alt

উপ-সম্পাদকীয়

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

মাহফুজ আলম

: মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগ

বাংলাদেশসহ সব আম উৎপাদনকারী দেশে আমের অন্যতম ক্ষতিকর রোগ হলো অ্যানথ্রাকনোজ। এই রোগ ঈড়ষষবঃড়ঃৎরপযঁস মষড়বড়ংঢ়ড়ৎরড়রফবং নামক এক ধরনের ছত্রাকের কারণে ঘটে। এটি মূলত আমগাছের কচি পাতা, কান্ড, মুকুল, কুঁড়ি এবং বাড়ন্ত ফলে আক্রমণ করে। রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে পাতায়, কা-ে ও ফলে ছোট ছোট কালো বা বাদামি দাগ দেখা যায়। সময়ের সাথে সাথে এই দাগগুলো একত্রিত হয়ে বড় আকার ধারণ করে।

গুরুতর আক্রান্ত পাতার কোষ দ্রুত মারা যায়, ফলে পাতা ঝরে পড়ে। কচি পাতার আক্রান্ত স্থানে টিস্যু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে পাতা বিবর্ণ হয়ে যেতে পারে। মুকুল বা ফুল আক্রান্ত হলে কালো দাগের সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীতে শুকিয়ে পড়ে। মুকুলের ওপর আক্রমণ হলে ফল ধারণ ব্যাহত হয়, ফলে ফলন কমে যায়। ছোট আমে এই ছত্রাকের আক্রমণে কালো দাগ দেখা দিলে সেগুলো ঝরে পড়তে পারে। পরিপক্ব আমে আক্রমণ হলে ফলের চামড়ায় কালো দাগ পড়ে, যা বাজারমূল্য কমিয়ে দেয়।

আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগ

১. আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগের কারণ :

ছত্রাকের নাম : ঈড়ষষবঃড়ঃৎরপযঁস মষড়বড়ংঢ়ড়ৎরড়রফবং

বিস্তার : বায়ু, বৃষ্টি, কুয়াশা এবং সংক্রামিত উদ্ভিদের অংশের মাধ্যমে ছড়ায়।

অনুকূল পরিবেশ : ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং ৯০%+ আর্দ্রতা এই রোগের দ্রুত বিস্তারে সহায়ক।

অবহেলা : অপরিচ্ছন্ন বাগান, সঠিকভাবে ছাঁটাই না করা গাছ এবং পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশনের অভাব।

২. আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগের লক্ষণ :

পাতায় : ছোট বাদামি বা কালো দাগ যা পরবর্তীতে বড় হয়ে পাতা শুকিয়ে ফেলতে পারে।

ফুলে : ছোট কালো দাগ যা পরে বড় আকার ধারণ করে এবং ফুল ঝরে পড়তে সহায়ক।

ফলে : ডিপ্রেশনযুক্ত কালো দাগ যা ফলের গুণগতমান হ্রাস করে।

ডালপালায় : কালো দাগ যা পরে শুকিয়ে ডালপালা মরে যেতে পারে।

৩. আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগের ক্ষতির প্রক্রিয়া :

ফলন হ্রাস : ফলের আকার ছোট হয়ে যায় এবং গুণগত মান কমে যায়।

মৃত্যুহার বৃদ্ধি : ডালপালা ও পাতার মারাত্মক ক্ষতি, যা গাছের মোট উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে।

ফল সংগ্রহের পরে ক্ষতি : ফল সংরক্ষণের সময় ছত্রাকের সংক্রমণ অব্যাহত থাকে, যা ফলকে দ্রুত পচিয়ে ফেলে।

রপ্তানি সংকট : রোগাক্রান্ত ফলের গুণগত মান কমে যাওয়ার কারণে রপ্তানির চাহিদা কমে যায়।

৪. আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগ দমনে করণীয় :

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা :

নিয়মিত গাছের পরিচর্যা ও ছাঁটাই করুন। গাছের আশপাশ পরিষ্কার রাখুন এবং জমিতে পানি জমে থাকা এড়িয়ে চলুন। সংক্রমণমুক্ত চারা রোপণ করুন।

রোগ নিবারণ : ফুল ফোটা থেকে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত ছত্রাকনাশক (যেমন- কার্বেন্ডাজিম, ম্যানকোজেব, কপার অক্সিক্লোরাইড) প্রয়োগ করুন। ১৫ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করুন। বায়ু চলাচল নিশ্চিত করতে গাছের শাখাগুলো ছাঁটাই করুন।

মুকুলে রোগের প্রতিরোধ :

মুকুলে ছত্রাকজনিত রোগ প্রতিহত করতে ম্যানকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক, যেমন- ডায়থেন এম-৪৫, পেনকোজেব বা ইন্ডোফিল এম-৪৫ (প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে) মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। আমের পুষ্পমঞ্জুরি ১০ সেন্টিমিটার লম্বা হলেই প্রথম স্প্রে সম্পন্ন করতে হবে। এরপর আম মোটরদানার মতো আকার ধারণ করলে দ্বিতীয়বার স্প্রে করতে হবে। এটি কচি আমে রোগের আক্রমণ রোধ করবে এবং আম ঝরে পড়া উল্লেখযোগ্যভাবে কমাবে। প্রয়োজনে এই ছত্রাকনাশক কীটনাশকের সাথে মিশিয়ে একত্রে স্প্রে করা যেতে পারে।

বড় আমে রোগের প্রতিরোধ :

বড় আমে ছত্রাকজনিত রোগ প্রতিরোধের জন্য আম ব্যাগিং একটি কার্যকর পদ্ধতি। তবে যদি ব্যাগিং সম্ভব না হয়, তাহলে রোগের লক্ষণ দেখা দিলেই ম্যানকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন- ডায়থেন এম-৪৫, পেনকোজেব, ইন্ডোফিল এম-৪৫) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। এটি ফলের গুণগত মান রক্ষা করতে সহায়ক হবে।

ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ :

পরিপক্ব ফল সময়মতো সংগ্রহ করুন। ফল সংগ্রহের পরে ৫২-৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১০-১৫ মিনিট গরম পানিতে ডুবিয়ে সংরক্ষণ করুন। আমের অ্যানথ্রাকনোজ একটি মারাত্মক রোগ; যা সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ এই রোগের বিস্তার রোধ করতে সহায়ক।

আমের বোঁটা পচা রোগ

বোঁটা পচা আমের সংগ্রহোত্তর একটি মারাত্মক রোগ, যা ইড়ঃৎুড়ফরঢ়ষড়ফরধ ঃযবড়নৎড়সধব নামক এক প্রকার ছত্রাকের কারণে ঘটে। প্রথমে আমের বোঁটায় ছোট বাদামি বা কালো দাগ দেখা দেয়, যা দ্রুত বড় হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই ছত্রাক ফলের শাঁস পর্যন্ত প্রবেশ করে, যেখানে এটি এনজাইম নিঃসরণ করে আমের কোষগুলোর গঠন নষ্ট করে ফেলে। ফলে, আক্রান্ত আম মাত্র ২-৩ দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ পচে যায়।

উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্র আবহাওয়া এই রোগের দ্রুত বিস্তারের জন্য অত্যন্ত অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা ফলের দ্রুত ক্ষতির অন্যতম কারণ।

১. বোঁটা পচা রোগের কারণ :

ছত্রাকের নাম : ইড়ঃৎুড়ফরঢ়ষড়ফরধ ঃযবড়নৎড়সধব ড়ৎ খধংরড়ফরঢ়ষড়ফরধ ঃযবড়নৎড়সধব

বিস্তার : বায়ু, বৃষ্টি, সংক্রামিত যন্ত্রপাতি এবং সংক্রমিত গাছের অংশের মাধ্যমে ছড়ায়।

অনুকূল পরিবেশ : ২৫-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং উচ্চ আর্দ্রতা (৮০%+) এই রোগের দ্রুত বিস্তারে সহায়ক।

অবহেলা : অপরিচ্ছন্ন বাগান, অপর্যাপ্ত ছাঁটাই এবং পানি নিষ্কাশনের অভাব।

আমের বোঁটা পচা রোগ

২. বোঁটা পচা রোগের লক্ষণ :

ফলে : বোঁটা বা ডাঁটায় কালো বা বাদামি দাগ যা ধীরে ধীরে বড় হয়ে পচে যেতে শুরু করে।

অভ্যন্তরীণ ক্ষতি : ফলের অভ্যন্তরে ছত্রাকের বৃদ্ধির ফলে মাংসল অংশ দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।

ফলের গন্ধ : পচনের ফলে ফল থেকে দুর্গন্ধ বের হতে পারে।

সংরক্ষণে সমস্যা : ফল সংগ্রহের পরেও পচনের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে, যা ফলের গুণগত মান কমিয়ে দেয়।

৩. ক্ষতির প্রক্রিয়া :

ফলন হ্রাস : বড় পরিমাণে ফল নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং বাজারমূল্য কমে যাওয়া।

রপ্তানি সংকট : রোগাক্রান্ত ফলের গুণগত মান কমে যাওয়ার কারণে রপ্তানির সুযোগ হ্রাস।

ভোক্তার সন্তুষ্টি কমে যাওয়া : পচা ও নিম্নমানের ফলের কারণে ভোক্তাদের অসন্তোষ।

৪. বোঁটা পচা রোগের দমনে করণীয় :

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা :

নিয়মিত গাছের পরিচর্যা ও ছাঁটাই করুন।

গাছের আশপাশ পরিষ্কার রাখুন এবং জমিতে পানি জমে থাকা এড়িয়ে চলুন।

সংক্রমণমুক্ত চারা রোপণ করুন।

রোগ নিবারণ :

ফল সংগ্রহের আগে ছত্রাকনাশক (যেমন- কারবেন্দাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক) স্প্রে করুন। ১৫ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করুন। ফল সংগ্রহের পর ৫২-৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১০-১৫ মিনিট গরম পানিতে ডুবিয়ে সংরক্ষণ করুন।

ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ :

পরিপক্ব ফল সময়মতো সংগ্রহ করুন। ফল সংগ্রহের পরে ফলগুলোকে পরিষ্কার এবং শুকনো স্থানে সংরক্ষণ করুন। আমের বোঁটা পচা একটি মারাত্মক রোগ যা সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ এই রোগের বিস্তার রোধ করতে সহায়ক।

[লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, শস্য বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল]

ছবি

বোধের স্ফূরণ, না ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’?

এসএসসিতে গণিত বিষয়ে ফল বিপর্যয় : কারণ ও উত্তরণের উপায়

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

মাহফুজ আলম

মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগ

বাংলাদেশসহ সব আম উৎপাদনকারী দেশে আমের অন্যতম ক্ষতিকর রোগ হলো অ্যানথ্রাকনোজ। এই রোগ ঈড়ষষবঃড়ঃৎরপযঁস মষড়বড়ংঢ়ড়ৎরড়রফবং নামক এক ধরনের ছত্রাকের কারণে ঘটে। এটি মূলত আমগাছের কচি পাতা, কান্ড, মুকুল, কুঁড়ি এবং বাড়ন্ত ফলে আক্রমণ করে। রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে পাতায়, কা-ে ও ফলে ছোট ছোট কালো বা বাদামি দাগ দেখা যায়। সময়ের সাথে সাথে এই দাগগুলো একত্রিত হয়ে বড় আকার ধারণ করে।

গুরুতর আক্রান্ত পাতার কোষ দ্রুত মারা যায়, ফলে পাতা ঝরে পড়ে। কচি পাতার আক্রান্ত স্থানে টিস্যু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে পাতা বিবর্ণ হয়ে যেতে পারে। মুকুল বা ফুল আক্রান্ত হলে কালো দাগের সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীতে শুকিয়ে পড়ে। মুকুলের ওপর আক্রমণ হলে ফল ধারণ ব্যাহত হয়, ফলে ফলন কমে যায়। ছোট আমে এই ছত্রাকের আক্রমণে কালো দাগ দেখা দিলে সেগুলো ঝরে পড়তে পারে। পরিপক্ব আমে আক্রমণ হলে ফলের চামড়ায় কালো দাগ পড়ে, যা বাজারমূল্য কমিয়ে দেয়।

আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগ

১. আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগের কারণ :

ছত্রাকের নাম : ঈড়ষষবঃড়ঃৎরপযঁস মষড়বড়ংঢ়ড়ৎরড়রফবং

বিস্তার : বায়ু, বৃষ্টি, কুয়াশা এবং সংক্রামিত উদ্ভিদের অংশের মাধ্যমে ছড়ায়।

অনুকূল পরিবেশ : ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং ৯০%+ আর্দ্রতা এই রোগের দ্রুত বিস্তারে সহায়ক।

অবহেলা : অপরিচ্ছন্ন বাগান, সঠিকভাবে ছাঁটাই না করা গাছ এবং পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশনের অভাব।

২. আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগের লক্ষণ :

পাতায় : ছোট বাদামি বা কালো দাগ যা পরবর্তীতে বড় হয়ে পাতা শুকিয়ে ফেলতে পারে।

ফুলে : ছোট কালো দাগ যা পরে বড় আকার ধারণ করে এবং ফুল ঝরে পড়তে সহায়ক।

ফলে : ডিপ্রেশনযুক্ত কালো দাগ যা ফলের গুণগতমান হ্রাস করে।

ডালপালায় : কালো দাগ যা পরে শুকিয়ে ডালপালা মরে যেতে পারে।

৩. আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগের ক্ষতির প্রক্রিয়া :

ফলন হ্রাস : ফলের আকার ছোট হয়ে যায় এবং গুণগত মান কমে যায়।

মৃত্যুহার বৃদ্ধি : ডালপালা ও পাতার মারাত্মক ক্ষতি, যা গাছের মোট উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে।

ফল সংগ্রহের পরে ক্ষতি : ফল সংরক্ষণের সময় ছত্রাকের সংক্রমণ অব্যাহত থাকে, যা ফলকে দ্রুত পচিয়ে ফেলে।

রপ্তানি সংকট : রোগাক্রান্ত ফলের গুণগত মান কমে যাওয়ার কারণে রপ্তানির চাহিদা কমে যায়।

৪. আমের অ্যানথ্রাকনোজ রোগ দমনে করণীয় :

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা :

নিয়মিত গাছের পরিচর্যা ও ছাঁটাই করুন। গাছের আশপাশ পরিষ্কার রাখুন এবং জমিতে পানি জমে থাকা এড়িয়ে চলুন। সংক্রমণমুক্ত চারা রোপণ করুন।

রোগ নিবারণ : ফুল ফোটা থেকে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত ছত্রাকনাশক (যেমন- কার্বেন্ডাজিম, ম্যানকোজেব, কপার অক্সিক্লোরাইড) প্রয়োগ করুন। ১৫ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করুন। বায়ু চলাচল নিশ্চিত করতে গাছের শাখাগুলো ছাঁটাই করুন।

মুকুলে রোগের প্রতিরোধ :

মুকুলে ছত্রাকজনিত রোগ প্রতিহত করতে ম্যানকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক, যেমন- ডায়থেন এম-৪৫, পেনকোজেব বা ইন্ডোফিল এম-৪৫ (প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে) মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। আমের পুষ্পমঞ্জুরি ১০ সেন্টিমিটার লম্বা হলেই প্রথম স্প্রে সম্পন্ন করতে হবে। এরপর আম মোটরদানার মতো আকার ধারণ করলে দ্বিতীয়বার স্প্রে করতে হবে। এটি কচি আমে রোগের আক্রমণ রোধ করবে এবং আম ঝরে পড়া উল্লেখযোগ্যভাবে কমাবে। প্রয়োজনে এই ছত্রাকনাশক কীটনাশকের সাথে মিশিয়ে একত্রে স্প্রে করা যেতে পারে।

বড় আমে রোগের প্রতিরোধ :

বড় আমে ছত্রাকজনিত রোগ প্রতিরোধের জন্য আম ব্যাগিং একটি কার্যকর পদ্ধতি। তবে যদি ব্যাগিং সম্ভব না হয়, তাহলে রোগের লক্ষণ দেখা দিলেই ম্যানকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন- ডায়থেন এম-৪৫, পেনকোজেব, ইন্ডোফিল এম-৪৫) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। এটি ফলের গুণগত মান রক্ষা করতে সহায়ক হবে।

ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ :

পরিপক্ব ফল সময়মতো সংগ্রহ করুন। ফল সংগ্রহের পরে ৫২-৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১০-১৫ মিনিট গরম পানিতে ডুবিয়ে সংরক্ষণ করুন। আমের অ্যানথ্রাকনোজ একটি মারাত্মক রোগ; যা সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ এই রোগের বিস্তার রোধ করতে সহায়ক।

আমের বোঁটা পচা রোগ

বোঁটা পচা আমের সংগ্রহোত্তর একটি মারাত্মক রোগ, যা ইড়ঃৎুড়ফরঢ়ষড়ফরধ ঃযবড়নৎড়সধব নামক এক প্রকার ছত্রাকের কারণে ঘটে। প্রথমে আমের বোঁটায় ছোট বাদামি বা কালো দাগ দেখা দেয়, যা দ্রুত বড় হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই ছত্রাক ফলের শাঁস পর্যন্ত প্রবেশ করে, যেখানে এটি এনজাইম নিঃসরণ করে আমের কোষগুলোর গঠন নষ্ট করে ফেলে। ফলে, আক্রান্ত আম মাত্র ২-৩ দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ পচে যায়।

উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্র আবহাওয়া এই রোগের দ্রুত বিস্তারের জন্য অত্যন্ত অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা ফলের দ্রুত ক্ষতির অন্যতম কারণ।

১. বোঁটা পচা রোগের কারণ :

ছত্রাকের নাম : ইড়ঃৎুড়ফরঢ়ষড়ফরধ ঃযবড়নৎড়সধব ড়ৎ খধংরড়ফরঢ়ষড়ফরধ ঃযবড়নৎড়সধব

বিস্তার : বায়ু, বৃষ্টি, সংক্রামিত যন্ত্রপাতি এবং সংক্রমিত গাছের অংশের মাধ্যমে ছড়ায়।

অনুকূল পরিবেশ : ২৫-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং উচ্চ আর্দ্রতা (৮০%+) এই রোগের দ্রুত বিস্তারে সহায়ক।

অবহেলা : অপরিচ্ছন্ন বাগান, অপর্যাপ্ত ছাঁটাই এবং পানি নিষ্কাশনের অভাব।

আমের বোঁটা পচা রোগ

২. বোঁটা পচা রোগের লক্ষণ :

ফলে : বোঁটা বা ডাঁটায় কালো বা বাদামি দাগ যা ধীরে ধীরে বড় হয়ে পচে যেতে শুরু করে।

অভ্যন্তরীণ ক্ষতি : ফলের অভ্যন্তরে ছত্রাকের বৃদ্ধির ফলে মাংসল অংশ দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।

ফলের গন্ধ : পচনের ফলে ফল থেকে দুর্গন্ধ বের হতে পারে।

সংরক্ষণে সমস্যা : ফল সংগ্রহের পরেও পচনের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে, যা ফলের গুণগত মান কমিয়ে দেয়।

৩. ক্ষতির প্রক্রিয়া :

ফলন হ্রাস : বড় পরিমাণে ফল নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং বাজারমূল্য কমে যাওয়া।

রপ্তানি সংকট : রোগাক্রান্ত ফলের গুণগত মান কমে যাওয়ার কারণে রপ্তানির সুযোগ হ্রাস।

ভোক্তার সন্তুষ্টি কমে যাওয়া : পচা ও নিম্নমানের ফলের কারণে ভোক্তাদের অসন্তোষ।

৪. বোঁটা পচা রোগের দমনে করণীয় :

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা :

নিয়মিত গাছের পরিচর্যা ও ছাঁটাই করুন।

গাছের আশপাশ পরিষ্কার রাখুন এবং জমিতে পানি জমে থাকা এড়িয়ে চলুন।

সংক্রমণমুক্ত চারা রোপণ করুন।

রোগ নিবারণ :

ফল সংগ্রহের আগে ছত্রাকনাশক (যেমন- কারবেন্দাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক) স্প্রে করুন। ১৫ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করুন। ফল সংগ্রহের পর ৫২-৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১০-১৫ মিনিট গরম পানিতে ডুবিয়ে সংরক্ষণ করুন।

ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ :

পরিপক্ব ফল সময়মতো সংগ্রহ করুন। ফল সংগ্রহের পরে ফলগুলোকে পরিষ্কার এবং শুকনো স্থানে সংরক্ষণ করুন। আমের বোঁটা পচা একটি মারাত্মক রোগ যা সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ এই রোগের বিস্তার রোধ করতে সহায়ক।

[লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, শস্য বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল]

back to top