জিয়াউদ্দীন আহমেদ
১৭ ডিসেম্বর ২০২৪। ভোরবেলায় গাজীপুরের টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সা’দ কান্ধলভীর অনুসারীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধে এবং এই সংঘর্ষে নিহত হন ৪ জন, আহত শতাধিক। মাওলানা সা’দপন্থিদের জোড় ইজতেমা ঠেকাতে মাওলানা মামুনুল হক ইজতেমা মাঠে অবস্থানের ঘোষণা দিলে ইজতেমা মাঠে দলে দলে প্রবেশ করতে থাকেন জুবায়ের অনুসারীরা। সংঘর্ষের পর যে মামুনুল হক সা’দপন্থিদের সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধ করার দাবি করছেন, সেই মামুনুল হক সংঘর্ষের আগে সা’দপন্থিদের ইজতেমা ময়দানে প্রবেশ বন্ধ করতে প্রয়োজনে তুরাগ নদী রক্তে লাল করে দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। মামুনুল হকের এমন হুঙ্কারে দুইপক্ষের সংঘর্ষ শুধু ইজতেমার মাঠেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ঢাকা শহরের বহু এলাকায় তা ছড়িয়ে পড়েছে।
রোগী নিয়ে আসা এক সা’দপন্থিকে হাসপাতাল থেকে ধরে এনে প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত লোকের সম্মুখে জোর করে সিএনজিতে তুলতে দেখা গেল জুবায়েরপন্থিদের। জনগণের জিজ্ঞাসার উত্তরে সন্ত্রাসীরা জানালো যে, কাকরাইল মসজিদে তার বিচার হবে। এমন দৃশ্য সিনেমায় দেখা গেলেও বাস্তবে ড্রাগ-কার্টেল কবলিত কলম্বিয়াও মাঝে মাঝে দেখা যায়।
মূলত ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সুন্নি মুসলমানদের বৃহত্তম সংগঠন তাবলিগ জামাত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ২০১৮ সালে গাজীপুরের টঙ্গী ইজতেমার ময়দানে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে নিহত হয় দুজন ও আহত শতাধিক। মাওলানা জুবায়েরপন্থিদের সঙ্গে মাওলানা সা’দপন্থিদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আগে-পরে দুপক্ষের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শুনে মনে হতে পারে, ইজতেমার মাঠ তাদের অবাধে ছেড়ে দেওয়া হলে সেই মাঠকে যুদ্ধের ময়দান বানাতে তাদের বেশি সময় লাগবে না। ইজতেমার মাঠে শীর্ষ আলেমদের বয়ান হচ্ছেÑ ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’, অথচ বাস্তবে কী দেখা যায়Ñ বাস্তবে তারাই অশান্তির মূল হোতা। শান্ত-নিরীহ প্রকৃতির তাবলিগের আলেমরাও যে প্রয়োজনে হিংস্র হয়ে ওঠতে পারে তার নমুনা কয়েক দিন ধরে জনগণ অবলোকন করছে। মুমিনের হত্যাকারী জাহান্নামি- কোরআনের এই অমোঘ বাণী তাদের কাছে তাৎপর্যহীন।
ধর্মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ লেগেই আছে। ওয়াজে এক আলেম আরেক আলেমকে ‘কাফের’, ‘মুনাফেক’, ‘বাটপার’ ইত্যাদি বলে ক্ষান্ত থাকে না, পায়ের জুতা প্রদর্শন করে পেটানোর হুমকি দেয়। ১৯২০ সালের দিকে তাবলিগ জামাতের শুরু; মাওলানা সা’দের দাদা এই আন্দোলনের সূচনা করেন। প্রথম দিকে এই সংস্কারবাদী আন্দোলনের আমিরত্ব একজনের ওপর ন্যাস্ত করা করা ছিলো, পরবর্তীতে তা দেয়া হয় একটি শূরা কমিটির ওপর। তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটির দুজন ইন্তেকাল করলে কমিটির অবশিষ্ট একমাত্র সদস্য মাওলানা সা’দ তাবলিগ জামাতের আমির হিসেবে একক দায়িত্ব নিয়ে নেন।
অন্যদিকে মাওলানা জুবায়েরের ছেলেও আমির হওয়ার দাবি করে বসেন। এভাবে ক্ষমতার ভাগ নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বের আরেকটি কারণ হচ্ছে মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াসের নাতি মাওলানা সা’দ কান্ধলভির ইসলাম সম্পর্কে কিছু বক্তব্য।
মাওলানা সা’দের যেসব ফতোয়া বিতর্কের সৃষ্টি করেছে তার একটি হচ্ছেÑ ‘বিনিময় নিয়ে কোরআনে কারিম পড়ানো নোংরা নারীর (বেশ্যা) বিনিময়ের মতো। নোংরা নারী তার আগে জান্নাতে যাবে।’ তাবিজ, পানিপড়া দিয়ে টাকা কামানো, অথবা মিলাদ বা ওয়াজ করে টাকা নেওয়ার বিপক্ষে এমন ফতোয়া দেওয়ার কারণে বাংলাদশের অধিকাংশ মাওলানা সঙ্গতকারণেই তার ওপর ক্ষেপেছেন। নবী মুসা (আ.) সম্পর্কে মাওলানা সা’দের বক্তব্য হচ্ছেÑ ‘মুসা আলাইহিস সালাম নিজের জাতির মধ্যে দাওয়াতের কাজ ছেড়ে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্যে নির্জনবাসে চলে যাওয়ার কারণে ৫ লাখ ৮৮ হাজার বনি ইসরাইল গোমরাহ হয়ে যায়।’ তার আরেকটি উক্তি হচ্ছে- ‘হযরত মুসা (আ.) কর্তৃক নিজের ভাই হারুনের জন্য আল্লাহর কাছে নব্যুয়ত চাওয়াও উচিত হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, আল্লাহর জিকির করলে বা না বুঝে কোরআন পড়লে কিছুই অর্জন হয় না। তার আরেকটি মন্তব্য আলেমদের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তিনি মনে করেন, হেদায়েত যদি আল্লাহর হাতেই থেকে থাকে, তাহলে তিনি কেন নবীদের প্রেরণ করেছেন।
তাবলিগ জামাত মূলত ধর্মীয় বিষয়ে মুসলমানদের অধিকতর সচেতন করার কাজ করে থাকে। তাদের এমন কাজের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-পর্যালাচনা অহর্নিশ চলছে। ষাটের দশক থেকে প্রতি বছর টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বিশ্ব ইজতেমায় একত্রিত হন তাবলিগ জামাতের অনুসারীরা। ধীরে ধীরে ইজতেমায় লোকসংখ্যা বাড়তে থাকায় ২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে ইজতেমার আয়োজন শুরু হয়। প্রথমে এই দুই ভাগে কোন পন্থির লোক চিহ্নিত ছিল না। পরবর্তীকালে ইজতেমার দুই পর্ব জুবায়ের ও সা’দপন্থিদের মধ্যে বণ্টন করার দায়িত্ব পালন করতে থাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জুবায়েরপন্থিরা অধিকতর শক্তিশালী হওয়ায় একবার মাওলানা সা’দ বাংলাদেশে এসেও ইজতেমায় যোগ দিতে পারেননি, পুলিশের সহায়তায় তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল কাকরাইল মসজিদে। হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীর উপস্থিতিতে তাবলিগ জামাতের একাংশের এক সম্মেলনে সা’দকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এরপর তিনি আর কখনো বাংলাদেশে আসেননি।
যে ১১ জন শূরা সদস্য বাংলাদেশে তাবলিগের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন তাদের মধ্যে কাকরাইল মসজিদের খতিব মুহাম্মাদ জুবায়েরের নেতৃত্বে পাঁচজন সা’দের বিপক্ষে এবং বাকি ছয়জন আরেক প্রভাবশালী শূরা সদস্য সৈয়দ ওয়াসিফ ইসলামের নেতৃত্বে সা’দের পক্ষে অবস্থান নেন। এতে দুপক্ষের আলেমদের মধ্যে শুধু বিরোধ আর বিক্ষোভ নয়, কাকরাইল মসজিদ দখল, পাল্টা দখল ও সহিংসতার ঘটনাও ঘটছে। জুবায়েরপন্থিরা মাওলানা সা’দকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ক্ষান্ত হয়নি, বাংলাদেশের তাবলিগ জামাতের কোনো ব্যক্তিকে তাবলিগ জামাতের বৈশ্বিক কেন্দ্রস্থল দিল্লির নিজামুদ্দিন বাংলাওয়ালি মসজিদে পাঠানো বন্ধ রেখেছে। ভারত, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের তাবলিগ জামাতের আলেমদের বিরোধ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তাবলিগ মুসল্লিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। এই দ্বন্দ্বের প্রভাবে মালয়েশিয়া, আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতেও তাবলিগ জামাতের নেতৃত্বে বিভক্তি দেখা দিয়েছে।
পৃথিবীর এমন কোন ভূখ- নেই, যেখানে এই তাবলিগ জামাতের লোক ইসলাম ধর্মের দাওয়াত নিয়ে যায়নি। তাবলিগ জামাতের লোকজন অলি-গলি, হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাট সর্বত্র যাকেই পায় তার কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়। সাধারণত মানুষকে আখিরাত, ইমান, আমল ইত্যাদির কথা বলে তিন দিন, সাত দিন ও চল্লিশ দিনের চিল্লায় আল্লাহর রাস্তায় উদ্বুদ্ধ করাই তাবলিগ জামাতের মূল লক্ষ্য। পরিবারের সদস্যদের রেখে চল্লিশ দিনের জন্য চিল্লায় যাওয়া নিয়ে মতভেদ থাকলেও তাদের নম্রতা ও ধৈর্য সর্বত্র প্রশংসনীয়। নিচু স্বরে ধীরে-সুস্থে কথা বলা, রাগ না করা, বিরক্তি প্রকাশ না করা ইত্যাদি হচ্ছে তাবলিগ জামাতিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু উদ্ভূত এই রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি তাবলিগ জামাতের শান্ত ও নিরীহ ভাবমূর্তি নষ্ট করে দিয়েছে। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে তাবলিগের জামাতিরা যখন একই থালায় একই তরকারি দিয়ে সবাই একত্রে হাত ডুবিয়ে খাবার খায় তখন কী কেউ ভাবতে পারে যে এরাও নেতৃত্বের জন্য প্রতিপক্ষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে! লাইন বেঁধে সৃষ্টিকর্তার প্রতি যাদের বিনা শর্তে আত্মসমর্পণের তাগিদ রয়েছে, যাদের আল্লাহ-ভীতি সন্দেহাতীতভাবে দৃশ্যমান, তারা যদি যুক্তি দিয়ে সমস্যার সমাধান না করে শক্তি দিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান তাহলে তাদের দাওয়াতে সাধারণ মুসল্লিরা সাড়া দেবেন কেন?
টঙ্গীর কয়েক একরের একটি ছোট জায়গার দখল নিয়ে তাবলিগের লোকেরা যেভাবে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত, একটি গোটা দেশের ক্ষমতার জন্য এরা সুযোগ পেলে বাংলাদেশকে কারবালার প্রান্তর বানিয়ে ফেলবে।
লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
রোববার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪
১৭ ডিসেম্বর ২০২৪। ভোরবেলায় গাজীপুরের টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সা’দ কান্ধলভীর অনুসারীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধে এবং এই সংঘর্ষে নিহত হন ৪ জন, আহত শতাধিক। মাওলানা সা’দপন্থিদের জোড় ইজতেমা ঠেকাতে মাওলানা মামুনুল হক ইজতেমা মাঠে অবস্থানের ঘোষণা দিলে ইজতেমা মাঠে দলে দলে প্রবেশ করতে থাকেন জুবায়ের অনুসারীরা। সংঘর্ষের পর যে মামুনুল হক সা’দপন্থিদের সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধ করার দাবি করছেন, সেই মামুনুল হক সংঘর্ষের আগে সা’দপন্থিদের ইজতেমা ময়দানে প্রবেশ বন্ধ করতে প্রয়োজনে তুরাগ নদী রক্তে লাল করে দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। মামুনুল হকের এমন হুঙ্কারে দুইপক্ষের সংঘর্ষ শুধু ইজতেমার মাঠেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ঢাকা শহরের বহু এলাকায় তা ছড়িয়ে পড়েছে।
রোগী নিয়ে আসা এক সা’দপন্থিকে হাসপাতাল থেকে ধরে এনে প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত লোকের সম্মুখে জোর করে সিএনজিতে তুলতে দেখা গেল জুবায়েরপন্থিদের। জনগণের জিজ্ঞাসার উত্তরে সন্ত্রাসীরা জানালো যে, কাকরাইল মসজিদে তার বিচার হবে। এমন দৃশ্য সিনেমায় দেখা গেলেও বাস্তবে ড্রাগ-কার্টেল কবলিত কলম্বিয়াও মাঝে মাঝে দেখা যায়।
মূলত ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সুন্নি মুসলমানদের বৃহত্তম সংগঠন তাবলিগ জামাত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ২০১৮ সালে গাজীপুরের টঙ্গী ইজতেমার ময়দানে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে নিহত হয় দুজন ও আহত শতাধিক। মাওলানা জুবায়েরপন্থিদের সঙ্গে মাওলানা সা’দপন্থিদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আগে-পরে দুপক্ষের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শুনে মনে হতে পারে, ইজতেমার মাঠ তাদের অবাধে ছেড়ে দেওয়া হলে সেই মাঠকে যুদ্ধের ময়দান বানাতে তাদের বেশি সময় লাগবে না। ইজতেমার মাঠে শীর্ষ আলেমদের বয়ান হচ্ছেÑ ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’, অথচ বাস্তবে কী দেখা যায়Ñ বাস্তবে তারাই অশান্তির মূল হোতা। শান্ত-নিরীহ প্রকৃতির তাবলিগের আলেমরাও যে প্রয়োজনে হিংস্র হয়ে ওঠতে পারে তার নমুনা কয়েক দিন ধরে জনগণ অবলোকন করছে। মুমিনের হত্যাকারী জাহান্নামি- কোরআনের এই অমোঘ বাণী তাদের কাছে তাৎপর্যহীন।
ধর্মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ লেগেই আছে। ওয়াজে এক আলেম আরেক আলেমকে ‘কাফের’, ‘মুনাফেক’, ‘বাটপার’ ইত্যাদি বলে ক্ষান্ত থাকে না, পায়ের জুতা প্রদর্শন করে পেটানোর হুমকি দেয়। ১৯২০ সালের দিকে তাবলিগ জামাতের শুরু; মাওলানা সা’দের দাদা এই আন্দোলনের সূচনা করেন। প্রথম দিকে এই সংস্কারবাদী আন্দোলনের আমিরত্ব একজনের ওপর ন্যাস্ত করা করা ছিলো, পরবর্তীতে তা দেয়া হয় একটি শূরা কমিটির ওপর। তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটির দুজন ইন্তেকাল করলে কমিটির অবশিষ্ট একমাত্র সদস্য মাওলানা সা’দ তাবলিগ জামাতের আমির হিসেবে একক দায়িত্ব নিয়ে নেন।
অন্যদিকে মাওলানা জুবায়েরের ছেলেও আমির হওয়ার দাবি করে বসেন। এভাবে ক্ষমতার ভাগ নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বের আরেকটি কারণ হচ্ছে মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াসের নাতি মাওলানা সা’দ কান্ধলভির ইসলাম সম্পর্কে কিছু বক্তব্য।
মাওলানা সা’দের যেসব ফতোয়া বিতর্কের সৃষ্টি করেছে তার একটি হচ্ছেÑ ‘বিনিময় নিয়ে কোরআনে কারিম পড়ানো নোংরা নারীর (বেশ্যা) বিনিময়ের মতো। নোংরা নারী তার আগে জান্নাতে যাবে।’ তাবিজ, পানিপড়া দিয়ে টাকা কামানো, অথবা মিলাদ বা ওয়াজ করে টাকা নেওয়ার বিপক্ষে এমন ফতোয়া দেওয়ার কারণে বাংলাদশের অধিকাংশ মাওলানা সঙ্গতকারণেই তার ওপর ক্ষেপেছেন। নবী মুসা (আ.) সম্পর্কে মাওলানা সা’দের বক্তব্য হচ্ছেÑ ‘মুসা আলাইহিস সালাম নিজের জাতির মধ্যে দাওয়াতের কাজ ছেড়ে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্যে নির্জনবাসে চলে যাওয়ার কারণে ৫ লাখ ৮৮ হাজার বনি ইসরাইল গোমরাহ হয়ে যায়।’ তার আরেকটি উক্তি হচ্ছে- ‘হযরত মুসা (আ.) কর্তৃক নিজের ভাই হারুনের জন্য আল্লাহর কাছে নব্যুয়ত চাওয়াও উচিত হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, আল্লাহর জিকির করলে বা না বুঝে কোরআন পড়লে কিছুই অর্জন হয় না। তার আরেকটি মন্তব্য আলেমদের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তিনি মনে করেন, হেদায়েত যদি আল্লাহর হাতেই থেকে থাকে, তাহলে তিনি কেন নবীদের প্রেরণ করেছেন।
তাবলিগ জামাত মূলত ধর্মীয় বিষয়ে মুসলমানদের অধিকতর সচেতন করার কাজ করে থাকে। তাদের এমন কাজের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-পর্যালাচনা অহর্নিশ চলছে। ষাটের দশক থেকে প্রতি বছর টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বিশ্ব ইজতেমায় একত্রিত হন তাবলিগ জামাতের অনুসারীরা। ধীরে ধীরে ইজতেমায় লোকসংখ্যা বাড়তে থাকায় ২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে ইজতেমার আয়োজন শুরু হয়। প্রথমে এই দুই ভাগে কোন পন্থির লোক চিহ্নিত ছিল না। পরবর্তীকালে ইজতেমার দুই পর্ব জুবায়ের ও সা’দপন্থিদের মধ্যে বণ্টন করার দায়িত্ব পালন করতে থাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জুবায়েরপন্থিরা অধিকতর শক্তিশালী হওয়ায় একবার মাওলানা সা’দ বাংলাদেশে এসেও ইজতেমায় যোগ দিতে পারেননি, পুলিশের সহায়তায় তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল কাকরাইল মসজিদে। হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীর উপস্থিতিতে তাবলিগ জামাতের একাংশের এক সম্মেলনে সা’দকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এরপর তিনি আর কখনো বাংলাদেশে আসেননি।
যে ১১ জন শূরা সদস্য বাংলাদেশে তাবলিগের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন তাদের মধ্যে কাকরাইল মসজিদের খতিব মুহাম্মাদ জুবায়েরের নেতৃত্বে পাঁচজন সা’দের বিপক্ষে এবং বাকি ছয়জন আরেক প্রভাবশালী শূরা সদস্য সৈয়দ ওয়াসিফ ইসলামের নেতৃত্বে সা’দের পক্ষে অবস্থান নেন। এতে দুপক্ষের আলেমদের মধ্যে শুধু বিরোধ আর বিক্ষোভ নয়, কাকরাইল মসজিদ দখল, পাল্টা দখল ও সহিংসতার ঘটনাও ঘটছে। জুবায়েরপন্থিরা মাওলানা সা’দকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ক্ষান্ত হয়নি, বাংলাদেশের তাবলিগ জামাতের কোনো ব্যক্তিকে তাবলিগ জামাতের বৈশ্বিক কেন্দ্রস্থল দিল্লির নিজামুদ্দিন বাংলাওয়ালি মসজিদে পাঠানো বন্ধ রেখেছে। ভারত, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের তাবলিগ জামাতের আলেমদের বিরোধ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তাবলিগ মুসল্লিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। এই দ্বন্দ্বের প্রভাবে মালয়েশিয়া, আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতেও তাবলিগ জামাতের নেতৃত্বে বিভক্তি দেখা দিয়েছে।
পৃথিবীর এমন কোন ভূখ- নেই, যেখানে এই তাবলিগ জামাতের লোক ইসলাম ধর্মের দাওয়াত নিয়ে যায়নি। তাবলিগ জামাতের লোকজন অলি-গলি, হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাট সর্বত্র যাকেই পায় তার কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়। সাধারণত মানুষকে আখিরাত, ইমান, আমল ইত্যাদির কথা বলে তিন দিন, সাত দিন ও চল্লিশ দিনের চিল্লায় আল্লাহর রাস্তায় উদ্বুদ্ধ করাই তাবলিগ জামাতের মূল লক্ষ্য। পরিবারের সদস্যদের রেখে চল্লিশ দিনের জন্য চিল্লায় যাওয়া নিয়ে মতভেদ থাকলেও তাদের নম্রতা ও ধৈর্য সর্বত্র প্রশংসনীয়। নিচু স্বরে ধীরে-সুস্থে কথা বলা, রাগ না করা, বিরক্তি প্রকাশ না করা ইত্যাদি হচ্ছে তাবলিগ জামাতিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু উদ্ভূত এই রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি তাবলিগ জামাতের শান্ত ও নিরীহ ভাবমূর্তি নষ্ট করে দিয়েছে। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে তাবলিগের জামাতিরা যখন একই থালায় একই তরকারি দিয়ে সবাই একত্রে হাত ডুবিয়ে খাবার খায় তখন কী কেউ ভাবতে পারে যে এরাও নেতৃত্বের জন্য প্রতিপক্ষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে! লাইন বেঁধে সৃষ্টিকর্তার প্রতি যাদের বিনা শর্তে আত্মসমর্পণের তাগিদ রয়েছে, যাদের আল্লাহ-ভীতি সন্দেহাতীতভাবে দৃশ্যমান, তারা যদি যুক্তি দিয়ে সমস্যার সমাধান না করে শক্তি দিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান তাহলে তাদের দাওয়াতে সাধারণ মুসল্লিরা সাড়া দেবেন কেন?
টঙ্গীর কয়েক একরের একটি ছোট জায়গার দখল নিয়ে তাবলিগের লোকেরা যেভাবে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত, একটি গোটা দেশের ক্ষমতার জন্য এরা সুযোগ পেলে বাংলাদেশকে কারবালার প্রান্তর বানিয়ে ফেলবে।
লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]