alt

উপ-সম্পাদকীয়

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও মানসিক স্বাস্থ্য সংকট

মতিউর রহমান

: মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৪

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, সহিংসতা, এবং সরকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়াগুলো দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং মানসিক স্থিতিশীলতাকে বারবার নাড়া দিয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব শুধু রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সাধারণ জনগণের জীবনের প্রতিটি স্তরেই প্রভাব ফেলে। একদিকে যেমন দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যও চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ক্রমাগত অনিশ্চয়তা, হিংসা এবং রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, এবং হতাশা মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে জনগণের দৈনন্দিন জীবনে অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পায়। কর্মজীবী মানুষ তাদের কাজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকেন, শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা জীবন নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে, এবং ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা অব্যাহত রাখতে সমর্থ হন না। এই ধরনের অনিশ্চয়তার ফলস্বরূপ, মানসিক চাপ এবং উদ্বেগের মাত্রা বেড়ে যায়। অনেক মানুষ তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অসন্তোষের মুখোমুখি হন, যা মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের এক বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাবে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ হয়ে যায় অথবা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা কঠিন হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ এবং হতাশা বেড়ে যায়, কারণ তারা তাদের শিক্ষার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয় না। প্রতিনিয়ত ধর্মঘট, অবরোধ, এবং সহিংস প্রতিবাদের কারণে শিক্ষাব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়, যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। এই ধরনের পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যে গভীর প্রভাব ফেলে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে সহিংসতার সঙ্গে সম্পর্কিত। হামলা ভাঙচুর, সড়ক অবরোধ, গাড়ি পোড়ানো এবং রাজনৈতিক সমাবেশে সহিংস আক্রমণ প্রায়ই সাধারণ মানুষের জীবনে হুমকি সৃষ্টি করে। এসব সহিংসতা এবং আতঙ্ক মানুষের মনের ওপর গভীর আঘাত হানে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। বিশেষত, নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে এই ধরনের পরিস্থিতি ভয়ানক মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, শিক্ষার পরিবেশ, এবং সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হয়। এই মানসিক আঘাত থেকে সৃষ্ট উদ্বেগ, হতাশা, এবং ট্রমা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্রমাগত দুর্বল করে তোলে। রাজনৈতিক সহিংসতা এবং অস্থিতিশীলতা কেবল যে সাধারণ মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তা নয়, এটি দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাতেও প্রভাব ফেলে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোতে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা কঠিন হয়ে পড়ে। চিকিৎসা সরবরাহে বাধা সৃষ্টি হয়, যা মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অভাবে অনেক মানুষ মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েও যথাযথ চিকিৎসা নিতে পারে না, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময়গুলোতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হওয়ার কারণে রাজনৈতিক সহিংসতা এবং সংঘাতের সময় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। তাদের জীবিকা নির্বাহের উপায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তারা তাদের পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। এই ধরনের অনিশ্চয়তা এবং দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তারা ক্রমাগত মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং হতাশার মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হয়, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাবে বাংলাদেশের জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির আরেকটি বড় কারণ হলো গণমাধ্যম এবং সামাজিক মিডিয়ার প্রভাব। প্রতিনিয়ত সহিংসতা, হতাহতের খবর এবং রাজনৈতিক সহিংসতার ছবি দেখে জনগণ ভয় এবং উদ্বেগে ভুগতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিভাজনমূলক বক্তব্য এবং হিংসাত্মক কর্মকা-ের প্রচার মানুষকে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ক্রমাগত এই ধরনের সংবাদ এবং বিতর্কিত বিষয়গুলো মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ বাড়ায়। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময় পারিবারিক এবং সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেও সংকট দেখা দেয়। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা এবং সম্পর্ক নষ্ট হতে শুরু করে, যা মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে। পরিবার এবং বন্ধুদের মধ্যেও মতবিরোধ এবং রাজনৈতিক বিরোধ দেখা দেয়, যা মানসিক চাপের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রাজনৈতিক মতবিরোধ থেকে সম্পর্ক ভেঙে পড়ে, যা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। প্রথমত, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময় জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও কার্যকর এবং প্রবেশযোগ্য করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং এই সেবাগুলো জনগণের কাছে সহজলভ্য করে তোলা উচিত। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সহিংসতা এড়িয়ে চলার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা জরুরি। রাজনৈতিক সমাবেশ এবং কার্যক্রমগুলোতে সহিংসতা এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এছাড়া, গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। জনগণকে সঠিক এবং নিরপেক্ষ তথ্য প্রদান করা উচিত, যাতে তারা ভয় এবং উদ্বেগে ভুগতে না হয়। তৃতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতি থেকে দূরে রেখে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি আরও মনোযোগী হওয়া উচিত। শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতা বজায় রাখার জন্য বিশেষ মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শদাতা নিয়োগ করা যেতে পারে এবং তাদের মানসিক সুস্থতার জন্য সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে উদ্ভূত মানসিক স্বাস্থ্য সংকট একটি বড় সমস্যা, যা দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। সমাজের প্রতিটি স্তরে রাজনৈতিক সহিংসতা এবং অস্থিরতা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে, যা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ জরুরি।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

হাওয়া লেগেছে রেমিট্যান্সের পালে

যুব সম্প্রদায়ের শহরমুখিতা

ছবি

‘ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’ জেগেছিল যে চির-বিস্ময়, তা কি নৈরাজ্যে হারিয়ে যাবে

পে-স্কেল যেন একটি দীর্ঘশ্বাস

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চিঠি ও খ্রিস্টান চার্চ

বর্ষা পেরিয়ে যাওয়ার পরও ডেঙ্গু আতঙ্ক

বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান কোন পথে

ধূমপান ছেড়ে দিলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে

প্রসঙ্গ : শিক্ষা জাতীয়করণ

ছবি

বিশ্ববাসীর নজর আমেরিকায়, কিন্তু কেন?

মূল্যস্ফীতি কমাতে কেন কোনো ফর্মুলাই কাজ করছে না?

ছবি

তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বের সৌন্দর্যের সন্ধানে

মধ্যপ্রাচ্য সংকট

গাজায় মানবিক সংকট

প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন গ্রেডে সংস্কার দরকার

ফিকে হচ্ছে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়ন, এআই এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন পথ

অতীতটা হয়ে যাক দূর

রম্যগদ্য: নিমক-হারাম

হ্যালোইনে আমি একা

প্রসঙ্গ : প্রতিযোগিতামূলক দর

ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ, ফ্যাসিবাদী প্রবণতা কি বন্ধ হয়েছে

ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের সমস্যা

মানুষ গড়ার কারিগর

‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’

বাদ, প্রতিবাদ ও সম্বাদ

জলবায়ুর পরিবর্তন নির্ণয়ে প্রযুক্তি

অটিজম প্রতিরোধ ও প্রতিকারে করণীয়

বাজারে কৃষিপণ্যের দাম কেন বেশি?

জাতিসংঘ ভবন

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ

ধর্মভিত্তিক জোট কোন পথে

ছবি

বিদায় অগ্নিকন্যা

রিমান্ড সংস্কৃতি : আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটি মানবাধিকার পরিপ্রেক্ষিত

ছবি

ডেঙ্গুজ্বর : সচেতনতার বিকল্প নেই

ছবি

উন্নয়ন ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য রাখা কেন জরুরি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও মানসিক স্বাস্থ্য সংকট

মতিউর রহমান

মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৪

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, সহিংসতা, এবং সরকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়াগুলো দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং মানসিক স্থিতিশীলতাকে বারবার নাড়া দিয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব শুধু রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সাধারণ জনগণের জীবনের প্রতিটি স্তরেই প্রভাব ফেলে। একদিকে যেমন দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যও চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ক্রমাগত অনিশ্চয়তা, হিংসা এবং রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, এবং হতাশা মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে জনগণের দৈনন্দিন জীবনে অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পায়। কর্মজীবী মানুষ তাদের কাজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকেন, শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা জীবন নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে, এবং ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা অব্যাহত রাখতে সমর্থ হন না। এই ধরনের অনিশ্চয়তার ফলস্বরূপ, মানসিক চাপ এবং উদ্বেগের মাত্রা বেড়ে যায়। অনেক মানুষ তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অসন্তোষের মুখোমুখি হন, যা মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের এক বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাবে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ হয়ে যায় অথবা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা কঠিন হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ এবং হতাশা বেড়ে যায়, কারণ তারা তাদের শিক্ষার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয় না। প্রতিনিয়ত ধর্মঘট, অবরোধ, এবং সহিংস প্রতিবাদের কারণে শিক্ষাব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়, যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। এই ধরনের পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যে গভীর প্রভাব ফেলে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে সহিংসতার সঙ্গে সম্পর্কিত। হামলা ভাঙচুর, সড়ক অবরোধ, গাড়ি পোড়ানো এবং রাজনৈতিক সমাবেশে সহিংস আক্রমণ প্রায়ই সাধারণ মানুষের জীবনে হুমকি সৃষ্টি করে। এসব সহিংসতা এবং আতঙ্ক মানুষের মনের ওপর গভীর আঘাত হানে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। বিশেষত, নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে এই ধরনের পরিস্থিতি ভয়ানক মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, শিক্ষার পরিবেশ, এবং সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হয়। এই মানসিক আঘাত থেকে সৃষ্ট উদ্বেগ, হতাশা, এবং ট্রমা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্রমাগত দুর্বল করে তোলে। রাজনৈতিক সহিংসতা এবং অস্থিতিশীলতা কেবল যে সাধারণ মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তা নয়, এটি দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাতেও প্রভাব ফেলে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোতে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা কঠিন হয়ে পড়ে। চিকিৎসা সরবরাহে বাধা সৃষ্টি হয়, যা মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অভাবে অনেক মানুষ মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েও যথাযথ চিকিৎসা নিতে পারে না, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময়গুলোতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হওয়ার কারণে রাজনৈতিক সহিংসতা এবং সংঘাতের সময় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। তাদের জীবিকা নির্বাহের উপায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তারা তাদের পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। এই ধরনের অনিশ্চয়তা এবং দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তারা ক্রমাগত মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং হতাশার মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হয়, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাবে বাংলাদেশের জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির আরেকটি বড় কারণ হলো গণমাধ্যম এবং সামাজিক মিডিয়ার প্রভাব। প্রতিনিয়ত সহিংসতা, হতাহতের খবর এবং রাজনৈতিক সহিংসতার ছবি দেখে জনগণ ভয় এবং উদ্বেগে ভুগতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিভাজনমূলক বক্তব্য এবং হিংসাত্মক কর্মকা-ের প্রচার মানুষকে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ক্রমাগত এই ধরনের সংবাদ এবং বিতর্কিত বিষয়গুলো মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ বাড়ায়। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময় পারিবারিক এবং সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেও সংকট দেখা দেয়। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা এবং সম্পর্ক নষ্ট হতে শুরু করে, যা মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে। পরিবার এবং বন্ধুদের মধ্যেও মতবিরোধ এবং রাজনৈতিক বিরোধ দেখা দেয়, যা মানসিক চাপের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রাজনৈতিক মতবিরোধ থেকে সম্পর্ক ভেঙে পড়ে, যা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। প্রথমত, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময় জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও কার্যকর এবং প্রবেশযোগ্য করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং এই সেবাগুলো জনগণের কাছে সহজলভ্য করে তোলা উচিত। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সহিংসতা এড়িয়ে চলার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা জরুরি। রাজনৈতিক সমাবেশ এবং কার্যক্রমগুলোতে সহিংসতা এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এছাড়া, গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। জনগণকে সঠিক এবং নিরপেক্ষ তথ্য প্রদান করা উচিত, যাতে তারা ভয় এবং উদ্বেগে ভুগতে না হয়। তৃতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতি থেকে দূরে রেখে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি আরও মনোযোগী হওয়া উচিত। শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতা বজায় রাখার জন্য বিশেষ মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শদাতা নিয়োগ করা যেতে পারে এবং তাদের মানসিক সুস্থতার জন্য সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে উদ্ভূত মানসিক স্বাস্থ্য সংকট একটি বড় সমস্যা, যা দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। সমাজের প্রতিটি স্তরে রাজনৈতিক সহিংসতা এবং অস্থিরতা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে, যা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ জরুরি।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

back to top