alt

উপ-সম্পাদকীয়

নাম ও মর্যাদা : অর্থবহ নামকরণে বৈষম্য রোধের আহ্বান

বাবুল রবিদাস

: সোমবার, ০২ জুন ২০২৫

নামকরণের পেছনে রয়েছে কার্যকারণলবদ্ধ একটি ইতিহাস। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় দেখা গেছে, শাসক ও শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক অঞ্চলের নামও পরিবর্তিত হয়েছে। এই নাম পরিবর্তনের পেছনে প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছে শাসকশ্রেণির রুচি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। যেমনভাবে একটি রাষ্ট্র বা শহরের নামকরণ শাসকদের নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়, তেমনি সন্তানদের নাম রাখার ক্ষেত্রেও অভিভাবকদের রুচি, মনন ও চিন্তাভাবনা প্রতিফলিত হয়। একটি নাম শুধু পরিচিতির মাধ্যম নয়, এটি হয়ে ওঠে ব্যক্তির অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয়ের অংশ।

জন্মের পর শিশুকে যে নাম দেয়া হয়, তা তার রক্ত-মাংসে, মননে, চিন্তায় এমনভাবে মিশে যায় যে সে নাম তাকে আজীবন অনুসরণ করে চলে। সে নাম ভালো বা মন্দÑউভয়ই হতে পারে। কেউ কেউ জীবনের এক পর্যায়ে গিয়ে সেই নামের সঙ্গে নিজেকে আর মানিয়ে নিতে পারেন না। তখন তারা এফিডেভিট করে নাম পরিবর্তনের পথে হাঁটেন। এটি প্রমাণ করে যে, প্রথমে দেয়া নামটি ছিল অসার্থক বা অপ্রাসঙ্গিক। কেবল ব্যক্তি নয়, অনেক প্রতিষ্ঠান কিংবা দেশের নামও সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তন করা হয়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়Ñপিকিং থেকে বেইজিং, বম্বে থেকে মুম্বাই, ক্যালকাটা থেকে কলকাতা, ঢাক্কা থেকে ঢাকা, বগড়া থেকে বগুড়া। এমনকি বার্মা থেকে মায়ানমার, রেঙ্গুন থেকে ইয়ানগুন। এসব পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে উচ্চারণের সঠিকতা, সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় এবং সময়োপযোগিতার গুরুত্ব।

আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামও একসময় অস্বাভাবিক, শ্রুতিকটু বা নেতিবাচক বার্তাবাহী ছিল। যেমনÑবরিশালের “চরকাউয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়” বা ময়মনসিংহের “চোরের ভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়”। শিশুর মানসিক বিকাশ ও আত্মসম্মানের দিক থেকে এসব নাম শুধু বিব্রতকর নয়, তা তাদের সামাজিক অবস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই উপলব্ধি থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে কয়েক শতাধিক বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করেছে, যা একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ।

নাম একটি পরিচয়; এটি যদি হয় কুশ্রী, বিকৃত কিংবা অপমানজনক, তবে তা শিশুর আত্মবিকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। আমাদের সমাজে অনেক সময় বাবা-মা না বুঝেই সন্তানের নাম রাখেন। অনেকে নামের অর্থ না জেনেই কেবল শব্দের ধ্বনি শুনে নাম ঠিক করেন। যেমনÑরহিমা খাতুন, যেখানে খাতুন মানে বিবাহিতা নারী, অথচ শিশুটি সদ্য জন্ম নেয়া কন্যা। অথবা “খায়রুল বাশার”Ñযার অর্থ “সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ”, যা অতিমূল্যায়ন মনে হতে পারে। আবার “শামছুন্নাহার”Ñমানে দিনে সূর্যের আলো, যেখানে সূর্য পুরুষবাচক, কিন্তু নামটি ব্যবহার হচ্ছে নারীর ক্ষেত্রে।

বেশ কিছু নাম সামাজিকভাবে এমনভাবে গড়ে উঠেছে, যা দলিত, অনগ্রসর বা শ্রমজীবী শ্রেণির শিশুদের প্রতি বৈষম্য ও অবজ্ঞার প্রতিচ্ছবি বহন করে। যেমনÑসিবা ডোম, বিষ্ণু লাল বেগী, সহদেব ভক্ত, রঘুনাথ চন্ডাল, বাবুলাল মুচি, রাম টুডু, বানিয়াস ক্যারকেটা ইত্যাদি। এসব নামের মধ্যে অনেকগুলো পদবি বা জাতিগত পরিচয় এমনভাবে যুক্ত রয়েছে, যা শিশুদের শিক্ষাজীবন ও সামাজিক জীবনে অব্যাহত অবজ্ঞা ও অবমাননার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় এই অবজ্ঞা এতটাই গভীর হয় যে, শিশুরা হতাশায় পড়ে পড়াশোনা পর্যন্ত ছেড়ে দেয়।

এজন্য আধুনিক যুগে নামকরণের ক্ষেত্রে গভীর চিন্তা-ভাবনা প্রয়োজন। নাম হতে হবে অর্থবহ, ইতিবাচক ও গ্রহণযোগ্য। নাম এমন হওয়া উচিত যা শিশুর আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদাবোধ জাগ্রত করে। বিশেষ করে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সন্তানদের ক্ষেত্রে আরও বেশি সচেতনতা প্রয়োজন, যাতে তারা ভবিষ্যতে বৈষম্যের শিকার না হয়।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, হতদরিদ্র পরিবার, যাদের হাতে শিক্ষা বা উপযুক্ত পরামর্শের সুযোগ থাকে না, তারা ‘হ্যান্ড টু মাউথ’ অবস্থায় জন্মের পরপরই কোনো চিন্তা না করেই সন্তানের নাম নিবন্ধন করে ফেলেন। এই সমস্যার সমাধানে জন্মনিবন্ধনের সময় যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, যেমন ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভার নিবন্ধনকর্মীরা শিক্ষিত, সংবেদনশীল ও পরামর্শদানে সক্ষম হন, তাহলে অনেক সুন্দর ও অর্থবহ নামকরণ সম্ভব।

সম্প্রতি জাপানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছেÑসেখানে এখন থেকে মা-বাবারা নিজেদের ইচ্ছামতো শিশুদের নাম রাখতে পারবেন না। সরকার অনুমোদিত “কাঞ্জি” (চীনাভিত্তিক প্রতীকী অক্ষর) ব্যবহার করে সন্তানের নাম রাখতে হবে। এতে অস্বাভাবিক, অতিরিক্ত “চকচকে” বা অযৌক্তিক নাম দেয়া বন্ধ হবে। জাপানের এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্য ও সমাজে গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখার প্রয়াস হিসেবেই দেখা যেতে পারে।

আমাদের দেশেও এমন একটি উদ্যোগ বিবেচনায় নেয়া জরুরি। প্রতিটি মানুষ যেমন চায় তার ঘর হোক সুন্দর, তার পোশাক হোক পরিষ্কার, তেমনি সন্তানদের নামও হোক সম্মানজনক ও আত্মপরিচয়ের গর্বের প্রতীক।

সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সকল পিতা-মাতা, অভিভাবক ও সমাজপতিদের প্রতি অনুরোধÑসন্তানের নাম রাখুন অর্থবহ, ইতিবাচক ও শ্রুতিমধুর। বিশেষ করে দলিত-বঞ্চিত, শ্রমজীবী, মজদুর ও অনগ্রসর জাতির অভিভাবকদের প্রতি এই আহ্বানÑসন্তান যেন নামের কারণে সমাজে লাঞ্ছিত না হয়, বরং আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদায় বলীয়ান হয়ে বেড়ে উঠতে পারে। এজন্য প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা ও একটি জাতীয় নীতিমালা, যাতে জাপানের মতো বাংলাদেশেও শিশুদের নামকরণ হয় অর্থপূর্ণ, সৌন্দর্যপূর্ণ ও সর্বজনগ্রাহ্য।

[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]

ছবি

বোধের স্ফূরণ, না ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’?

এসএসসিতে গণিত বিষয়ে ফল বিপর্যয় : কারণ ও উত্তরণের উপায়

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

tab

উপ-সম্পাদকীয়

নাম ও মর্যাদা : অর্থবহ নামকরণে বৈষম্য রোধের আহ্বান

বাবুল রবিদাস

সোমবার, ০২ জুন ২০২৫

নামকরণের পেছনে রয়েছে কার্যকারণলবদ্ধ একটি ইতিহাস। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় দেখা গেছে, শাসক ও শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক অঞ্চলের নামও পরিবর্তিত হয়েছে। এই নাম পরিবর্তনের পেছনে প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছে শাসকশ্রেণির রুচি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। যেমনভাবে একটি রাষ্ট্র বা শহরের নামকরণ শাসকদের নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়, তেমনি সন্তানদের নাম রাখার ক্ষেত্রেও অভিভাবকদের রুচি, মনন ও চিন্তাভাবনা প্রতিফলিত হয়। একটি নাম শুধু পরিচিতির মাধ্যম নয়, এটি হয়ে ওঠে ব্যক্তির অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয়ের অংশ।

জন্মের পর শিশুকে যে নাম দেয়া হয়, তা তার রক্ত-মাংসে, মননে, চিন্তায় এমনভাবে মিশে যায় যে সে নাম তাকে আজীবন অনুসরণ করে চলে। সে নাম ভালো বা মন্দÑউভয়ই হতে পারে। কেউ কেউ জীবনের এক পর্যায়ে গিয়ে সেই নামের সঙ্গে নিজেকে আর মানিয়ে নিতে পারেন না। তখন তারা এফিডেভিট করে নাম পরিবর্তনের পথে হাঁটেন। এটি প্রমাণ করে যে, প্রথমে দেয়া নামটি ছিল অসার্থক বা অপ্রাসঙ্গিক। কেবল ব্যক্তি নয়, অনেক প্রতিষ্ঠান কিংবা দেশের নামও সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তন করা হয়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়Ñপিকিং থেকে বেইজিং, বম্বে থেকে মুম্বাই, ক্যালকাটা থেকে কলকাতা, ঢাক্কা থেকে ঢাকা, বগড়া থেকে বগুড়া। এমনকি বার্মা থেকে মায়ানমার, রেঙ্গুন থেকে ইয়ানগুন। এসব পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে উচ্চারণের সঠিকতা, সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় এবং সময়োপযোগিতার গুরুত্ব।

আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামও একসময় অস্বাভাবিক, শ্রুতিকটু বা নেতিবাচক বার্তাবাহী ছিল। যেমনÑবরিশালের “চরকাউয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়” বা ময়মনসিংহের “চোরের ভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়”। শিশুর মানসিক বিকাশ ও আত্মসম্মানের দিক থেকে এসব নাম শুধু বিব্রতকর নয়, তা তাদের সামাজিক অবস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই উপলব্ধি থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে কয়েক শতাধিক বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করেছে, যা একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ।

নাম একটি পরিচয়; এটি যদি হয় কুশ্রী, বিকৃত কিংবা অপমানজনক, তবে তা শিশুর আত্মবিকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। আমাদের সমাজে অনেক সময় বাবা-মা না বুঝেই সন্তানের নাম রাখেন। অনেকে নামের অর্থ না জেনেই কেবল শব্দের ধ্বনি শুনে নাম ঠিক করেন। যেমনÑরহিমা খাতুন, যেখানে খাতুন মানে বিবাহিতা নারী, অথচ শিশুটি সদ্য জন্ম নেয়া কন্যা। অথবা “খায়রুল বাশার”Ñযার অর্থ “সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ”, যা অতিমূল্যায়ন মনে হতে পারে। আবার “শামছুন্নাহার”Ñমানে দিনে সূর্যের আলো, যেখানে সূর্য পুরুষবাচক, কিন্তু নামটি ব্যবহার হচ্ছে নারীর ক্ষেত্রে।

বেশ কিছু নাম সামাজিকভাবে এমনভাবে গড়ে উঠেছে, যা দলিত, অনগ্রসর বা শ্রমজীবী শ্রেণির শিশুদের প্রতি বৈষম্য ও অবজ্ঞার প্রতিচ্ছবি বহন করে। যেমনÑসিবা ডোম, বিষ্ণু লাল বেগী, সহদেব ভক্ত, রঘুনাথ চন্ডাল, বাবুলাল মুচি, রাম টুডু, বানিয়াস ক্যারকেটা ইত্যাদি। এসব নামের মধ্যে অনেকগুলো পদবি বা জাতিগত পরিচয় এমনভাবে যুক্ত রয়েছে, যা শিশুদের শিক্ষাজীবন ও সামাজিক জীবনে অব্যাহত অবজ্ঞা ও অবমাননার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় এই অবজ্ঞা এতটাই গভীর হয় যে, শিশুরা হতাশায় পড়ে পড়াশোনা পর্যন্ত ছেড়ে দেয়।

এজন্য আধুনিক যুগে নামকরণের ক্ষেত্রে গভীর চিন্তা-ভাবনা প্রয়োজন। নাম হতে হবে অর্থবহ, ইতিবাচক ও গ্রহণযোগ্য। নাম এমন হওয়া উচিত যা শিশুর আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদাবোধ জাগ্রত করে। বিশেষ করে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সন্তানদের ক্ষেত্রে আরও বেশি সচেতনতা প্রয়োজন, যাতে তারা ভবিষ্যতে বৈষম্যের শিকার না হয়।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, হতদরিদ্র পরিবার, যাদের হাতে শিক্ষা বা উপযুক্ত পরামর্শের সুযোগ থাকে না, তারা ‘হ্যান্ড টু মাউথ’ অবস্থায় জন্মের পরপরই কোনো চিন্তা না করেই সন্তানের নাম নিবন্ধন করে ফেলেন। এই সমস্যার সমাধানে জন্মনিবন্ধনের সময় যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, যেমন ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভার নিবন্ধনকর্মীরা শিক্ষিত, সংবেদনশীল ও পরামর্শদানে সক্ষম হন, তাহলে অনেক সুন্দর ও অর্থবহ নামকরণ সম্ভব।

সম্প্রতি জাপানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছেÑসেখানে এখন থেকে মা-বাবারা নিজেদের ইচ্ছামতো শিশুদের নাম রাখতে পারবেন না। সরকার অনুমোদিত “কাঞ্জি” (চীনাভিত্তিক প্রতীকী অক্ষর) ব্যবহার করে সন্তানের নাম রাখতে হবে। এতে অস্বাভাবিক, অতিরিক্ত “চকচকে” বা অযৌক্তিক নাম দেয়া বন্ধ হবে। জাপানের এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্য ও সমাজে গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখার প্রয়াস হিসেবেই দেখা যেতে পারে।

আমাদের দেশেও এমন একটি উদ্যোগ বিবেচনায় নেয়া জরুরি। প্রতিটি মানুষ যেমন চায় তার ঘর হোক সুন্দর, তার পোশাক হোক পরিষ্কার, তেমনি সন্তানদের নামও হোক সম্মানজনক ও আত্মপরিচয়ের গর্বের প্রতীক।

সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সকল পিতা-মাতা, অভিভাবক ও সমাজপতিদের প্রতি অনুরোধÑসন্তানের নাম রাখুন অর্থবহ, ইতিবাচক ও শ্রুতিমধুর। বিশেষ করে দলিত-বঞ্চিত, শ্রমজীবী, মজদুর ও অনগ্রসর জাতির অভিভাবকদের প্রতি এই আহ্বানÑসন্তান যেন নামের কারণে সমাজে লাঞ্ছিত না হয়, বরং আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদায় বলীয়ান হয়ে বেড়ে উঠতে পারে। এজন্য প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা ও একটি জাতীয় নীতিমালা, যাতে জাপানের মতো বাংলাদেশেও শিশুদের নামকরণ হয় অর্থপূর্ণ, সৌন্দর্যপূর্ণ ও সর্বজনগ্রাহ্য।

[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]

back to top