এম এ হোসাইন
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ছিল এক জটিল মিশ্রণÑআদর্শবাদ, সামরিক হস্তক্ষেপ; আর কখনো-কখনো ভ্রান্ত ধারণার মিশ্রণ। বিভিন্ন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট একদিকে নীতির বুলি আউড়ানো, অন্যদিকে সামরিক হস্তক্ষেপের মাঝে দোদুল্যমান থেকেছেন; যার ফলাফল ছিল প্রায়শই হতাশাজনক, এমনকি ধ্বংসাত্মক; কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে এবং এবার ফিরে এসেÑ এই নীতিতে একটি পুনর্বিন্যাসের সূচনা করছেন বলে মনে হচ্ছে। এ পরিবর্তনের মূল বৈশিষ্ট্য হলো লেনদেননির্ভর কূটনীতি, যেখানে আদর্শ নয়, বরং ফলাফল, চুক্তি এবং প্রভাব-ব্যবহার মুখ্য।
সমালোচকেরা প্রায়ই এই কৌশলকে নির্দয় স্বার্থপরতার নাম দিয়ে খাটো করে দেখান; কিন্তু এমন দৃষ্টিভঙ্গি এটির অন্তর্নিহিত কৌশলগত যুক্তিকে অবমূল্যায়ন করে। ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গিÑ যদিও কখনও কখনও অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হতে পারে যেমন- আদর্শিক অতিরঞ্জনের প্রতি স্বমূলে প্রত্যাখ্যান এবং জাতীয় স্বার্থকে পুনরায় অগ্রাধিকার দেওয়ার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। মধ্যপ্রাচ্যের মতো জটিল অঞ্চলে, যেখানে গণতন্ত্র ও শান্তির আকাক্সক্ষা বারবার গিয়ে ঠেকেছে সাম্প্রদায়িকতা ও কর্তৃত্ববাদের বশে, সেখানে এমন বাস্তববাদ হয়তো অনেক আগেই প্রয়োজন ছিল।
ট্রাম্পের কাঠামো বিচ্ছিন্নতাবাদ থেকে জন্ম নেয়নি। বরং এটি একটি কঠোর বাস্তব মূল্যায়নের প্রতিফলনÑ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী করতে সক্ষম এবং কী নিয়ে আর ভান করা উচিত নয়। আগের প্রশাসনগুলোরÑ বিশেষত বারাক ওবামার নেতিক আবেগের বিপরীতে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি সতেজভাবে অরোমান্টিক। এটি স্বীকার করে যে মার্কিন প্রভাব সীমাহীন নয়, জোট হতে হবে পারস্পরিক সুবিধাভিত্তিক এবং দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক নাটক প্রায়শই প্রকৃত অগ্রগতির বদলে প্রতীকী আড়ম্বরে পর্যবসিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ, ওবামা প্রশাসনের আরব বসন্ত ব্যবস্থাপনা বিবেচনা করা যাক। কায়রো থেকে দামেস্ক পর্যন্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি তৎকালীন প্রেসিডেন্টের বক্তৃতামূলক সমর্থন নীতিগতভাবে অনুপ্রেরণাদায়ক হলেও বাস্তবে তা ছিল বিপর্যয়কর। ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারীদের শূন্যস্থান পূরণ করেছিল উদার গণতন্ত্র নয়, বরং বিশৃঙ্খলা, গৃহযুদ্ধ এবং নতুন করে মাথাচাড়া দেওয়া কর্তৃত্ববাদ। ট্রাম্প এর বিপরীতে মধ্যপ্রাচ্যকে পুনর্গঠনের বিষয়ে কোনো উচ্চাভিলাষী ঘোষণা না দিয়ে বরং নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ এবং চুক্তি করার কৌশলকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
এই পন্থার গভীর তাৎপর্য রয়েছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বে, যা আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য নীতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর এলাকা। একের পর এক সরকার ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান উভয়ইÑ সমঝোতা, সম্মেলন, রোডম্যাপ এবং প্রস্তাবে আটকে থেকেছে। ট্রাম্প এই ইস্যুটিকে কেবল একটি অচল কূটনৈতিক ধাঁধাঁ নয়, বরং একটি লেনদেনভিত্তিক সংকট হিসেবে দেখেছেন। এখানে শান্তি হলো পারস্পরিক সুবিধাজনক চুক্তির ফল, যা চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ইসরায়েলকে যে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছিলেন তা নজিরবিহীনÑ জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর, গোলান মালভূমিকে ইসরায়েলি ভূখ- হিসেবে স্বীকৃতি এবং আব্রাহাম চুক্তির প্রতি আকন্ঠ সমর্থন। এসব আমেরিকা-ইসরায়েল সম্পর্ককে দৃঢ় করেছে, তবে একটি গুরুতর প্রশ্নও উত্থাপন করেছেÑ যখন কোনো অংশীদার এত সমর্থন পায়, কিন্তু বিনিময়ে কিছুই দেয় না, তখন কী হবে?
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এ সমর্থনের জোরে একতরফাভাবে এমন নীতি গ্রহণ করেছেন, যা শান্তি প্রক্রিয়াকে পিছিয়ে দিয়েছে এবং গাজা, সিরিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। এমনকি ইসরায়েলি হস্তক্ষেপের অভিযোগও উঠেছে মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এ নিয়ে অসন্তোষের ইঙ্গিত স্পষ্ট।
এই জায়গাতেই ট্রাম্প তার কৌশলগত পুনর্বিন্যাস স্পষ্ট করেছেনÑ বন্ধুত্ব মানে অন্ধ সমর্থন নয়। যদি আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে গ্রহণযোগ্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে থাকতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই নৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। ট্রাম্প এ ভারসাম্য রক্ষাকে বিশ্বাসঘাতকতা নয়, বরং ন্যায্য সংশোধন হিসেবে দেখেন।
একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সৌদি আরবের সঙ্গে নতুন কৌশলগত হিসাব। ঐতিহাসিকভাবে সৌদি আরব বিশ্বাস করে, ফিলিস্তিন প্রশ্নের সমাধান ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তি সম্ভব নয়। ট্রাম্পকে যারা এ বিষয় নিয়ে উদাসীন হিসেবে ভাবতেন, তারা এখন দেখছেনÑ তিনি রাজনৈতিক প্রেরণা নয়, বরং বাস্তব কারণেই ফিলিস্তিনি নিপীড়নের বিপর্যয়কর প্রভাব বুঝছেন।
তবে এর মানে এই নয় যে, ট্রাম্প হামাসকে বৈধতা দিচ্ছেন বা সহিংসতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। বরং তিনি বুঝেছেন, অস্ত্র চুক্তি ও ইরানবিরোধী জোটের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যে সমৃদ্ধি চাইলে ফিলিস্তিনিদের মর্যাদা ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আর এই বোঝাপড়ার মধ্যে আঞ্চলিক শক্তিগুলোকেও যুক্ত করতে হবে, যারা এখন কেবল মার্কিন বুলি নয়, বাস্তব অগ্রগতি চায়।
সৌদি আরব ও উপসাগরীয় অন্যান্য রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আগ্রহী তবে শর্তসাপেক্ষে। তারা ফিলিস্তিন প্রশ্নে বাস্তব পদক্ষেপ চায়। ট্রাম্প যিনি কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগে পারদর্শী, এটা দেখছেন এক অনন্য সুযোগ হিসেবে। তিনি ইসরায়েলকে চাপে রেখে এবং আরব রাজধানীগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করে এমন একটি কৌশল গড়ার, যেখানে প্রত্যেক পক্ষ আদর্শিক নয়, বরং কৌশলগত স্বার্থে যুক্ত থাকবে।
এই দৃষ্টিভঙ্গিকে ঐতিহাসিক ভিত্তিও দেওয়া যায়। ১৯৫৬ সালে প্রেসিডেন্ট আইজেন আওয়ার ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েলকে সুয়েজ অভিযানে পিছু হটতে বাধ্য করেছিলেন। এটি এমন একটি ঘটনা যা দেখিয়েছে, আমেরিকা তার ন্যায্যতা লবির চেয়ে বড় ভাবতে পারে। ট্রাম্প হয়তো সচেতনভাবে, হয়তো না, একই রকম কিছু করতে চাইছেন। মার্কিন নীতিকে লবির প্রভাবে নির্ধারিত না করে স্বাধীনভাবে পরিচালিত করতে চাইছেন।
আইজেন আওয়ারের যুগ থেকে শেখার বিষয় হলোÑ প্রকৃত মিত্রতা তৈরি হয় পারস্পরিক সম্মান ও কৌশলগত সংহতির ভিত্তিতেÑঅন্ধ আনুগত্যে নয়। ট্রাম্প যদি সেই পাঠ প্রয়োগ করতে পারেন, তবে হয়তো তিনি অন্যদের যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানে সফল হবেন।
নিশ্চয়ই এই কৌশলের কিছু ঝুঁকি রয়েছে। একটি লেনদেনভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি যদি স্পষ্ট নীতিমালার দ্বারা সমর্থিত না হয়, তবে তা দ্রুতই অস্থিরতায় পরিণত হতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন সূক্ষ্ম ভারসাম্যÑচাপ প্রয়োগ করতে হবে, তবে সম্পর্ক নষ্ট না করে; বাস্তববাদী হতে হবে, তবে পিছু হটে নয়। আর ট্রাম্প নিজেই, যিনি ব্যক্তিগত প্রতিশোধ পরায়ণতা ও অপ্রত্যাশিত অবস্থান পরিবর্তনের জন্য সুপরিচিত, ফলে তিনি এমন সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষার আদর্শ ব্যক্তি নন।
তবুও তার মধ্যপ্রাচ্য কৌশল বলছেÑ একটি বাস্তববাদী পুনর্বিন্যাস ঘটছে, যা আগের প্রেসিডেন্টরা তাদের বক্তৃতা ও আদর্শে অর্জন করতে পারেননি। তাৎক্ষণিক শান্তি না এলেও এটি হয়তো এমন একটি আঞ্চলিক কাঠামোর ভিত্তি গড়তে পারেÑযেটি কল্পনাজনিত রূপান্তরের বদলে পারস্পরিক স্বার্থে নির্মিত।
এই পরিবর্তন স্থায়ী হবে কিনা, তা এখনো নিশ্চিত নয়। এর অনেকটাই নির্ভর করবে ট্রাম্প এই নীতিগত পরিবর্তনকে তার ব্যক্তিগত ছায়া ছাড়িয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারেন কিনা তার ওপর। তবে আপাতত এটা স্পষ্টÑ আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য নীতি নতুনভাবে রূপান্তরিত হচ্ছে; কোনো বিমূর্ত আদর্শে নয়, বরং এক বাস্তব কৌশলের ভিত্তিতে, যা এ সময়ে উপযুক্ত হতে পারে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে ট্রাম্প আমেরিকার অঞ্চলভিত্তিক ভূমিকা ভেঙে দিচ্ছেন নাÑ তিনি তাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছেন। একটি মূল্যবোধ-নির্ভর সাম্রাজ্য নয়, বরং স্বার্থভিত্তিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে। আর আদর্শবাদী ক্লান্তির এই বিশ্বে সম্ভবত এটিই মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি দরকার।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
এম এ হোসাইন
শনিবার, ৩১ মে ২০২৫
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ছিল এক জটিল মিশ্রণÑআদর্শবাদ, সামরিক হস্তক্ষেপ; আর কখনো-কখনো ভ্রান্ত ধারণার মিশ্রণ। বিভিন্ন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট একদিকে নীতির বুলি আউড়ানো, অন্যদিকে সামরিক হস্তক্ষেপের মাঝে দোদুল্যমান থেকেছেন; যার ফলাফল ছিল প্রায়শই হতাশাজনক, এমনকি ধ্বংসাত্মক; কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে এবং এবার ফিরে এসেÑ এই নীতিতে একটি পুনর্বিন্যাসের সূচনা করছেন বলে মনে হচ্ছে। এ পরিবর্তনের মূল বৈশিষ্ট্য হলো লেনদেননির্ভর কূটনীতি, যেখানে আদর্শ নয়, বরং ফলাফল, চুক্তি এবং প্রভাব-ব্যবহার মুখ্য।
সমালোচকেরা প্রায়ই এই কৌশলকে নির্দয় স্বার্থপরতার নাম দিয়ে খাটো করে দেখান; কিন্তু এমন দৃষ্টিভঙ্গি এটির অন্তর্নিহিত কৌশলগত যুক্তিকে অবমূল্যায়ন করে। ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গিÑ যদিও কখনও কখনও অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হতে পারে যেমন- আদর্শিক অতিরঞ্জনের প্রতি স্বমূলে প্রত্যাখ্যান এবং জাতীয় স্বার্থকে পুনরায় অগ্রাধিকার দেওয়ার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। মধ্যপ্রাচ্যের মতো জটিল অঞ্চলে, যেখানে গণতন্ত্র ও শান্তির আকাক্সক্ষা বারবার গিয়ে ঠেকেছে সাম্প্রদায়িকতা ও কর্তৃত্ববাদের বশে, সেখানে এমন বাস্তববাদ হয়তো অনেক আগেই প্রয়োজন ছিল।
ট্রাম্পের কাঠামো বিচ্ছিন্নতাবাদ থেকে জন্ম নেয়নি। বরং এটি একটি কঠোর বাস্তব মূল্যায়নের প্রতিফলনÑ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী করতে সক্ষম এবং কী নিয়ে আর ভান করা উচিত নয়। আগের প্রশাসনগুলোরÑ বিশেষত বারাক ওবামার নেতিক আবেগের বিপরীতে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি সতেজভাবে অরোমান্টিক। এটি স্বীকার করে যে মার্কিন প্রভাব সীমাহীন নয়, জোট হতে হবে পারস্পরিক সুবিধাভিত্তিক এবং দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক নাটক প্রায়শই প্রকৃত অগ্রগতির বদলে প্রতীকী আড়ম্বরে পর্যবসিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ, ওবামা প্রশাসনের আরব বসন্ত ব্যবস্থাপনা বিবেচনা করা যাক। কায়রো থেকে দামেস্ক পর্যন্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি তৎকালীন প্রেসিডেন্টের বক্তৃতামূলক সমর্থন নীতিগতভাবে অনুপ্রেরণাদায়ক হলেও বাস্তবে তা ছিল বিপর্যয়কর। ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারীদের শূন্যস্থান পূরণ করেছিল উদার গণতন্ত্র নয়, বরং বিশৃঙ্খলা, গৃহযুদ্ধ এবং নতুন করে মাথাচাড়া দেওয়া কর্তৃত্ববাদ। ট্রাম্প এর বিপরীতে মধ্যপ্রাচ্যকে পুনর্গঠনের বিষয়ে কোনো উচ্চাভিলাষী ঘোষণা না দিয়ে বরং নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ এবং চুক্তি করার কৌশলকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
এই পন্থার গভীর তাৎপর্য রয়েছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বে, যা আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য নীতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর এলাকা। একের পর এক সরকার ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান উভয়ইÑ সমঝোতা, সম্মেলন, রোডম্যাপ এবং প্রস্তাবে আটকে থেকেছে। ট্রাম্প এই ইস্যুটিকে কেবল একটি অচল কূটনৈতিক ধাঁধাঁ নয়, বরং একটি লেনদেনভিত্তিক সংকট হিসেবে দেখেছেন। এখানে শান্তি হলো পারস্পরিক সুবিধাজনক চুক্তির ফল, যা চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ইসরায়েলকে যে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছিলেন তা নজিরবিহীনÑ জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর, গোলান মালভূমিকে ইসরায়েলি ভূখ- হিসেবে স্বীকৃতি এবং আব্রাহাম চুক্তির প্রতি আকন্ঠ সমর্থন। এসব আমেরিকা-ইসরায়েল সম্পর্ককে দৃঢ় করেছে, তবে একটি গুরুতর প্রশ্নও উত্থাপন করেছেÑ যখন কোনো অংশীদার এত সমর্থন পায়, কিন্তু বিনিময়ে কিছুই দেয় না, তখন কী হবে?
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এ সমর্থনের জোরে একতরফাভাবে এমন নীতি গ্রহণ করেছেন, যা শান্তি প্রক্রিয়াকে পিছিয়ে দিয়েছে এবং গাজা, সিরিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। এমনকি ইসরায়েলি হস্তক্ষেপের অভিযোগও উঠেছে মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এ নিয়ে অসন্তোষের ইঙ্গিত স্পষ্ট।
এই জায়গাতেই ট্রাম্প তার কৌশলগত পুনর্বিন্যাস স্পষ্ট করেছেনÑ বন্ধুত্ব মানে অন্ধ সমর্থন নয়। যদি আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে গ্রহণযোগ্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে থাকতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই নৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। ট্রাম্প এ ভারসাম্য রক্ষাকে বিশ্বাসঘাতকতা নয়, বরং ন্যায্য সংশোধন হিসেবে দেখেন।
একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সৌদি আরবের সঙ্গে নতুন কৌশলগত হিসাব। ঐতিহাসিকভাবে সৌদি আরব বিশ্বাস করে, ফিলিস্তিন প্রশ্নের সমাধান ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তি সম্ভব নয়। ট্রাম্পকে যারা এ বিষয় নিয়ে উদাসীন হিসেবে ভাবতেন, তারা এখন দেখছেনÑ তিনি রাজনৈতিক প্রেরণা নয়, বরং বাস্তব কারণেই ফিলিস্তিনি নিপীড়নের বিপর্যয়কর প্রভাব বুঝছেন।
তবে এর মানে এই নয় যে, ট্রাম্প হামাসকে বৈধতা দিচ্ছেন বা সহিংসতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। বরং তিনি বুঝেছেন, অস্ত্র চুক্তি ও ইরানবিরোধী জোটের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যে সমৃদ্ধি চাইলে ফিলিস্তিনিদের মর্যাদা ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আর এই বোঝাপড়ার মধ্যে আঞ্চলিক শক্তিগুলোকেও যুক্ত করতে হবে, যারা এখন কেবল মার্কিন বুলি নয়, বাস্তব অগ্রগতি চায়।
সৌদি আরব ও উপসাগরীয় অন্যান্য রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আগ্রহী তবে শর্তসাপেক্ষে। তারা ফিলিস্তিন প্রশ্নে বাস্তব পদক্ষেপ চায়। ট্রাম্প যিনি কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগে পারদর্শী, এটা দেখছেন এক অনন্য সুযোগ হিসেবে। তিনি ইসরায়েলকে চাপে রেখে এবং আরব রাজধানীগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করে এমন একটি কৌশল গড়ার, যেখানে প্রত্যেক পক্ষ আদর্শিক নয়, বরং কৌশলগত স্বার্থে যুক্ত থাকবে।
এই দৃষ্টিভঙ্গিকে ঐতিহাসিক ভিত্তিও দেওয়া যায়। ১৯৫৬ সালে প্রেসিডেন্ট আইজেন আওয়ার ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েলকে সুয়েজ অভিযানে পিছু হটতে বাধ্য করেছিলেন। এটি এমন একটি ঘটনা যা দেখিয়েছে, আমেরিকা তার ন্যায্যতা লবির চেয়ে বড় ভাবতে পারে। ট্রাম্প হয়তো সচেতনভাবে, হয়তো না, একই রকম কিছু করতে চাইছেন। মার্কিন নীতিকে লবির প্রভাবে নির্ধারিত না করে স্বাধীনভাবে পরিচালিত করতে চাইছেন।
আইজেন আওয়ারের যুগ থেকে শেখার বিষয় হলোÑ প্রকৃত মিত্রতা তৈরি হয় পারস্পরিক সম্মান ও কৌশলগত সংহতির ভিত্তিতেÑঅন্ধ আনুগত্যে নয়। ট্রাম্প যদি সেই পাঠ প্রয়োগ করতে পারেন, তবে হয়তো তিনি অন্যদের যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানে সফল হবেন।
নিশ্চয়ই এই কৌশলের কিছু ঝুঁকি রয়েছে। একটি লেনদেনভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি যদি স্পষ্ট নীতিমালার দ্বারা সমর্থিত না হয়, তবে তা দ্রুতই অস্থিরতায় পরিণত হতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন সূক্ষ্ম ভারসাম্যÑচাপ প্রয়োগ করতে হবে, তবে সম্পর্ক নষ্ট না করে; বাস্তববাদী হতে হবে, তবে পিছু হটে নয়। আর ট্রাম্প নিজেই, যিনি ব্যক্তিগত প্রতিশোধ পরায়ণতা ও অপ্রত্যাশিত অবস্থান পরিবর্তনের জন্য সুপরিচিত, ফলে তিনি এমন সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষার আদর্শ ব্যক্তি নন।
তবুও তার মধ্যপ্রাচ্য কৌশল বলছেÑ একটি বাস্তববাদী পুনর্বিন্যাস ঘটছে, যা আগের প্রেসিডেন্টরা তাদের বক্তৃতা ও আদর্শে অর্জন করতে পারেননি। তাৎক্ষণিক শান্তি না এলেও এটি হয়তো এমন একটি আঞ্চলিক কাঠামোর ভিত্তি গড়তে পারেÑযেটি কল্পনাজনিত রূপান্তরের বদলে পারস্পরিক স্বার্থে নির্মিত।
এই পরিবর্তন স্থায়ী হবে কিনা, তা এখনো নিশ্চিত নয়। এর অনেকটাই নির্ভর করবে ট্রাম্প এই নীতিগত পরিবর্তনকে তার ব্যক্তিগত ছায়া ছাড়িয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারেন কিনা তার ওপর। তবে আপাতত এটা স্পষ্টÑ আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য নীতি নতুনভাবে রূপান্তরিত হচ্ছে; কোনো বিমূর্ত আদর্শে নয়, বরং এক বাস্তব কৌশলের ভিত্তিতে, যা এ সময়ে উপযুক্ত হতে পারে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে ট্রাম্প আমেরিকার অঞ্চলভিত্তিক ভূমিকা ভেঙে দিচ্ছেন নাÑ তিনি তাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছেন। একটি মূল্যবোধ-নির্ভর সাম্রাজ্য নয়, বরং স্বার্থভিত্তিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে। আর আদর্শবাদী ক্লান্তির এই বিশ্বে সম্ভবত এটিই মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি দরকার।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]