alt

উপ-সম্পাদকীয়

ঢাকার বাসিন্দাদের নিঃশ্বাসে এক বিপন্নতা

এম এ হোসাইন

: বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশের রাজধানীতে এক ধীরগতির ধ্বংসযজ্ঞ চলছেÑনা, তা কোনো যুদ্ধ কিংবা সন্ত্রাসের নয়, বরং প্রতিটি নিঃশ্বাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক নির্মম বিষের আঘাত। পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর ঢাকা আজ সত্যিই বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করছে। এক সময় শীতকালে শুধু ধোঁয়াশা দেখা যেত, আজ সেই ধোঁয়াশা সারা বছর বিষাক্ত আবরণে রূপ নিয়েছে। ঢাকার বাতাস কেবল অস্বাস্থ্যকর নয়, বরং তা একপ্রকার গণবিধ্বংসী অস্ত্রের রূপ ধারণ করেছে। যুদ্ধের যেমন বিজয়ী থাকে এখানে তা নেইÑআছে শুধু লাখ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ।

ঢাকায় বায়ুদূষণ কোনো পরিসংখ্যানগত বিচ্যুতি নয় বরং এটি একটি পূর্ণমাত্রার জরুরি অবস্থা। আইকিউএয়ার-এর বৈশ্বিক সূচক অনুযায়ী, ঢাকা নিয়মিতভাবেই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর শীর্ষে থাকে। এখানে পিএম-২.৫ (একধরনের সূক্ষ্ম কণা যা ফুসফুস ক্যানসার, স্ট্রোক ও হৃদরোগের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত) এর মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরাপদ সীমা থেকে ১৬-২০ গুণ বেশি। এসব কণা কেবল বাতাসে ভেসে বেড়ায় না, তারা ঢুকে পড়ে আমাদের রক্তপ্রবাহে, আমাদের সন্তানের ফুসফুসে, এবং হাজারো মৃত্যুর চূড়ান্ত চিকিৎসা প্রতিবেদনে।

পরিসংখ্যানই যথেষ্ট আঁতকে ওঠার মতো। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি এন্ড ক্লিন এয়ার-এর গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১,০২,৪৫৬ জন মানুষের অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী বায়ুদূষণÑযার বেশিরভাগই ঘটে রাজধানী ঢাকায়। সেন্টার ফর এটমোস্ফরিক পলিউশন স্টাডিজ-এর গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার একজন সাধারণ বাসিন্দা দীর্ঘমেয়াদি দূষণের প্রভাবে প্রায় সাত বছর পর্যন্ত তার গড়আয়ু হারাচ্ছেন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও শিল্পখাতে উন্নয়নকে নিয়ে যে দেশ গর্ব করে, এ বাস্তবতা সেখানে এক গভীর জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কিছু নয়।

এবং সরাসরি বলিÑএই সংকট আকাশ থেকে পড়েনি। দোষীরা দৃশ্যমান, চিহ্নিত, এবং লজ্জাজনকভাবে সহনীয় হয়ে উঠেছে। যানবাহনের নৈরাজ্য থেকেই শুরু করি। ঢাকার রাস্তাগুলো এক বিশৃঙ্খল নৈরাজ্যের মূর্ত প্রতীকÑপুরনো ডিজেলচালিত ট্রাক, নিয়ন্ত্রণহীন বাস, আর দুই-স্ট্রোক অটোরিকশার বিশাল বাহিনী বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে চলেছে। ধোঁয়া নির্গমন পরীক্ষার কার্যত কোন ব্যবস্থা নেই। ক্যাটালিটিক কনভার্টার এখানে যেন কোনো পৌরাণিক যন্ত্র।

তারপর আছে ইটভাটাÑরাজধানী ও আশেপাশে চলছে প্রায় সাত হাজার ইটভাটা, যেগুলোর বেশিরভাগই কয়লা, কাঠ এমনকি টায়ার পুড়িয়ে শতাব্দীপ্রাচীন পদ্ধতিতে চলছে। শুধু এই ইটভাটাগুলো ঢাকার শীতকালীন পিএম২.৫ দূষণের অর্ধেকেরও বেশি জোগান দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত করে কারখানার দূষণ, নির্মাণস্থলের ধুলাবালি, খোলা জায়গায় আবর্জনা পোড়ানো, এবং চুল্লির ধোঁয়াÑএকটি নগর ব্যবস্থা যেন নিজ বাসিন্দাদের ধ্বংস করে গড়ে উঠছে।

এই সমস্যা ঢাকার সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পাঞ্চল থেকে আসা দূষণ বাংলাদেশের আকাশে এসে মেশে। এই আন্তঃসীমান্ত ধোঁয়াশা যেমন রাজনৈতিক সীমারেখা মানে না, তেমনি এ বিষয়ক আঞ্চলিক সহযোগিতা এখনও কূটনীতির মূল আলোচনার বাইরে। এই দূষণের মানবিক মূল্য অপরিসীম। একইসাথে অর্থনৈতিক ক্ষতিও বিপুল। বিশ্ব ব্যাংকের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের বছরে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়, যা দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশÑএই অঙ্ক দেশের পুরো গার্মেন্টস রপ্তানি আয়ের সমান।

এ যেন এক আত্মঘাতী স্বীদ্ধান্ত; বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চায়, পর্যটন বাড়াতে চায়। অথচ তার রাজধানী শহর ঢাকা হয়ে উঠছে বসবাস অযোগ্যদের তালিকায় বিশ্বের প্রথম সারির একটি। এ শহরে কেউ কেন করপোরেট হেডকোয়ার্টার বানাবে, কনফারেন্স করতে আসবে, কিংবা ট্রাভেল ডকুমেন্টারি বানাতে চাইবেÑযেখানে বাইরে বের হওয়াই স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি? এমন এক অস্তিত্ব সংকটের মুখে সরকার জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেবেÑএটাই তো স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। কিছু পুরনো যানবাহন বাতিল হয়েছে, হ্যাঁ। কিছু মৌসুমি অভিযানও হয় ইটভাটার বিরুদ্ধে। কিন্তু এগুলো ছেঁড়া কাঁথায় পট্টি দেয়ার মতোÑঅভিযান ক্ষণস্থায়ী, জরিমানা হাস্যকর, আর রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রায় অনুপস্থিত।

বাংলার চিরায়ত একটা উক্তি এ ক্ষেত্রে খুব প্রাসঙ্গিক: “কেউ যদি ঘুমিয়ে থাকে তাহলে তাকে জাগানো সহজ কিন্তু কেউ যদি জেগে থেকে ঘুমের ভান করে, তাকে জাগানো সহজ নয়।” যারা এই দূষণের জন্য দায়ী, তারা কোনো অজানা শিল্পপতি নয়Ñতারা প্রায়শই প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, সংসদ সদস্য, বা ক্ষমতাসীন দলের পৃষ্ঠপোষক। বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শহরের সাধারণ মানুষগুলোÑযাদের অভিযোজনের ক্ষমতা কম, কণ্ঠস্বরের তীক্ষতা আরও কম।

সমাধান আছে। একেবারে নতুন কিছু নয়। ব্যয়বহুলও নয়। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক সংকল্প।

শুরু হোক গণপরিবহনকে বৈদ্যুতিক করার মাধ্যমে। ঢাকার বাস ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিদ্যুৎচালিত ও কম-দূষণকারীতে রূপান্তর করতে হবেÑযা সবুজ বন্ড বা জলবায়ু অভিযোজন তহবিল থেকে অর্থায়ন করা যেতে পারে। এরপর ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে সব ইটভাটা বন্ধ করে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন হাইব্রিড হফম্যান ক্লিনে রূপান্তর করতে হবে, বা বিকল্প উপকরণে ঝুঁকতে হবে।

বায়ুদূষণের মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে রিয়েল-টাইম পর্যবেক্ষণ এবং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে। একটি স্বাধীন পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে, যাকে মন্ত্রী কিংবা ব্যবসায়ীরা চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না। এবং যানবাহনের ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণে চালু করতে হবে কনজেশন প্রাইসিংÑযেটি জাকার্তা ও নাইরোবিতেও পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে।

শহরের সবুজ অঞ্চলÑপার্ক, সবুজ বেষ্টনী এবং ভার্টিকেল বাগানÑএইগুলোকে সৌন্দর্যবর্ধনের বাইরে ভাবতে হবে। এগুলো কার্বন শোষণ করে, ক্ষুদ্র আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে, এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য সরাসরি উপকারী। কলম্বিয়ার মেডেলিন শহর “সবুজ করিডোর” ধারণায় আশ্চর্যজনক সাফল্য দেখিয়েছে। তাহলে ঢাকা কেন পারবে নাÑইচ্ছা থাকলে উপায় অবশ্যই আছে।

তবে এই সংকটে সবচেয়ে কম ব্যবহৃত হাতিয়ার হলো জনগণের চাপ। ভাষার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য একদা যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাস্তায় নেমেছিল, আজ তারা পরিবেশ বিপর্যয়কে নিঃশব্দে মেনে নিচ্ছে। তারা নিজেরাই আবর্জনা পুড়িয়ে, অবৈধ জেনারেটর ব্যবহার করে, বা সামান্য কর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এই দুর্যোগকে আরও ত্বরান্বিত করছে।

এই নীরবতা ভাঙতেই হবে। নাগরিক সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দÑসবারই একসাথে বলতে হবে: পরিষ্কার বাতাস কোনো বিলাসিতা নয়, এটি অধিকার। এই অধিকার ত্যাগ করা মানেই শুধু অবহেলা নয়Ñএটি অপরাধের অংশীদার হওয়া।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান, আন্তর্জাতিক ফোরামে জলবায়ু সংকল্পের কথা বারবার বলেনÑনেট জিরো এমিশন, অভিযোজনযোগ্যতা ইত্যাদি। কিন্তু যখন দেশের রাজধানীই দম বন্ধ হয়ে মরছে, তখন মানুষের কাছে এসব প্রতিশ্রুতি শুধু কথার ফুলঝুরি হিসেবে মনে হয়।

রবার্ট সোয়ানের কথাটি মনে রাখা দরকার: “আমাদের গ্রহের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো এই বিশ্বাস যে অন্য কেউ এসে এটিকে রক্ষা করবে।” ঢাকায় এই বিশ্বাস মানুষকে হত্যা করছে। আর সময় নেই। আর দেরি নয়। ঢাকাকে আর একবার কোনো সম্ভাব্য সমীক্ষা দরকার নেই। দরকার রাজনৈতিক সাহস, নাগরিক জাগরণ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। নইলে এই শহর উন্নয়নের রোল মডেল নয়, ধ্বংসের চরম সতর্কবার্তা হয়ে থাকবে। ঢাকাকে বিষমুক্ত করতেই হবেÑনা হলে নিজেদেরই কবর রচনা করতে হবে এই উদাসীনতার ধোঁয়ায়।

[ লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ]

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

প্রযুক্তির ফাঁদে শৈশব : স্ক্রিন টাইম গিলে খাচ্ছে খেলার মাঠ

রমগদ্য : সিরাজগঞ্জে ‘ব্রিটিশ প্রেতাত্মা’

বামপন্থা : নীতির সঙ্গে নেতৃত্বের ভূমিকা

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : জনশিক্ষা ও সুশাসনের পথ

ইমাম রইস উদ্দিন হত্যাকাণ্ড : সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব

কারাগার, সংশোধনাগার ও ভবঘুরে কেন্দ্রগুলোর সংস্কার কি হবে

জ্বালানির বদল, জীবিকার ঝুঁকি

প্রসঙ্গ : রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও চট্টগ্রামে এস্কর্ট ডিউটি

দেশটা কারো বাপের নয়!

বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বশান্তির প্রার্থনা

আর কত ধর্ষণের খবর শুনতে হবে?

সংস্কারের স্বপ্ন বনাম বাস্তবতার রাজনীতি

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

লিঙ্গের রাজনীতি বা বিবাদ নয়, চাই মানবিকতার নিবিড় বন্ধন

বাজেট : বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনার স্থবিরতা

রম্যগদ্য: “বাঙালি আমরা, নহি তো মেষ...”

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

রঙ্গব্যঙ্গ : কোটের কেবল রং বদলায়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

শ্রম আইন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চাই আন্তরিকতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ঢাকার বাসিন্দাদের নিঃশ্বাসে এক বিপন্নতা

এম এ হোসাইন

বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশের রাজধানীতে এক ধীরগতির ধ্বংসযজ্ঞ চলছেÑনা, তা কোনো যুদ্ধ কিংবা সন্ত্রাসের নয়, বরং প্রতিটি নিঃশ্বাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক নির্মম বিষের আঘাত। পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর ঢাকা আজ সত্যিই বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করছে। এক সময় শীতকালে শুধু ধোঁয়াশা দেখা যেত, আজ সেই ধোঁয়াশা সারা বছর বিষাক্ত আবরণে রূপ নিয়েছে। ঢাকার বাতাস কেবল অস্বাস্থ্যকর নয়, বরং তা একপ্রকার গণবিধ্বংসী অস্ত্রের রূপ ধারণ করেছে। যুদ্ধের যেমন বিজয়ী থাকে এখানে তা নেইÑআছে শুধু লাখ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ।

ঢাকায় বায়ুদূষণ কোনো পরিসংখ্যানগত বিচ্যুতি নয় বরং এটি একটি পূর্ণমাত্রার জরুরি অবস্থা। আইকিউএয়ার-এর বৈশ্বিক সূচক অনুযায়ী, ঢাকা নিয়মিতভাবেই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর শীর্ষে থাকে। এখানে পিএম-২.৫ (একধরনের সূক্ষ্ম কণা যা ফুসফুস ক্যানসার, স্ট্রোক ও হৃদরোগের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত) এর মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরাপদ সীমা থেকে ১৬-২০ গুণ বেশি। এসব কণা কেবল বাতাসে ভেসে বেড়ায় না, তারা ঢুকে পড়ে আমাদের রক্তপ্রবাহে, আমাদের সন্তানের ফুসফুসে, এবং হাজারো মৃত্যুর চূড়ান্ত চিকিৎসা প্রতিবেদনে।

পরিসংখ্যানই যথেষ্ট আঁতকে ওঠার মতো। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি এন্ড ক্লিন এয়ার-এর গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১,০২,৪৫৬ জন মানুষের অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী বায়ুদূষণÑযার বেশিরভাগই ঘটে রাজধানী ঢাকায়। সেন্টার ফর এটমোস্ফরিক পলিউশন স্টাডিজ-এর গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার একজন সাধারণ বাসিন্দা দীর্ঘমেয়াদি দূষণের প্রভাবে প্রায় সাত বছর পর্যন্ত তার গড়আয়ু হারাচ্ছেন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও শিল্পখাতে উন্নয়নকে নিয়ে যে দেশ গর্ব করে, এ বাস্তবতা সেখানে এক গভীর জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কিছু নয়।

এবং সরাসরি বলিÑএই সংকট আকাশ থেকে পড়েনি। দোষীরা দৃশ্যমান, চিহ্নিত, এবং লজ্জাজনকভাবে সহনীয় হয়ে উঠেছে। যানবাহনের নৈরাজ্য থেকেই শুরু করি। ঢাকার রাস্তাগুলো এক বিশৃঙ্খল নৈরাজ্যের মূর্ত প্রতীকÑপুরনো ডিজেলচালিত ট্রাক, নিয়ন্ত্রণহীন বাস, আর দুই-স্ট্রোক অটোরিকশার বিশাল বাহিনী বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে চলেছে। ধোঁয়া নির্গমন পরীক্ষার কার্যত কোন ব্যবস্থা নেই। ক্যাটালিটিক কনভার্টার এখানে যেন কোনো পৌরাণিক যন্ত্র।

তারপর আছে ইটভাটাÑরাজধানী ও আশেপাশে চলছে প্রায় সাত হাজার ইটভাটা, যেগুলোর বেশিরভাগই কয়লা, কাঠ এমনকি টায়ার পুড়িয়ে শতাব্দীপ্রাচীন পদ্ধতিতে চলছে। শুধু এই ইটভাটাগুলো ঢাকার শীতকালীন পিএম২.৫ দূষণের অর্ধেকেরও বেশি জোগান দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত করে কারখানার দূষণ, নির্মাণস্থলের ধুলাবালি, খোলা জায়গায় আবর্জনা পোড়ানো, এবং চুল্লির ধোঁয়াÑএকটি নগর ব্যবস্থা যেন নিজ বাসিন্দাদের ধ্বংস করে গড়ে উঠছে।

এই সমস্যা ঢাকার সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পাঞ্চল থেকে আসা দূষণ বাংলাদেশের আকাশে এসে মেশে। এই আন্তঃসীমান্ত ধোঁয়াশা যেমন রাজনৈতিক সীমারেখা মানে না, তেমনি এ বিষয়ক আঞ্চলিক সহযোগিতা এখনও কূটনীতির মূল আলোচনার বাইরে। এই দূষণের মানবিক মূল্য অপরিসীম। একইসাথে অর্থনৈতিক ক্ষতিও বিপুল। বিশ্ব ব্যাংকের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের বছরে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়, যা দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশÑএই অঙ্ক দেশের পুরো গার্মেন্টস রপ্তানি আয়ের সমান।

এ যেন এক আত্মঘাতী স্বীদ্ধান্ত; বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চায়, পর্যটন বাড়াতে চায়। অথচ তার রাজধানী শহর ঢাকা হয়ে উঠছে বসবাস অযোগ্যদের তালিকায় বিশ্বের প্রথম সারির একটি। এ শহরে কেউ কেন করপোরেট হেডকোয়ার্টার বানাবে, কনফারেন্স করতে আসবে, কিংবা ট্রাভেল ডকুমেন্টারি বানাতে চাইবেÑযেখানে বাইরে বের হওয়াই স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি? এমন এক অস্তিত্ব সংকটের মুখে সরকার জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেবেÑএটাই তো স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। কিছু পুরনো যানবাহন বাতিল হয়েছে, হ্যাঁ। কিছু মৌসুমি অভিযানও হয় ইটভাটার বিরুদ্ধে। কিন্তু এগুলো ছেঁড়া কাঁথায় পট্টি দেয়ার মতোÑঅভিযান ক্ষণস্থায়ী, জরিমানা হাস্যকর, আর রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রায় অনুপস্থিত।

বাংলার চিরায়ত একটা উক্তি এ ক্ষেত্রে খুব প্রাসঙ্গিক: “কেউ যদি ঘুমিয়ে থাকে তাহলে তাকে জাগানো সহজ কিন্তু কেউ যদি জেগে থেকে ঘুমের ভান করে, তাকে জাগানো সহজ নয়।” যারা এই দূষণের জন্য দায়ী, তারা কোনো অজানা শিল্পপতি নয়Ñতারা প্রায়শই প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, সংসদ সদস্য, বা ক্ষমতাসীন দলের পৃষ্ঠপোষক। বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শহরের সাধারণ মানুষগুলোÑযাদের অভিযোজনের ক্ষমতা কম, কণ্ঠস্বরের তীক্ষতা আরও কম।

সমাধান আছে। একেবারে নতুন কিছু নয়। ব্যয়বহুলও নয়। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক সংকল্প।

শুরু হোক গণপরিবহনকে বৈদ্যুতিক করার মাধ্যমে। ঢাকার বাস ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিদ্যুৎচালিত ও কম-দূষণকারীতে রূপান্তর করতে হবেÑযা সবুজ বন্ড বা জলবায়ু অভিযোজন তহবিল থেকে অর্থায়ন করা যেতে পারে। এরপর ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে সব ইটভাটা বন্ধ করে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন হাইব্রিড হফম্যান ক্লিনে রূপান্তর করতে হবে, বা বিকল্প উপকরণে ঝুঁকতে হবে।

বায়ুদূষণের মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে রিয়েল-টাইম পর্যবেক্ষণ এবং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে। একটি স্বাধীন পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে, যাকে মন্ত্রী কিংবা ব্যবসায়ীরা চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না। এবং যানবাহনের ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণে চালু করতে হবে কনজেশন প্রাইসিংÑযেটি জাকার্তা ও নাইরোবিতেও পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে।

শহরের সবুজ অঞ্চলÑপার্ক, সবুজ বেষ্টনী এবং ভার্টিকেল বাগানÑএইগুলোকে সৌন্দর্যবর্ধনের বাইরে ভাবতে হবে। এগুলো কার্বন শোষণ করে, ক্ষুদ্র আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে, এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য সরাসরি উপকারী। কলম্বিয়ার মেডেলিন শহর “সবুজ করিডোর” ধারণায় আশ্চর্যজনক সাফল্য দেখিয়েছে। তাহলে ঢাকা কেন পারবে নাÑইচ্ছা থাকলে উপায় অবশ্যই আছে।

তবে এই সংকটে সবচেয়ে কম ব্যবহৃত হাতিয়ার হলো জনগণের চাপ। ভাষার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য একদা যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাস্তায় নেমেছিল, আজ তারা পরিবেশ বিপর্যয়কে নিঃশব্দে মেনে নিচ্ছে। তারা নিজেরাই আবর্জনা পুড়িয়ে, অবৈধ জেনারেটর ব্যবহার করে, বা সামান্য কর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এই দুর্যোগকে আরও ত্বরান্বিত করছে।

এই নীরবতা ভাঙতেই হবে। নাগরিক সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দÑসবারই একসাথে বলতে হবে: পরিষ্কার বাতাস কোনো বিলাসিতা নয়, এটি অধিকার। এই অধিকার ত্যাগ করা মানেই শুধু অবহেলা নয়Ñএটি অপরাধের অংশীদার হওয়া।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান, আন্তর্জাতিক ফোরামে জলবায়ু সংকল্পের কথা বারবার বলেনÑনেট জিরো এমিশন, অভিযোজনযোগ্যতা ইত্যাদি। কিন্তু যখন দেশের রাজধানীই দম বন্ধ হয়ে মরছে, তখন মানুষের কাছে এসব প্রতিশ্রুতি শুধু কথার ফুলঝুরি হিসেবে মনে হয়।

রবার্ট সোয়ানের কথাটি মনে রাখা দরকার: “আমাদের গ্রহের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো এই বিশ্বাস যে অন্য কেউ এসে এটিকে রক্ষা করবে।” ঢাকায় এই বিশ্বাস মানুষকে হত্যা করছে। আর সময় নেই। আর দেরি নয়। ঢাকাকে আর একবার কোনো সম্ভাব্য সমীক্ষা দরকার নেই। দরকার রাজনৈতিক সাহস, নাগরিক জাগরণ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। নইলে এই শহর উন্নয়নের রোল মডেল নয়, ধ্বংসের চরম সতর্কবার্তা হয়ে থাকবে। ঢাকাকে বিষমুক্ত করতেই হবেÑনা হলে নিজেদেরই কবর রচনা করতে হবে এই উদাসীনতার ধোঁয়ায়।

[ লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ]

back to top