alt

উপ-সম্পাদকীয়

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

কামরুজ্জামান

: শনিবার, ১০ মে ২০২৫

প্রকৃতিতে এখন চলছে বৈশাখ মাস। সামনেই জৈষ্ঠ। এই দুই মাসকে একত্রে বলা হয় ‘মধুমাস’। কারণ এ সময় দেশজ রসাল ফলের প্রাচুর্য চারপাশে এক অনন্য মাধুর্য ছড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম, আনারসসহ অসংখ্য ফল পাকে এ সময়। ফলে ম ম গন্ধে বাতাস ভরে ওঠে।

আমাদের শৈশব ছিল এই ফলগাছঘেরা মৌসুমের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। বৈশাখ মানেই খরতাপে দীপ্ত দুপুর, কখনও কালবৈশাখীর হঠাৎ আগমনÑ বজ্রসহ ঝড়-বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি আর গাছপালার উলটপালট। ঝড় কেবল গাছ নয়, মানুষ, পশুপাখিÑ সবকিছুকেই আঘাত করে। তবু এই রূঢ় প্রকৃতির ভেতরেও গ্রামবাংলার কৃষকের ঘরে ওঠে নতুন ধান। ধানের সেই গন্ধÑ আক্ষরিক অর্থেই জীবনের গন্ধ।

এই সময় গাছে গাছে ধরে কাঁচা আম। আমগাছে ঢিল ছুড়ে আম পাড়া, কাঁচামরিচ ও ধনে পাতা দিয়ে ভর্তা বানিয়ে খাওয়াÑ স্মৃতিতে আজও তরতাজা। কাঁঠাল পাকে বৈশাখ-জৈষ্ঠেই। বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল তখন গাছেই ফেটে পড়ে। গাছের নিচে কাঁঠাল ভাগ করে খাওয়ার আনন্দ, কাঁঠালের কোয়া নিয়ে কাড়াকাড়িÑ সব ছিল শৈশবের রঙিন খেলা। এখন গাছ কমে এসেছে, গরুও তেমন কেউ পালন করে না।

জৈষ্ঠে আম পাকেÑ যাকে ফলের রাজা বলা হয়। দেশীয় পাকা আম টকমিষ্টি স্বাদের হয়। কখনও পোকায় খাওয়া অংশ কেটে বাদ দিয়ে খাওয়ার মধ্যেও এক ধরনের আনন্দ ছিল। এখন বাজারের চাহিদায় কাঁচা আম বেশি জনপ্রিয়, ফলে দেশীয় পাকা আম চোখে পড়ে কম।

জৈষ্ঠ মাসে পাওয়া যায় রসাল কালো জাম। বড়সড় জামগাছে চড়ে জাম পাড়া, পাতিলে নিয়ে কাসুন্দি, লবণ আর কাঁচামরিচ দিয়ে ঝাঁকিয়ে ভর্তা বানানোর রোমাঞ্চ ভুলবার নয়।

লিচু পাকতে শুরু করে মে মাসের মাঝামাঝি থেকে। দেশীয় ছোট লিচু স্বাদে পিছিয়ে থাকলেও বড় দেশি লিচুর গন্ধ ও স্বাদ অতুলনীয়। বাদুড় তাড়াতে রাত জেগে পাহারা দেয়াও ছিল লিচুর মৌসুমের অংশ। এখন চায়না জাত ও হাইব্রিড লিচু বাজার দখল করে নিয়েছে।

মধুপুরের আনারস জগদ্বিখ্যাত। টকমিষ্টি এই ফল শুধু স্বাদে নয়, ঠা-া-জ্বরের ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার হতো। মা খাওয়াতেন শরীর খারাপ হলে। গরুর খাবার হতো কাঁঠালের খোসা, মানুষের ছিল কাঁঠালের কোয়া।

গাছে বসে সবচেয়ে বেশি খাওয়া ফল ছিল বেল। পাকা বেলের শরবত পান্তাভাতের সঙ্গে, বা সরাসরি খাওয়াÑ দুভাবেই উপভোগ করত সবাই। হজমে সহায়ক এই ফল বাজারে এখন খুবই কম।

লটকন পাকে আষাঢ়ের শুরুতে। পুষ্টিকর ও স্বাদের এই ফল সাধারণত বড় গাছের নিচে ছায়ায় ভালো হয়। পেয়ারা অবশ্য বারোমাসি ফল হলেও জৈষ্ঠ থেকেই পাকা শুরু করে। আগে বনেবাদাড়েও পেয়ারা গাছ থাকতÑ আজ তা শুধুই স্মৃতি।

আতাফল, যাকে অনেকে শরিফা, শরূপা বা মাদারও বলেন, খুব পুষ্টিকর ও উপকারী ফল। হজমে সহায়ক, হাঁপানি রোগে উপকারী, এবং কোষ্ঠকাঠিন্য নিরসনে সহায়ক। একসময় আমাদের বাড়িতে বহু আতাফলগাছ ছিল, এখন একটিও নেই।

এছাড়া সফেদা, জামরুল, পানিফলÑ সবই ছিল মধুমাসের অংশ। সফেদা গ্লুকোজসমৃদ্ধ, শক্তিদায়ক ফল। জামরুল ফল বাড়ির সৌন্দর্য বাড়াত, আর স্বাদেও পিছিয়ে ছিল না। আজকাল এসব ফলের গাছও প্রায় বিলুপ্ত।

বৈশাখ-জৈষ্ঠ ছিল শুধু একটি ঋতু নয়, ছিল স্মৃতির রসাল উপাখ্যান। আজ প্রযুক্তি আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামবাংলার সেই মধুময় সময় আর আগের মতো নেই। দেশীয় ফলের গন্ধ ও স্বাদের মতোই হারিয়ে যাচ্ছে তার ঘ্রাণময় ইতিহাসও। এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব।

[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, ভাওয়ালগড়, সদর, গাজীপুর]

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

প্রশিক্ষণ থেকে কেন বাদ নারী কৃষকরা?

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

লই গো বুক পেতে অনল-বাণ!

সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ

আমেরিকার অলিগার্কি পতনের আখ্যান

রম্যগদ্য : ‘উহু উহু, তোরে মাফ করা যায় না...’

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট : সংকোচন, সংকট ও সম্ভাবনার প্রতিফলন

আম রপ্তানি : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

সামাজিকমাধ্যম গুরুত্বহীন নয়

জমির শ্রেণী চেনার উপায় ও পরিবর্তনের নিয়ম-কানুন

বাংলাদেশ : “রক্তে জন্ম আর পানিতে মরণ”

নতুন নোট, নতুন বিতর্ক

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের হতাশা ও উপজেলা পর্যায়ের অদক্ষতা : কে নেবে দায়িত্ব?

তরল সম্পর্কের গোলকধাঁধা

পরিবার থেকে রাষ্ট্র : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের উপায়

বাজেটে বৈষম্য কমানোর কোনো স্পষ্ট প্রতিফলন আছে কি

চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে

রম্যগদ্য : ‘নির্বাচন, না নীর-বচন...’

প্লাস্টিক দূষণ নয়, প্রকৃতির পাশে দাঁড়ান

কোরবানির পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

ত্যাগের মহিমায় ঈদুল আজহা

নাম ও মর্যাদা : অর্থবহ নামকরণে বৈষম্য রোধের আহ্বান

ডিজিটাল পুঁজিবাদের যুগে নগর বাংলাদেশের শ্রেণী কাঠামো

পারিবারিক শিক্ষা ও রাষ্ট্রসংস্কার : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের পথরেখা

প্রসঙ্গ : রাজধানীর যানজট

নবায়নযোগ্য জ্বালানি : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

ছবি

তাহলে একাত্তরে হয়নিকো কোনো অপরাধ!

ঈদযাত্রা হোক নিরাপদ

আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য কৌশলে বাস্তববাদী বাঁক

রম্যগদ্য : ‘জনগণের ভালোবাসা কি আমার ব্যাংক-ব্যালেন্স বাড়াইবো?’

ভালো থাকার কঠিন কলা : কিছু সরল সত্য

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

কামরুজ্জামান

শনিবার, ১০ মে ২০২৫

প্রকৃতিতে এখন চলছে বৈশাখ মাস। সামনেই জৈষ্ঠ। এই দুই মাসকে একত্রে বলা হয় ‘মধুমাস’। কারণ এ সময় দেশজ রসাল ফলের প্রাচুর্য চারপাশে এক অনন্য মাধুর্য ছড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম, আনারসসহ অসংখ্য ফল পাকে এ সময়। ফলে ম ম গন্ধে বাতাস ভরে ওঠে।

আমাদের শৈশব ছিল এই ফলগাছঘেরা মৌসুমের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। বৈশাখ মানেই খরতাপে দীপ্ত দুপুর, কখনও কালবৈশাখীর হঠাৎ আগমনÑ বজ্রসহ ঝড়-বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি আর গাছপালার উলটপালট। ঝড় কেবল গাছ নয়, মানুষ, পশুপাখিÑ সবকিছুকেই আঘাত করে। তবু এই রূঢ় প্রকৃতির ভেতরেও গ্রামবাংলার কৃষকের ঘরে ওঠে নতুন ধান। ধানের সেই গন্ধÑ আক্ষরিক অর্থেই জীবনের গন্ধ।

এই সময় গাছে গাছে ধরে কাঁচা আম। আমগাছে ঢিল ছুড়ে আম পাড়া, কাঁচামরিচ ও ধনে পাতা দিয়ে ভর্তা বানিয়ে খাওয়াÑ স্মৃতিতে আজও তরতাজা। কাঁঠাল পাকে বৈশাখ-জৈষ্ঠেই। বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল তখন গাছেই ফেটে পড়ে। গাছের নিচে কাঁঠাল ভাগ করে খাওয়ার আনন্দ, কাঁঠালের কোয়া নিয়ে কাড়াকাড়িÑ সব ছিল শৈশবের রঙিন খেলা। এখন গাছ কমে এসেছে, গরুও তেমন কেউ পালন করে না।

জৈষ্ঠে আম পাকেÑ যাকে ফলের রাজা বলা হয়। দেশীয় পাকা আম টকমিষ্টি স্বাদের হয়। কখনও পোকায় খাওয়া অংশ কেটে বাদ দিয়ে খাওয়ার মধ্যেও এক ধরনের আনন্দ ছিল। এখন বাজারের চাহিদায় কাঁচা আম বেশি জনপ্রিয়, ফলে দেশীয় পাকা আম চোখে পড়ে কম।

জৈষ্ঠ মাসে পাওয়া যায় রসাল কালো জাম। বড়সড় জামগাছে চড়ে জাম পাড়া, পাতিলে নিয়ে কাসুন্দি, লবণ আর কাঁচামরিচ দিয়ে ঝাঁকিয়ে ভর্তা বানানোর রোমাঞ্চ ভুলবার নয়।

লিচু পাকতে শুরু করে মে মাসের মাঝামাঝি থেকে। দেশীয় ছোট লিচু স্বাদে পিছিয়ে থাকলেও বড় দেশি লিচুর গন্ধ ও স্বাদ অতুলনীয়। বাদুড় তাড়াতে রাত জেগে পাহারা দেয়াও ছিল লিচুর মৌসুমের অংশ। এখন চায়না জাত ও হাইব্রিড লিচু বাজার দখল করে নিয়েছে।

মধুপুরের আনারস জগদ্বিখ্যাত। টকমিষ্টি এই ফল শুধু স্বাদে নয়, ঠা-া-জ্বরের ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার হতো। মা খাওয়াতেন শরীর খারাপ হলে। গরুর খাবার হতো কাঁঠালের খোসা, মানুষের ছিল কাঁঠালের কোয়া।

গাছে বসে সবচেয়ে বেশি খাওয়া ফল ছিল বেল। পাকা বেলের শরবত পান্তাভাতের সঙ্গে, বা সরাসরি খাওয়াÑ দুভাবেই উপভোগ করত সবাই। হজমে সহায়ক এই ফল বাজারে এখন খুবই কম।

লটকন পাকে আষাঢ়ের শুরুতে। পুষ্টিকর ও স্বাদের এই ফল সাধারণত বড় গাছের নিচে ছায়ায় ভালো হয়। পেয়ারা অবশ্য বারোমাসি ফল হলেও জৈষ্ঠ থেকেই পাকা শুরু করে। আগে বনেবাদাড়েও পেয়ারা গাছ থাকতÑ আজ তা শুধুই স্মৃতি।

আতাফল, যাকে অনেকে শরিফা, শরূপা বা মাদারও বলেন, খুব পুষ্টিকর ও উপকারী ফল। হজমে সহায়ক, হাঁপানি রোগে উপকারী, এবং কোষ্ঠকাঠিন্য নিরসনে সহায়ক। একসময় আমাদের বাড়িতে বহু আতাফলগাছ ছিল, এখন একটিও নেই।

এছাড়া সফেদা, জামরুল, পানিফলÑ সবই ছিল মধুমাসের অংশ। সফেদা গ্লুকোজসমৃদ্ধ, শক্তিদায়ক ফল। জামরুল ফল বাড়ির সৌন্দর্য বাড়াত, আর স্বাদেও পিছিয়ে ছিল না। আজকাল এসব ফলের গাছও প্রায় বিলুপ্ত।

বৈশাখ-জৈষ্ঠ ছিল শুধু একটি ঋতু নয়, ছিল স্মৃতির রসাল উপাখ্যান। আজ প্রযুক্তি আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামবাংলার সেই মধুময় সময় আর আগের মতো নেই। দেশীয় ফলের গন্ধ ও স্বাদের মতোই হারিয়ে যাচ্ছে তার ঘ্রাণময় ইতিহাসও। এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব।

[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, ভাওয়ালগড়, সদর, গাজীপুর]

back to top