alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রশিক্ষণ থেকে কেন বাদ নারী কৃষকরা?

সামসুল ইসলাম টুকু

: সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫

“পড়াশোনা কম, তাই প্রশিক্ষণ থেকে নারীকে বের করে দিলেন কৃষি কর্মকর্তা”Ñশিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ২১ মে ২০২৫। ঘটনাটি কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চলাকালে, ‘কম পড়াশোনা জানেন’ এই অজুহাতে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা চারজন নারীকে প্রশিক্ষণ কক্ষ থেকে বের করে দেন। তাদের একজন, জহুরা খাতুন, জানান, তারা নিজেরাই চাষাবাদ করেন এবং উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ শেখার আগ্রহেই এই প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলেন। অথচ, সেখানে গিয়ে পড়তে না পারার ‘অপরাধে’ তাদের কেবল বের করে দেয়া হয়নি, অপমানও করা হয়।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, “তারা পড়াশোনা জানেন না, তাই বের করে দেয়া হয়েছে, তবে খারাপ ব্যবহার করা হয়নি।” কিন্তু প্রশ্ন উঠছেÑপ্রশিক্ষণ কি শুধু শিক্ষিতদের জন্য? যারা শস্য ফলান, মাঠে কাজ করেন, তাদের শিক্ষা নয়, প্রয়োজন চাষাবাদের ব্যবহারিক দক্ষতা।

এখানে স্পষ্টতই দেখা যায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দৃষ্টিভঙ্গির সংকট। গ্রামীণ নারীরা যারা শিম, লাউ, কুমড়া, মরিচ, ঢেঁড়শ লাগিয়ে ঘরের চাহিদা পূরণ করেন, হাঁস-মুরগি ছাগল পালন করে সংসারে সহায়তা করেন, তাদের অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। এমন নারীরা শুধু নিজেদের নয়, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির চালিকাশক্তির অন্যতম ভিত্তি। তাদের কাজই প্রমাণ করে তারা ‘অদক্ষ’ বা ‘অযোগ্য’ নন, বরং বাস্তব অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। প্রশিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব হলো তাদের আরও দক্ষ করে তোলা, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা।

প্রশ্ন হলো, প্রশিক্ষক নিজেই যদি অংশগ্রহণকারীদের স্তর বুঝে প্রশিক্ষণ প্রদানে অক্ষম হন, তবে তার প্রশিক্ষকের আসনে থাকার ন্যায্যতা কোথায়? মাঠপর্যায়ের এই কর্মকর্তা যদি বাস্তবতা বুঝে কাজ না করেন, তবে তার ‘প্রশিক্ষণদানে অযোগ্যতা’ নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।

এই ঘটনায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচনায় আসা দরকারÑবাংলাদেশে বহুল আলোচিত ‘প্রশিক্ষণ সংস্কৃতি’। পুকুর খনন, খিচুড়ি রান্না থেকে শুরু করে বিদেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়া পর্যন্ত অসংখ্য প্রকল্পের নামেই বছরে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়। অথচ, এর ফলাফল কোথায়? বাস্তব পরিবর্তন কোথায়? জনমানুষ বা অংশগ্রহণকারীদের দক্ষতা কতটা বেড়েছে, তা নিয়ে নেই কোনো সমীক্ষা, নেই গবেষণা। বরং বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে, প্রশিক্ষণ খাতে অধিকাংশ ব্যয় হয় প্রশাসনিক ভ্রমণ, সম্মেলন, কনসালটেন্সি বা ভাতা খাতে; অংশগ্রহণকারীদের জন্য যা বরাদ্দ, তা প্রায় সামান্য।

বিশেষ করে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের প্রশিক্ষণ খাতে এই ব্যয়ের অসামঞ্জস্যতা প্রকট। কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ব্যয় অনেক বেশি হলেও কৃষকদের, বিশেষত নারী কৃষকদের জন্য বরাদ্দকৃত অংশ নগণ্য। অথচ মাঠের এই নারীরাই দেশের কৃষিব্যবস্থার চালিকাশক্তি।

সুতরাং, রৌমারীর এই ঘটনাকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটা বৃহৎ একটি কাঠামোগত সংকটের প্রতিচ্ছবিÑযেখানে উপেক্ষা করা হয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে, হেয় করা হয় অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত শ্রমজীবী মানুষদের। প্রশিক্ষণ হোক বাস্তবসম্মত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, শ্রেণিভেদাভেদহীন এবং ফলাফলনির্ভর। আর তা দিতে হবে সম্মান ও সহানুভূতির মনোভাব নিয়েÑহয়রানি বা অবজ্ঞা নয়।

[লেখক : সাংবাদিক]

ছবি

বোধের স্ফূরণ, না ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’?

এসএসসিতে গণিত বিষয়ে ফল বিপর্যয় : কারণ ও উত্তরণের উপায়

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রশিক্ষণ থেকে কেন বাদ নারী কৃষকরা?

সামসুল ইসলাম টুকু

সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫

“পড়াশোনা কম, তাই প্রশিক্ষণ থেকে নারীকে বের করে দিলেন কৃষি কর্মকর্তা”Ñশিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ২১ মে ২০২৫। ঘটনাটি কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চলাকালে, ‘কম পড়াশোনা জানেন’ এই অজুহাতে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা চারজন নারীকে প্রশিক্ষণ কক্ষ থেকে বের করে দেন। তাদের একজন, জহুরা খাতুন, জানান, তারা নিজেরাই চাষাবাদ করেন এবং উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ শেখার আগ্রহেই এই প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলেন। অথচ, সেখানে গিয়ে পড়তে না পারার ‘অপরাধে’ তাদের কেবল বের করে দেয়া হয়নি, অপমানও করা হয়।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, “তারা পড়াশোনা জানেন না, তাই বের করে দেয়া হয়েছে, তবে খারাপ ব্যবহার করা হয়নি।” কিন্তু প্রশ্ন উঠছেÑপ্রশিক্ষণ কি শুধু শিক্ষিতদের জন্য? যারা শস্য ফলান, মাঠে কাজ করেন, তাদের শিক্ষা নয়, প্রয়োজন চাষাবাদের ব্যবহারিক দক্ষতা।

এখানে স্পষ্টতই দেখা যায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দৃষ্টিভঙ্গির সংকট। গ্রামীণ নারীরা যারা শিম, লাউ, কুমড়া, মরিচ, ঢেঁড়শ লাগিয়ে ঘরের চাহিদা পূরণ করেন, হাঁস-মুরগি ছাগল পালন করে সংসারে সহায়তা করেন, তাদের অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। এমন নারীরা শুধু নিজেদের নয়, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির চালিকাশক্তির অন্যতম ভিত্তি। তাদের কাজই প্রমাণ করে তারা ‘অদক্ষ’ বা ‘অযোগ্য’ নন, বরং বাস্তব অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। প্রশিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব হলো তাদের আরও দক্ষ করে তোলা, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা।

প্রশ্ন হলো, প্রশিক্ষক নিজেই যদি অংশগ্রহণকারীদের স্তর বুঝে প্রশিক্ষণ প্রদানে অক্ষম হন, তবে তার প্রশিক্ষকের আসনে থাকার ন্যায্যতা কোথায়? মাঠপর্যায়ের এই কর্মকর্তা যদি বাস্তবতা বুঝে কাজ না করেন, তবে তার ‘প্রশিক্ষণদানে অযোগ্যতা’ নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।

এই ঘটনায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচনায় আসা দরকারÑবাংলাদেশে বহুল আলোচিত ‘প্রশিক্ষণ সংস্কৃতি’। পুকুর খনন, খিচুড়ি রান্না থেকে শুরু করে বিদেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়া পর্যন্ত অসংখ্য প্রকল্পের নামেই বছরে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়। অথচ, এর ফলাফল কোথায়? বাস্তব পরিবর্তন কোথায়? জনমানুষ বা অংশগ্রহণকারীদের দক্ষতা কতটা বেড়েছে, তা নিয়ে নেই কোনো সমীক্ষা, নেই গবেষণা। বরং বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে, প্রশিক্ষণ খাতে অধিকাংশ ব্যয় হয় প্রশাসনিক ভ্রমণ, সম্মেলন, কনসালটেন্সি বা ভাতা খাতে; অংশগ্রহণকারীদের জন্য যা বরাদ্দ, তা প্রায় সামান্য।

বিশেষ করে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের প্রশিক্ষণ খাতে এই ব্যয়ের অসামঞ্জস্যতা প্রকট। কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ব্যয় অনেক বেশি হলেও কৃষকদের, বিশেষত নারী কৃষকদের জন্য বরাদ্দকৃত অংশ নগণ্য। অথচ মাঠের এই নারীরাই দেশের কৃষিব্যবস্থার চালিকাশক্তি।

সুতরাং, রৌমারীর এই ঘটনাকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটা বৃহৎ একটি কাঠামোগত সংকটের প্রতিচ্ছবিÑযেখানে উপেক্ষা করা হয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে, হেয় করা হয় অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত শ্রমজীবী মানুষদের। প্রশিক্ষণ হোক বাস্তবসম্মত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, শ্রেণিভেদাভেদহীন এবং ফলাফলনির্ভর। আর তা দিতে হবে সম্মান ও সহানুভূতির মনোভাব নিয়েÑহয়রানি বা অবজ্ঞা নয়।

[লেখক : সাংবাদিক]

back to top