সাজেদা সুলতানা কলি
অটিজম শিশুর মস্তিষ্কের একটি বিকাশগত সমস্যা। এই অটিজম আক্রান্ত বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের সুরক্ষার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন মাসিক ভাতা, শিক্ষা ভাতা, চিকিৎসা ভাতা ইত্যাদি। এসব বাচ্চা এবং তাদের বাবা-মায়েদের উৎসাহ দেয়ার জন্য বিশেষ শিশুদের (শুধু অটিজম আক্রান্ত) আঁকা ছবি দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান (ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, নববর্ষ ইত্যাদি) উপলক্ষে শুভেচ্ছা কার্ড তৈরি করেছে। যাদের আঁকা ছবি কার্ড তৈরির জন্য নির্বাচিত হয়েছে তাদের জন্য একটা অনুদানের ব্যবস্থা করেছে। তাদেরকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য বিশেষায়িত স্কুল ছাড়াও নরমাল স্কুলে ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছে।
এক সময় বাবা-মায়েরা তাদের স্পেশাল চাইল্ডদের ঘরের কোণে লুকিয়ে রাখতেন। আত্মীয়স্বজনদের সামনেও বের করতেন না। এখন এই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বর্তমানে বাবা-মায়েরা স্বপ্রণোদিত হয়ে তাদের বাচ্চাদের নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ছাড়াও পার্কে, শপিংমলে যাচ্ছেন। তাদের নিয়ে রাস্তায় বেরোচ্ছেন কোন দ্বিধা ছাড়া। দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সাধারণ মানুষও তাদের আন্তরিকভাবে গ্রহণ করছেন। অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগে থেকেই কম বেশি ধারণা ছিল কিন্তু অটিজম আক্রান্ত শিশুদের দেখে বোঝা যায় না যে তারা আচরণগত দিক থেকে আমাদের চেয়ে আলাদা। তাদের আচরণে মানুষ বিরক্ত হয়ে ভাবতেন বাচ্চার শিষ্টাচার বা আদব-কায়দায় ঘাটতি আছে।
সরকারের প্রচার প্রচারণার কারণে যেভাবে মানুষ এই শিশুদের বিষয়ে জানতে পেরেছেন তেমনই এক শ্রেণীর অসাধু মানুষ অটিজম আক্রান্ত বা অটিস্টিক শিশুদের মা বাবার অসহায়ত্বকে পুঁজি করে ফুলেফেঁপে উঠছে। যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে তথাকথিত স্পেশাল স্কুল। এই স্কুলের টিচারদের না আছে কোন স্পেশাল এডুকেশনের সার্টিফিকেট না আছে কোন প্রশিক্ষণ। আবার স্পেশাল এডুকেশনের সার্টিফিকেট থাকলেও সেটা কতটা পিওর সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আমি স্পেশাল এডুকেশনের কোর্স করতে গিয়ে (সাত আট মাস ক্লাস করেছিলাম) মাঝপথে থেমে যাই। সবকিছু সামলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তখন আমাকে একজন পরামর্শ দিয়েছিল, আরে ক্লাস করা লাগে না, আপনি টাকা দিলে সরকারি সার্টিফিকেট পেয়ে যাবেন। তারপর কিভাবে সার্টিফিকেট পাওয়া যায় সেই প্রসেসটাও বললেন। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম! আমাদের দেশের মানুষ এত মেধাবী (!) যে এই নিষ্পাপ শিশুগুলোকেও তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে কিভাবে নিজের পকেট ভারী করা যায় সেই কৌশলও তাদের জানা আছে।
যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা এসব স্পেশাল স্কুলগুলোর খরচ মেটাতে গেলে ভিটেমাটি বিক্রি করতে হবে। কারণ স্কুলগুলোতে একটা বাচ্চার শুধু ভর্তি ফি বিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা আর মাসিক বেতন আট থেকে দশ হাজার টাকা। অনেক চাকরিজীবী আছেন যাদের মাসিক দশ হাজার বেতনে পুরো সংসার চলে। সেখানে একটা বাচ্চার শুধু স্কুলের পেছনে এত টাকা খরচ করে কুলিয়ে উঠা সম্ভব নয়। অনেক বিত্তশালী বাবা মাও এই ধরনের ব্যয় বহুল প্রতিষ্ঠানের খরচ বহন করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে এসেছেন। কারণ বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন (অটিজম) বাচ্চাদের পেছনে প্রচুর খরচ। এরা কোনো বায়না ধরলে সামলানো খুব কঠিন হয়ে যায়। তখন মনে হয় যে নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও এই চাহিদা পূরণ করতে হবে। এমনও না যে যোগ্য শিক্ষক থাকলে এবং টাকা দিলে তারা অটিজম নিরাময় করে দেবেন। অটিজম নিরাময় করার সাধ্য পৃথিবীর কারও নেই। এখন পর্যন্ত এর কারণ, প্রতিরোধ, প্রতিকার কোনোটাই আবিষ্কৃত হয়নি।
সম্প্রতি মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশের যে টালমাটাল অবস্থা তাতে ভিটেমাটি কয়জনের অবশিষ্ট থাকবে সেটাও বিরাট একটা প্রশ্ন। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে কোনোরকমে খেয়েপরে বেঁচে থাকাও কষ্টকর হয়ে যাবে। তার ওপর সুযোগসন্ধানীদের এত বিশাল উদর ভরাতে গেলে ভিটেমাটিতেও কুলোবে না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমাদের মাসিক ভাতা, শিক্ষা ভাতা, চিকিৎসা ভাতা কিছুই চাই না। শুধু তথাকথিত স্পেশাল স্কুলের নামে গজিয়ে উঠা শিকারীর ফাঁদগুলোর দিকে একটু নজর দিন।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ]
সাজেদা সুলতানা কলি
বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
অটিজম শিশুর মস্তিষ্কের একটি বিকাশগত সমস্যা। এই অটিজম আক্রান্ত বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের সুরক্ষার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন মাসিক ভাতা, শিক্ষা ভাতা, চিকিৎসা ভাতা ইত্যাদি। এসব বাচ্চা এবং তাদের বাবা-মায়েদের উৎসাহ দেয়ার জন্য বিশেষ শিশুদের (শুধু অটিজম আক্রান্ত) আঁকা ছবি দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান (ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, নববর্ষ ইত্যাদি) উপলক্ষে শুভেচ্ছা কার্ড তৈরি করেছে। যাদের আঁকা ছবি কার্ড তৈরির জন্য নির্বাচিত হয়েছে তাদের জন্য একটা অনুদানের ব্যবস্থা করেছে। তাদেরকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য বিশেষায়িত স্কুল ছাড়াও নরমাল স্কুলে ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছে।
এক সময় বাবা-মায়েরা তাদের স্পেশাল চাইল্ডদের ঘরের কোণে লুকিয়ে রাখতেন। আত্মীয়স্বজনদের সামনেও বের করতেন না। এখন এই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বর্তমানে বাবা-মায়েরা স্বপ্রণোদিত হয়ে তাদের বাচ্চাদের নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ছাড়াও পার্কে, শপিংমলে যাচ্ছেন। তাদের নিয়ে রাস্তায় বেরোচ্ছেন কোন দ্বিধা ছাড়া। দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সাধারণ মানুষও তাদের আন্তরিকভাবে গ্রহণ করছেন। অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগে থেকেই কম বেশি ধারণা ছিল কিন্তু অটিজম আক্রান্ত শিশুদের দেখে বোঝা যায় না যে তারা আচরণগত দিক থেকে আমাদের চেয়ে আলাদা। তাদের আচরণে মানুষ বিরক্ত হয়ে ভাবতেন বাচ্চার শিষ্টাচার বা আদব-কায়দায় ঘাটতি আছে।
সরকারের প্রচার প্রচারণার কারণে যেভাবে মানুষ এই শিশুদের বিষয়ে জানতে পেরেছেন তেমনই এক শ্রেণীর অসাধু মানুষ অটিজম আক্রান্ত বা অটিস্টিক শিশুদের মা বাবার অসহায়ত্বকে পুঁজি করে ফুলেফেঁপে উঠছে। যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে তথাকথিত স্পেশাল স্কুল। এই স্কুলের টিচারদের না আছে কোন স্পেশাল এডুকেশনের সার্টিফিকেট না আছে কোন প্রশিক্ষণ। আবার স্পেশাল এডুকেশনের সার্টিফিকেট থাকলেও সেটা কতটা পিওর সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আমি স্পেশাল এডুকেশনের কোর্স করতে গিয়ে (সাত আট মাস ক্লাস করেছিলাম) মাঝপথে থেমে যাই। সবকিছু সামলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তখন আমাকে একজন পরামর্শ দিয়েছিল, আরে ক্লাস করা লাগে না, আপনি টাকা দিলে সরকারি সার্টিফিকেট পেয়ে যাবেন। তারপর কিভাবে সার্টিফিকেট পাওয়া যায় সেই প্রসেসটাও বললেন। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম! আমাদের দেশের মানুষ এত মেধাবী (!) যে এই নিষ্পাপ শিশুগুলোকেও তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে কিভাবে নিজের পকেট ভারী করা যায় সেই কৌশলও তাদের জানা আছে।
যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা এসব স্পেশাল স্কুলগুলোর খরচ মেটাতে গেলে ভিটেমাটি বিক্রি করতে হবে। কারণ স্কুলগুলোতে একটা বাচ্চার শুধু ভর্তি ফি বিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা আর মাসিক বেতন আট থেকে দশ হাজার টাকা। অনেক চাকরিজীবী আছেন যাদের মাসিক দশ হাজার বেতনে পুরো সংসার চলে। সেখানে একটা বাচ্চার শুধু স্কুলের পেছনে এত টাকা খরচ করে কুলিয়ে উঠা সম্ভব নয়। অনেক বিত্তশালী বাবা মাও এই ধরনের ব্যয় বহুল প্রতিষ্ঠানের খরচ বহন করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে এসেছেন। কারণ বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন (অটিজম) বাচ্চাদের পেছনে প্রচুর খরচ। এরা কোনো বায়না ধরলে সামলানো খুব কঠিন হয়ে যায়। তখন মনে হয় যে নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও এই চাহিদা পূরণ করতে হবে। এমনও না যে যোগ্য শিক্ষক থাকলে এবং টাকা দিলে তারা অটিজম নিরাময় করে দেবেন। অটিজম নিরাময় করার সাধ্য পৃথিবীর কারও নেই। এখন পর্যন্ত এর কারণ, প্রতিরোধ, প্রতিকার কোনোটাই আবিষ্কৃত হয়নি।
সম্প্রতি মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশের যে টালমাটাল অবস্থা তাতে ভিটেমাটি কয়জনের অবশিষ্ট থাকবে সেটাও বিরাট একটা প্রশ্ন। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে কোনোরকমে খেয়েপরে বেঁচে থাকাও কষ্টকর হয়ে যাবে। তার ওপর সুযোগসন্ধানীদের এত বিশাল উদর ভরাতে গেলে ভিটেমাটিতেও কুলোবে না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমাদের মাসিক ভাতা, শিক্ষা ভাতা, চিকিৎসা ভাতা কিছুই চাই না। শুধু তথাকথিত স্পেশাল স্কুলের নামে গজিয়ে উঠা শিকারীর ফাঁদগুলোর দিকে একটু নজর দিন।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ]