রপ্তানি আয় আসছিল না। এ নিয়ে দেশি ও বিদেশি নানা সংস্থা থেকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। এখন থেকে প্রকৃত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। আমরা আশা করব, সরকার রপ্তানির হিসাবের এই বিচ্যুতির বিষয়টি যথাযথভাবে তদন্ত করে দেখবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনবে। খতিয়ে দেখতে হবে, ভুলটি ইচ্ছাকৃত কিনা। অনেক সরকারি কর্মকর্তাই অর্থনীতির উজ্জ্বল চিত্র তুলে ধরে নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে বাহবা নিতে চান। অথচ এ ধরনের ভুলের মাশুল দিতে হয় জনগণকেই। ব্যবসায়ীরা ইপিবির রপ্তানির হিসাবের সঙ্গে একমত ছিলেন না। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো হিসাবের গরমিল নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তুলেছে; কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বরাবর আমলাদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। ইপিবির হিসাবের শুভংকরের ফাঁকি ধরা পড়ার পর সরকার সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়Ñ সেটাই দেখার বিষয়।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
রেজাউল করিম খোকন
বুধবার, ২৪ জুলাই ২০২৪
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছিল ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৫০০ টন। তবে বিবিএস বলছে, একই অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছিল ২৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯৯৪ টন। ফলে পেঁয়াজের উৎপাদন নিয়ে ডিএইর তুলনায় বিবিএসের তথ্যে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে ৯ লাখ ৯ হাজার ৫০৬ টন। পেঁয়াজ উৎপাদনের তথ্য নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বিস্তর ফারাক দেখা যাচ্ছে।
অন্যান্য কৃষিপণ্যের উৎপাদনের হিসাব নিয়ে সংস্থা দুটির মধ্যে সমন্বয় থাকলেও পেঁয়াজের ক্ষেত্রে রয়েছে ভিন্নতা। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটির চাহিদা নিরূপণ এবং সরবরাহ নিশ্চিত করতে সমস্যায় পড়ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আর তথ্যের এমন ফারাকের সুযোগ নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরাও। ফলে বিপাকে পড়ছে ভোক্তারা।
গত কয়েক বছর ধরে পেঁয়াজের আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তাদের জন্য বড় বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছে। গত এক মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। কেজিতে বেড়েছে ১০-১৫ টাকা। বছরে পণ্যটির চাহিদা ২৬ লাখ টন। তবে উৎপাদনের সঠিক হিসাব নিয়ে দেখা দিয়েছে ভিন্নতা। সরকারের দুটি সংস্থার মধ্যে উৎপাদনের তফাৎ দেখা যাচ্ছে নয় লাখ টনের বেশি, যা মোট চাহিদার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। তথ্যের এমন বিস্তর ফারাক পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা তৈরির পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে।
রাষ্ট্রের অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট তথ্য থাকা উচিত। দুই ধরনের তথ্যের কারণে চাহিদা-জোগানের পার্থক্য দেখা দেয়, যা নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে ও বাজার ব্যবস্থাপনায় সমস্যা তৈরি করে। তথ্যের এমন গরমিল থাকলে দামে প্রায়ই উত্থান-পতন দেখা দেয়। ব্যবসায়ীদের মধ্যেও ভুল বার্তা যায়। ফলে সময়মতো আমদানি না করায় বাজারে হঠাৎ সংকট দেখা দেয়। এতে ভোগান্তিতে পড়ে ক্রেতা সাধারণ, বাড়ে মূল্যস্ফীতিও। তথ্য দেয়ার সময় নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কিছুটা বাড়িয়ে দেখানোর একটা প্রবণতা থাকে। তাই দুই সংস্থার তথ্যে গরমিল থাকে। বিবিএস অনেক দেরিতে তথ্য দেয়। ফলে সময়মতো আমদানি করা যায় না। আর ভারত পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ করলে বাজারে হৈ চৈ পড়ে যায়। উৎপাদনের পরই বিবিএস তথ্য দিলে সেটা কাজে লাগত; কিন্তু মৌসুম চলে গেলে তথ্য দিলে তা বইয়ের মধ্যেই শোভা পায়। বাজার ব্যবস্থাপনায় সেই তথ্য কোনো কাজে আসে না। আমাদের পেঁয়াজের প্রকৃত চাহিদা ২৯-৩০ লাখ টন।
কিন্তু উৎপাদনের পর কিছু পেঁয়াজ নষ্ট হওয়ায় নিট উৎপাদন দাঁড়ায় ২২ লাখ টনের মতো। ফলে চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর আমাদের ছয়-সাত লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। দেশের মধ্যে একেক সংস্থা উৎপাদনের একেক তথ্য দেয়, যা অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেখা যায়। সংস্থাগুলোর তথ্যে আবার অনেক বেশি তফাৎ থাকে, যা উচিত নয়। সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বিতভাবে হিসাব করা উচিত। রাষ্ট্রের যেকোনো ডাটা একই হওয়া উচিত। একেক প্রতিষ্ঠান একেক ডাটা দেবে এটা হতে পারে না। এতে বাজার ব্যবস্থাপনায় সমস্যা তৈরি হয়। চাহিদা নিরূপণে সমস্যা হওয়ায় সার্বিক নীতি গ্রহণেও সমস্যা হতে পারে। ডিএইর তথ্য ঠিক থাকলে এত উচচ দাম হতো না। তথ্যের হেরফের থাকলেই মূল্য ওঠানামা করে। নিজেদের কর্মকা- ভালো দেখানোর জন্য অনেক সময় সংস্থাগুলো ফলাফল বেশি দেখায়।
দুই ধরনের তথ্যে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। ব্যবসায়ীদের মধ্যেও ভুল বার্তা যায়। উৎপাদন বেশি বলা হলে ব্যবসায়ীরা আমদানির জন্য প্রস্তুত থাকে না। পরে দাম বেড়ে গেলে আমদানির সিদ্ধান্ত হলেও পণ্য আসতে দেরি হয়। এতে দাম আরো বেড়ে গিয়ে ভোগান্তি তৈরি হয়, যা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে; যা একটি রাজনৈতিক সরকারের জন্যও বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে। তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয়ভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বিবিএস। তাদের এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ রয়েছে। আইনগতভাবেও তাদের তথ্য গ্রহণযোগ্য।
দেশের পণ্য রপ্তানির হিসাবে গরমিল বের হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকৃত রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, গত দুই অর্থবছরের মোট ২০ মাসে রপ্তানির হিসাব থেকে ২ হাজার ৩৩৪ কোটি মার্কিন ডলার উধাও। রপ্তানির হিসাবের এই ওলট-পালট হওয়ার কারণ কী, প্রভাব কী? দুই অর্থবছরের ২০ মাসের রপ্তানি হিসাব থেকে ২৩ বিলিয়ন ডলার উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ওপর দায় চাপিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বড় এ ঘাটতির ফলে দেশের বিভিন্ন আর্থিক পরিসংখ্যান ওলট-পালট হয়ে পড়েছে। রপ্তানি কমে যাওয়ায় চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত থেকে ঘাটতিতে পড়েছে। আর রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ আসার লক্ষ্য কমে যাওয়ায় আর্থিক হিসাব ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্তে ফিরে গেছে। এনবিআরের সরবরাহকৃত রপ্তানির ডেটাসেটে একাধিকবার রপ্তানির হিসাব থাকার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে তাদের পর্যবেক্ষণের পর জানিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানি আয়ের তথ্য-উপাত্ত তফসিলি ব্যাংকগুলোর শাখা থেকে সংগ্রহ করে থাকে। ফলে সেই তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে প্রকৃত রপ্তানির তেমন পার্থক্য থাকে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংগ্রহ এবং ইপিবি কর্তৃক প্রকাশিত রপ্তানিসংক্রান্ত তথ্যে পার্থক্য থাকার কারণগুলোকে চিহ্নিত করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি বলেছে, একই রপ্তানি তথ্য এবং পণ্যের এইচএস কোড একাধিকবার ইনপুট দেয়া হয়েছে। পণ্যের কাটিং, মেকিং এবং ট্রিমিংয়ের ক্ষেত্রে শুধু তৈরির মাশুল পাওয়ার কথা, কিন্তু ইপিবি কাপড়সহ সব যন্ত্রাংশের হিসাব করেছে। ইপিবি অনেক সময় নমুনা পণ্যের দামও ইনপুট দিয়েছে, অথচ নমুনা পণ্যের কোনো দাম হিসাবে আসার কথা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল থেকে দেশের অভ্যন্তরে বিক্রয়কে রপ্তানি হিসবে এবং এসব পণ্য আবার বিদেশে রপ্তানির সময় হিসাব করা হয়েছে। সাধারণত পণ্য রপ্তানির সময় রপ্তানির প্রাথমিক ঋতপত্র মূল্য থেকে কিছুটা কম হয়ে থাকে, যা ইপিবি সমন্বয় করে না। এছাড়া স্টকলট, ডিসকাউন্ট এবং কমিশনের কারণে ক্ষয়ক্ষতি ইপিবি কর্তৃক সমন্বয় করা হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সব ব্যাংক, ইপিবি, এনবিআরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আমদানি ব্যয়, রপ্তানি আয়, অদৃশ্য ব্যয়, অদৃশ্য আয়, রেমিট্যান্সের তথ্য মাসিক ভিত্তিতে সংগ্রহ করে লেনদেন ভারসাম্যের বিবরণী প্রস্তুত করে থাকে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ কম, ফলে রপ্তানিও কমে গেছে। আগে প্রতি মাসে ৪-৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হলেও ওই সময় তা কমে ৩ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। অথচ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বলছিল, রপ্তানি বেড়েছে। ওই বছরের নভেম্বরে ৫০৯ কোটি ডলারের রপ্তানির তথ্য দেয় ইপিবি, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ রপ্তানি। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর ইউডির হিসাবের সঙ্গেও এই হিসাব মেলেনি। তারপরও কয়েক মাস ধারাবাহিকভাবে ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলারের বেশি রপ্তানির তথ্য দিয়ে যাচ্ছিল ইপিবি। সে কারণে ইপিবির রপ্তানির তথ্য নিয়ে দেড় থেকে দুই বছর ধরেই দ্বিমত প্রকাশ করে আসছে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ।
দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে আমরা অনেক দিন ধরেই চ্যালেঞ্জের মধ্য রয়েছি। রপ্তানির গোলমেলে হিসাবের কারণে সামনে আরও খারাপ সময় আসছে। রপ্তানির ভুল তথ্যের জন্য আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমেছে। কারণ ইপিবির বাড়িয়ে দেখানো রপ্তানির তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সরকার নীতি গ্রহণ করেছে। ইপিবির হিসাবে বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৭৪৭ কোটি ডলারের পণ্য। অন্যদিকে এনবিআর হিসাব কষে বলেছে, ওই সময়ে দেশ থেকে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
এনবিআরের এই হিসাবকে চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি তিন সংস্থা মিলে গত দুই বছরের রপ্তানি হিসাব চূড়ান্ত করেছে। এতেও এনবিআরের হিসাবকে চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানির যে তথ্য প্রকাশ করেছে, এটাই প্রকৃত। প্রতি মাসে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি রপ্তানি দেখিয়ে আসছিল ইপিবি। বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস জুলাই-এপ্রিলে ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৮০ কোটি ডলার কমে যাওয়ায় রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ আসার পার্থক্যও কমে এসেছে। এই সময়ে এক্ষেত্রে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৬৮ কোটি ডলার। আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থে ২৪৩ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। ফলে গত জুলাই-এপ্রিল সময়ে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি থেকে ২২৩ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে।
কাদের ভুলের কারণে রপ্তানির হিসাব ওলট-পালট হয়ে গেল, সেটি খুঁজে বের করা দরকার। এ প্রক্রিয়ায় রপ্তানি খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদেরও যুক্ত করা প্রয়োজন। এছাড়া প্রকৃত রপ্তানি হিসাব যেটি করা হয়েছে, সেটি সঠিক কি না, তা-ও নিশ্চিত হতে হবে। তবে প্রকৃত রপ্তানির তথ্য প্রাথমিকভাবে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে। যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে অন্যান্য যেসব সূচক এ রপ্তানি তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে, সেগুলোর পরিবর্তনও দ্রুত করা উচিত। সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই সময়ে রপ্তানি ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৮০ কোটি মার্কিন ডলার কমেছে। এর ফলে দেশের আর্থিক হিসাব ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্ত হয়ে গেছে। তবে এতে নতুন করে ঘাটতিতে পড়েছে চলতি হিসাব। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
আর্থিক হিসাব ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্ত হয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। এটা শুধু গণনার হিসাবে পরিবর্তন। এতে চলতি হিসাব আবার ঘাটতিতে চলে গেছে। অর্থনীতি এখনো চাপের মধ্যে আছে। প্রকৃত রপ্তানি কত হচ্ছে, সেই তথ্য ব্যবহার করে আর্থিক হিসাব গণনা শুরু হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আর রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোও (ইপিবি) একই রকম রপ্তানি তথ্য ব্যবহার করবে। ফলে রপ্তানি তথ্য নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছিল, তা কেটে যাবে। এত দিন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বা ইপিবি রপ্তানি ধরে হিসাব করা হতো; কিন্তু হিসাব অনুযায়ী দেশে রপ্তানি আয় আসছিল না। এ নিয়ে দেশি ও বিদেশি নানা সংস্থা থেকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, এত পণ্য রপ্তানি হয়নি। ফলে আয় বেশি আসার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এখন থেকে প্রকৃত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। সঠিক হিসাব না দেয়ায় এত দিন নীতিনির্ধারকদের কাছে ভুল বার্তা গেছে। এতে করে পুরো খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এত দিন রপ্তানির ভুল তথ্য দেখিয়ে হিসাব করা হয়েছে। এটা আগেই ঠিক করে ফেলা উচিত ছিল।
রপ্তানির তথ্যে গরমিলের পেছনে সরকারের তিন সংস্থার সমন্বয়হীনতা ছিল, তবে দেরিতে হলেও বিষয়টির সমাধান হয়েছে। সম্প্রতি রপ্তানির তথ্য সংশোধন করা হয়েছে।
যাই হোক, এ বিষয়ে একটা সমাধান হয়েছে। আশা করছি, ভবিষ্যতে এমন বিভ্রান্তি আর হবে না। সরকারি সংস্থাগুলো সমন্বয় করে কাজ করবে। অনেক দিন ধরেই ইপিবির তথ্যের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের রপ্তানির তথ্য মিলছিল না। আমাদের যেখানে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়, সেখানে ইপিবি দেখায় ইতিবাচক। এটি ইপিবি কিভাবে করে, তা আমাদের জানা নেই। ইপিবির তথ্য সংগ্রহের ভুল ঠিক করা প্রয়োজন। এমন ভুলের কারণে দেশের ভাবমূর্তি নেতিবাচক হতে পারে। রপ্তানির ক্ষেত্রে এত দিন ধরে ভুল তথ্য দেখিয়ে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে নগদ প্রণোদনা কমানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। এর মাধ্যমে আমাদের টেক্সটাইল শিল্প খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। নানাবিধ সংকটের কারণে ইতোমধ্যে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আরও অনেক কারখানা যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। রপ্তানির হিসাবে বড় ধরনের গরমিলের তথ্য প্রকাশের পরে হুঁশ ফিরেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি)। সংস্থাটি এখন বাণিজ্যসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংকলন ও উপস্থাপনের পদ্ধতি আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ইপিবি এখন থেকে রপ্তানি সংশিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে তথ্য প্রকাশ করবে। এ জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি (এসওপি) অনুসরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সমন্বিতভাবে কাজ না করে, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো খাতের ভুল হিসাব তুলে ধরে, তার নেতিবাচক প্রভাব প্রবৃদ্ধি তথা অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে যে পড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়সহ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো পরিমাপের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো রপ্তানি আয়ের তথ্য।
সংশোধনের মাধ্যমে রপ্তানি আয় কমে আসায় দেশের জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়সহ এসব সূচকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে। রপ্তানি আয়ের হিসাব পরিবর্তনের ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রায় সব ধরনের সূচকেই পরিবর্তন আসবে। রপ্তানির তুলনায় আমদানির হিসাবে পরিবর্তন না হওয়ায় বাণিজ্য-ঘাটতি বাড়বে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও কমে আসবে।
এত দিন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বা ইপিবির রপ্তানি ধরে হিসাব করা হতো। কিন্তু হিসাব অনুযায়ী দেশে রপ্তানি আয় আসছিল না। এ নিয়ে দেশি ও বিদেশি নানা সংস্থা থেকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। এখন থেকে প্রকৃত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। আমরা আশা করব, সরকার রপ্তানির হিসাবের এই বিচ্যুতির বিষয়টি যথাযথভাবে তদন্ত করে দেখবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনবে। খতিয়ে দেখতে হবে, ভুলটি ইচ্ছাকৃত কিনা। অনেক সরকারি কর্মকর্তাই অর্থনীতির উজ্জ্বল চিত্র তুলে ধরে নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে বাহবা নিতে চান। অথচ এ ধরনের ভুলের মাশুল দিতে হয় জনগণকেই। ব্যবসায়ীরা ইপিবির রপ্তানির হিসাবের সঙ্গে একমত ছিলেন না। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো হিসাবের গরমিল নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তুলেছে; কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বরাবর আমলাদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। ইপিবির হিসাবের শুভংকরের ফাঁকি ধরা পড়ার পর সরকার সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়Ñ সেটাই দেখার বিষয়।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]